#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৩
তিনটি গাড়ি পর পর যাচ্ছে। প্রথম গাড়িতে মিহু বসে আছে আর দুজন অফিসার। মাঝখানের গাড়িতে চালক সহ ঝুমুর বাইজি, কৌশিক আর আহির বসে আছে। পেছনের গাড়িতে আবার কয়েকজন অফিসার। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয়। পেছনের গাড়িটা জোরে ব্রেক কসে। মিহু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামলেই মিহু দৌড়ে পেছনে আসে।দেখে আসামিদের গাড়িতে আগুন জ্বলছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। মিহুর বুঝতে বাকি নেয় এইখানে কেউ বম ফিট করে রেখেছিলো। গাড়ি আসতেই উড়িয়ে দিয়েছে। মিহুর চিন্তাও ছিলো না এমন কিছু হতে পারে। ঝুমুর বাইজির এত বড় শত্রু কথা থেকে এলো। সে এখন কি জবাব দিবে প্রশাসনের কাছে। মিহু রাগে গাড়িতে লাথি মারে আর বলে,
– ডেমেট। আশেপাশে খুজে দেখো সন্দেহ ভাজন কাউকে পাওকিনা।
সবাই বলে,
– জ্বি ম্যাম।
কয়েকজন কনস্ট্রাবল আশেপাশে খুজে দেখে কিন্তু না কেউ নেয়। কোনো সন্দেহভাজন কিছু নেয়। হঠাৎ মিহুর মোবাইলে কল আসে। মিহু রিসিভ করে বলে,
– স্যার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে।
– শেষ হয়ে গেছে মানে।
– স্যার কেউ আসামিদের গাড়িটা উড়িয়ে দিয়েছে।
– হোয়াট। তোমরা কোথায় ছিলে? কোনো আন্দাজ আছে তোমার মিহু এখন আদালতে কি বলবো আমরা।
– সরি স্যার। আমাদের আরও সর্তক থাকা উচিৎ ছিলো। তবে স্যার যে এই কাজটা করছে তাকে খুজে বের করার দায়িত্ব আমার। আমি নিজে ওকে খুজে বের করবো।
– হয়ছে আর বড় বড় কথা বলতে হবে না। তুমি কি করতে জান বা পার তা আমার জানা হয়ে গিয়েছে। এখন কলটি কাটো।
– হ্যালো স্যার আমার কথাটা শুনোন স্যার।
কিন্তু ওপাশ থেকে কল কেটে দিয়েছে। মিহু এইবার রাগে ফুসছে। সে পারছে না তো নিজেকে নিজে গিলে খাচ্ছে। রাফাত অনেকক্ষণ ধরে নিজের রুমে বসে আছে। বনুলতা এসে খাবারের জন্য ডাকলেও সে যায়নি। ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সবকিছু বন্ধ করে রেখেছে রাফাত। হঠাৎ মোবাইল টা বেজে উঠলে রুমটা আলোকিত হয়ে উঠে। রাফাত কল রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– হ্যালো।
ওপাশ থেকে কেউ খুশি হয়ে বলে,
– স্যার কাজ হয়ে গিয়েছে। অফিসার মিহুর চেহারাটা দেখার মতো ছিলো। ওর নাকের ডগায় দাড়িয়েছিলাম স্যার তবুও কিছু বুঝতে পারেনি। স্যার এখন কি করবো।
– দেশ ছেড়ে চলে যাও। তোমার ভিসা আমি ঠিক করে রেখেছি। বিকেলে ফ্লাইট।
– ওকে স্যার ধন্যবাদ।
সিয়াম কল কেটে দেয়। রাফাত মোবাইল টা রেখে হা হা করে হেসে দেয়।কেমন একটা শান্তি লাগছে বুকের ভেতরে। অন্যরকম শান্তি। যে তার ভালোবাসাকে তার থেকে দূরে সরিয়েছে। তাকে সে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এমনটা যে যে করবে তাকে সে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিবে। আবার পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ পূর্ণার কেসের রায় হয়েছে। সেখানে প্রমাণিত হয়েছে পূর্ণা খুন করেছে। কিন্তু আত্মরক্ষাত্ত্বে খুন করার জন্য তার সাজা কম হয়েছে। তিন বছরের জেল হয়েছে। যেটা শোনার পর থেকে রাফাত নিজেকে ঘরে আটকে রেখেছে। রাফাত উঠে দাড়ায়। ড্রয়ার খুলে একটা এ্যালবাম বের করে যেখানে সে আর ঝুমুর বাইজি আছে। রাফাত প্রথমে ছবিটায় হাত বুলায় তারপর আস্তে করে বলে,
– আমি তোমায় জানে মারতাম না মামনি। কিন্তু তুমি শেষ বেলায় এসেও আমায় মিথ্যে বলেছো। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি সত্যি বলো। কিন্তু সেটা তুমি বলোনি। তোমার প্রথম মিথ্যে তুমি ইচ্ছে করে আমায় আদর করোনি। আমায় বুকে টেনে নাওনি। নিজের স্বার্থে করেছো এই কাজ। তোমার দ্বিতীয় মিথ্যে আমার মায়ের জ্বরের কারণে তুমি ঐ বাড়ি আসো নি। এসেছিলে আমার আব্বুর কাছাকাছি আসার জন্য। কারণ আমার আব্বু ছিলো তোমার প্রেমিক। যাকে তুমি ভালোবাসতে। আমার আব্বুর দোষ ছিলো বিয়ের পর স্ত্রীর বোনকে ভালোবাসা। কিন্তু আমার মা সব জানার পরও তোমায় বিশ্বাস করে ঐ বাড়ি এনেছিল। কিন্তু তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে বসলে। আমার মা বুকে পাথর চেপে তোমার সাথে আমার আব্বুর বিয়ে দিলো। তাও তুমি শান্ত হলে না। আমার মাকে ঘর থেকে বের করে দিলে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে। তোমার পেটের সন্তান নাকি আমার মা মেরে ফেলতে চেয়েছে। তখন আমি খুব ছোট নয় মামনি তখন রাফাত চৌধুরীর ছয় বছল চলে। একটু হলেও অনেক কিছু বুঝে। আমি তোমার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতাম। কারণ প্রথমে তো তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসতে। আমি যে তোমার নেউটা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই আদরটা যে স্বার্থের ছিলো সেটা বুঝিনি। আমার মাকে ঘর থেকে বের করে দিলে। আমার মা তখন অন্তঃশত্বা। রিয়ান তার গর্ভে। কি ঝড় তুফানের রাত ছিলো সেইদিন। অপদার্থ বাবাও সেদিন তোমার কথা শুনেছিল। আমি ঐখান থেকে চলে আসার পরে জ্বরে ভুগেছিলাম। তোমার জন্য। তোমার বুকে ঘুমানোল জন্য। কিন্তু তুমি তুমি ছিলে স্বার্থবাদী। তুমি তো ভালো মানুষ ছিলে না। তোমার চরিত্রে তো আগেই দোষ ছিলো। তাই তুমি আমাদের বাড়ির চাকরের সাথে খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেলে। চোখ খুললো আমার আব্বুর। সে তোমাকে ছুড়ে মারলো বাইজি গৃহে। আর যখন কৌশিক হলো তখন তাকে নিয়ে আমাদের কাছে চলে আসলো। প্রথমে মা মানতে চায় নি। কিন্তু স্বামী তো তাই ফেলে দিতে পারেনি। গ্রহণ করেছিল তোমার সন্তান। মামনি আমি সত্যি তোমায় মারতে চায়নি। যেমনটা তুমি আমায় বলেছিলে তুমি আমায় মারতে চাওনি। মিথ্যেবাদী, চরিত্রহীন, স্বার্থবাদী মহিলা একটা। তুমি আমার পূর্ণার গায়ে হাত তুলছো। আমার মাকে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে আসছো। অভিনয়টা তুমি ভালোই করতে যান। আমাকেও তো প্রায় সব বিশ্বাসই করিয়ে ফেলেছিলে। যদি না আগে থেকে সবকিছু আমার জানা না থাকতো। তোমার জন্য এই মৃত্যুই ঠিক আছি। ছাই হয়ে গেছো। রূপের যে বড় গৌরব ছিলো তোমার। এই রূপ দিয়ে তো আর কম মেয়ের সংসার ধ্বংস করোনি তুমি।
কথা শেষ করে রাফাত অ্যালবাম টা ফ্লোরে ছুড়ে মারে। তারপর ছবিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
______________________________________
রিয়ান দৌড়ে বাড়ি আসে। ড্রয়িং রুমে এসে হাপাতে থাকে। তাকে হাপাতে দেখে বনুলতা বলে,
– কিরে কি হয়েছে এইভাবে হাপাচ্ছিস কেন?
রিয়ান হাপাতে হাপাতে বলে,
– মম কৌশিক।
– কৌশিক কৌশিকের কি হয়েছে।
– মম ওদের গাড়িটা কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। লাশের কঙ্কাল ছাড়া আর কিচ্ছু নেয় মম।
বনুলতা সোফায় বসে পড়ে। জবা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কারণ সেখানে তো তার ছেলে আহির ছিলো। কৌশিক বনুলতার ছেলে না হলেও নিজে হাতে তো বড় করেছে। আম্মু আম্মু বলে বাড়ি মাথায় করেছে। বনুলতার বুকের বা পাশটায় কেমন চিনচিন ব্যথা অনুভব হয়। এই ব্যথা শুধু কি ছেলের জন্য নাকি ঝুমুর নামের সেই বোনের জন্যও আছে। হয়তো আছে নয়তো বা না। জবা কেঁদে কেঁদে জ্ঞান হারিয়েছে। বনুলতা নিজেকে শক্ত রেখেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ বাইরে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে রাফাত নিচে যায়। পরণে কালো পাঞ্জাবী পায়জামা। চাদর দিয়ে উপরটা ঢেকে রেখেছে। রাফাত নিচে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– কোন শোকে এই বাড়িতে এত কান্নাকাটি শুনি।
রাফাতের কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। বনুলতা ছেলের কাছে এসে বলে,
– তুই মাথা ঘামাস না এইসব নিয়ে আমি আছি তো।আই বাবা তোকে কিছু খেতে দেয়।
রাফাত বনুলতাকে থামিয়ে বলে,
– সরি মম আমি কিছু খাব না। খিদে নেয়। আমি একটু বের হচ্ছি। আর বাড়ি এসে যেনো না দেখি এইসব কান্নাকাটি মনে যেনো থাকে।
কথাটা বলে রাফাত চলে যায়। যাওয়ার আগে একবার রশীদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে যায়। রশীদ চৌধুরী ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। কারণ সে জানে তার জীবনের জঘন্য অতীত আর কেউ না জানলেও তার বড় ছেলে ঠিকই যেনে নিয়েছে।
________________________________________
রাফাত কারগারে এসেছে। এসেই মিহুর কাছে গিয়েছে। মিহু রাফাতকে দেখে বলে,
– আবার কেন এসেছেন?
– কেন আসতে পারি না।
– নাহ আসতে পারেন না। কারণ আপনার সাথে ঝুমুর বাইজির দেখা হওয়ার পর উনার গাড়ি ব্লাস্ট হয়েছে। তাই আমি চাই না আপনি আর কারো সাথে দেখা করেন।
রাফাত আয়েশ করে চেয়ারে বসে। তারপর মিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি কি কোনো ভাবে আমাকে সন্দেহ করছো।
– না করার কি আছে। আমি সবাইকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছি।
– আচ্ছা। তাহলে খুজে বের করো কার্পিটকে। এখন আপাদত আমাকে পূর্ণার সাথে দেখা করতে দাও।
– নাহ। বললাম তো হবে না।
– মিহু তুমি কি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।
– মিস্টার রাফাত চৌধুরী এইটা আপনার অফিস না যে আপনি চিল্লিয়ে কথা বলবেন এইটা পুলিশ স্টেশন।
– মিহু আমাকে ক্ষেপিও না বলে দিলাম।
– কি করবেন আপনি শুনি।
– কিছু করতে চায় না তোমার সাথে। বিকস তুমি আমার ভাইয়ের ভালোবাসা। তাই আমার পথের কাটা হয়েও না। আমি পূর্ণার সাথে দেখা করবো।
– ভিজিটিং আওয়ারে আসবেন।
– আমি পূর্ণার সাথে দেখা করবো।
– নো।
– ইয়েস।
– নো।
– ইয়েস।
মিহু রেগে চিৎকার করে বলে,
– বললাম তো নাহ।
তখন ঐ জায়গায় মিহুর বস আসে। আর মিহুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– এইসব কি মিহু। তুমি চেচামেচি করছো কেন? আর রাফাত চৌধুরী এখানে কি করে?
– সরি স্যার। উনি পূর্ণার সাথে দেখা করতে এসেছে।
– তো দেখা করতে দাও। এর জন্য কেউ এইভাবে চেচায়।
– কিন্তু স্যার।
– কোনো কিন্তু না মিহু। আপাদত তুমি এই কেসে নেয়। তাই তুমি কোনো ডিসিশন নিবে না।
– মানে স্যার।
– হ্যা এআ কেস অন্য অফিসারের সাথে হ্যান্ডেল করা হয়েছে। মিস্টার চৌধুরী আপনি যান।
– ধন্যবাদ অফিসার।
কথাটা বলে রাফাত ভেতরে চলে যায়। পূর্ণা সাদা রঙের শাড়ি পরে মাথা হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে। দূর থেকে দৃশ্য টা দেখে রাফাতের বুকটা কেঁপে উঠে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। কোনো এক যন্ত্রণায় ভেতরটা কুড়ে খাচ্ছে। রাফাত একটু কাছে এসে বলে,
– পূর্ণাবতি।
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পূর্ণা উপরে চোখ তুলে তাকায়। দেখে রাফাত দাড়িয়ে আছে। পূর্ণার চোখে পানি হয়তো কাঁদছিলো। পূর্ণা চোখের পানি মুছে ফেলে। উঠে দাড়ায়। মন পিঞ্জিরায় ব্যথা হচ্ছে। মাংস পিন্ডের পেছনের যন্ত্রণা তিনগুর বেশি দ্রুত গতিতে চলছে। পূর্ণা চোখ বাধা মানছে না। না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানো বৃথা চেষ্টা করছে। পূর্ণা ধীর পায়ে রাফাতের দিকে এগিয়ে আসছে। রাফাত গারদের লোহাটা ধরে রেখেছে। পূর্ণা রাফাতের কাছে আসলে রাফাত কেঁদে দেয়। পূর্ণা কাঁদছে রাফাত কাঁদছে। দুজনেই নিঃশব্দে কাঁদছে। আশেপাশের কয়েদিরা তাদের কান্ড দেখছে। পূর্ণা লোহার মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। রাফাত পূর্ণার মাথার জায়গায় মাথা ঠেকিয়ে দেয়। রাফাত লোহার মধ্যখানের ফাক দিয়ে হাত গলিয়ে পূর্ণার হাত ধরে। পূর্ণা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। রাফাত সেই হাতে চুমু খায়। পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাদের মধ্যেখানে দেয়ালের মতো কাজ করছে এই লোহার বেড়া। পূর্ণা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে কোনো কথা বলছে না। রাফাত পূর্ণার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে দূরে কোথাও চলে যাবে। পূর্ণা হেচকি তুলে বলে,
– কেন এসেছো?
রাফাত কান্না আটকে বলে,
– আমার মায়া পরীকে দেখতে। আমার মায়া পরীর একি চেহারা হয়েছে। কেঁদে কেঁদে চোখের নিচে কালি পড়িয়ে ফেলছে। সুন্দর সুশ্রী মুখটা লালচে হয়ে গিয়েছে। একি করছো পূর্ণা।
পূর্ণা হাসার চেষ্টা করে। তারপর বলে,
– পাপ করেছি তার শাস্তি ভোগ করছি এখন।
– পূর্ণা এইভাবে বলো না প্লিজ। তুমি ইচ্ছে করে কোনো পাপ করোনি।
– যেভাবেই করেছি করছি তো।
– আমি যে আমার আগের পূর্ণাকে চাই। এই পূর্ণাকে তো আমি কখনো দেখি নি। পূর্ণা বতি তোমার মুখের এই গরন আমার ভেতরটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে।
– তুমি এমন করো না।
– আমি দহনে পুড়ে যাচ্ছি পূর্ণা। আমার ভেতরে শান্তি নেয়।
পূর্ণা কেঁদে দিয়ে বলে,
– আমি কী ভালো আছি তোমাকে ছাড়া।
– কেন এমনটা করলে। আমি চাইলে তোমাকে এখনো ছাড়িয়ে নিতে পারি পূর্ণা।
– নাহ এমনটা তুমি করবে না।
রাফাত বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। সাথে পূর্ণাও। দুজনে বিরহের জালায় পুড়ছে। রাফাত কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমি কেন বার বার তোমায় হারিয়ে ফেলি।
– নিয়তিতে আছে তাই।
– পূর্ণা আমার কষ্ট হচ্ছে খুব আমি আর পারছি না। দেখো দেখো আমার বুকে হাত দিয়ে কতটা পুড়ছে এইখানে। পূর্ণা আমি এই জীবন চাইনি পূর্ণা। তোমার জন্য আমি আমার রাজ্য সাজিয়েছি। আর সেই রাজ্য ছেড়ে তুমি আজ এইখানে। ঐ রাজ্যটা আমার গিলে খাচ্ছে পূর্ণা। রাণী ছাড়া রাজা যে অসহায় পূর্ণা। পূর্ণা আমি পাগল হয়ে যাব পূর্ণা। আমার কষ্টটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে রাফাত নিচে বসে পড়ে।পূর্ণা বুঝে রাফাতকে সামলাতে হবে নয়তো পাগলামি করবে। পূর্ণাও নিচে বসে তারপর বলে,
– আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো।
– এক বুক ভালোবাসা নিয়ে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো পূর্ণা।
– আমিও এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবো।এখন এসো আর কখনো এইখানে এসো না প্লিজ।
– পূর্ণা।
– হ্যা আমি চাই না তুমি আমাকে এইভাবে দেখো। আমি আমার রাফাতকে এইভাবে দেখতে পারি না। আমি যেই রাফাতকে চিনে সে খুব স্ট্রোঙ্গ এত দুর্বল না। তাই তোমার এই দুর্বল স্বত্তাটা আমাকে দেখিও না রাফাত।
হঠাৎ একজন এসে পূর্ণার খাবার দিয়ে যায়। রাফাত তাকিয়ে দেখে পুরা রুটি। রাফাতের মেজাজটা বিগড়ে যায়। সে কিছু বলার জন্য উদ্দোত হবে তখন পূর্ণা আটকে দিয়ে বলে,
– এইটা জেলখানা রাফাত। তুমি যাও ঝামেলা করবে না যাও প্লিজ।
– আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা থাকবো তুমি আসবে তো।
– ইনশাআল্লাহ আসবো। তোমার পূর্ণা কি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে। যদি নিঃশ্বাস থাকে তাহলে তোমার কাছে ঠিকই যাব।
– পূর্ণা।
– হ্যা।
রাফাত চলে যায়। পূর্ণা রাফাতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলে। আর একজন কয়েদি পূর্ণাকে বলে,
– ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসে বোন। কখনো তার ভালোবাসা উপেক্ষা করো না।
– তার ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো শক্তি আমার নেয়।
______________________________________
বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রাফাত বাড়ি ফিরে। তার এমন করুণ অবস্থা দেখে বনুলতা এগিয়ে আসে। রাফাত মাকে সরিয়ে দিয়ে উপরে চলে যায়। রিয়ান মায়ের কাছে এসে বলে,
– মম ভাই পূর্ণার কাছে গিয়েছিল। মিহু বললো আমায়। খুব পাগলামি করেছে সেখানে গিয়ে।
বনুলতার বুকটা হা হা করে উঠে মেয়ে তুল্য পূর্ণা জেলে বন্দি। তার জন্য ছেলে দেবদাস হয়ে আছে। বনুলতার কিছু ভালো লাগছে না। সে সোজা উপলে চলে যায় গিয়ে দেখে রাফাত সার্ভেন্টকে বলছে,
– আমার জন্য দুটো পুড়া রুটি নিয়ে এসো।
সার্ভেন্ট কথাটা শোনার পর হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বনুলতা রাফাতের কাছে গেলে রাফাত বনুলতার দিকে তাকায়। বনুলতা বলে,
– এইসব কি রাফাত তুই পুড়া রুটি দিয়ে কি করবি।
– মম আমি পুড়া রুটি খাবো। আমার পূর্ণা ঐখানে বসে পুড়া রুটি ডাল ভাত খাবে। আর আমি এখানে বসে লেগ পিছ খাব। সরি মম আমি পারবো না। তুমি এইগুলোর ব্যবস্থা করো। এখন থেকে আমি এইসবই খাব।
– রাফাত কেন পাগলামি করছিস।
– আমি পাগলামি করছি না মম। যা বলছি তাই কর। নয়তো আমি বাগান বাড়ি চলে যাব।
– বাগান বাড়ি।
– হ্যা।
বনুলতার পাগল পাগল লাগছে এই ছেলেকে সে কীভাবে সামলাবে। বনুলতা সার্ভেন্টকে বলে,
– যাও পুড়া রুটি নিয়ে আসো।
সার্ভেন্ট নিচে আসতে আসতে বলে,
– এইসব কি হচ্ছে আল্লাহ্। কেউ কারো জন্য এত পাগল হতে পারে। স্যারে তো পুরাই দিওয়ানা হয়ে গেছে।
বনুলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে,
– রাফাত কেন এমন করছিস। তুই কি ঐসব খেতে পারবি। কখনো কী খেয়েছিস।
– কেন পারবো না। আমার পূর্ণা পারলে আমিও পারবো। আমার কোনো কষ্ট হবে না।
কিচ্ছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট পুড়া রুটি নিয়ে আসলে রাফাত রুটির প্লেট নিয়ে নিচে বসে পড়ে। যেটা দেখে বনুলতা এবং সার্ভেন্ট দুজনেই অবাক হয়ে যায়। রাফাত নিচে বসে রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার এই রুটি খেতে। কখনো কখনো গলায় আটকে যাচ্ছে। বনুলতা ছেলের এই হাল আর সহ্য করতে পারে না। তাই আঁচলে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সার্ভেন্টও চলে যায়। রাফাত মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
– হায়রে মা জননী। মারা সব সময় এমনি হয় বুঝি সন্তানের দুঃখ কষ্ট দেখতে পারে না। মাগো তুমি জনম দুঃখীনিই রয়ে গেলে।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৪
নিশুতি রাত। কোনো আওয়াজ নেয়। চারপাশ নিস্তব্ধ নির্জীব। যেনো কোনো প্রাণ নেয়। রাফাত মেঝেতে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে। মেঝেতে শুয়ার অভ্যাস নেয় যে। বনুলতা আস্তে আস্তে হেঁটে উপরে আসে। রাফাতের ঘরের দরজা টা আস্তে করে খুলে। তারপর যা দেখে তাতে তার কলিজা কেঁপে উঠে। একি দৃশ্য দেখছে সে। যেই ছেলেকে সে সোনার চামচ মুখে দিয়ে বড় করিয়েছে। কখনো কষ্টের ধারে কাছে যেতে দেয় নি। সে আজ মেঝেতে ঘুমাচ্ছে। এত সুন্দর বিছানা ছেড়ে সে নিজের সঙ্গী করেছে এই মেঝেকে। বনুলতা কাঁদে। তার চোখের পানি ঝরঝর করে পড়তে থাকে। আওয়াজ যেনো না বেড়োয় তার জন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে কান্না করে। খুব ভালোবাসে সে তার এই ছেলেকে। ছোট বেলায় নিজের বোনের কারণে ছেলেকে নিজের কাছে পায় নি। যখন কাছে পেলো সবটা দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে সফলও হয়েছে। তাহলে আজ কিসে কমতি পড়ে গেলো। বনুলতার হেঁচকি উঠে যায়। কারো হেঁচকির শব্দ শুনে রাফাতের ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসে। সামনে তাকিয়ে দেখে তার মা দরজার সামনে দাড়িয়ে কাঁদছে। রাফাত ম্লান হাসে। মাকে নিজের কাছে ডাকে।বনুলতা ছেলের পাশে গিয়ে বসে। রাফাত মায়ের কোলে মাথা রাখে। বনুলতা হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। রাফাত মায়ের চোখের পানি মুঝে দিয়ে বলে,
– কম তো জীবনে কাঁদলে না। আর কত কাঁদবে। এইবার তোমার শক্ত হওয়া দরকার।
বনুলতা কান্না আটকে বলে,
– আমি সব সহ্য করতে পারি। মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমার ছেলেদের কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি না। বিশ্বাস কর বাবা আমার কাছে যদি এমন কোনো ঔষধ থাকতো যেটা দিয়ে তোর ক্ষত সারানো যায়। আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও সেটা তোকে এনে দিতাম।
রাফাত রেগে বলে,
– মম। এইসব কি কথা। আমার জীবনে যেমন পূর্ণা ইমপোরটেন্ট। ঠিক তেমনি তুমিও ইমপোরটেন্ট। মম তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা আর পূর্ণা দ্বিতীয়। আমি প্রথম যদি কোনো নারীর প্রেমে পড়ে থাকি তাহলে সেটা তুমি। তবে অনুভূতি গুলো আলাদা। তুমি আমার মা জন্মদাত্রী যার জন্য আমি এই পৃথিবীর আলো দেখেছি। যে আমাকে ছোট্ট বেলা থেকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। যে আমার ভালোর জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে। যে নিজে না খেয়ে আমায় খায়িছে। আমার অসুস্থতায় রাত জেগে আমার সেবা করেছে। তুমি আমার মা। আমার মা। আর পূর্ণা হচ্ছে আমার জীবনের অর্ধেক একটা অংশ। যাকে না দেখলে আমার ঘুম হয় না। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় এখনি দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু মৃত্যু হয় না। জ্বালা দেয়। পিড়া দেয়। আমার মনে হয় আমার কলিজার কেউ ছুরি বসিয়ে মোচড়াচ্ছে। যানো মম যখন পূর্ণা পাশে থাকে মনে হয় জীবনের সব সুখ আমার কাছে। পৃথিবীর সব শান্তি আমার হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছে। আর না থাকলে মনে হয় পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট আল্লাহ্ আমার হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছে। মৃত্যু মনে হয় এই যন্ত্রণার থেকে ভালো। ভালোবাসা চার অক্ষরের এই শব্দটি কেউ দূর থেকে দেখলে ভাববে। ভালোবাসায় কতই না শান্তি আছে। ভালোবাসা মানে ভালো থাকা ভাববে। সবাই এর স্বাদ গ্রহণ করতে চাইবে। কিন্তু মম যখন এর স্বাদ মানুষ গ্রহণ করবে তখন বুঝবে কতটা যন্ত্রণা দেয় এই ভালোবাসা। তুমি ভালোবাসার মানুষ পেয়েছো তো রাতের আকাশের ঐ চাঁদ পেয়েছো। আর ভালোবাসার মানুষ পাওনি তো আকাশের কালো ঐ মেঘ রাশি তোমার জীবনকে আকরে ধরবে। তোমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করাবে। মনে হবে কেউ তোমার গলা চেপে ধরে আছে। যেকোন সময় মৃত্যু আসবে। কিন্তু আসছে না। মাঝপথে জমদূত এসে দাড়িয়ে আছে। তোমার জান কবজ করছে না। সে শুধু দূর থেকে তোমার যন্ত্রণা দেখছে আর আসছে। বলছে দেখো ভালোবাসছো তো মরছো। কেন ভালোবাসলে এখন যন্ত্রণা ভোগ করো। ধীকে ধীকে মরো। তোমার এই যন্ত্রণা যেনো তাকে শান্তি দিবে। ভালোবাসা এমন কেনো মম?
রাফাত এতদূর বলে থামলো। তার গলা ধরে আসছে। সে নিরবে কাঁদছে। তার চোখের পানি বনুলতার শাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। বনুলতা রাফাতের চোখের পানি মুঝে দিয়ে বলে,
– এত ভালোবাসিস।
রাফাত হেসে বলে,
– বিশ্বাস করো মম। যেনে বুঝে করেনি। কেন জানি হয়ে গেলো। কীভাবে হলো জানি না। শুধু জানি ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি আমি ঐ মেয়েটাকে। যানো মম প্রথম যেদিন আমি ওকে দেখেছিলাম ওহ তখন ছোট্ট পূর্ণা। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলো। সাড়া শরীর ভিজে আছে। সেইদিন ঐ মুহূর্তে ঐ ভেজা পান্ডুর মুখশ্রীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। এক মুহূর্তের জন্য আমার হৃদয় থমকে গিয়েছিল। পায়ের তলায় শিরশির অনূভব হলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো। অন্যরকম একটা ভালো লাগা মনের মধ্যে কাজ করলো। কিছু নতুন অনূভুতির সাথে পরিচয় হলো রাফাত চৌধুরী। যেই অনুভূতি সে আগে কখনো দেখিনি। তাদের কথা শুনেনি। যাদের সাথে তার আগে কখনো দেখা হয়নি।
বনুলতা রাফাতের কপালে চুমু খেলো। তারপর বললো,
– ভালোবাসা এমনি হয় রে পাগল। তবে তুই বেশি পাগলামি করছিস। পূর্ণা জানলে খুব রাগ করবে তুই দেখে নিস।
রাফাত উঠে বসে। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে জরিয়ে বসে। তারপর বলে,
– জানি আমি সে এখন অনেক বুঝে। কিন্তু অবুঝ পূর্ণার কথা শুনবে তুমি।
রাফাতের ইচ্ছুক দৃষ্টি দেখে বনুলতা বুঝলো রাফাত পূর্ণার গল্প বলতে চায় মাকে। তাই সে বললো,
– শুনি আমার মেয়ের কথা।
রাফাত হাসে। রাফাতের এই হাসি বনুলতার মন ছুয়ে দেয়। রাফাতকে সে একটু হাসাতে পেরেছে।
রাফাত বলতে শুরু করে,
– যেদিন আমি পূর্ণাকে প্রথম বলি পূর্ণা আমাকে বিয়ে করবো। পূর্ণা খিলখিল করে হেসেছিল আর শেষে বললো বিয়ে কি? আমি খুব অবাক হলাম পূর্ণার বয়স তো খুব কম না। তাহলে সে কেনো বিয়ে বুঝি না। তাও ওকে বুঝিয়ে বললাম। সব শোনার পর মেয়েটা হেসে বলে মাকে বলেনি। তারপর নাহয় দেখা যাবে। বুঝলাম পূর্ণার মায়ের আদেশ ছাড়া কিছু করে না। তারপর আরও অনেক কথা হয় পূর্ণা চলে যায়। বাসায় গিয়ে ওর মাকে সব বলে দেয়।ওর মা সোজা আমার কাছে আসে। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভদ্রমহিলা কোনো ভনিতা না করেই আমায় জিঙ্গাসা করলো তুমি পূর্ণাকে কি বলছো। আমিও সব বললাম ভয় হয় নি যানো মম। আমি একটুও ভয় পায়নি।সাহস করে বলেছিলাম ছোট্ট পূর্ণাকে আমি বিয়ে করবো। আপনি আমার জন্য ওকে তৈরি করে রাখবেন। ভদ্রমহিলা সেদিন আমায় এমন কথা বলেছিল যা শোনার পর আমি বাক্যহারা হয়ে পড়েছিলাম কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই সেদিন বোকার মতো পালিয়ে আসি। আর জীবনের সব থেকে বড় ভুলটায় আমি সেদিন করি। যদি সেদিন আমি পূর্ণার হাত না ছাড়তাম।যদি সেইদিন সাহস করে একবার বলতাম আমার কিছু যায় আসে না। তাহলে আজ হয়তো পূর্ণা জেলে নয় আমার সাথে থাকতো।
রাফাতের কন্ঠে অনুতপ্তের ছোয়া। সে মাথা নিচু করে আছে। বনুলতা জিঙ্গাসা করে,
– সেইদিন পূর্ণার মা তোকে কি বলে যা শুনে তুই পালিয়ে আসিস।
রাফাত জোরে শ্বাস নেয় তারপর বলে,
– মম পূর্ণার মা বাইজি ছিলো। পূর্ণার জন্মের হদিস সে জানতো কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। পূর্ণার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সে পূর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে আসে।
বনুলতার আফসোস হয়। কি অভাগা কপাল নিয়েই না পূর্ণার জন্ম। নাহলে কি আর এমন হয় বাবার সান্নিধ্য পেলো না। সতেরো বছর বয়সে মাকে হারালো। জীবন দিয়ে যাকে ভালোবাসলো বিধির নিষ্ঠুর খেলায় আজ তার থেকেও দূরে। বনুলতা রাফাতকে বলে,
– এই কারণেই কি ঝুমু পূর্ণাকে তুলে নেয়।
– না মম। তোমার জন্য তুলে নিয়েছে।
রাফাতের অকপট জবাব। যা বনুলতাকে নাড়িয়ে দেয়। সে অবাক হয়ে বলে,
– আমার জন্য মানে। আচ্ছা রাফাত কোনো ভাবে তুই ঝুমুর গাড়ি উড়িয়ে দিসনি তো।
রাফাত বাকা হাসে তারপর বলে,
– যেই লোকটা আমার মাকে কষ্ট দিলো। আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো। আমার ভালোবাসার গায়ে কলঙ্ক লাগালো। তাকে কি করে ছেড়ে দেয়।
বনুলতা চিৎকার করে বলে,
– রাফাত উনি তোর মামনি ছিলো। যার জন্য তুই একসময় পাগল ছিলি।
রাফাতও রাগী কন্ঠে বলে,
– ভুল। ঝুমুর বাইজি আমার কিছু হয় না। ঝুমুর নামের একটি মেয়ে ছিলো যাকে আমি আমার মামনি ভাবতাম। এখন সে আর নেয় সে মরে গিয়েছে আরও অনেক আগে। আর তুমি কার জন্য কষ্ট পাচ্ছো ঐ মহিলার জন্য তুমি জানো বাবার ব্যবসায় কে ধ্বংস করছে ঐ মহিলা। তুমি জানো পূর্ণা কার জন্য জেলে ঐ মহিলার জন্য। ঐ মহিলা আমার মাকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। জীবন ভরে আমার মা ঐ মহিলার জন্য কষ্ট করছে। মুখ বুজে কান্না করছে। তাও উনি আমার মায়ের সুখ সহ্য করতে পারেনি। কি করছে সে জানো। সে তোমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে চেয়েছে তোমার ছেলে তোমার রাফাতকে দুনিয়ে থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। রাফাতের ভালোবাসা পূর্ণাকে একজন বাইজি বানাতে চেয়েছে। কেন জানো যাতে তুমি আরও কষ্ট পাও। তিলে তিলে তুমি মরো আর তুমি এইসব বলছো।
বনুলতা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
– তুই ঝুমুর সাথে দেখা করেছিলি।
– হ্যা করেছিলাম। আমার আগেই মনে হয়েছিল এই মহিলা আর কেউ না তোমার আদরের বোন ঝুমুর ই হবে। তাই সন্দেহ দূর করতে জবা মাকে কল করি। সে বলে হ্যা এইটাই ঝুমুর। চলে যাত জেলখানায় কথা বলি তার সাথে। সেখানে সে তোমার নামে বানিয়ে বানিয়ে এত গুলা মিথ্যে কথা বলে। তোমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয়। আমি তোমার সন্তান। ছোট্ট বেলা থেকে তোমাকে কষ্ট পেতে দেখেছি। ঐ মহিলার মিথ্যে শুনে ইচ্ছে করছিলো ঐখানেই গলা টিপে ধরি। কিন্তু তা করিনি। আমি চেয়েছিলাম যেই রূপে উনি আমার বাবাকে বশ করেছে সেই রূপ আমি ঝলসে দিবো। তাই করছি ঝলসে দিয়েছি তার রূপ।
রাফাত জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার চোখ দিয়ে যেনো ওলকা বের হচ্ছে। এই ওলকা দিয়ে মনে হচ্ছে সে সব ভস্ম করে দিবো। তার এই দৃষ্টি দেখলে যে কেউ ছাই ছাই হয়ে যাবে। বনুলতা ছেলের পিঠে হাত রাখে। রাফাত শান্ত হয়। মাকে জরিয়ে ধরে। কেঁদে দিয়ে বলে,
– আমি সব পারব মম তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। তুমি ভালো থাকো আমি চাই। তুমি আর পূর্ণা আমার জীবনের সব। এদেয কিছু হয়ৃ গেলে আমি নিঃশ্ব মম। আমার দুনিয়া নিঃশ্ব।
– থাম বাবা। এত পাগলামি কেউ করে না। আমার এখন আর কোনো কষ্ট নেয়। যেদিন থেকে আমার ছেলেরা বড় হয়েছে সেদিন থেকে আমার আর কোনো কষ্ট নেয়।
কারো কান্নার আওয়াজে রিয়ানের ঘুম ভেঙেছিল। কে কাঁদছে সেটা দেখতে এসে সে মা আর ভাইয়ের সব কথা শুনে নেয়। মায়ের জীবনের এত বড় একটা সত্যি সে জানতো না। আজ জানলো মা তার কাছে সবকিছু গোপন করে রেখেছিল। কিন্তু কেন? বনুলতা দরজার দিকে তাকায় দেখে রিয়ান দাড়িয়ে আছে। বনুলতা অবাক হয়ে বলে,
– রিয়ান তুই।
রিয়ান রাগ করে সেখান থেকে চলে যায়। রাফাত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মনে হয় সব শুনে নিয়েছি।
– এইবার কি হবে।
– কিছু না। সব খুলে বলো রিয়ানকে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও।
বনুলতা উঠে রিয়ানের পেছন পেছন যায়। রাফাত ভাবে তার এই ভাইটা বড্ড অভিমানি। রাফাত বেলকনিতে চলে যায়। এইদিকে রিয়ান নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করতে গেলে বনুলতা ধরে ফেলে। রিয়ান দরজা ছেড়ে দেয়। রাগের মাথায় মাকে আর যায় হোক আঘাত করতে চায় না। রিয়ান রুমে এসে বিছানায় বসে পড়ে। বনুলতাও রিয়ানের পাশে এসে বসে। রিয়ান ফুসছে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে তার ভেতরে আগুন জ্বলছে। অভিমানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। বনুলতা রিয়ানের হাত ধরলে সে এক ঝটকায় হায় সরিয়ে নেয়। বনুলতা রিয়ানের মাথায় হাত রেখে রিয়ান রেগে বলে,
– মম প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও।
বনুলতা হাসার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে তার ছেলের ভেতরে কি চলছে। সে রিয়ানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– মায়ের প্রতি এত রাগ।
রিয়ান বনুলতাকে জরিয়ে ধরে বলে,
– মম তুমি এমন কেন? সব কষ্ট বুকে চেপে রাখো। কিছু বলার হলে ভাইকে বলো তাও আমাদের বলো না।
– বোকা ছেলে আমি কাউকেই কিছু বলি না। তোর ভাই তো খুব চালাক তাই সে বুঝে নেয়।
রিয়ান উঠে বসে। তারপর বলে,
– আব্বু কি করছো মম। যার জন্য ভাই এতো রেগে আছে। আমি সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখে আসছি ভাই কখনোই আব্বুকে আপন করতে পারেনি। আব্বুর সাথে মনে হতো জোর করে কথা বলে। হু হা ছাড়া কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেন মম?
বনুলতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শূণ্যে তাকিয়ে বলে,
– তোর বাবা আমার ছোট বোনকে ভালোবাসতো। তাকে বিয়েও করেছিল। তাদের সন্তান আছে কৌশিক। কৌশিক ওদের সন্তান।
রিয়ান অবাক হয়ে যায়। সে অবাক কন্ঠে বলে,
– এইসব কি বলছো মম।
– হ্যা ঠিকই বলছি।
তারপর বনুলতা এক এক করে সব কথা রিয়ানকে বলে। শুরো থেকে কীভাবে কী হয়েছে সব বলে। সব শোনার পর রিয়ানের মুখ দিয়ে শুধু একটা উচ্চারণ আসে,
– ছিঃ।
বনুলতা ছেলের মুখ চেপে ধরে বলে,
– এইভাবে বলতে নেয় বাবা উনি তোমার বাবা হয়। বাবাকে সম্মান দাও। আমি জানতাম তোমরা এইসব শোনার পর বাবাকে ঘৃণা করবে তাই কিছু বলতে চায় নি। রাফাতকেও কিছু বলতাম না। ওহ তখন খুব একটা ছোট ছিলো না তাই অনেক কিছু বুঝতো। সেই নিজের জীবনের কিছু ঘটকার পেছনে ওহ পড়ে থাকে। সেইখান থেকেই খুজে বের করে ওর মায়ের অতীত। ওর মামনির অতীত যেই মামনিকে ওহ খুব ভালোবাসতো। আমি ওকে কিছুই বলিনি সব কিছু ওকে আপা বলেছে।
– কেন মম তোমার মধ্যে কিসের কম ছিলো যে আব্বু ঐ মহিলার কাছে গেলো। আমার মা তো শ্রেষ্ঠ মা। রূপে গুনে সব দিক দিয়ে তাহলে কেন?
– হয়তো যেই ভালোবাসা টা উনি ঝুমুর মধ্যে দেখেছিল সেটা আমার মধ্যে পায়নি। তবে জীবনের এক পর্যায়ে নিজের ভুলটা তো বুঝতে পেরেছে। এখন উনি অনুতপ্ত। আর যারা নিজের ভুল বুঝতে পারে তাদের ক্ষমা আমাদের দায়িত্ব বুঝলি।
– মম ভাই ওদের খুন করছে না।
বনুলতা ঠোটে আঙুল বসিয়ে বলে,
– হুশ কেউ শুনে নিবে। রাফাত অন্যায়কে প্রশ্রয় কখনোই দেয় না। নিজের বাবাকে ছাড় তো না। যদি না আমার ঐ মানুষ টার উপর অগাধ ভালোবাসা থাকতো। ওহ ওর মায়ের কাছ থেকে সোহাগ কেড়ে নিবে না। তাই রশীদ চৌধুরী এখনো শ্বাস নিতে পারছে। বাকি রইলো ঐ তিনজন। তারা ওর প্রাণ ভোমরায় হাত দিয়েছে। পূর্ণা রাফাতের প্রাণ। আজ ওদের জন্য পূর্ণা জেলে তাই ওদের ওহ ছেড়ে দেয়নি। মিহুকে ওহ এই কেস থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কারণ ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি ওহ করতে চায় না তাই বুঝলি।
– মম ভাই অনেক ভালো। কিন্তু আল্লাহ্ কেন আমার ভাইটাকে এত কষ্ট দিচ্ছে। ভাইয়ের এই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না।মিহু বললো ভাই অনেক পাগলামি করেছে জেল খানায় গিয়ে। শুধু তাই নয় তুমি তো দেখলে বাসায় এইসব কি করছে। আচ্ছা তুমিই বলো এইসব দেখলে পূর্ণার কি ভালো লাগবে। ওহ যদি জানতে পারে ভাই এইসব করছে তাহলে কত কষ্ট পাবে একবার ভাবো।
– হুম। কিন্তু ওকে এইসব কে বুঝাবে। যে বুঝাবে সে এখন জেলে। আর ওকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেয়। যেদিন থেকে পূর্ণাতে মত্ব হয়েছে সেদিন থেকে পূর্ণা ছাড়া কিছু বুঝে না সবকিছুতে শুধু পূর্ণা।
– এতটাও কাউকে ভালোবাসা যায় মম।
– কেন যাবে না তুই কি মিহুকে ভালোবাসিস না।
– খুব বাসি। কিন্তু হয়তো ভাইয়ের মতো কখনো বাসতে পারবো না। ভাইয়ের ভালোবাসা নিখুত একদম খাটি কোনো খাত নেয়। পূর্ণা ভাগ্যবতী মম ভাইয়ের মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে। ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
– তোর কী মনে হয় পূর্ণা রাফাতকে ভালোবাসে না খুব বাসে। ওর জন্য জীবনও দিতে পারে। মেয়েটা কেমন জানি খুব চুপচাপ। অথচ মাথায় চলে অন্যকিছু। ঠাণ্ডা মাথায় কাছ করে। ওর মতো মেয়ে কাউকে খুন করবে আমি কল্পনাতেও আনি নি। জীবন বাজি রেখে রাফাতকে বাচিয়েছে। যতবার ওর ভালোবাসা বিপদে পড়বে আমার বিশ্বাস সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ভালোবাসাকে রক্ষা করবে। যেই দহনে রাফাত পুড়ছে সেই একি দহনে পূর্ণা পুড়ছে। শুধু বুকের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে সেই যন্ত্রণা। ধীকে ধীকে মরছে মেয়েটা। খুব কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য ছোট বেলা থেকে তো শুধু কষ্টই করলো। বাবার আদর চোখে দেখলো না। মাটাকেও কেড়ে নিলো আল্লাহ্। রাফাত ছাড়া ওর জীবনে আর কে আছে।
– হুম মম। ওদের দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় কান্না পায়।
বনুলতা রিয়ানের কান ধরে বলে,
– এখন বল তো কবে থেকে মিহু ঠুকলো তোর মনে। মমকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।
রিয়ান কান ধরে বলে,
– আহ মম ছাড়ো লাগছে। তোমাকে সব বলছি আগে আমার কান ছাড়ো। কান ছিড়ে গেলে মিহু আমায় বিয়ে করবে না।
বনুলতা অবাক হয়ে বলে,
– শুনছো ছেলের কথা কি বলে। ঠোঁট কাটা বজ্জায়ত ছেলে। আসুক মিহু তোর নামে আমি ওর কাছে বিচার দিবো।
রিয়ান কান ডলতে ডলতে বলে,
– কি পায়ছো কি তোমরা। মিহুকে কিছু বললে বলে মার কাছে বিচার দিবো আর তোমাকে কিছু বললে বলো মিহুর কাছে বিচার দিবে। তাহলে আমিও বলে দিচ্ছি তোমরা আমায় কিছু বললে আমি ভাইয়ের কাছে বিচার দিবো।
বনুলতা ছেলের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয়। রিয়ানও মায়ের হাসি দেখে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে এমন অবস্থা যেনো তাদের দম বেড়িয়ে আসবে। বনুলতা হাসি থামিয়ে বলে,
– অনেক হয়েছে রঙ তামাশা এখন ঘুমা। আমি আসছি।
– আচ্ছা মম। তুমিও গিয়ে শুয়ে পড়ো।
– আচ্ছা। শুভ রাত্রি।
– শুভ রাত্রি।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।