তুমি আমার প্রেমবতী পর্ব -০৩

#তুমি_আমার _প্রেমবতী
#পর্বঃ৩
#সানজিদা_খানম_স্বর্ণা

৫.
ক্লান্ত তিনজন ড্রয়িংরুমে বসে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ব্যাস্ত।শাহানাজ বেগম গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,’সাথী,কোথায় তুই?’
মিনিট খানেকের মধ্যে একটা ১৫ বছর বয়সী মেয়ে এসে দাঁড়ালো ড্রয়িংরুমে।মুখ গোলগাল।গায়ের রঙ ততটা ফর্সা নয়।গায়ে ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ। মাথার চুলগুলো দুই বিনুনি করে কাঁধের সামনে এনে রেখেছে।দেখে যতটা শান্ত স্বভাবের মনে হয় ততটা শান্ত সে নয়।এসেই দ্রুততার সাথে জবাব দিল,’এই তো বড় মা।আমি এখানে।’

শাহানাজ বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,’কোথায় ছিলি তুই?নিশ্চয়ই ফোন নিয়ে ব্যাস্ত ছিলি?অভিকে বার বার করে বললাম তোকে ফোন কিনে না দিতে,কিন্তু কে শোনে কার কথা?স্মৃতিকে ফোন কিনে দিছে বলে তোকেও দিতে হবে!বলি তোর আর স্মৃতির এতটুকু তর সইলো না কেন?স্মৃতি তো একটু বড় হয়েছে।এসএসসি পরীক্ষা দিবে।তুই তো মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়িস।ফোনের কি খুব দরকার ছিল?’

একে তো গরম।এখন আবার সাথীর সাথে শাহানাজ বেগম স্মৃতিকেও ছাড়লেন না।স্মৃতি সামান্য তেজ দেখিয়ে বললো,’আম্মু তোমার একবার মনে হলেই হলো।এখন ফোন নিয়ে পরলে কেন?সারাক্ষন এক বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে তোমার খুব ভালো লাগে বুঝি?দুনিয়াতে যা কিছুই হোক,সব দোষ আমার আর আমার ফোনের।ঐ যে বলে না, আমি হলাম বাড়ির সেই নন্দঘোষ।যা কিছুই হোক সব আমার দোষ।যদি কোনো দিন শোনো,সূর্য পূর্ব দিকে না ওঠে পশ্চিম দিকে ওঠছে সেটাও আমার আর আমার ফোনের দোষ।’

স্মৃতি বেশ রেগেই নিজের রুমের দিকে পা’ বাড়ালো।সাথী হতভম্বের মতো দেখছে।সে এই বাড়িতে কাজ করে।মোজাম্মেল সাহেব নিজের গ্রামের বাড়ি থেকে সঙ্গে করে সাথীকে শহরে নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে কাজ দেয়।সাথী শাহানাজ বেগমের কাজে টুকিটাকি সাহায্য করে।বাড়ির সবাই তাকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতোই দেখে।তার জন্যই তো পড়াশোনার জন্য আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।কিন্তু তাই বলে সে নিজের সীমানা ভুলে যাবে এমন নয়।মোজাম্মেল সাহেব স্মৃতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললেন,
‘মেয়েটা এসে একটু শান্তিতে বসতেও পারলো না।তোমার অযথা কথায় উঠে চলে গেল।সত্যিই তো সর্বক্ষণ এক বিষয় নিয়ে পরে থাকো কেন বলতো?সব কথায় এক ফোনের খোঁচা না দিলেই কি নয়?সাথীকে কেন ডেকেছো সেটা তো এখনো বললে না।’

শাহানাজ বেগম স্বামীর কথায় ভ্রূ কুঁচকালো।কিন্তু মুখে কিছু না বলে সাথীর দিকে তাকিয়ে বলল,’একটু ঠান্ডা শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়।তাড়াতাড়ি করিস।’

সাথী দৌড়ে ছূটলো রান্না ঘরের দিকে।।কিছুক্ষনের মধ্যেই শরবত সহ ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো।শাহানাজ বেগমের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি তড়িৎ ঘুড়িয়ে নিলো।শাহানা বেগম সেদিকে লক্ষ্য করে বললেন,’কিছু কি বলবি?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাথী।শাহানাজ বেগম বুঝতে পারলেন সাথী কী জানতে চাইছে?পাত্রী দেখে কি হলো এই সব নিয়েই হয়তো প্রশ্নের ভীর সাথীর মনে।শাহানাজ বেগম আর কিছু বললেন না সাথীকে।ব্যার্থ দৃষ্টিতে আরেকবার শাহানাজ বেগমের পাণে তাকালো সাথী।মোজাম্মেল সাহেব একটা শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে সাথীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’অভি ফিরেছে?’

‘জী কাকাবাবু,বড় ভাইজান কিছুক্ষন আগেই ফিরেছে।ফিরে এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরের বসে আছে।আমি একবার ডাকতে গেছিলাম।আমাকে বলল,’তুই যা।বিরক্ত করিস না।’ তাই আমি আর কিছু না বলে চলে এসেছি।

মোজাম্মেল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।অভির ঘরের দিকে পা’ বাড়ালেন তিনি।স্নিগ্ধার বাড়িতে ঐ অভদ্রতা কেন করলো?কেন উনার মানসম্মান ডুবিয়ে দিলো?এই প্রশ্নের উত্তর চান তিনি।

অভির ঘরের দিকে এগুতে নিলে পথিমধ্যে আঁটকে দেন শাহানাজ বেগম।বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক রেখেই বলেন,’কি করছো কি?মাত্র এসেছো এক্ষুণি এক্ষুণি অভির রুমের দিকে যাচ্ছো কেন?ছেলেটার রাগের ধারণা নিশ্চয়ই আছে তোমার।এখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।কেন সে বিয়েটা করতে না করেছে এই সব পরে জানা যাবে এখন আমার ছেলেটাকে একা থাকতে দাও।’
মোজাম্মেল সাহেব বিনাবাক্যে শাহানাজ বেগমের কথাগুলো মেনে নিলেন।

৬.

আকাশটা রঙ বদলেছে।একটু আগের সেই রোদের তেজ এখন আর নেই।জোরে হাওয়া দিচ্ছে।ঘন অন্ধকার করেছে চারপাশ। ব্যাস্ততম মানুষের জীবনে হঠাৎ করে বৃষ্টির আগমন খুব একটা সুখের বার্তা নয়।গরীব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কর্মের সমাপ্তি টেনে শূণ্য হাতে ঘরে ফেরার দৃশ্য খুবই করুণ।আভিজাত্যের শেকলে বন্ধি থাকা মানুষগুলোর পক্ষে সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয়।বৃষ্টির হালকা ফোঁটা ধরণী বুকে আঁছড়ে পরছে। ক্রমশ ভারী বর্ষনের রূপ নেবে।
দ্রুত ছুটে গেল এক অষ্টাদশী রমনী।রোদে শুকাতে দেওয়া জামা কাপড় গুলো বৃষ্টিতে ভেজার আগেই হাতে তুলে বিদ্যুৎ বেগে ফিরে এলো সে।ঘরে এসে একপলক বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ মায়ের দিকে তাকালো শ্যামকন্যা।কাপড়গুলো বিছানার এক পাশে রেখে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে।বৃষ্টির পানি মাটিতে পরে আবার কিছু ছিঁটে এসে বারান্দার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়েছে।বারান্দার এক পাশে মাটির উনুন।দ্রুত একটা হালকা ছেঁড়া বস্তা দিয়ে ঢেকে দিল সেটা।তার ওপরে একটা ভারী কাঠের টুকরো।বৃষ্টিতে ভিজে গেলে রান্না করে খাওয়া জুটবে না কপালে।
বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করলো সে।আহা! বৃষ্টি পরার কি এক সুন্দর শব্দ,যেন নতুন এক ছন্দের সৃষ্টি করেছে।একবার ভাবলো বৃষ্টিতে ভিজবে।বারান্দা থেকে লাফিয়ে নামার আগেই ঘর থেকে মায়ের ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজে থমকে যায় শ্যামবতী।
‘প্রেমা,ছেলেটা কি এখনো আসেনি?কোথায় আছে এই ঝড়ের মাঝে?’
বৃষ্টিতে ভেজার তোরজোর রেখেই মায়ের ডাকা সাড়া দিতে ঘরে ডুকে সে।মায়ের মাথার কাছে বসে কপালে হাত রেখে বলে,’তুমি চিন্তা করছো কেন মা?আদু এক্ষুনি চলে আসবে।’

‘কি বললি তুই?কত বার বলেছি? ছেলেটার নাম ব্যাঙ্গাত্মক সুরে উচ্চারণ করবি না।তোর নিজের ভাই তুই যদি তার নাম ঠিক করে না বলিস তাহলে বাকী লোকেরা ঠিক করে বলবে কেন?’
মায়ের রাঙানো চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমা বলে,’আর কখনো বলবো না।তোমার ছেলেকে এখন থেকে আদিল বলেই ডাকবো।রাগ করো না। সোনা মা’ আমার।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই একটু ছাতাটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখ ছেলেটা কোথায় আছে?’

‘আচ্ছা,দেখছি।’
আরেকবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবেদনের সুরে বলে,’মা আজকে বৃষ্টিতে একটু ভিজতে দাও না।ছাতা ছাড়া যাই?’

‘বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধালে তোমার ষোলোকলা পূর্ণ হবে!তাই না?একদম না।তুই ছাতা নিয়েই যা।’

অগত্যা প্রেমা ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পরে।সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে আদিলকে খুঁজার চেষ্টা চালাতে চালাতে এগুতে থাকে।মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে আর কিছুক্ষন।ঢাকার বুকে বৃষ্টি খুব যে পরিবর্তন আনতে পারে তা নয়।তবে কয়েকটা রাস্তার মোড়ে একটু আধটু ফাঁকা।বৃষ্টির মাঝেও কেউ কেউ রেইনকোড পরে রাস্তায় বেরিয়েছে। ভাইকে না পেয়ে প্রেমার মন অস্থির হয়ে ওঠেছে।চোখে ঘনায়মান স্পষ্ট ভয়ের ছায়া।

‘এই বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যা বেলায় একা একা রাস্তায় কি করছিস?’

পুরুষ কন্ঠে চমকে পেছনে তাকায় প্রেমা।বিশ্রী হাঁসি দিয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে চোখে মুখে।ছেলেটার ভ্রুক্ষেপহীন দৃষ্টি প্রেমার দিকে।
‘আপনি এখানে কেন কুদ্দুস ভাই?’

‘কেন? রাস্তাটা কি তোর একার নাকি?আমি আসতে পারি না।’

‘আমি আপনাকে সেটা কখন বললাম!আমি বলতে চাইছি আপনি এই সময়ে এখানে কি করেন?’

‘তুই এই সন্ধ্যা বেলায় শুণ্য রাস্তায় একা একা কি করছিস?মেয়ে মানুষ ভয় নেই?কোনো বাজে ছেলে পেলের নজরে পরলে রক্ষা পাবি কি করে?’

প্রেমা উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না।বাজে অন্য ছেলেদের থেকে সাবধান করছে অথচ নিজের চরিত্র কেমন সে সম্পর্কে উদাসীন।বাজে ছেলেদের তালিকায় নিজের নামটাও যে আছে সেটা কি বেমালুম ভুলে গেলো নাকি? প্রেমা জানে কুদ্দুস নিজেই প্রেমাকে বিয়ে করতে চায়।প্রেমা সে প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বেশ কয়েকবার অভদ্রতাও করেছে প্রেমার সাথে।সমবয়সী অন্য মেয়েদের থেকেও শুনেছে, কুদ্দুস মেয়েদের দেখলে বাজে ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে।একা পেলেই মেয়েদের বাজে ইঙ্গিত দিতে ভুল হয়না কুদ্দুসের।তাই ভালোই ভালোই সেখান থেকে সরে যেতে নিলে কুদ্দুস প্রেমার ওড়না টেনে ধরে।

‘কি রে!জবাব না দিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছিস?’

প্রেমা তেজী গলায় এক প্রকার ধমকের সুরে বলে,
‘ভালোই ভালোই বলছি কুদ্দুস ভাই,ওড়নাটা ছাড়ুন।কি সব অভদ্রতা শুরু করেছেন আপনি?নিজের ভালো চান তো ওড়নাটা ছাড়ুন!

কুদ্দুস ওড়নাটা ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে এসে বলল,’কিসের এতো তেজ তোর?থাকিস তো রেললাইনের ধারের সস্তা বস্তিতে। বস্তির মেয়েদের এতো অহংকার কিসের?এখন তো দুই ভাই বোন মিলে ফুলের মালা আর পানি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা চালাচ্ছিস। কয় দিন পর তো মায়ের চিকিৎসার টাকার জন্য নষ্টামি করতেও পিছু হটবি না।এখন নিজেকে এতো পবিত্র…’

কথা শেষ হবার আগেই শক্ত একটা থাপ্পড় পরে কুদ্দুসের গালে।গালে হাত দিয়ে ফুঁসে ওঠে কুদ্দুস।প্রেমার চুলের মুঠি ধরে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলে,’আজকের এই থাপ্পড়ের শোধ আমি ঠিক তুলবো।কুদ্দুসকে এতো হালকা ভাবে নেওয়ার কিছু নাই।মনে রাখিস একবার তোরে ভাগে পাই।তোর তেজ মিটিয়ে দিবো।’

ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে নেয় প্রেমা।চোঁখ থেকে দু ফোটা অশ্রু বাধাহীন ভাবে গড়িয়ে পরে।তার দোষ কি মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ায় নাকি সমাজে কিছু কুরুচিপূর্ণ পুরুষের চরিত্রই এমন?নারীদের কি সর্বদায় ভোগের বস্তু মনে করে তারা?

চলবে, ইনশাআল্লাহ ✨

(আসসালামু আলাইকুম।গল্পটাতে আপনাদের এতো ভালোবাসা পাবো আশাই করতে পারিনি। ধন্যবাদ সবাইকে। হ্যাপি রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here