অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -১৪

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ14

রুশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আয়াশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
–“কিন্তু এখানে আসার পর কি হয়েছিল? সবাইকে ক‍্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার কথা বলে তুই-ই বা কেন এখানের মেডিকেল থেকে নিজের স্টাডি কম্পিলিট করেছিস? আর পরিবারের সবার সাথে যোগাযোগ-ই বা বিচ্ছিন্ন রেখেছিলি কেন?”

রুশা বলল,
–“সব কথা আজকেই শুনে শেষ করে ফেলবি না-কি? ভবিষ্যতের জন‍্যেও কিছু বাঁচিয়ে রাখ।”

আয়াশ কটাক্ষের স্বরে বলল,
–“ভবিষ্যতের জন‍্যে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়েই আজকে আমাকে এমন ডিসগাস্টিং সিচুয়েশনে পড়তে হয়েছে। আগে থেকেই যদি তোর ব‍্যাপারে সবটা ভালো করে জেনে নিতাম, তাহলে আমি এই বাড়িতে ভুলেও পাঁ রাখতাম না।”

আয়াশের কথায় রুশা একটা ভেংচি কাটল। তারপর বলা শুরু করল,

–“এখানে আসতে না আসতেই ইমদাদ সিকদার সোজা আমার মুখের উপর বলেদিলেন আমি যেন ওনার সামনে ভুলেও না আসি। যতদিন ইচ্ছে হবে এখানে থেকে আমি যেন আবার ফিরে যাই। আমিও ছিলাম ভয়ংকর জেদি। দাদি মনির দাফনের পর নিজেকে একদম রুম বন্ধি করে ফেলেছিলাম। কোনো আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে দেখা করিনি। যারা আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল তারা সবাই আমার রুমের দরজার সামনে থেকেই ফিরে গেছে। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। সারাদিন নিজের রুমে বসে ফোন টিপতাম, আর মাঝে মাঝে দাদুভাইয়ের রুমে গিয়ে দাদুভাইয়ের সাথে গল্প করে আসতাম। খাবার খাওয়ার জন‍্যেও নিচে নামতাম না। প্রতি বেলায় কেউ না কেউ গিয়ে আমার রুমে খাবার দিয়ে আসত। এরকম একদিন বোরিং লাগছিল বলে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে গেলাম। ছাদে গিয়ে রেলিং ঘেশে দাড়াতেই আমার চোখ নিচের গেটের দিকে আটকে গেল। ব্লাক সুট পড়া একটা ছেলে কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে খুবই ব‍্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইল দেখতে দেখতে আমাদের বাসার ভিতরের দিকে আসছিল। ছেলেটাকে দেখে কিছু ক্ষনের জন‍্যে আমি থমকে গেলাম। মনে হয়েছিল অজান্তেই কয়েকটা হার্টবিট মিস করে ফেলেছি। ছেলেটা কে আমি তখনও জানতাম না। তবে তার প্রতিচ্ছবি যে আমার মনের কোথাও একটা গেঁথে গেছে সেটা আমি ভালোই আন্দাজ করতে পারছিলাম।”

রুশার কথা শুনে আয়াশের মুখ ইয়া বড় হা হয়ে গেল। ‘ও’ ড‍্যাবড‍্যাব চোখে রুশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

–“ছেলেটার উপর ক্রাশ ট্রাশ খেয়েছিলি না-কি?”

রুশা স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-“না, সে আমার লাভ এ‍্যাট ফাস্ট সাইড ছিল।”

আয়াশ চোখে মুখে হাজারো বিষ্ময় নিয়ে বলল,
–“হোয়াট? কে ছিল ছেলেটা?”

রুশা ঠোঁট কামড়ে মৃদ‍্যু হাসল। ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু প্রসস্ত রেখেই বলা শুরু করল,

–“ছাদ থেকে নিচে নেমে ছেলেটাকে ড্রইংরুমে বসে ইমদাদ সিকদারের সাথে কথা বলতে দেখেছিলাম। কিন্তু ছেলেটা কে সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার হয়ে উঠেনি। তারপর প্রায় পনেরো দিন কেটে গিয়েছিল। ওই ছেলেটা আমার মাথায় চুইঙ্গামের মতো আটকে গিয়েছিল। ঘুমের মধ‍্যেও ওকে আমি স্বপ্ন দেখতাম। এরমধ‍্যে হঠাৎ একদিন বড়-মা এসে হাজির হল। আমার সাথে কথা বলার জন‍্যে দরজার সামনে দাড়িয়ে রইল। আমিও ওনার সাথে কথা বলব না বলে বেঁকে বসলাম। পরে উনি আমাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে দিয়ে দরজা খোলালেন। কিছুক্ষন আমার সাথে কথা বলে দাদুর রুমে চলে গেলেন। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আবারও আমার রুমে আসলেন। বড়-মার এমন কান্ডে আমি বেশ অবাক হলাম। উনি ওনার ফোন ঘেটে একটা পিক বের করে আমার সামনে ধরে বললেন, দেখ ত ছেলেটাকে পছন্দ হয় কিনা। আমি বড় মার কথা শুনে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এটা সেদিনের সেই ছেলেটা। ছেলেটাকে দেখে আমি আবারও কয়েক দফা নিজের হার্টবিট মিস করলাম। বড় মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি নিশ্চুপ হয়ে ছেলেটার দিকে ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম। আমার নিরবতা দেখে বড় মা মুচকি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, এটা আমার ছেলে সান। আমি আর তোর দাদুভাই মিলে ওর সাথে তোর বিয়ের ডিসিশন নিয়েছি। বিয়েটা একবার হয়ে গেলে তোকে আর এখান থেকে কোথাও যেতে হবে না। তুই সারা জীবন এখানেই নিজের পরিবারের কাছে থাকতে পারবি।”

আয়াশের মাথাটা ভনভন করে ঘুরিয়ে উঠল। ‘ও’ মাথাটা চেপে ধরে টাস্কি খেয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–“আমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে গেল? শান! আমাকে মেরে হসপিটালে কে ভর্তি করল? শান! আমার বাড়িতে গিয়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের উপরে অ‍্যাটাক কে করল? শান! আমার সো কল্ড মায়ের ভাইয়ের ছেলে কে? শান! আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডের লাভ এ‍্যাট ফাস্ট সাইড কে? শান! শান, শান, শান, এই শানের বাচ্চা আমার জীবনটা হেল করে দিল। ওর নাম শান না হয়ে বাশ হলে ভালো হত। কারন ওর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ত ‘ও’ আমাকে শুধু বাশই দিয়ে যাচ্ছে।”

আয়াশের কথা শুনে রুশা শব্দ করে হেঁসে দিল। আয়াশ ওর দিকে তাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল,
–“দাঁত বের করে না হেঁসে বাকিটা বল।”

রুশা ঠোঁট কামড়ে বহু কষ্টে নিজের হাসি আটকে বলল,
–“বড়-মা আমাকে ওসব বলে আমার রুম থেকে চলে যাওয়ার পর আমি একদম ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম। কারন শানকে আমি ছোট বেলায় তেমন একটা পছন্দ করতাম না। ‘ও’ সারাক্ষন গম্ভীর মুখ করে বসে বসে ভিডিও গেমস খেলত। আর চব্বিশ ঘন্টাই গিলতে থাকত। কারো সাথে তেমন কথাও বলত না। খেতে খেতে একদম কুমড়ো পটাশের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই কুমড়ো পটাশ এতটা ড‍্যাশিং হয়ে গেছে ভাবতেই আমার নিজের চোখকে অবিশ্বাস হতে লাগল। অতঃপর সপ্তাহ খানেক পর বড়-মা আবারও আসলেন। জানালেন, আপাতত আমার সাথে শানের এ‍্যানগেজমেন্ট টা করিয়ে রাখবেন। আর তারপর আমার যখন স্টাডি কম্পিলিট হবে তখন পাব্লিক‍্যালি এনাউন্সমেন্ট করে ওনারা আমাদের বিয়েটা দিবেন। আমাকে রেডি হতে বলে বড়-মা নিচে চলে গেলেন। আমিও খুশী মনে রেডি হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে আসার জন‍্যে উদ‍্যত হলাম। এরমধ‍্যেই নিচ থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ আমার কানে আসাতে আমি থেমে যাই। কড়িডোরের কাছে এগিয়ে গিয়ে রেলিংয়ের উপর হাত রাখতেই দেখতে পাই, নিচে শান বড়-মার উপরে চিল্লাচিল্লি করছে। ‘ও’ বড়-মাকে বলছে, ‘ও’ এই বিয়েটা করতে চায় না। কজ ‘ও’ অন‍্য একজনকে ভালোবাসে। আর বড়-মা ওকে ফোর্স করছে এই বিয়েটা করার জন‍্যে। সেটা নিয়েই দুজনের মধ‍্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শান ভাঙচুর শুরু করল। বড়-মা কিছুটা দমে গেলেন। ইমদাদ সিকদার আর মোহনা সিকদার বললেন, শান যেটা চায় সেটাই হবে, ওর ইচ্ছেকেই সবার আগে প্রায়োরিটি দেওয়া হবে। ব‍্যস সবকিছু সেখানেই শেষ হয়ে যায়। আমার ভাঙাচোরা মন নিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর বড়-মা এসে আমার কাছে মাফ চেয়ে যান। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। উনি যাওয়ার পর আমিও কেঁদেছিলাম ভিষণ। কাঁদতে কাঁদতে শান নামক চাপ্টার টা সেখানেই ক্লোজ করে দিয়েছিলাম। তারপর মাঝখানে আরো কিছুদিন কেটে যায়। একদিন রাতে হঠাৎ করেই দাদুভাই আমার রুমে এসে আমাকে জানায়, ইমদাদ সিকদার না-কি আমাকে আবারও ক‍্যালিফোর্নিয়া পাঠানোর ডিসিশন নিয়েছেন। নিজের দেশ ছেড়ে আমার আর ওখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। তাই দাদুভাইকে বলে দাদুভাইয়ের থেকে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে ওই রাতেই আমি বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে আসি। তারপর আর ওনাদের সাথে কখনো যোগাযোগ করার আমার ইচ্ছে হয়নি। দাদু ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতাম। দাদুভাই আমাকে চুপিচুপি টাকা পয়সা পাঠাতেন। আর ওদের বলতেন, রুশা ক‍্যালিফোর্নিয়াতেই আছে, এবং সেফ আছে। ওনারাও দাদুভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে আমার আর কখনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন নি। হয়ত বা প্রয়োজন মনে করেন নি।”

রুশা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে শূন‍্যে দৃষ্টি রাখল। আয়াশের বুকটা হঠাৎ করেই ভারি হয়ে আসলো। আগে ওর মনে হত এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যবান ব‍্যাক্তি বোধহয় ‘ও’ নিজেই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এই মেয়েটা জীবনে ওর থেকেও বেশি সাফার করেছে। রুশার জীবনটা সম্পূর্নটাই অপূর্ণতা দিয়ে ভর্তি। মা-বাবা, ফ‍্যামিলি, ভালোবাসা কিছুই পাওয়া হয়নি ওর জীবনে। অথচ আজ অবদি আয়াশ এসব নিয়ে ওকে কখনো আপসোস করতে দেখেনি। আয়াশের মনে পড়ে গেল পুরনো একটা কথা। ইতির সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পর আয়াশ যখন একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন রুশা ওকে প্রায়ই বোঝাত। মুভ অন করে নিজের লাইফটা গোছাতে বলত। একদিন আয়াশ বিরক্ত হয়ে রুশাকে বলেছিল, “এসব মুখে বলে সান্ত্বনা দেওয়া অনেক সোজা রুশ। যদি আমার জায়গায় থাকতি তাহলে বুঝতে পারতি মন ভাঙার কষ্ট কতটা তীব্র।” সেদিন আয়াশের কথার প্রতিউত্তরে রুশা কিছু বলেনি। শুধু ম্লানো একটা হাসি দিয়ে আয়াশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই হাসির মানে তখন বুঝতে না পারলেও এখন বোধহয় আয়াশ বুঝতে পারছে। আহত দৃষ্টিতে রুশার মুখপানে তাকিয়ে আয়াশ বলল,

–“তারমানে কি ইতির ফ্লাটে তুই যখন শানকে দেখেছিলি তখনই তুই ওকে চিনতে পেরেছিলি?”

রুশা দূরের অন্ধকারে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনুভূতিহীন কণ্ঠে বলে উঠল,

–“হসপিটালে রোহান যখন ওনার নাম বলেছিল তখনই চিনতে পেরেছিলাম। আর এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, উনি যাকে ভালোবাসে সেটা আর কেউ না, ইতি।”

রুশা কথাটা বলার সাথে সাথে ছাদের দরজায় খট করে শব্দ আসলো। আয়াশ আর রুশা দুজনেই চমকে উঠে সেদিকে তাকাল। সিড়ির কর্নারে লাগানো আবছা লাইটের আলোতে দেখতে পেল, একটা অবয়ব সেখান থেকে খুব দ্রুত সরে যাচ্ছে। আয়াশ দ্রুত গতিতে সেদিকে ছুটে গেল। কিন্তু কাউকেই সেখানে দেখতে পেল না। তাই ফিরে এসে রুশাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে পিঞ্চ করে বলল,

–“এই বাড়ির লোকদের দেখি আড়ি পাতারও স্বভাব আছে। মনে হচ্ছে কিছু বলার আগে একশো বার ভেবে তারপর বলতে হবে।”
________________________

ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষন বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইল রুশা। বাইরের অন্ধকার ভাবটা চলে গিয়ে দিনের আলোর দেখা দিয়েছে। রুশা বেড থেকে নেমে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে একদম নিচে চলে আসলো। এত সকালে কেউই এখনো নিচে নামেনি। ‘ও’ খুব সাবধানে দরজা খুলে খালি পায়ে বের হয়ে গেল নিজের গন্তব্যস্থল‍্যের উদ্দেশ্য। বাসার সামনের মোটা চওরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে থামল একটা কবরস্থানের সামনে। এটা রুশাদের পারিবারিক কবরস্থান। মেন রোড থেকে বেশ অনেকটা দূরে শূনশান জায়গায় জুড়ে এই কবরস্থান টা। রুশা ধীরে ধীরে পাঁ ফেলে কবরস্থানের বাউন্ডারির মধ‍্যে ঢুকে পড়ল। তারপর একপাশে থাকা বাধানো একটা কবরের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল। কবরের পাঁকা অংশে হাত রেখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ওর বুকের মধ‍্যে অসম্ভব ব‍্যাথা শুরু হল। কখনো বলতে না পারা কথাগুলো অশ্রু হয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল। রুশা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না গুলোকে আটকে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বহু বছরের চাপা কষ্ট গুলো সব বের হয়ে আসলো। শব্দহীন কান্না একটা সময় ফোপানোতে রূপ নিল। রুশা কবরের বাধাই করা দেয়ালের এক অংশ ডান হাতের আঙুল দিয়ে শক্ত করে খামচে ধরল। তারপর মাথাটা নিচু করে দেয়ালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। অতিরিক্ত শক্ত করে দেয়াল চেপে ধরায় এক পর্যায়ে রুশার ডান হাতের মধ‍্যমা আঙুলের নক ভেঙে সেখান থেকে ব্লিডিং শুরু হল। কিন্তু সেদিকে রুশার বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ হল না। ‘ও’ ত আজ নিজের দুঃখ বিলাশে ব‍্যস্ত।

প্রায় মিনিট বিশেক পর রুশা নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়াল। লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। লাস্ট এখানে সেদিন এসেছিল যেদিন ‘ও’ ওর বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। এটা ওর মায়ের কবর। সেদিনের পর ত ওর আর ওর মাকে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি কখনো। তাই আজকে যখন সুযোগ টা পেল তখন চুপিচুপি মায়ের সাথে দেখা করতে চলে এলো। রুশা মাথায় ভালো করে ওড়না দিয়ে আস্তে আস্তে কবরস্থানের বাউন্ডারি থেকে বেড়িয়ে আসলো। সরু কাচা রাস্তা দিয়ে মেন রোডের দিকে হাঁটা দিতেই দেখতে পেল শান একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। রুশা শানকে দেখেও না দেখার ভান করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শানকে ক্রস করে দু-কদম এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে শান বলে উঠল,

–“আমাকে বিয়ে করবে রুশা? আই প্রমিস, এখন পযর্ন্ত তোমার যা যা হারিয়ে গেছে সেই সব আমি তোমাকে আবারও ফেরত পাইয়ে দিব।”

শানের কথায় রুশার পাঁ জোড়া থমকে গেল। ‘ও’ চমকে পিছনে ঘুড়ে শানের দিকে তাকাল। শান এখনো গাছের সাথে হেলান দিয়েই দাড়িয়ে আছে। ওর গায়ে হোয়াইট টি-শার্ট আর পড়নে ব্লু রঙের ট্রাউজার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে। চোখে হালকা ফোলা ফোলা ভাব। দেখেই বোঝা যাচ্ছে চোখ থেকে এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। রুশার থেকে কোনো রকম অ‍্যান্সার না পেয়ে শান এগিয়ে আসলো। নরম কণ্ঠে আবারও বলে উঠল,

–“আমি তোমাকে প্রমিস করছি আমি সব ঠিক করে দিব। তোমার গায়ে একটা আচ পযর্ন্ত আসতে দিব ন….”

শানকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে রুশা চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল,
–“দয়া করতে চাইছেন আমার উপরে? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন মিঃ রায়জাদা, রুশা কারো থেকে দয়া নিতে মোটেও অভ‍্যস্ত না।”

শান বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
–“না রুশা দয়া কেন করতে যাব? দেখো, আমার ভুলের জন‍্যেই ত তোমাকে নিজের বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। আমি যদি সেদিন আম্মুর কথা মেনে নিতাম তাহলে আজকের সিচুয়েশন টা অন‍্যরকম থাকত।”

শানের কথা শুনে রুশার আর বুঝতে বাকি রইল না যে কালকে রাতে শান ওর আর আয়াশের কনভারসেশন শুনে নিয়েছে। ‘ও’ তীর্যক দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

–“কারো প্রাইভেট কথা আড়ি পেতে শোনাটা ম‍্যানারলেস মানুষের কাজ। আপনাকে ত জেন্টেলম‍্যান ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনার মধ‍্যে ত ছ‍্যাচরা টাইপ মানুষের লক্ষন আছে দেখছি।”

শান এতক্ষন নরম স্বরে কথা বললেও এবার রুশার দিকে ধারাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারপর কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল,

–“আমি মোটেও আড়ি পাতিনি রুশা। ছাদে এসেছিলাম তখনই তোমাদের কথাগুলো আমি শুনতে পেয়েছি। আর শুনে ভালোই করেছি। নাহলে অনেক কিছুই হয়ত আমার অজানা থেকে যেত।”

রুশা দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
–“সব শুনে আপনি কোন মাউন্ট এবারেস্ট জয় করে ফেলেছেন একটু শুনি?”

শান থমথমে মুখে রুশার দিকে তাকাল। রুশা রাগে গজগজ করতে করতে শানের সামনে তর্জনী আঙুল উঠিয়ে বলল,

–“আপনি আসলেই একটা ম‍্যানারলেস লোক। শুধু ম‍্যানারলেস না, অসভ‍্য, কান্ডজ্ঞানহীন, বাজে লোকও বটে।”

শান চোখ ছোট ছোট করে রুশার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“এখন এসব বলে ত লাভ নেই মিস রুশানি। আমি ত সবটা জেনে গেছি। এখন তুমি স্বীকার করো যে তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো?”

রুশা ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলল,

–“হোয়াট? আমি এখনো আপনাকে ভালোবাসব? আপনার কি আমাকে ইমোশনাল বেচারি টাইপ মেয়ে মনে হয়? না মানে যে ছেলেটা আমাকে রিজেক্ট করে অন‍্য একটা মেয়েকে সবার সামনে ভালোবাসার কথা বলল তাকে আমি এখনো আমার মনে এখনো জায়গা দিব? এরকম স্টুপিড মার্কা চিন্তা-ভাবনা আপনার মাথায় আসলো কীভাবে মিঃ রায়জাদা?”

রুশার কথায় শান মোটেও বিচলিত হল না। ‘ও’ রুশার থেকে এরকম অ‍্যান্সারই প্রত‍্যাশা করেছিল। রুশার ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপের হাসি থাকলেও চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে। শান এক হাত নিজের ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে সটান হয়ে রুশার মুখোমুখি দাড়াল। তারপর একদম স্বাভাবিক কণ্ঠেই রুশাকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে প্রশ্ন করল,

–“তারমানে কি আমি ধরে নিব, তুমি আমাকে হেট করো?”

রুশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলল,
–“আপনাকে হেট করব? আপনি আদৌ কি সেটার যোগ‍্য? রুশার ঘৃনা পেতে হলেও না যোগ‍্যতা লাগে। আপনার ত সেই যোগ‍্যতা টুকুও নেই।”

রুশার কথায় শানের ভিষন হাসি পেল। ‘ও’ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে রুশা নিজের মনে পুষে রাখা এতদিনের রাগ-ক্ষোভ এখন ওর উপরে ঝাড়ছে। শান অন‍্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিঃশব্দে হাঁসল। তারপর আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে রুশার দিকে তাকিয়ে বলল,

–“ওকে ঘৃনা যখন করোই না, তখন ত আর টেনশনের কোনো কারন নেই। আমি আজকেই আম্মুর সাথে কথা বলে আম্মুকে বিয়ের ডেট টা ফাইনাল করতে বলব। তারপর নাহয় বিয়ের পর আস্তে আস্তে তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলবে।”

শানের এমন গা জ্বালানো কথা শুনে রুশার রাগের মাত্রাটা বেড়ে গেল। ‘ও’ রাগি কণ্ঠে বলল,

–“আপনি বড়-মাকে কিচ্ছু বলবেন না। আর বললেও আমি আপনাকে বিয়ে করার জন‍্যে কিছুতেই রাজি হবো না।”

শান বলল,
–“রাজি ত তোমাকে হতেই হবে রুশা। আমি জানি আম্মুর কথা তুমি অমান‍্য করতে পারবে না।”

শান কথাটা বলার সাথে সাথে রুশা এসে শানের টি-শার্টের কলার খামচে ধরল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–“অমান‍্য করব। যেই আপনাকে বিয়ে করতে বলবে তার কথাই অমান‍্য করব। আপনি যদি এই পৃথিবীর লাস্ট পার্সনও হন, তাহলেও আমি কোনোদিন আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হব না। তাই এসব দিবা-স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। আর আমাকে বিয়ে করার চিন্তাও মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলুন। নাহলে আমি আপনার লাইফ জাহান্নাম বানিয়ে দিব।”

কথাটা বলে রুশা ঝাড়া মেরে শানের কলার ছেড়ে দিয়ে হনহন করে সামনের দিকে হাঁটা দিল। রুশা শানের টি-শার্টের কলার ছাড়তেই শানের ডান পাশের গলার সাইড থেকে জ্বলে উঠল। শান চোখ-মুখ কুচকে গলায় হাত ছোয়াতেই বুঝতে পারল ওর গলায় রুশার নখ বসে গেছে। আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় শান আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বিরবির করে বলে উঠল,

–“বি কেয়ারফুল শান, এই জংলি বিল্লি এত সহজে তোর আয়ত্বে আসবে না। একে নিজের আয়ত্বে আনতে হলে তোকে জাল বেছাতে হবে।”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here