অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব -১৩

#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ13

রাত 8:00

ছাদের পাশে রেলিংয়ের উপর উঠে বাইরের দিকে পাঁ ঝুলিয়ে বসে আছে আয়াশ। পাশেই রুশা রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে আয়াশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের এক ঝাক প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাবার আশায়। ছাদের চার কোনার চারটে রঙিন লাইটের আলোতে আর কুয়াশা পড়া হালকা ঠাণ্ডায় ছাদের পরিবেশটা বেশ মোহনীয় হয়ে উঠেছে। অন‍্য সময় হলে হয়ত রুশা কফি মগ হাতে নিয়ে ওয়েদারটা উপভোগ করত। কিন্তু আপাতত ওর মস্তিষ্কের মধ‍্যে যে প্রশ্ন গুলো দলা পাকিয়ে রয়েছে, সেগুলোর উত্তর পেতে ‘ও’ উদগ্রিব হয়ে আছে। মৌনতা কাটিয়ে বিষন্ন মনে আয়াশ বলে উঠল,

–“আমার বয়স তখন মাত্র নয় বছর। বাবা একদিন হঠাৎ একটা মেয়েকে নিয়ে এসে জানাল উনি নাকি মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন। মাকে বললেন আমাদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। মাও বিনা বাক‍্যে সেদিনই আমাকে আর আশুকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন। আমাদের ঠাই হল বড় মামুর বাড়িতে। দুইদিন পর মামারা সবাই মিলে আমাকে আমার বাবার কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ওনাদের ভাষ‍্যমতে, সন্তান যখন দুজনের তখন ওনাদের বোন একাই কেন দুটো সন্তানের ভার নিবেন? যে জন্ম দিয়েছে তারও ত একটা দায়ভার থেকে যায়। এসব নিজেদের মধ‍্যে আলোচনা করে বড় মামা গিয়ে আমাকে ওই বাড়িতে ফেরত রেখে আসলেন। যাওয়ার আগে মায়ের কাছে থাকার জন‍্যে আমি ভিষন কেঁদেছিলাম। কিন্তু আমার কান্নায় ওনাদের কারোর আমার প্রতি বিন্দুমাত্রও মায়া হয়নি। এমনকি আমার নিজের মা অবদি আমাকে রাখার জন‍্যে একটাবার চেষ্টা করেন নি। যখন আমি ওনাকে ঝাপটে ধরে কাঁদছিলাম তখন উনি পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। শেষ পযর্ন্ত আমার জায়গা হল সৎ মায়ের সংসারে। যদিও উনি বাবার ভয়ে আমাকে কোনোদিন কিছু বলার সাহস পাননি। তবুও আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমি রোজ মায়ের কাছে আসার জন‍্যে কান্নাকাটি করতাম। আর বাবা আমার উপরে রেগে গিয়ে আমাকে মারধোর করতেন। মার খেতে খেতে একটা সময় এসব অভ‍্যাসে পরিনত হয়ে গেল। মায়ের সাথে বাবার মিচ‍্যুয়াল ডিবোর্সটাও হয়ে গেল। সাথে মায়ের কাছে যাবার জন‍্যে আমার পাগলামিটাও দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে দুইবার পালিয়ে মামার বাড়ির সামনেও এসেছিলাম। কিন্তু বড় মামা আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেননি। গেটের সামনে থেকেই টানতে টানতে নিয়ে এসে আমাকে আবার ওই নরকে ফেলে গিয়েছিলেন। বাবা বুঝতে পারছিলেন আমাকে ওভাবে কন্ট্রোল করা যাবে না। তাই বাধ‍্য হয়ে উনি এখানের সবকিছু বিক্রি করে আমাকে নিয়ে ক‍্যালিফোর্নিয়া শিফট হয়ে যান।”

হতবাক হয়ে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে রুশা। আয়াশের বড় মামা যে আরাফ রায়জাদা সেটা আর রুশার বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু আরাফ রায়জাদার মতো একজন মানুষ যে এরকম কাজ করতে পারেন সেটা রুশার কল্পনারও বাইরে ছিল। ইনফ‍্যাক্ট ওনারা সবাইকে এটাই বলেছিলেন, মিচ‍্যুয়ালি ডিবোর্স হওয়ার পর মোহনা এবং তার এক্স হাসবেন্ট দুই সন্তানকে নিজেদের মধ‍্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ত দেখছে কাহিনী পুরাই অন‍্যরকম। রুশার ভাবনার মধ‍্যেই আয়াশ বলতে লাগল,

–“ক‍্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পর বাবা নিজের নতুন সংসার আর বিজনেস নিয়ে বিজি হয়ে গেলেন। ওনার স্থী আমাকে সামলাতে পারছিলেন না বলে আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন। আমিও সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নিজের পড়ালেখায় মনোযোগ দিলাম। ভেবেছিলাম লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় হয়ে আবার আমার মায়ের কাছে ফিরে আসব। কিন্তু বছর দুই পরে বাবা একদিন জানাল ওই মহিলাও নাকি একজন রিচ পার্সনকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করছেন। সেই দিন থেকে শালার এই মা নামক শব্দটার উপরেই ঘৃনা ধরে গেছে আমার। জীবনে আর যাই করি না কেন, ওই মহিলাকে আর কোনোদিন মা বলে ডাকব না।”

বলতে বলতে আয়াশ তাচ্ছিল্য হাসল। রুশা দেখল আয়াশের চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। রুশা লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

–“মাকে যখন এতই ঘৃনা করিস তাহলে বাংলাদেশে ফিরেছিলি কেন? তুই ত চাইলে ওখানেই সেটেল্ড হতে পারতি।”

আয়াশ সোজাসাপ্টা ভাবেই বলল,
–“আমি ওই জঘন‍্য লোকটার আশেপাশেও থাকতে চাইনি। ওনার থেকে অনেক দূরে যেতে চেয়েছিলাম। নিজের একটা আলাদা পরিচয় বানিয়ে সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে ওনাদের ছাড়াও আমি অনেক কিছু করতে পারি। আর দেখ, আমি আজকে সাকসেস। বাংলাদেশের প্রায় 80% মানুষ আজকে আমাকে এক নামে চিনে। এইজন‍্যে অবশ‍্য আমি আমার চাচ্চুর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। আজকে আমি যতটুকু সাকসেস হতে পেরেছি, সবটুকুই আমার চাচ্চুর জন‍্যে হতে পেরেছি। আমার বাবা-মা আমার জন‍্যে যেটা করেনি। সেটা আমার চাচ্চু আর চাচিমনি করেছে।”

আয়াশ এইটুকু বলে থামতেই রুশা গভীর ভাবনায় ডুব দিল। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে আয়াশকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে গম্ভীর স্বরে বলল,

–“আচ্ছা তোর যখন লাস্ট বারের মতো মোহনা সিকদারের সাথে দেখা হয়েছিল তখন ত তুই একদম ছোট ছিলি। তাহলে আজকে উনি তোকে দেখে চিনল কিভাবে? ওনার ত কোনো ভাবেই তোকে দেখে চেনার কথা না?”

আয়াশ বলল,
–“আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো তুই কোথায় দেখেছিলি তোর মনে আছে?”

রুশা এক ভ্রু উপরে উঠিয়ে বলল,
–“মনে না থাকার কি আছে? সেকেন্ড টাইম আমাদের হসপিটালে দেখা হয়েছিল।”

আয়াশ ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–“না রে গাধি। হসপিটালে আমাদের কথা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তুই আমাকে ওইদিন রাতে রাস্তায় অ‍্যাক্সিডেন্টরত অবস্থায় দ্বিতীয় বারের মতো দেখেছিলি।”

রুশা বিরক্তির ভঙ্গিতে আয়াশের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তো? একই ত হল।”

রুশায় কথায় আয়াশ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর সামনের শূন‍্যের দিকে দৃষ্টি রেখে বলা শুরু করল,

–“আমার চাচ্চুর থেকে আমার বাংলাদেশে আসার খবরটা মিসেস মোহনা জানতে পেরেছিলেন। তারপর ওইদিন রাতে উনি আমার সাথে দেখা করতে চাচ্চুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। ওনাকে দেখেই আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। আমি রেগে ওনার উপরে প্রচুর চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি রীতিমতো কান্নাকাটি করে আমাকে ওনার সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি সেদিন ওনাকে অপমান করে চলে যেতে বলেছিলাম। উনি চলে যাওয়ার পর আমার রাগ তরতর করে বেড়ে গিয়েছিল। রাগে বিরক্তিতে আমি বাইক নিয়ে একটা পাবে চলে যাই। সেখানে গিয়ে ইচ্ছে মতো ড্রিংকস করে আবারও বাইক চালিয়ে বাসায় ফেরার জন‍্যে রওনা দেই। কিন্তু মিনিট দুইয়ের মতো বাইক চালাতেই আমি মাথা ঘুরে বাইক নিয়ে রাস্তায় পড়ে যাই। আমার অ‍্যাক্সিডেন্ট হয়। আর তারপরই তোর ওখানে আগমন ঘটে।”

রুশা ড‍্যাবড‍্যাব করে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে ওদের লাইফটা এমন ফিল্মি টাইপ হয়ে গেল কেন? রুশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়াশ ভ্রু নাচিয়ে বলল,

–“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কি দেখছিস?”

রুশা ডানে বামে মাথা নেড়ে “কিছুনা” বোঝাল। আয়াশ চোখ ছোট ছোট করে রুশার দিকে তাকিয়ে রইল। রুশা নিশ্চুপে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল,

–“তবে যাই বলিস, মিসেস মোহনা কিন্তু সত‍্যিই তোকে অনেক ভালোবাসে। দেখলি না আজকে তোকে দেখে কীভাবে রিয়‍্যাক্ট করল? ভালো না বাসলে তোকে দেখে এভাবে রিয়‍্যাক্ট করত না। এভাবে পাগলের মতো কান্নাকাটিও করত না।”

আয়াশ বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বলল,
–“আরেহ ছাড় ত। এসব কিছু ওনার নাটক। উনি যদি আমাকে এতই ভালো বাসতেন তাহলে কখনোই উনি আমাকে কাছ ছাড়া করতেন না। আশুর মতো আমাকেও নিজের কাছে আগলে রাখতেন।”

রুশা বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
–“এমনও ত হতে পারে যে উনি তোকে ওনার কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে অথবা সবার চাপে পড়ে রাখতে পারেন নি। তুই ত তখন অনেক ছোট ছিলি। হয়ত তোর স্পষ্ট সব মনে নেই। দেখ আয়াশ, দুনিয়ার সবাই খারাপ হলেও মায়েরা কখনো খারাপ হয় না। সবাই স্বার্থপর হলেও একজন কোনোদিন স্বার্থপরতা করতে পারে না।”

রুশার কথায় আয়াশ হো হো করে হাসতে লাগল। এই হাসিতে যে কটাক্ষ, বিষাদ আর বিদ্রুপ মিশে আছে সেটা রুশা ভালোই বুঝতে পারছে। আয়াশ কোনো রকম নিজের হাসি থামিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

–“আচ্ছা ধর আমি মেনে নিলাম উনি অনেক ভালো একজন মা। আর এটাও মেনে নিলাম উনি পরিস্থিতির কারনে আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে বাধ‍্য হয়েছেন। কিন্তু তাহলে উনি তোকে কেন আপন করতে পারল না রুশা? তোকে ত চাইলেই উনি ওনার মেয়ের মতো করে আগলে রাখতে পারত। তাহলে তোকে বাড়ি ছাড়া করে উনি ওনার নিজের মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতে এত স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাল কীভাবে?”

রুশা আয়াশের চোখে চোখ রেখে মৃদ‍্যু হাসল। তারপর অন্ধকারে শূন‍্যের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,

–“উনি আমাকে আপন ভাবতে পারেন নি, এটা বললে ভুল হবে। আসলে আমিই ওনাকে কখনো আমাকে আপন ভাবার সুযোগ দেইনি। সৎ শব্দটার মধ‍্যে সাংঘাতিক একটা বিষ থাকে জানিস ত? সেই বিষ আমাকে এমন ভাবে গ্রাস করেছিল যে আমি কখনো ওনাকে আমার কাছেই ঘেষতে দেইনি।”

রুশার কথার মানে বুঝতে না পেরে আয়াশ ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাল। রুশা আগের মতো করেই সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলা শুরু করল,

–“মাত্র পাঁচ বছর বয়সে আমার আম্মু মারা যান। ছয় মাসের প্রেগনেন্ট ছিল আম্মু। ওয়াশরুমে আছাড় খেয়ে অতিরিক্ত ব্লিডিং হওয়ার ফলে ওনার মৃত‍্যু হয়। আম্মুর মৃত‍্যুতে মিঃ ইমদাদ সিকদার একদম ভেঙে পড়েছিলেন। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে ওনাকে সামলানোর জন‍্যে ওনার বেস্ট ফ্রেন্ড আরাফ রায়জাদা নিজের ডিবোর্সি বোনের সাথে ওনার বিয়ে ঠিক করেন। দাদুভাই আর দাদি মনিরও সেই বিয়েতে সম্মতি ছিল। ওনাদের মনে হয়েছিল আমার একজন মায়ের প্রয়োজন। তাই আমি আমার মাকে হারানোর মাত্র দু-মাসের মধ‍্যেই ওনারা আমার মায়ের জায়গায় অন‍্য একজন মহিলাকে এনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা আমি কিছুতেই মানতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল ওই মহিলা আমার মায়ের জায়গাটা দখল করতে এসেছেন। যখন ওনাকে নিয়ে গিয়ে আমার মায়ের রুমে বসানো হল, সেই মুহূর্তে আমি অ‍্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠলাম। রাগে, ক্ষোভে ভাঙচুর শুরু করলাম। আমাকে সামলানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তাই বড় বাবা আর বড় মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে ওনাদের সাথে ওনাদের বাড়িতে নিয়ে যান।”

রুশাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে আয়াশ জিজ্ঞেস করল,
–“বড় মা, বড় বাবা কে?”

রুশা বলল,
–“শানের বাবা-মা, মিসেস রাহেলা রায়জাদা আর আরাফ রায়জাদা। বুঝ হওয়ার পর থেকেই ওনাদের আমি বড় বাবা, বড় মা ডাকতাম। ইমদাদ সিকদার আর বড় বাবা বিজনেস পার্টনার ছিলেন। ওনাদের ফ‍্যামিলির সাথে আমাদের ফ‍্যামিলির খুব ভালো একটা সক্ষতা ছিল। দাদুভাই বড় বাবাকেও নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন। আর বড় বাবা-বড় মাও আমাকে ভিষন ভালোবাসতেন। আম্মুর সাথেও বড় মায়ের বেশ ভাব ছিল। ওনারা দুজনও খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।”

আয়াশ বলল,
–“তারমানে মিসেস মোহনার সাথে তোর বাবার বিয়ে হওয়ার আগ থেকেই তোদের সাথে ওনাদের ভালো একটা সম্পর্ক ছিল, তাই ত?”

আয়াশের প্রশ্নে রুশা উপর নিচ করে হ‍্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। আয়াশ কৌতূহলী হয়ে বলল,
–“তারপর?”

রুশা বলল,
–“মাস দুইয়ের মতো শানদের বাসায় ছিলাম। আমি, সৃজা, আশু আপু তখন একদম পিঠেপিঠি ছিলাম। সৃজা আমার থেকে দুই বছরের ছোট ছিল। আর আমি আশু আপুর থেকে তিন বছরের ছোট ছিলাম। আমাদের তিনজনকে সামলাতে গিয়ে বড় মা একদম হিমশিম খাচ্ছিলেন। তখন দাদুভাই বলল, আমাকে আর আশু আপুকে এই বাড়িতে রেখে যেতে। বড় মা আমাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এই বাড়িতে রেখে গেলেন। আমার সাথে আশু আপুকেও এখানে রেখে গেলেন। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ঠিকই ছিল। কিন্তু যখন আমি দেখলাম আমার বাবা আমার থেকে বেশি আশু আপুকে আদর করছে, তখন আমার মনটা আবারও বিষিয়ে যেতে শুরু করল। বাবার উপর এক আকাশ সমান অভিমান জন্মাল। আমি বাবার থেকে দূরে থাকতে শুরু করলাম। আশু আপু ওনাদের সাথে ওনাদের রুমেই ঘুমাত। আর আমি ঘুমাতাম দাদুভাই, দাদি-মনির রুমে। যেটা আমাকে আরো বেশি কষ্ট দিত। মোহনা সিকদার আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করতেন। আমাকে মায়ের ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমি সব সময় ওনার থেকে দূরে থাকতাম। ওনাকে দেখলেই আমার রাগ হত। আমার মনে হত উনিই আমার থেকে আমার বাবাকে নিয়ে নিয়েছেন। আশু আপুর সাথেও আমার দূরত্ত্ব বাড়ল। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমি আশু আপুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। এভাবেই কিছুদিন কেটে গেল। এরমধ‍্যে জানা গেল মোহনা সিকদার কনসিভ করেছেন। এই খবর শুনে সবাই খুশীতে গদগদ হয়ে গেল। শুধু খুশী হতে পারলাম না আমি। আমার বিষিয়ে যাওয়া মনটাকে আরো বেশি বিষিয়ে দিতে কাকিমা আমার মনের মধ‍্যে বিষ ঢালল। আমাকে বোঝাল ওই বেবী আসার পর আমার ফ‍্যামিলি মেম্বারেরা কেউ আর আমাকে ভালোবাসবে না। বাবা যেমন আমার থেকে দূরে চলে গেছেন। ওই বেবী হওয়ার পর বাবার মতো সবাই আমার থেকে দূরে চলে যাবে। ওনার কথায় আমি কি বুঝেছিলাম জানি না। আমার তখন কি হয়েছিল আমি সেটাও জানি না। রাগের বশে আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মোহনা সিকদারকে দোতলার সিড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিলাম। এতটাই জোরে ধাক্কাটা দিয়েছিলাম যে উনি ব‍্যালেন্সলেস হয়ে একেবারে নিচের ড্রইংরুমে এসে পড়েছিলেন।”

কথাগুলো বলতে বলতে রুশা নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। আয়াশ উচ্চ স্বরে বলল,
–“হোয়াট?”

রুশা চমকে আয়াশের দিকে তাকাল। আয়াশ চোখে মুখে বিষ্ময় নিয়ে রুশার দিকেই তাকিয়ে আছে। রুশা জিহ্ব দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়াকে একটু ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

–“ওই ঘটনার পর মোহনা সিকদারের মিসক‍্যারেজ হয়ে যায়। কিছু কমপ্লিকেশনের কারনে উনি মা হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। সবার সব ক্ষোভ-রাগ এসে পড়ে আমার উপরে। কিন্তু মুখে কেউ আমাকে কিছুই বলেনি। ওইদিনের পর থেকে আমি মোহনা সিকদারের চোখের বিষ হয়ে গিয়েছিলাম। উনি আমার ছায়াটাও সহ‍্য করতে পারতেন না। বাকিরাও সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকাত যে আমার নিজেকে খু*নি মনে হত। ভয়ে আমি শিটিয়ে থাকতাম। তার কিছুদিন পর ইমদাদ সিকদার আমাকে ক‍্যালিফোর্নিয়া পাঠানোর ডিসিশন নেয়। সবাই ওনার এই ডিসিশের বিরোধ করেছিলেন। কিন্তু উনি কারো কথাই শুনেন নি। বলেছিলেন, আমি এখানে থাকলে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই উনি চান আমি ক‍্যালিফোর্নিয়া গিয়ে ওখানে বসে নিজের স্টাডি কম্পিলিট করি। আমি সবাইকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু ভয়ে সেটা আর বলতে পারিনি। ইমদাদ সিকদারের কথা শুনে চুপচাপ নিজের দেশ, নিজের কাছের মানুষদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে উনি আমাকে একটা বডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। ছোট বেলাটা আমার সেখানেই কেটেছে। প্রাইমারি শেষ করার পর মাধ‍্যমিকটাও আমার বডিং স্কুলেই কেটেছে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হত ঠিকই। কিন্তু আমার পরিবারের প্রতি আমার রাগের মাত্রাটা এতটাই বেশি ছিল যে সেই কষ্টও আমার কাছে খুবই সামান‍্য ছিল। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, এই দেশের মাটিতে আর কখনো পাঁ রাখব না। তাই হায়ার স্টাডি কম্পিলিট করে ওখানেরই এক মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাকে আবারও এই দেশে টেনে নিয়ে আসলো।”

রুশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আয়াশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
–“কিন্তু এখানে আসার পর কি হয়েছিল? সবাইকে ক‍্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার কথা বলে তুই-ই বা কেন এখানের মেডিকেল থেকে নিজের স্টাডি কম্পিলিট করেছিস? আর পরিবারের সবার সাথে যোগাযোগ-ই বা বিচ্ছিন্ন রেখেছিলি কেন?”

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here