তুমি আমার প্রেমবতী পর্ব -০৪

#তুমি_আমার_প্রেমবতী
#পর্বঃ৪
#সানজিদা_খানম_স্বর্ণা

৭.
জীবনে কত বসন্ত, কত শরৎ, কত বর্ষা তাদের অপরূপ সৌন্দর্য্যের মাধুরী দিয়ে মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কল্পনার জগতে।আমাদের মনের মনি কোঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে কোনো কোনো দিন।কিন্তু চৈত্র মাসে এই রকম বৃষ্টি! এটা বেশ দুর্লভ। সেই জন্যই আরেকটা স্মরণীয় দিন হতে চলেছে বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যার এই মুহুর্তটা।
শাহানাজ বেগম রান্না ঘরে খিচুড়ি রান্নায় ব্যাস্ত। হাতে হাতে একটু আধটু সাহায্য করছে সাথী।সন্ধ্যার এই সময়টাতে তার ভীষণ গান শুনতে ইচ্ছে হলো।ছুটে গেল নিজের ঘরে।ব্যাগ থেকে অতি সন্তপর্ণে বের করলো একটা ছোট রেডিও। বেশ যত্ন করে একটা পাতলা কাপড় দিয়ে মোড়ানো।

রেডিওটা সাথীর বাবার।এই বাড়ি তে কাজ করতে আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিল।রেডিওটা নিয়ে পা টিপে টিপে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো।শাহানাজ বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে রেডিওটা চালু করে দিল।শাহানাজ বেগম চমকালেন।রেডিও দেখে অবাক হয়ে শুধালেন,’এই বাড়িতে রেডিও কোথায় পেলি?’

সাথী চমৎকার হেসে জবাব দিল,’আমি গ্রাম থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম।এটা আমার বাবার রেডিও। বড় মা এখন চুপ করে গান শুনো তো।কথা বলো না।’

শাহানাজ বেগম রেডিওতে চলা গানের দিকে মনযোগ দিলেন।রেডিও থেকে ভেসে এলো মন উদাস করা রবীন্দ্রসংগীতে সুর–

❝মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিক–দিগন্তের পাণে
নিঃসীম শূণ্যে
শ্রাবণ–বরষণ সঙ্গীতে।❞

স্মৃতি নিত্যকার মতো জানালার পাশে থাকা টেবিল’টাতে বই নিয়ে পড়তে বসেছে।বৃষ্টি বেশ খানিকটা কমেছিল আধ ঘন্টা আগে।এখন আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো।চারদিক আরও ঘন অন্ধকার হয়ে ওঠলো।এমন বাদলা দিনে কি পড়ায় মন বসে?কোনো এক স্বপ্নপুরীর কল্পনায় মন ভেসে যেতে চায়।অবুঝ মন সুই–সুঁতো বিহীন এক রঙিন সপ্নের মালা গেঁথে চলে।অশান্ত বর্ষণের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে স্মৃতি।তার পড়ার ঘর নিচতলায়।জানালার পাশেই একটা ক্ষুদ্র ফুলের বাগান।বাগানে গোলাপ, বেলি,গাঁধা,আরও কয়েকটি নাম না জানা কয়েক জাতের ফুলের গাছ আছে। তাছাড়া বাগানে একটা বড় বকুল গাছ সাথে দুইটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ আছে।

মোজাম্মেল সাহেব বেশ কয়েকবার চেয়েছেন বকুল গাছটি কেটে ফেলতে।কিন্তু স্মৃতি গাছটি কাটতে দেন নি। বকুল ফুল বড় পছন্দের কিনা!মেঘের কালো ছায়ায়, বৃষ্টিতে, ঝড়ো হাওয়ায়, ঘন ঘন মেঘের গুরু গুরু ডাকে অদ্ভুত একটা মায়াবী পরিবেশ।বকুল গাছের ডালে পাতায় চলছিল ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ফোঁটার অবিরাম মাতামাতি।

এরই মাঝে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় যেন কোনো একজনকে খুব মনে পড়ছে স্মৃতির।একটা অলস অতলতা মনের গভীরে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।সে যে কী অনুভূতি!কী যন্ত্রণা বলে বোঝানো যাবে না।বয়সটাই হয়তো এমন,মন মাঝে মাঝে কল্পনার মাঝেও একজন স্বপ্নের নায়ক খুঁজে নিতে ব্যাস্ত হয়ে ওঠে। কল্পনা বিলাসী মন মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় পাখনা মেলে উড়ে চলে কোনো এক কল্পলোকে।কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী আবেগ মনের বাগিচায় এক অপুর্ব অনুভূতি জাগায়,

❝হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে,ময়ূরের মত নাচেরে।❞

বৃষ্টির বেধড়ক অত্যাচারে অভির মনটা বেশ বিরূপ হয়ে আছে। ওর কাছে বৃষ্টি মানেই ভুনা খিচুড়ি, রাস্তায় বেরুলেই হাঁটু কাদা জল,পদে পদে পিছল পথের হুমকি,সবচেয়ে নিধারুণ ভাবে অফিসে কর্মচারীদের বৃষ্টির জন্য নানা অজুহাতে অফিস কামাই করার চিন্তা,একদম বিরক্তিকর!
তবুও জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখছে সে।দৃষ্টিতে ভীষণ প্রখরতা।বাহিরের বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ অভির কানে পৌঁছাচ্ছে না।

ঘরে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা।সামান্য ড্রিম লাইটের আলোয় অস্পষ্ট অভির মুখের অবয়ব ঠিক কি জানান দিচ্ছে কেউ জানে না।এমন বাদলা দিনের অমৃত স্বাধ আস্বাদনে অক্ষম অভি।সিগারেটের লীলাভ ধোঁয়ায় ভরে ওঠেছে চারপাশ।এর মাঝেই কয়েকটা শুঙ্ক কাঁশি দিয়ে ওঠে দাঁড়ালো অভি।হাতে থাকা সিগারেটের বাকী অংশটা একটানে সুখের সহিত গ্রহন করে ফিরতি ভারী শ্বাস দ্রুত ছাড়ালো।চারপাশে ধোঁয়ায় ভরে ওঠলো আবার।জানালা দিয়ে সিগারেটের শেষাংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাহিরে।

দু’ কদম এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারের ভেতর থেকে ধুলো জমা ডাইরিটা বের করলো অভি।যদিও ড্রয়ারের ভেতরে ছিল তবুও অযত্নে, অলেখায় ডাইরির পাতাতেও ধুলো জমেছে।লেখাগুলোতে হাত বুলালো অভি।এ যে শুধু লেখা নয়,জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা এক কুৎসিত অতীত।যা আজও অতি যত্নে সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে অভি।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজে অভির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত সজাগ হলো।ডাইরিটা পুনরায় পূর্বের জায়গায় রেখে দরজা খুলে দিল।সাথীকে দেখে সহজভাবে জিজ্ঞেস করলো,’এখন এখানে কি চাই তোর?’

‘বড় আম্মা খেতে ডাকলো।তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছে, তাই এসেছি।’

অভির মুখে কিঞ্চিৎ বিরক্তির আবির্ভাব হলো।তবুও শান্ত গলায় বললো,’আচ্ছা আমি আসছি তুই যা।’
সাথী যেতে নিলে, অভি আবার ডাকলো।’শোন আম্মু কি রান্না করছে?’
সাথী পিছিনে ঘুরে ‘খিচুড়ি’ বলেই আবার ছূট লাগালো।অভি অসস্থিতায় নিজের অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে সবার সাথে খিচুড়ি ভোজনের উদ্দেশ্য পা’ বাড়ালো খাবার টেবিলের দিকে।

৮.

গালে হাত দিয়ে চিন্তায় বারান্দার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে প্রেমা।দৃষ্টিতে ব্যাকুলতা।তবুও পলকহীনভাবে দেখতে লাগলো অঝোর ধারায় সুক্ষ্ম জলকণার বর্ষণ।চিন্তায় মাথা পা*গ*ল হবার উপক্রম। ভাইটাকে কোথাও খুঁজে পেল না সে।উল্টো এর ঝড় বাদলের দিনে বেরিয়ে কুদ্দুসের মতো বাজে লোকটার সাথে বাকবিতন্ডায় জড়াতে হলো।প্রেমা ঘরে ফিরে অসুস্থ সেলিনা পারভীনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলো।সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে প্রেমা আর আদিল জেনেছে তাদের বাবা ছোট বেলায় মারা গেছে।

স্বামীর মৃত্যুর শোকে এখনো আজাহারী করেন সেলিনা পারভীন।এখন জেগে যদি আদিলকে দেখতে না পায় চিন্তা করবে।ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে আর কোনো কষ্ট দিতে চায় না প্রেমা।এই ভেবে আর সেলিনা পারভীন’কে ডাকেনি সে। ইচ্ছে করেই নিঃশব্দে বারান্দায় বসে আছে প্রেমা।
মাগরিবের আযান হতে কিছুক্ষন মাত্র বাকী।ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো প্রেমা।কিছুক্ষন আগেই বিদ্যুৎ চলে গেছে। রেললাইনের ধারের বস্তিতে এমন দিনেও বিদ্যুৎ সংযোগ থাকবে এই চিন্তা করা মহা অন্যায় হবে।
দূরে কেউ একজন টর্চের ক্ষীণ আলোতে শ্যাওলা মিশ্রিত মাটিতে অতি সন্তপর্ণে পা’ ফেলে এগিয়ে আসছে।অতি সাবধানী লঘু পদক্ষেপ।বৃষ্টির জন্য দৃষ্টি বেশি দূর প্রসারিত করা গেল না।চোখের ঠিক সামনেই টপটপ করে পানির বড় বড় ফোঁটা পড়ছে চাল গড়িয়ে।বৃষ্টির পর্দার আড়ালে চেহেরা চিনিবার উপায় নেই কারো।প্রেমা বুঝার চেষ্টা চালালো লোকটাকে চেনার। আর বেশি বেগ পেতে হলো না।

বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধা পর ঘরে ফিরলো আদিল।প্রেমা চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়।’আজ তোর ঘরে ঢুকা বারণ।’গায়ে ভেজা জামাকাপড় সমেত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আদিল।মাথায় একটা পলিথিন পেঁচিয়ে এই ভারী বৃষ্টি থেকে বাঁচার সামান্য চেষ্টা করে বাড়িতে এসেছে সে।কিন্তু তাতে লাভ কি হলো?এখনো বৃষ্টিতেই ভিজে চলেছে।প্রেমা ধমকের সুরে বলে,’এতোক্ষন কোথায় ছিলি তুই?’

কম্পিত কন্ঠে আদিল জবাব দেয়,’আসলে আমি সবার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে গেছিলাম।’

কথাটা শেষ হবার আগেই লাঠি দিয়ে দু ঘা’ বসিয়ে দিলো প্রেমা।যন্ত্রণায় আহ! শব্দ করে ওঠলো আদিল।প্রেমা আরও কয়েকটা কথা শুনাতে যাচ্ছিল এর আগেই ঘর থেকে সেলিনা পারভীনে’র কথায় থেমে যায় প্রেমার কন্ঠ।
‘প্রেমা!!! তুই কি ছেলেটাকে মারলি নাকি?’

‘তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো এতোক্ষণ কোথায় ছিল?তারপর আমি কি করছি সেটা বলতেছি।’
নিজেকে বাঁচাতে কৌশলে জবাব দিল প্রেমা।বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা আদিলের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,’ তা তুই কি সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজবি নাকি?এখনো দাঁড়িয়ে আছিস যে!!!’

আদিল বারান্দায় উঠে দাঁড়ালে প্রেমা শুকনো জামা কাপড় এনে দিল।ভেজা কাপড় বদলে ঘরে ডুকে মায়ের মাথার কাছে বসলো সে।চোরের মতো কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,’আপু,ক্ষুদা লাগছে।কিছু খেতে দাও।’

সেলিনা পারভীন ছেলের হাতে হাত রাখেন।ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন,’তুই কি এখনো ছোট আছিস বাবা?অমন বেখেয়ালি করলে কি করে হবে।ঘরে আমি আছি, প্রেমা আছে আমাদের না জানিয়ে এইভাবে কোথাও যাবি না।আমাদের চিন্তা হয়।’

‘তোমার ছেলের সেদিকে কোনো খেয়াল নাই মা।সে শুধু আমাদের চিন্তায় ফেলতে ভালোবাসে।’

বলতে বলতে প্লেট ভর্তি ভাত আর আলুভর্তা এনে আদিলের সামনে দিলো প্রেমা।আদিল সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’সব ভাত কি আমাকেই দিয়ে দিলি নাকি আপু?তুই আর মা খেয়েছিস?’
প্রেমা ধমকের সুরে বলল,’তোমাকে এতো চিন্তা করতে কেউ বলেনি।তুই চুপচাপ খেয়ে নে।’

চলবে,ইনশাআল্লাহ ✨

(আসসালামু আলাইকুম।সবার দেখছি নায়িকা ‘কে’ এই নিয়ে অনেক প্রশ্ন।গল্পের নাম অনুসারে নায়িকা কে হতে পারে?🤔🧐
ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।সবার গঠন মুলক মন্তব্য আশা করছি।হ্যাপি রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here