অরুণিকা পর্ব -৭+৮+৯

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৭||

১৩.
মহল্লার বাচ্চাদের সাথে সারাদিন দৌঁড়ঝাঁপ করেই সময় পার করে অরুণিকা। ইদানীং সে একটু বেশিই দুষ্টু হয়ে গেছে। কারো কথা শুনবে না। নিজের ইচ্ছেমতো ছুটোছুটি করবে। আজও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
তাদের মহল্লার এক চাচা নতুন বাইক কিনে এনেছেন। সেই বাইকটা নিয়েই বাচ্চাদের এতো গবেষণা। তারা এক নতুন খেলা আবিষ্কার করেছে। মহল্লার শুরুর সীমানা থেকে দৌঁড়ে এসে, যে আগে বাইকে উঠে, আবার সেখান থেকে নেমে একদম শেষ মাথায় পৌঁছাবে, সেই হবে বিজয়ী। তবে এই খেলায় অরুণিকায় সবচেয়ে ছোট। বাকীদের বয়স সাত-আট বছর হবে।

এদিকে অরুণিকাকে সুরাইয়ার কাছে রেখে আরাফ, আহনাফ, তাহমিদ ও তূর্য স্কুলে চলে গেছে। ইভান আর ইমন তূর্যের জন্য গিটার কিনতে গেছে।
সুরাইয়া সংসারের কাজে ব্যস্ত। তিনি অরুণিকাকে একটু পর পর এসে দেখছেন। অরুণিকা তো তার বয়সী বড় বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করতেই ব্যস্ত। এরপর শুরু হলো তাদের খেলা। বাইকের উপর একসাথে তিনজন উঠে নেমে পড়লো। এরপরই বাইকটি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ঠিক যেই সময় অরুণিকা বাইকে উঠে নামতে যাবে, তখনই বাইকটাসহ সে নিচে পড়ে গেলো। বাইকের ভারে তার পা আর পিঠের চামড়া একটুখানি ছিঁড়ে গেলো। মুখটা সোজা ইটের রাস্তায় এসে পড়তেই একটা দাঁত তো ভাঙলই সাথে থুতনিও ফেঁটে গেলো। তারপর তার কান্না দেখে পুরো মহল্লায় আতংক ছড়িয়ে পড়লো। সুরাইয়া আর আলেয়া আপা দৌঁড়ে বেরিয়ে এলেন। এরপর নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার জানিয়েছে থুতনিতে সেলাই করতে হবে।

এদিকে ইভান আর ইমন গিটার পছন্দ করে স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। তখনই আরাফদের ছুটি হয়েছিল। তারা স্কুল থেকে সোজা গিটার কিনতে যাবে। কিন্তু তারা বের হওয়ার আগ মুহূর্তেই সালেহ আলী স্কুলে এসে তাদের অরুণিকার ব্যাপারে বললেন। তারাও দেরী না করে হাসপাতালে ছুটে গেলো। গিয়ে দেখলো অরুণিকা নিস্তেজ হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। চোখ দুটি আধো খোলা, আধো বন্ধ। অরুণিকার এমন অবস্থা দেখে আহনাফের রাগ উঠে গেলো। সে একটু কর্কশ কন্ঠে সুরাইয়াকে বলল,
“আপনি তো বলেছিলেন ওকে দেখবেন, তাহলে ওর এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে?”

সালেহ আলী আহনাফকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বললেন,
“দেখো, ও তো ভেতরে কাজ করছিলো। আর অরুণিকা বাইরে খেলছিলো। সে তো বুঝতে পারে নি, এমন কিছু হয়ে যাবে।”

সুরাইয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“বাবুনকে কি আমি একটুখানি ভালোবাসি নাকি? অনেক ভালোবাসি। আমি তো জানতাম না যে ওমন ঘটনা ঘটে যাবে। এই তো একটু আগেই তাকে দেখে গেলাম। কি সুন্দর খেলছিলো তখন! ব্যস চোখের পলক পড়তেই এই দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। আমাকে ক্ষমা করো বাবা। আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। আমার তো ওকে বাইরে বের হতে দেওয়া উচিত ছিলো না।”

এবার আলেয়া আপা বললেন,
“ওকে কি করে চোখে চোখে রাখবো বলো দেখি। কি দুষ্টু হয়েছে! এক মিনিট তো শান্ত হয়ে বসেই থাকে না। সারাদিন ছুটোছুটি করবে। সকালেও খাওয়ার সময় কতো তাল-বাহানা করেছিলো, এরপর একটুখানি রুটি খেয়ে আবার হুমড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়েছে।”

সালেহ আলী বললেন,
“হ্যাঁ, অরুণিকা তোমাদের ভীষণ ভয় পায়। ওদের কথা তো শুনেই না।”

আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বসে আছে। তার চোখ দু’টো ছলছল করছে। ইমনও অরুণিকার পাশে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে গেছেন। এরপর থুতনিতে তুলা দিয়ে গজ ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ওষুধপত্র কেনা হয়েছিলো। আর অপারেশনের জন্য হাসপাতালে অর্ধেক টাকা আগেই দিয়ে দিতে হবে। তাদের হাতে তূর্যের গিটার কেনার টাকাটাই আছে। তাহমিদ টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করে বলল,
“তূর্যের জন্য গিটার…”

তূর্য একটু দূরেই ছিলো। সে জানে আজকে তার বন্ধুরা তাকে সারপ্রাইজ দেবে। আর এটাও বুঝেছে সেটি তার প্রিয় গিটারই হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে অরুণিকার চেয়ে বেশি তার জন্য কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে ইভান আর তাহমিদের সামনে এসে বলল,
“টাকাটা দিয়ে দে। আগে টুইংকেলের চিকিৎসা হবে, তারপর আমার স্বপ্ন।”

ইভান বলল, “তুই জানিস?”

“তোদের আমি ভালো করেই চিনি। আমি জানতাম তোরা আমাকে গিটার কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিস। কিন্তু টুইংকেল সুস্থ না হলে আমার কিছুই ভালো লাগবে না। টাকাটা দিয়ে দে। আমাকে না হয় পরে কিনে দিবি।”

ইভান টাকাটা সালেহ আলীকে দিয়ে দিলো। তিনি টাকাগুলো হাসপাতালে জমা করে দিলেন। এরপর অরুণিকাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। আর আধা ঘন্টা পর থুতনিতে চারটা সেলাই করিয়ে তাকে বের করে আনা হলো। অরুণিকা এখনো ঘুমের মধ্যেই আছে। হাসপাতাল থেকে তাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। তবে অ্যানাসথেসিয়া দেওয়ায় সে এখনো অচেতন অবস্থায় আছে। আরো কয়েক ঘন্টা হাসপাতালে রাখলে আরো বিল আসবে। আর এতোগুলো টাকা একসাথে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই তারা অরুণিকাকে বাসায় নিয়ে এসেছে।

রাত তিনটায় অরুণিকার ঘুমটা পুরোপুরি কাটলো। আর এরপর থেকেই সে ব্যথায় ‘উঁ উঁ’ করে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ শুনে আহনাফ তার পাশে এসে বসলো। নরম কন্ঠে বলল,
“অরু, তোমার খুব ব্যথা করছে?”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নাড়লো। তারপর হাতে যেই জায়গায় ব্যথা লেগেছে তা দেখিয়ে দিতে লাগলো। আহনাফ হাতে ফুঁ দিয়ে বলল,
“এখন ঠিক হয়ে যাবে। আমি ম্যাজিক দিয়েছি।”

ইভান অরুণিকার সামনে একটা বক্স রেখে বলল,
“এখানে কি আছে বলো তো!”

অরুণিকা বালিশ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। ইভান বলল,
“তোমার জন্য এনেছি।”

অরুণিকার চোখে মুখে আনন্দ। সে বক্সটা নিজের কাছে টেনে আনলো। ইমন তাকে বক্স খুলে দিতে সাহায্য করলো। ভেতরে একটা পুতুল বিড়াল ছিলো। অরুণিকা সেটা দেখে খুশি হয়ে বলল,
“এটা আমার ছানা?”

ইমন বলল,
“হ্যাঁ, এখন এটা দিয়েই খেলবে। বাইরে যাবে না।”

অরুণিকা বিড়ালটাকে তার পাশে বসিয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ নড়াচড়া করার পর সে মলিন মুখে বললো,
“ছানা তো হাঁটছে না। ও কি হাঁটতে পারে না?”

তাহমিদ বলল,
“ও একটু পায়ে ব্যথা পেয়েছে তো তাই।”

“কোথায় ব্যথা পেয়েছে?”

তূর্য তাহমিদকে বলল,
“একটা বিড়াল বাচ্চা নিয়ে এলেই তো হতো। এসব পুতুল দিয়ে ও কি করবে?”

তাহমিদ চোখ বড় বড় করে বলল,
“বিড়াল নিয়ে এলে আমার ঘর নষ্ট করবে। এখন পুতুল দিয়েই খেলুক।”

এবার আরাফ বলল,
“তূর্য যদি অরুর জন্য ওর প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে পারে, তুই এতোটুকু করতে পারবি না?”

তাহমিদ কিছুটা দমে গেলো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ওর খেলার সাথী এনে দেবো। কিন্তু বিড়ালের বাচ্চা না। আমি পাখি কিনে এনে দেবো। খাঁচায় থাকলে পরিষ্কার করা সহজ হবে। কিন্তু বিড়ালটা পুরো মহল্লা দৌঁড়ে এরপর আমার বাড়িতে ঢুকবে, এ আমি হতে দেবো না। অপরিচ্ছন্ন কোনো কিছুই আমার পছন্দ না। আরেকটা কথা, পাখি আমিই কিনে এনে দেবো। কিন্তু তার খাঁচা পরিষ্কার করার দায়িত্ব তোদের। আমি এর মধ্যে নেই।”

ইমন বলল,
“তাহমিদের অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কিন্তু এক প্রকার মানসিক রোগ৷ কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম, এই ব্যাধিকে শুচিবায়ু বলে। বিছানায় কেউ বসলে সমস্যা, খালি পায়ে হাঁটলে সমস্যা, কেউ বাসায় এলেই আবার ঘর পরিষ্কার করা, থালা-বাসন আলাদা করা, এসব রোগ।”

“এগুলো রোগ না৷ এগুলো করা উচিত। আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া দরকার। আর আমরা বাসায় কিন্তু এভাবেই চলেছি। এখানে এসে ব্যতিক্রম কেন হবে? আমাদের কি কখনো আলাদা প্লেট ছিলো না। আলাদা গ্লাস ছিলো না?”

আরাফ বলল,
“ভাই ওই পরিবেশ আর এই পরিবেশ আলাদা। ওখানে কাজের লোক আমাদের জামা-কাপড় ধুয়ে দিতো। এখন আমরা সেই কাজ নিজেরা করছি। তোর অতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কিন্তু আমরা সহ্য করছি৷ বাকীরা করবে না। প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে আসে, তুই ওদের সামনে এমন করলে ওরা কি মনে করবে? এখানে সবাই তোকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসে নি। তাই বাইরের মানুষদের সামনে নিজের এসব দুর্বলতাগুলো দেখানো উচিত না।”

তাহমিদ মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“ওরা পাশের ঘর থেকে খালি পায়ে বাসায় আসবে, আর আমি বাসায় ঢুকতে দেবো? রাস্তা কি কেউ স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করেছে?”

ইভান হেসে বলল,
“ভাই তোরা কাকে বোঝাচ্ছিস? ওর মাথায় এসব জীবনেও ঢুকবে না। ও থাকুক না, ওর ডেটল স্যাভলন নিয়ে, আমাদের কি!”

তূর্য এবার অরুণিকার পাশে বসে বলল,
“টুইংকেল, তোমার দাঁতটা দেখি।”

অরুণিকা মুখ উঠিয়ে তার ভাঙা দাঁতটি দেখালো। তূর্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“টুইংকেলের নতুন দাঁত উঠলে আমি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো।”

অরুণিকা তূর্যের কাছে এসে বলল,
“আমি লাড্ডু খাবো। শতু আপু দিয়েছিলো। অনেক মজা।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কবে দিয়েছিলো তোমাকে?”

“অনেকবার। ওদের বাড়িতে অনেক মিষ্টি থাকে। সন্দেশ, ক্ষীর, রসো গোল্লা। এতো মজা! আমাকে এনে দেবে?”

আরাফ বলল, “কালই নিয়ে আসবো।”

এবার তাহমিদ বলল,
“আনতে হবে না। বাইরের খাবার খেলে ও অসুস্থ হয়ে যাবে। এমনিতেই মুখ ফেটে বসে আছে। জানিস, ওসব মিষ্টির দোকানে কতো মাছি ভনভন করে!”

তূর্য বলল,
“আমি যা ভেবেছি তাই। তুই যে এই কথা বলবি, তা আমি আগেই জানতাম।”

“আগে আমি কথা শেষ করি।”

“আচ্ছা, আচ্ছা, বল।”

“আমি এগুলো বাসায় বানাবো। তারপর না হয় খাবি। আর আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে।”

“কি বুদ্ধি!”

“মিষ্টিগুলো বিক্রি করলে অনেক লাভ হবে। দোকানে এসবের অনেক দাম। এরা তো পূজা-অর্চনায় এসব মিষ্টি নিয়ে যায়। এতে ওদেরও লাভ হলো, কম দামে মিষ্টি কিনতে পারলো, আর আমাদেরও লাভ হবে। এই মহল্লায় কিন্তু অনেক হিন্দু পরিবার আছে। শতাব্দীরাও কিন্তু আমাদের থেকে নিয়ে যেতে পারে। এখন এই মুহূর্তে ছোট একটা ব্যবসা করলে, আমরা ভালোভাবে চলতে পারবো। আগামী বছর অরুণিকাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। ও তো এখন অনেক কিছুই বুঝে। শুধু শুধু বাসায় বসে থেকে কি হবে?”

“বুদ্ধিটা ভালো। কিন্তু অনেক সময় দিতে হবে।”

“হ্যাঁ, দেবো। অর্ডার আসলে বানাবো। প্রতিদিন তো আর বানাবো না।”

“এর জন্য একটা ফ্রিজ কেনা দরকার। নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। ফ্রিজ কেনার টাকা কোথায় পাবি? এখন তো শুকনো খাবারগুলো দিয়েই চলে যায়। মাছ-মাংস চাচাদের বাসায় রেখে আসি। কিন্তু মিষ্টি বানিয়ে ওখানে রাখলে থাকবে? ওনার বাচ্চাগুলো যা দুষ্টু! একদিনেই সব শেষ করে দেবে।”

তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আসলেই সংসার চালানো বড় ঝামেলার ব্যাপার। বাবা-মা এতোকিছু কিভাবে সামলিয়েছে?”

পরের দিন তাহমিদ তার কথা রেখেছে। সে একজোড়া টিয়া পাখি নিয়ে এসেছে। অরুণিকা সেই পাখি পেয়ে ভীষণ খুশি। সারাদিন খাঁচার এইপাশ ওইপাশ ছুটোছুটি করে সময় পার করেছে। এদিকে তূর্য আর আহনাফ মিষ্টি বানানোর জন্য দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনলো। ঘরে ঢুকতেই শতাব্দী এসে বলল,
“বাহ! ভালো বাজার-সদাই হয়েছে দেখছি। তা আজ কি জিলাপি হবে নাকি নাড়ু।”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। তূর্য হেসে বলল,
“তুমি যা বলো তাই হবে।”

শতাব্দী হেসে বলল,
“বাসায় কি ঢুকতে পারি? অরুণিকাকে দেখতে এসেছি।”

“অবশ্যই।”

“না, আপনাদের বন্ধুমশাই যদি আবার আমাকে তাড়িয়ে দেয়?”

তূর্য শতাব্দীর পায়ের দিকে তাকালো। শতাব্দী বলল,
“আমি পা ভালোভাবেই ধুয়ে এসেছি। একটুও ময়লা নেই। দেখাবো?”

তূর্য হেসে বলল,
“আমাকে দেখাতে হবে না। ভেতরে চলো।”

শতাব্দীকে দেখে অরুণিকা ছুটে এলো। শতাব্দী অরুণিকাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। তাহমিদের চোখাচোখি হতে শতাব্দী বলল,
“জিলাপি আজ ক’টা প্যাঁচ লাগিয়েছে?”

কথাটি বলেই শতাব্দী তার চুলগুলো পেছন থেকে সামনে নিয়ে এলো। তা দেখে তাহমিদ মুচকি হাসলো। আজ শতাব্দী চুল আঁচড়ে এসেছে। দেখতে বেশ পরিপাটিই লাগছে। এভাবে দেখলেই তো মায়া লাগে। এ কথা তাহমিদ মুখে চেপে রাখলো না। বলল,
“আজ এতো প্যাঁচ লাগায় নি। প্যাঁচবিহীন পরিপাটি জিলাপিই তো দেখছি।”

শতাব্দী হাঁ করে রইলো। তূর্য আর আহনাফ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ নিজের ভারসাম্যহীন কথায় নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। সে আমতা-আমতা করে বলল,
“মানে আজ সন্দেশ বানাবো। জিলাপি না। অরুণিকা খেতে চাইছে।”

শতাব্দী খুশি হয়ে বলল,
“আমার সন্দেশ খুব প্রিয়। আমাকেও দেবে?”

“বেশি বানাতে পারলে সবাইকে দেবো।”

“কম হলে আমাকে দেবে না?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে কেউ খুঁজে খুঁজে নিমন্ত্রণ নেয়?”

“আমি তো অরুণিকার বান্ধবী। আমাকে তো সবার আগেই নিমন্ত্রণ করা উচিত।”

তখনই ইভান, আরাফ আর ইমন বাসায় এলো। শতাব্দীকে দেখে ইভান কিছুটা বিরক্ত হলো। কোনো কারণ ছাড়াই সে শতাব্দীর উপস্থিতি পছন্দ করে না। শতাব্দী ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তারপর যেতে যেতেই ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এ বাড়িতে এলে ষষ্ঠ রকমের মানুষ দেখা যায়। কেউ হাসিখুশি থাকে তো কারো মুখে বিরক্তির ছাপ। কেউ সুন্দর করে কথা বলে, আর কারো মুখ যেন আগুনের গোলা। কেউ অতিথিদের সাথে মিষ্টি ভাষী, আর কেউ কখনো তেঁতো হলে, কখনো হয় বাসি।”

শতাব্দী বের হতেই তূর্য গেইট লাগানোর জন্য বাইরে এসে বলল,
“এর মধ্যে আমি কোনটা?”

“ভেবে দেখো। কারণ এই বাসায় তিনজন সোজা, তিনজন বাঁকা। বাঁকাদের খুঁজে নাও, পেয়ে যাবে সোজা।”

শতাব্দী কথাটি বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার মুখে বিরক্তির ছাপ, নাকি আগুনের গোলা। ও আমাকেই ইঙ্গিত করে বলেছে, তাই না?”

আহনাফ বলল,
“কি বা যায় আসে! মানুষের বলার বলবেই। আমরা যেমন ওভাবেই ভালো আছি। অন্যদের জন্য তো আর নিজেদের পরিবর্তন করতে পারবো না।”

এবার ইমন বলল,
“না, এটা ভুল। আহনাফের কিন্তু একটু পরিবর্তন হয়েছে।”

আহনাফ এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তবে অরুর জন্য পরিবর্তন হতে সমস্যা নেই।”

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৮||

১৪.
তাহমিদ সারারাত বসে সন্দেশ বানিয়েছে। তাকে সাহায্য করেছে ইভান আর ইমন। আগামীকাল স্কুল ছুটি, তাই তারা সারাদিন ঘুমোতে পারবে। কিন্তু অরুণিকা জেগে থাকলে কোনো কাজই ঠিকমতো করা যায় না। সে ঘরে থাকলে পুরো ঘরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে সময় পার করে। আর এমন অবস্থায় মেঝেতে কিছু রাখলেই তা সে উলটে দেবে। তাই অরুণিকা উঠার আগেই তারা বেশিরভাগ কাজ করে ফেললো।
সকালে উঠেই আরাফ তাহমিদকে বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি বানিয়ে ফেলেছিস?”

ইমন দাঁত কেলিয়ে বলল,
“আমার আর ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে সব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে।”

“ক’টা হয়েছে দেখি!”

আরাফ বাটির ঢাকনা উলটে দেখলো পঞ্চাশের বেশি সন্দেশ হয়েছে। আহনাফ তা দেখে বলল,
“প্রতিবেশিদের দিবি নাকি!”

ইভান বলল,
“অরুণিকা ক’টা খায় আগে দেখি। এসব তো ওর জন্যই।”

তাহমিদ বলল,
“ফ্রিজে না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে হয়তো। আমি আসলে জানিনা নষ্ট হবে কিনা, কিন্তু যদি হয়ে যায়? এই প্রথম বানিয়েছি তো। তবে খারাপ হয় নি। আর দোকানের মতো ওতো ভালোও হয় নি। প্রতিবেশীদের পরে দেবো ভাবছি। সালেহ চাচার ওখানে এক বাটি রেখে আসবো। উনাদেরও কিছু দিয়ে আসবো। যদি খায় খাবে।”

হঠাৎ তূর্য বলে উঠলো,
“শতাব্দীদের দিবি না? ও কতো করে বলে গেলো।”

ইভান তূর্যের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। ইমন বলল,
“তূর্য, তোকে কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না।”

“আমি আবার কি করলাম?”

“শতাব্দীকে নিয়ে একটু বেশিই কথা বলিস। কি চলছে তোদের মধ্যে?”

তাহমিদ বুকে হাত গুঁজে তূর্যের দিকে তাকালো। বাকীরাও তূর্যের উত্তর শুনার আগ্রহে তার দিকেই তাকিয়ে রইলো। তূর্য সবার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“শতাব্দী আমাদের প্রতিবেশী।”

ইমন বলল,
“প্রতিবেশী তো আরো আছে!”

“ও মাঝে মাঝে এদিকে আসে। টুইংকেলের সাথেও খেলে।”

“এই মহল্লায় অনেকেই অরুণিকার সাথে খেলে।”

তূর্য মুখ বাঁকিয়ে বলল, “যা তো। দিতে হবে না।”

ইমন বলল, “প্রেম-টেম নয়তো!”

তূর্য দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে হাত গুঁজে বলল,
“আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি প্রেমে পড়বো?”

আরাফ ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ইমন, বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস কেন? ওর প্রেম করার বয়স হয়েছে নাকি? প্রেম করলে এই বাড়িতে জায়গা হবে না। ও প্রেম করে একটা পর একটা ঝামেলা করবে, এসব আমাদেরই সামাল দিতে হবে। ভুলে যাবি না আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য প্রেম করে সময় নষ্ট করা নয়। কিছু একটা করে, আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।”

ইমন মলিন মুখে আরাফের দিকে তাকালো। ইভান ইমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আরাফ, ও তো ফাজলামো করছিলো। এসব বারবার মনে করিয়ে দিস না। আমরা কিন্তু সবাই বাবা-মা হারিয়েছি, পরিবার হারিয়েছি। এসব মনে পড়লে দুর্বল হয়ে যাই।”

আহনাফ বলল,
“আরাফ এমনি বলেছে। কিছু মনে করিস না।”

তূর্য সবার গম্ভীরমুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“বিষয় ছিল শতাব্দী আর তূর্যের প্রেম হচ্ছে কি না তা। আর বিষয় চলে গেছে গম্ভীর দিকে।”

এবার তাহমিদ বলল,
“তোদের মধ্যে সত্যিই কিছু চলছে কিনা তাই বল!”

“আরেহ না, কিভাবে সম্ভব? প্রথমত ও অন্য ধর্মের। ওর বাবা-মা কখনোই এটা মানবে না। দ্বিতীয়ত আমি রকস্টার হবো। সবাই আমাকে চিনবে ‘রিকি দা স্টার’ নামে। আমি গিটার হাতে স্টেজে উঠে গাইবো, ‘আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই।’ এমন গান তখন আসবে যখন আমার মধ্যে একাকীত্ব থাকবে, শূণ্যতা থাকবে। আর যদি প্রেম করে বসে থাকি, তখন আমার এই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না। সিরিয়াস প্রেমিকার পেছনে সময় নষ্ট করার মতো কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

এরপর তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তবে টুইংকেল থাকলে…”

আরাফ আর আহনাফ তূর্যের কথা আটকে দিয়ে একসাথে বলে উঠলো, “অসম্ভব!”

আরাফ বলল,
“অরু অনেক ছোট। এসব উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”

“ছোট হয়েছে তো কি হয়েছে। সারাজীবন ছোট থাকবে নাকি!”

“না, আমি তোর হাতে অরুকে কখনোই দেবো না।”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সমস্যা নেই। টুইংকেল আমাকেই বেশি পছন্দ করে। ওকে আমি পটিয়ে ফেলবো।”

ইভান একটু গম্ভীরমুখে বলল,
“তূর্য তুই ফাজলামো করলে ঠিক আছে। কিন্তু সত্যিই যদি তোর এমন পরিকল্পনা থাকে, তাহলে এটা বাদ দে।”

“কেন তোর কি সমস্যা?”

“ও অনেক ছোট। ওর এসব বোঝার বয়স হয় নি। আর জুবাইয়ের আংকেল কিন্তু আমাদের হাতেই ওর দায়িত্ব দিয়েছেন।”

তূর্য হাসতে হাসতে অরুণিকার পাশে বসে পড়ল। তখনই অরুণিকার ঘুম ভাঙলো। তূর্য মিষ্টি হেসে বলল,
“টুইংকেল তাড়াতাড়ি উঠো। দেখো, সবাই তোমার রকস্টারের সাথে ঝগড়া করছে। তুমি ওদের বকে দাও।”

অরুণিকা আরাফের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলো। আরাফ এগিয়ে আসতেই সে কোলে উঠে মাথা হেলিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আরাফ তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরু আমাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। আর আমি ওর জীবনে যেমন সিদ্ধান্ত দেবো, তা-ই হবে।”

এবার ইমন বলল,
“যদি বড় হলে ও নিজেই একটা পছন্দ করে ফেলে?”

আরাফ বলল,
“আশা করি এমন সুযোগ ও পাবে না। তবে যদি হয়েও যায়, তাহলে অবশ্যই আমরা চিন্তাভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত দেবো।”

তূর্য মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বাহ! তারপরও আমাকে দিবি না। থাক সমস্যা নেই। আমি আমার গিটারকেই বিয়ে করে নেবো।”

১৫.

লোহার গ্রিলে শব্দ হতেই তাহমিদ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শতাব্দী মুখে হাসি টেনে বলল,
“তা মিষ্টি মশাই কি আজ সন্দেশ বানিয়েছে?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি সন্দেশ খেতে এসেছো?”

শতাব্দী হেসে বলল,
“সকালে উঠে একটু মিষ্টিমুখ না করলে আমার হয় না। ভাবছি তোমার হাতে বানানো মিষ্টি খেয়েই আজ দিনটা শুরু করি।”

তাহমিদ ভেতরে গিয়ে একটা সন্দেশ নিয়ে এলো। তারপর গ্রিলের ফাঁক দিয়ে শতাব্দীর হাতে দিয়ে বলল,
“অরুণিকা এখনো খায় নি।”

“থাক, আমার একটাতেই চলবে।”

শতাব্দী মুখে দিয়েই তাহমিদের দিকে তাকালো। তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। শতাব্দী বলল,
“আমি যদি তোমাদের অরুণিকা হতে পারতাম! ভীষণ স্বাদ হয়েছে বলতে হবে। তুমি কি আজ প্রথম বানিয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“বাহ, তুমি তো দারুণ। তোমার নাম এখন থেকে মিষ্টি মশাই রাখলাম। এতো মিষ্টি তোমার হাতে, মুখেও সেই মিষ্টিটা রাখলে ভালোই হতো।”

তাহমিদ চোখ ছোট করে বলল,
“প্রশংসা করছো নাকি!”

“ওই যা বলো না। প্রশংসা করলেই তো কম হবে। তবে আমি প্রশংসা নয়, তোমাকেই ব্যাখ্যা করছি। তুমি আসলেই খুব ভালো রন্ধনশিল্পী। আমার তো অরুণিকাকে দেখেই জ্বলছে। কি সৌভাগ্য তার!”

আহনাফ পেছন থেকে তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শতাব্দীকে দেখে বলল,
“তো তুমি সকালে উঠেই সন্দেশ খেতে চলে এসেছো!”

শতাব্দী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বাইরের কেউ যদি খাবারের প্রশংসা না করে, তাহলে রন্ধনশিল্পের মান বাড়ে না। তাই খেয়ে তোমার বন্ধুর আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছি। তোমার তো আমাকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। আচ্ছা এখন চলি। বিকেলে আবার আসবো কিন্তু।”

এরপর সে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার জন্য আরো কয়েকটা রেখো দেবে কিন্তু। আমার সন্দেশ ভীষণ ভালো লাগে। তবে এখন আসি, মিষ্টি মশাই।”

তাহমিদ মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। আহনাফ তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই, রন্ধনশিল্প, বেশ ভারী ভারী শব্দ ব্যবহার হচ্ছে দেখছি।”

তাহমিদ হেসে বলল,
“মেয়েটা যেমনই হোক, তার মনটা আসলেই ভালো। অনেক মিশুক মেয়ে। ওর মধ্যে জড়তা নেই। যেটা ভালো লাগে তাই বলে। মিথ্যে বলে না।”

অরুণিকার পুরোপুরি ঘুম ভেঙেছে দুপুর বারোটায়। ঘুম থেকে উঠেই সে নিজে গিয়েই প্রাকৃতিক কাজ সেরে এলো। এখন সে নিজেই এই কাজটা করতে পারে। তবে আলেয়া আপা এখনো তাকে গোসল করিয়ে দেন। আজ তার চুলে শ্যাম্পু করাতে হবে। এ হলো এক গুরুতর কাজ। শ্যাম্পু করতে গেলেই অরুণিকার কান্না শুরু। তাকে চেপে ধরে বসিয়ে রাখতে গিয়ে কতোবার যে আলেয়া আপা ওয়াশরুমেই পিছলে পড়েছেন তার হিসেব নেই। তবে তিনি কখনো অরুণিকার গায়ে হাত তুলেন নি। তিনি প্রচন্ড ধৈর্যশীল নারী। এদিকে ইভান পানি গরম করে রেখেছে। আলেয়া আপা এসেই তাড়া দিয়ে বললেন,
“আজ আমার একটা কাজ আছে। তাই একটু তাড়া দিচ্ছি।”

ইভান বলল, “গরম পানি রেখেছি।”

আলেয়া আপা অরুণিকার হাত ধরতেই সে হাত ফসকে বেরিয়ে এলো। তারপর আরাফের পেছনে লুকিয়ে গেলো। আলেয়া আপা বললেন,
“এ-ই টুকুন মেয়েটার এতো শক্তি! হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো?”

অরুণিকা আরাফের পা দু’টো ঝাপটে ধরে রেখেছে। সে কোনোভাবেই চুলে শ্যাম্পু দেবে না। তাহমিদ চেঁচিয়ে বলল,
“চুল পরিষ্কার না করলে একদম সব কেঁটে দেবো। তখন দেখতে পেত্নীর মতো লাগবে!”

অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল,
“তুমি না লক্ষী একটা মেয়ে। যাও, চুল ধুয়ে এসো।”

অরুণিকা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল,
“আমার চোখ ব্যথা করে। আমাকে তিতুন করিয়ে দিতো, তখন একদম ব্যথা পাই নি।”

অরুণিকা হঠাৎ তিতুনের কথা বলায় আলেয়া আপা বললেন, “তিতুন কে?”

আহনাফ বলল,
“আমাদের বাসায় কাজ করতো।”

তখনই ইভান একটা বালতি ঘরে এনে বলল,
“আরাফ তুই করিয়ে দে। মাথাটা তুই ধুয়ে দে। গোসল খালা করিয়ে দেবেন।”

এরপর আরাফ করিয়ে দেবে শুনে অরুণিকা চুপচাপ বিছানায় উঠে বসলো। আরাফ অরুণিকাকে শুইয়ে দিয়ে তার মাথায় পানি ঢেলে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে শ্যাম্পু মাখতে লাগলো। অরুণিকা চোখে হাত দিয়ে শুইয়ে আছে। আলেয়া আপা তা দেখে বললেন,
“এখন দেখছি একদম চুপ করে আছে। আমি করিয়ে দিলে পুরো গোসলখানা দৌঁড়াতে থাকে।”

আরাফ এরপর মাথায় পানি ঢেলে দিয়ে শ্যাম্পুগুলো ধুয়ে দিলো। ইভান অরুণিকার মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে দিয়ে বলল,
“খালা, এভাবেই চুল ধুইয়ে দিতে হয়। ও তো এখনো ছোট। চোখে শ্যাম্পু চলে যায়, তাই হয়তো ওমন করে।”

আলেয়া আপা বললেন,
“আমি কি এতোকিছু জানি, বাবা? ডুমুর, খোকা, বাঁধন ওদেরকেও আমি মাথা ধুইয়ে দেই। কখনো লাফালাফি করে নি।”

এরপর আলেয়া আপা অরুণিকাকে গোসল করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অরুণিকা জামা পরে চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। তার পাশে একটা প্লাস্টিকের উপর টিয়া পাখির খাঁচাটা রাখা আছে। তাহমিদ ভাত মেখে অরুণিকার সামনে বসে পড়লো।

অরুণিকা বলল,
“আমি ভাত খাবো না। সন্দেশ খাবো।”

“আগে ভাত খেয়ে নাও। তোমাকে ওষুধ খেতে হবে। খালি পেটে মিষ্টি খাওয়া ভালো না।”

অরুণিকা মুখ ছোট করে বলল,
“আমি চকোলেট খাবো।”

“আচ্ছা, আগে ভাতটা খেয়ে নাও।”

তারপর সে নিজের জামাটা দেখিয়ে বলল,
“আমি নতুন জামা কিনবো। এটা পরবো না। এটা ভালো লাগে না। আমার সাদা জামাটা বাসা থেকে নিয়ে আসো নি কেন?”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে এই মেয়ে। খেতে বলছে, খাও।”

তাহমিদ জোর করেই মুখে এক দলা ভাত ঢুকিয়ে দিলো। সেটা খেতেই তার অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলো। অরুণিকা মুখে ভাত নিয়েই বলল,
“আমার সাদা জামাটা নিয়ে আসবে?”

আহনাফ তার পাশে বসে বলল,
“সাদা জামা কোথায় দেখেছো!”

“আরাফের ফোনে ছবি আছে। ওখানে দেখেছি।”

অরুণিকা মাঝে মাঝেই আরাফের ফোনে থাকা ছবিগুলো দেখতে থাকে। গতকালই আরাফ ছবিগুলো পরিষ্কার করিয়ে এনে এলবামে রেখে দিয়েছে। এখন থেকে এলবামেই দেখবে। আরাফ এলবামটি বের করে অরুণিকার সামনে রাখলো। অরুণিকা ছবি দেখতে দেখতে বাকী খাবার শেষ করে ফেললো। খাওয়া শেষ হওয়ার পর অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“আমার জন্য সাদা জামা এনে দেবে? আমি এটা পরবো না।”

আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, এনে দেবো। তুমিসহ যাবে, ঠিক আছে?”

অরুণিকা হেসে বলল,
“টুন আর ঝুনকেও নিয়ে যাবো, ঠিক আছে?”

টুন আর ঝুন হলো অরুণিকার টিয়া পাখি। এই নাম দু’টো তূর্যই রেখেছে। এরপর থেকেই অরুণিকা তাদের টুন-ঝুন বলেই ডাকে।

বিকেলে অরুণিকার আবদার রাখতে আরাফ, আহনাফ আর ইমন অরুণিকাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। টুন-ঝুনকে আনতে পারে নি তাই অরুণিকার মন খারাপ। সে বলল,
“আমি তোমাদের সাথে রাগ করেছি। টুন-ঝুনকে আমি বলেছি তাদের ঘুর‍তে নিয়ে যাবো। কিন্তু তোমরা খুব পঁচা। ওদের নাও নি।”

আহনাফ বলল,
“ওরা এতো ছোট বের হলেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি কি চাও ওরা অসুস্থ হয়ে যাক?”

“আচ্ছা, ওরা আমার মতো বড় হলে বের হতে পারবে?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই পারবে।”

এরপর তারা একটার পর একটা দোকানে গিয়ে অরুণিকার জন্য জামা পছন্দ করতে লাগলো। কিন্তু এই মেয়ের তো কিছুই পছন্দ হয় না। সাদা জামা পেলেও তার সাইজের পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ অনেক রাজী করিয়ে একটার পরিবর্তে চারটা জামা কিনে নিলো। অরুণিকা জামাগুলো পেয়ে ভীষণ খুশি। বাসায় এসে বাকীদের বের করে দেখাতে লাগলো। তাকে হাসতে দেখেই ছ’জনের মন হালকা হলো। এরপর তূর্য একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা তোমার জন্য এনেছি।”

অরুণিকা প্যাকেট খুলে দেখলো অনেকগুলো চকোলেট আর একটা ছোট মেকাপ বক্স। সেটা খুলে বলল,
“এটা দিয়ে কি খেলে?”

তূর্য হেসে বলল,
“না মুখে লাগাবে। তারপর তোমাকে দেখতে টুইংকেল প্রিন্সেস লাগবে।”

তাহমিদ মেকাপ বক্সটা নিয়ে বলল,
“ছোটদের মেকাপ করা উচিত না। ও এমনিতেই সুন্দর। তারপর দেখা যাবে এগুলো লাগিয়ে ওর সুন্দর মুখটাই নষ্ট হয়ে গেছে।”

“ভাই, আমি টুইংকেলের ক্ষতি করবো না। এসব তো মাঝে মাঝেই লাগাবে। প্রতিদিন তো আর লাগাবে না। যখন কোনো অনুষ্ঠান হবে তখনও লাগাতে পারে। আগামী সপ্তাহে পাশের বাড়ির সিনথিয়া আপুর বিয়ে। টুইংকেল এভাবে যাবে নাকি? একটু সাজবে, তারপরই তো ভালো লাগবে দেখতে। আর আমি টাকা জমিয়ে ভালো দোকান থেকেই এটা কিনে এনেছি। আর শতাব্দী আমাকে বলেছে সেই দোকানের জিনিসপত্র ভালো।”

অরুণিকাকে নিয়ে একেক জনের একেক চিন্তা, এক এক শখ। তবে এসবের কিছুই এখনো অরুণিকা বুঝে না। যেদিন বুঝবে, সেদিন মেনে নেবে, সে অনাথ হয়েও হয় নি। কারণ সে সব হারিয়েও অনেক কিছুই পেয়েছে। এর চেয়েও বেশি কিছু পাওয়া গেলে সে নিশ্চিত সৌভাগ্যবতী।

(💥কাল রাতে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি কোনো কারণবশত গল্পটা সম্পূর্ণ করতে পারে নি। তাই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।)

চলবে-#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৯||

১৬.
অরুণিকা আর শতাব্দী পাশাপাশি বসে তাহমিদের বানানো সন্দেশ খেয়ে যাচ্ছে। আর তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহমিদ, আহনাফ, আরাফ ও ইমন। অরুণিকা শতাব্দীর দেখাদেখি হাত চেটেপুটে খাচ্ছে। তা দেখে তূর্য মুখ চেপে হাসছে আর ইভানের চোখে মুখে বিরক্তি। শতাব্দী এই নিয়ে মোট আটটা সন্দেশ খেয়েছে। ইভান এবার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি কি আজ বাড়িসুদ্ধ মানুষের খাবার খেয়ে ফেলবে নাকি! এভাবে কেউ খায়?”

শতাব্দী আরেকটা সন্দেশ মুখে নিয়ে বলল,
“আমি সন্দেশ এতো ভালোবাসি, এতো ভালোবাসি যে এখনি পুরো বাজার সামনে এনে দিলেও আপত্তি নেই।”

আহনাফ অরুণিকার পাশে এসে বসলো। তারপর তার হাতটা ধরে বলল,
“তুমি আর খেও না।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল,
“অনেক মজা। আমি আরো খাবো।”

“এতো মিষ্টি খেলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

আহনাফ সন্দেশের বাটিটি সরিয়ে টেবিলের উপর তুলে রাখলো। অরুণিকা এবার টেবিলের কাছে গিয়ে পা উঁচিয়ে বাটিটি খুঁজতে লাগলো। অনেক দূরে সরিয়ে রাখায় সে আহনাফের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। আহনাফ চোখ গরম করে তাকানোর সাথে সাথে সে মুখ ফুলিয়ে শতাব্দীর পাশে এসে দাঁড়ালো। শতাব্দী হেসে বলল,
“আমি ভাগ দিচ্ছি।”

শতাব্দী তার ভাগের সন্দেশ অরুণিকাকে খাইয়ে দিতে যাবে তখনই ইভান সেই সন্দেশ নিয়ে বলল,
“তুমি বরং বাকি সন্দেশ নিজের বাড়ি গিয়ে খাও। এখন আমাদের বাসা বের হও।”

শতাব্দী তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছ, তোমার বন্ধু আমাকে জোর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।”

আহনাফ বিরক্তির সুরে বলল,
“তো তুমি কি এখানেই থেকে যাবে নাকি!”

শতাব্দী মিষ্টি হেসে বলল,
“আমার ছোট সখী এখানে, আমার কি এখন ঘরে মন বসে?”

অরুণিকা শতাব্দীকে ঝাপটে ধরে বলল,
“শতু আপু, তুমি যেও না। আমার সাথে এখানে থাকো।”

অরুণিকা তার বিছানার কাছে গিয়ে বলল,
“এখানে আমি থাকি, আমার পাশে তুমি থাকবে।”

শতাব্দী হেসে বলল,
“সখী, তুমি বরং আমার বাড়ি চলো। আমরা একসাথে ঘুমাবো।”

আহনাফ এবার ক্ষুব্ধ চোখে শতাব্দীর দিকে তাকালো। আহনাফের দিকে চোখ পড়তেই শতাব্দী হেসে বলল,
“জানি জানি থাকতে দেবে না। এমনিতেই বললাম। তবে আজ চলি। আবার আসবো।”

শতাব্দী বের হতেই অরুণিকা তার পিছু পিছু যেতে লাগলো, তখনই ইমন খপ করে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো বাবু! যা মিষ্টি খেয়েছ! সারারাত তো ঘুমাতে পারবে না। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”

অরুণিকা ইমনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি ঘুমাবো না।”

শতাব্দী বের হতেই গেইটে তালা লাগিয়ে আহনাফ দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর তাহমিদকে বলল,
“এই মেয়ে এত্তোগুলো সন্দেশ খেলো!”

তাহমিদ বিষ্ময়কর কন্ঠে বলল,
“এতো মজাও হয় নি, তবুও খেয়ে যাচ্ছিলো। অদ্ভুত মেয়েটা!”

তূর্য মুচকি হেসে বললো,
“অদ্ভুত মেয়েগুলোকে আমার বেশিই ভালো লাগে।”

তূর্যের কথায় তাহমিদ আর আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো।

এদিকে রাত ১টায় অরুণিকার কান্নার শব্দে ইভানের ঘুম ভেঙে গেলো। বাকীরা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইভান বিছানা ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালালো। দেখলো অরুণিকা পুরো বিছানায় বমি করে দিয়েছে। তার মুখটাও শুকিয়ে গেছে। ইভান তাড়াতাড়ি মশারী উঠিয়ে বাকীদের ডাকতে লাগলো। অরুণিকার জামা, বিছানা, বালিশ সব নোংরা হয়ে গেছে। তাহমিদ অপরিচ্ছন্নতা একদমই সহ্য করতে পারে না, কিন্তু অরুণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মাথাটাই পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এর আগে কখনো বাচ্চাদের বমি পরিষ্কার করার মতো দায়িত্ব তাদের কাঁধে আসে নি, এখন এই কাজটা তাদের জন্য মারাত্মক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরাফ কাছে এসে অরুণিকাকে তুলতে যাবে সে আবার গলগল করে বমি করে দিলো। ইভান ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“এতো রাতে চাচা-চাচীকে ডাকলে ভালো দেখাবে?”

আরাফ বলল,
“আমি তো দেখছিই। ওদের কেন ডাকবো?”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“সব ওই বদমাশ মেয়েটার জন্য হয়েছে। নিজে তো এত্তোগুলো সন্দেশ খেয়েছে, অরুকেও খাইয়েছে।”

তাহমিদ চুলায় গরম পানি বসিয়ে দিয়েছে। আরাফ অরুণিকার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে ইভান আর তূর্য বিছানাপত্র উঠাতে লাগলো। আহনাফ পানিতে লেবু আর লবণ মিশিয়ে অরুণিকার কাছে এসে বসলো। অরুণিকার চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। সে মাথা ফেলে দিতেই আহনাফ ভীত কন্ঠে বললো,
“ভাই, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি?”

ইমন বলল,
“আরেহ বদহজমই হয়েছে। চিন্তা করিস না। আর এতো রাতে ওকে নিয়ে বের হওয়াটাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রাস্তায় ডাকাত পড়লে?”

আহনাফ অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর লেবু পানি খাইয়ে দিচ্ছে। পানি গরম হলে আরাফ নিজেই অরুণিকাকে পরিষ্কার করিয়ে দিলো। তারপর তাকে কোলে নিয়ে পুরো ঘর হেঁটে বাকি রাত পার করলো। রাতে আর কারোই ঘুম হয় নি। অল্প কিছু পানিই ড্রামে অবশিষ্ট ছিলো তা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করা মোটেও সম্ভব না। তাই তাহমিদ না চাইতেও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো।

সকালে উঠেই আরাফ আর ইভান অরুণিকাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। সেখানেই অরুণিকাকে স্যালাইন দেওয়া হলো। যদিও এটা খুবই সাধারণ অসুস্থতা। তবুও অরুণিকার প্রতি ছ’জনের চিন্তা দেখেই সালেহ আলী দেরী করেন নি। এরপর ডাক্তার জানিয়েছেন, ফুড পয়জনিং হয়েছে। তারপর প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিয়েছেন। মোট তিনদিন পর অরুণিকা একটু শক্ত হয়েছে। আবার আগের মতো কথা বলছে, হাসছে, খেলছে। এতোদিন শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে কার্টুন দেখেই সময় পার করেছিল।

এদিকে অরুণিকা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই ইভান শতাব্দীকে ঘরে ঢুকতে দেয় নি৷ শতাব্দীও মলিন মুখে নিজের ঘরে বসে ছিল। সে জানতো না যে তার ছোট সখী অসুস্থ হয়ে যাবে। সে মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে অনেকবার বলল অরুণিকাকে দেখবে, কিন্তু ইভান কিছুতেই অনুমতি দেয় নি। উল্টো শতাব্দীর মাকেই বলে দিয়েছে, যাতে শতাব্দীকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। নয়তো হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে। এসব শুনে শতাব্দীর মা মেয়ের উপরই রেগে গেলেন। একটা অপরিচিত ছেলে এসে যদি এভাবে তার মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ আর শাসনের মধ্যে রাখতে বলে, তার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে মাস্টারমশাই ইভানের পক্ষ নিয়েই স্ত্রীকে বললেন,
“ওদের বোন ওরা চিন্তা করবেই। আজ শতাব্দী যদি অতিরিক্ত সন্দেশ খেয়ে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলতো, তুমি কিন্তু তাহমিদের উপরই দোষটা চাপিয়ে দিতে। ও যে মিষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারে না, তা আর মাথায় আসতো না।”

এরপর অরুণিকা সুস্থ হওয়ার পরও শতাব্দী আর সে বাড়ি যায় নি। বাইরেই এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। তূর্য ছাড়া আর কারো সাথেই সে কথা বলে নি। তবে প্রয়োজনে আরাফের সাথে কথা বলেছিল।

১৭.

দুই মাস পর-
মহল্লায় সাজ সাজ রব। কারণ এই মহল্লায় অনেক বছর পর বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। মহল্লার মেয়ে সিনথিয়ার বিয়ের তারিখ দু’মাস পিছিয়েছিল। এখন সেই বিয়ের তারিখ সন্নিকটে এসেছে। বিয়ের যে কতো আয়োজন থাকে, তা সিনথিয়ার বিয়ে না দেখলে জানা যেতো না। এদিকে অরুণিকাও বিয়ে উপলক্ষে নতুন বান্ধবী জুটিয়েছে। সিনথিয়ার অনেক কাজিনই অরুণিকার সমবয়সী, তাদের সাথেই ছুটোছুটি করে তার সময় পার হচ্ছে। অন্যদিকে সিনথিয়ার এনগেজমেন্টের দিনটাও খুব ধুমধাম করে হয়েছিল। আর সেদিনই তূর্য অনেক মাস পর খোলা গলায় অনেকের সামনে গান গাওয়ার সুযোগটাও পেয়ে যায়। আর তার কন্ঠে গান শুনে পুরো মহল্লার মানুষজন মুগ্ধ হয়ে পড়লো। সেই সাথে তূর্যের স্বপ্নটাও চমৎকার হাতের স্পর্শ পেলো। সিনথিয়ার খালা তূর্যকে আলাদাভাবে এসে সব অনুষ্ঠানে গান করার নিমন্ত্রণ দিয়েছেন, সাথে পারিশ্রমিকও ধার্য করলেন। এমন প্রস্তাব শুনে তূর্যসহ তার বাকী পাঁচ বন্ধুও অবাক। সিনথিয়ার খালা নিজেও একজন সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। কিন্তু ভোকাল কর্ডে সমস্যা হওয়ায় তাকে গান ছাড়তে হয়েছিল। এরপর হলুদ অনুষ্ঠানের দিন তিনি নিজের হারমোনিয়ামটি তূর্যকে সবার সামনে উপহার দিলেন। আর তূর্যকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার গানগুলো ছাড়ার উপদেশ দিলেন। তাছাড়া তিনি তূর্যকে গান শেখানোর প্রশিক্ষণেও ভর্তি করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে দেখালেন। তিনি আশা দিলেন, সিনথিয়ার বিয়ের পরই তিনি এই দায়িত্ব নেবেন।

আজ সিনথিয়ার বিয়ে। সকাল থেকেই অরুণিকা শতাব্দীর বাড়িতে বসে আছে৷ নিজের জামা-কাপড় নিয়ে সেই যে তৈরী হতে গেছে, এখনো বাসায় আসে নি। শতাব্দী খুব যত্নের সাথে অরুণিকার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিলো। তাকে লাল লেহেঙ্গা পরিয়ে হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলো। অরুণিকার চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়েছে। শতাব্দী চুলগুলো পুরো পিঠে ছড়িয়ে দিলো। তবে এখনো অরুণিকার কান ছিদ্র করানো হয় নি। তাই সে পাথরের টিপ অরুণিকার কানে লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন মনে হচ্ছে টপ পরেছো। বোঝায় যাচ্ছে না এগুলো কপালে লাগানোর টিপ।”

শতাব্দী এবার অরুণিকার কপালে একটা কালো টিপ বসিয়ে তাকে হালকা সাজিয়ে দিলো। এবার বলল,
“ছোট সখী, এখন দেখো তোমাকে কিন্তু পরীর মতো লাগছে।”

অরুণিকা আয়নায় তাকিয়ে হাতের চুড়িগুলো নাড়ালো। লেহেঙ্গা ছড়িয়ে দিয়ে এপাশ-ওপাশ হয়ে নিজেকে দেখলো। তারপর শতাব্দীর কাছে এসে বলল,
“আমি চলে যাবো এখন? আমাকে সাজিয়ে দিয়েছ?”

“হ্যাঁ, এটাকেই তো সাজগোজ করা বলে। এরচেয়ে বেশি সাজলে মনে হবে আজ তোমার বিয়ে।”

“আমার বিয়ে কখন হবে?”

শতাব্দী হেসে বলল, “যখন তুমি বড় হবে।”

“তোমার মতো?”

“আমার চেয়েও বড় হতে হবে।”

“তোমার বিয়ে কখন হবে?”

“যখন আমি সিনথিয়া দিদির মতো বড় হবে তখন।”

“তুমি কখন বড় হবে?”

শতাব্দী মুচকি হেসে বলল,
“যেদিন তুমি আমার সমান হবে, তখন আমি অনেক বড় হবো। তারপর আমার বিয়ে হবে তোমার দাদার সাথে।”

অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আরাফ বলেছে দাদা অনেক দূরে চলে গেছে। আর আসবে না।”

শতাব্দী মলিন মুখে বলল,
“আরেহ তোমার দাদাভাইয়ের কথা বলছি না। আমার বরের কথা বলছি। আমার বর তো তোমার দুলাভাই হবে, তাই না? দুলাভাইকে আমরা দাদা বলি।”

“দুলাভাই কে?”

শতাব্দী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখন বাড়ি গিয়ে ভাইয়াদের জিজ্ঞেস করে এসো, তোমার দুলাভাই কে হবে! আমি এখন একটু তৈরী হয়ে নেই। যাও সখী, এখন আমাকে বিরক্ত করো না।”

অরুণিকা দৌঁড়ে ঘরে চলে এলো। লোহার দরজা অরুণিকার জন্য খোলা রাখা ছিল। সে ঘরে ঢুকতেই আরাফ তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে এটা?”

আরাফের কথায় বাকিরাও অরুণিকার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। আরাফ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“অরু তোমাকে দেখতে তো একদম রাজকন্যার মতো লাগছে।”

অরুণিকা আরাফকে বলল, “আমার দুলাভাই কে হবে?”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এটা আবার কেমন প্রশ্ন!”

“শতু আপু বলেছে আমার দুলাভাই কে তোমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে। তোমরা জানো দুলাভাই কে? শতু আপুর যখন বিয়ে হবে তখন আমি আপুর মতো বড় হয়ে যাবো। এরপর আমারও বিয়ে হবে।”

আহনাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে বলল,
“তোমার মাথায় এসব উদ্ভট কথাগুলো কে ঢুকিয়ে দিয়েছে?”

“উদ্ভট কথা কি!”

তূর্য অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাই, টুইংকেল তোর এই প্রশ্ন বুঝবে না। আমিই ওর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেই।”

তারপর অরুণিকাকে বলল,
“ইভান হচ্ছে তোমার দুলাভাই, বুঝেছ। আর তোমার বিয়েটা তো আমার সাথেই হবে।”

কথাটি শুনে আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালো। আর ইভান বিরক্তির সুরে বলল,
“আমার নাম কেন নিয়েছিস? সারাদিন তো তুই-ই ওই মেয়ের পেছনে পড়ে থাকিস।”

তূর্য হেসে বলল,
“আরেহ, মজা করছি।”

এরপর তূর্য আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আর আহনাফ, তুই এভাবে আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি তোর বন্ধু। আমার বংশও খারাপ না। শুধু একটু পড়াশোনাটাই বিরক্ত লাগে, এছাড়া আমার কি কোনো দোষ আছে? সৎ পাত্র হওয়ার সব গুণ আমার মধ্যে আছে।”

আহনাফ তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমরা অরুর বিয়েই দেবো না। আর শুন, দ্বিতীয়বার ওকে নিয়ে এভাবে বলবি না। এখন ও এসব বুঝতে শুরু করেছে। তারপর দেখা যাবে, সত্যিই তোকে বর ভেবে বসে থাকবে।”

“তো সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা আছে। এসব মাথায় ঢুকলে ওর ভবিষ্যৎ শেষ।”

অরুণিকা একবার আহনাফের দিকে তাকায়, আরেকবার তূর্যের দিকে। একটু পর সে আহনাফের চুল টেনে ধরে বলল,
“তুমি রকস্টারকে বকছো কেন? আমি তোমার সাথে কথা বলবো না।”

আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। আরাফ অরুণিকার হাতের মুঠো থেকে চুল ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“বড়দের চুল টেনে ধরা ভালো না। লক্ষী বাচ্চারা এমন করে না। তুমি না ভালো মেয়ে?”

“তাহলে ও রকস্টারকে বকছে কেন?”

আহনাফ অরুণিকাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তূর্য অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আহনাফের পিছু পিছু গেলো।

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল,
“আমার পিছু পিছু আসছিস কেন?”

“ভাই, আমি সত্যিই মজা করেছি।”

“তুই মজা করেছিস, আর ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে। আমি এটা মানতে পারছি না৷ এখন যা।”

“টুইংকেল আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওকে ছাড়া আমার একটা দিনও চলে না। ওকে না দেখলে আমার ভালোই লাগে না। কিন্তু এটা তো ওরকম কিছুই না। ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে! তোরা বারবার আমার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলিস।”

“তূর্য প্লিজ, অরুকে নিয়ে এমন কথা আর বলবি না। ও এখনো ছোট। ও আরেকটু বড় হলে এভাবে থাকাটাও সুন্দর দেখাবে না। ওকে একা কোথায় রাখবো আমরা? আরাফ ওকে হোস্টেলে দেবে না বলে দিয়েছে। অন্য বাড়িতে রাখার মতো সাহসও নেই, আজকাল কি কারো বিশ্বাস আছে? ও সারাজীবন হয়তো আমাদের সাথেই এক বাড়িতে থাকবে। এমন কিছু যদি ওর মাথায় ঢুকে ওর মন-মানসিকতা কেমন হবে একটু চিন্তা কর। ইতস্ততভাব নিয়ে এক ঘরে থাকা সম্ভব না। তাই আমাদের সবাইকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হবে। ওর যখন যথেষ্ট বুদ্ধি হবে, নিজে চলার মতো ম্যাচিউরিটি আসবে সেদিন এমন কথা বলিস। ততোদিনে ও সব সত্য জেনে যাবে। এখন এসব বুঝবে না। যা বুঝিয়ে দিবি, সবাইকে তাই বলবে। এখন বলছিস তুই ওর বর হবি। ধর, এই কথা ও না বুঝে পুরো মহল্লায় বলল, তারপর কেউ এসে অরুকে আমাদের থেকে আলাদা করে দিলো! এটা মেনে নিতে পারবি? মহল্লার সবাই জানে আমরা অরুর ভাইয়া। শুধু চাচা-চাচী, আলেয়া খালা আর শতাব্দীরা ছাড়া কেউই আসল সত্যটা জানে না। অরুর অভিভাবক নেই, কাজিন বা বাবার বন্ধুর ছেলেকে এই সমাজ যোগ্য অভিভাবক হিসেবে মানবে না। তখন অরুকে যদি কেউ দত্তক নিয়ে ফেলতে চায়? যেখানে আপন ভাই-বোনরাই বাবা-মার মৃত্যুর পর আলাদা হয়ে যায়, সেখানে আমরা তো ওর আপন ভাই-ই না। ওকে আমরা কিভাবে পড়াশোনা করাবো সেটাই এখনো নিশ্চিত না। ওকে নিজেদের কাছে রাখার মতো আমাদের কাছে কি আছে? কোনো যোগ্যতা আছে? এই মহল্লার সবাই জানে আমরা ওর ভাই। সালেহ চাচা আমাদের আপন চাচা। বাবা-মার মৃত্যুর পর আমরা এই দেশে এসেছি চাচা-চাচীর পাশে থাকার জন্য। এটাই আমাদের বর্তমান পরিচয়। অরুণিকা এভাবেই বড় হোক। ওকে হারিয়ে ফেলার মতো কোনো ক্ষমতা আমার নেই। সবাইকেই তো হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের তো আর কেউ নেই। চাচ্চুর শেষ ইচ্ছেটা কি আমরা ধরে রাখতে পারবো না? সমাজ তো আমাদের অনুভূতি বুঝবে না। ওরা বাস্তবতা দেখবে। আর অরুণিকা আমাদের অনুভূতি। এই অনুভূতি আমাদের প্রতি সেকেন্ডে এই আশা দেখায় যে হয়তো একদিন আমরা আমাদের নিজ দেশে ফিরবো, নিজেদের সব অধিকার ফিরে পাবো। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আমাদের প্রেরণা দিচ্ছে। ওর দায়িত্ব আমাদের মনকে শক্ত করছে। আমরা অনাথ কিশোর হয়েও দু’বেলা খাওয়ার মতো ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছি। ও না থাকলে আমরা আগের মতোই বেপরোয়ায় থেকে যেতাম।”

তূর্য আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“টুইংকেল আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। এতো সহজে কি কেউ ওকে আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলবে? এতো মাস ওকে দেখে রেখেছি, বাকী জীবনও রাখতে পারবো।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here