অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -১০

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১০ (অলকানন্দা ফুল)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“এভাবেই এক নন্দিনীর রূপের আগুনে ঝলসে যাচ্ছি। আমার এ-রাস্তাটা সহজ হোক!”
কথাটা শুদ্ধ এতটাই আস্তে বলেছিল যে, তনুজার কান অবধি পৌঁছায়নি। তনুজা শোনার আগ্রহও দেখায়নি। এদিকে হেলমেটের আড়ালে শুদ্ধর ওষ্ঠ যে কতটা প্রসারিত হয়েছে, তা-ও তনুজা লক্ষ করল না।

চলো এখনো সময় আছে, বেরিয়ে পড়ি, ফেলে রেখে সব পিছু টান।
ঝাড়া হাত-পা নিয়ে চলো যাই পেরিয়ে, সব বাঁধা সব ব্যবধান…
শুধু চলার জন্য চলা যাক না, ভুলে গিয়ে গন্তব্য।
আমি আমার পথের গান গাইছি, তুমি তোমার গানটা ধরো তো।
এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!

শুদ্ধর মস্তিষ্কে খুব সুন্দর ভাবে এই গানটা বেজে চলেছে। বেজে চলেছে অনেক অসম্ভাব্য ইচ্ছে। তার মধ্যে একটি খুব বেশিই হচ্ছে—এই রাস্তার মাঝে হাঁটু মুড়ে, দু-হাত ছড়িয়ে তনুজাকে বলতে, “ভালোবাসি, মিস. তনুজা। আপনাকে বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসি।”

নিজের ভাবনার উপর হাসল শুদ্ধ। আর কথা না বলে তনুজাকে তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো। তনুজা বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। শুদ্ধ খেয়াল করল—তনুজা তাকিয়ে আছে। শুদ্ধও তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল—তনুজা বোধহয় এখন কৃতজ্ঞতা থেকে একবার ‘থ্যাংক ইউ’ বলবে। কেন বলবে না? এটা তো জেনারেল নোলেজ! কেউ উপকার করলে, তাকে ধন্যবাদটা অবশ্যই জানাতে হয়।

কিন্তু শুদ্ধর সে-গুড়ে বালি। তনুজা বলে উঠল, ‘ইয়ে, বাড়ি গিয়ে শার্টটা ধুয়ে দিয়ো।’

শুদ্ধ কপাল কুঁচকে ফেলল। মুখ দিয়ে বেরোল কেবল একটিই শব্দ, “কেন?”

এর উত্তর দিলো না তনুজা। পিছু মুড়ে সোজা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেল। শুদ্ধ অবুঝ হয়ে তাকিয়ে রইল। বিরবির করে বলল, “যাহ! একটা থ্যাংক্সও বলল না! তা রেখে শার্ট ধুতে বলল! কেন?”

পরপরই বাইক স্টার্ট দিয়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ধরল। আস্তে-ধীরে নিজমনে বলতে লাগল, “নারীজাতি রহস্যময়ী। শাওনের ভাষায় প্যাচাইল্যা।”

______
কলিং বেল চাপছে মিনিট দশেক ধরে। অথচ শাওন দরজা খুলছে না। পকেটে এক্সট্রা কী-ও নেই; সকালে তাড়াহুড়োতে বাসায়ই রেখে গিয়েছিল। ফোন হাতে নিয়ে কল লাগাল শাওনকে। সঙ্গে সঙ্গে সে রিসিভ করল, মুখে হাসি নিয়ে শাওন বলল, “ক, ব্যাটা। কই তুই? আসবি না?”

শুদ্ধ শান্ত থেকে বলল, “তুই কই?”

আড়মোড়া ভাঙল শাওন, “এই তো, ক্যাট্রিনার গান শুনতাছি আর লাফাইতাছি।”

“হেডফোনে?”

“হ। দেখলি কেমনে? ক্যামেরা লাগাইছোসনি?”

শুদ্ধ চাপা শ্বাস ফেলে বলল, “আজাইরা কথা শেষ হলে দরজাটা খুলে দে।”

“ক্যা লো? আইছোসনি? নাকি আমারে এখন আমার কিটিক্যাট থেকে দূর করার ধান্দা, দুষ্টুউউউ?”

শেষ সম্বোধনটা শাওন দুষ্টুভাবে হেসে বলল। শুদ্ধ দুষ্টুমির মুডে নেই। শুধু বলল, “দশ সেকেন্ড দিলাম। দরজা খুলতে যত সেকেন্ড দেরি হবে, পেছনে ঠিক ততগুলাই লাথি খাবি।”

শাওন বুঝল। হেডফোন খুলে, এক দৌড়ে এসে দরজা খুলল। সে জানে, শুদ্ধ এটা এমনিই বলেনি। এর আগেও তো বলেছে। দেরি করায় লাথিও খেয়েছে। গুনে গুনে ঠিক ততটাই, যত সেকেন্ড দেরি করেছে।

দরজা খুলে শুদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাওন দাঁত কেলিয়ে হাসল, “বন্ধু, ভালা আছ?”

শুদ্ধ শাওনের দিকে একটা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলল। শাওন খুশি মনে বলল, “মামা, আজ তো মনটা এক্কেরে ফুরফুরা হইয়া আছে।”

শুদ্ধ তাকিয়ে বলল, “কেন, কী হইছে?”

“আরে! দিশার বিয়া। মাইয়াডারে দুইদিন ডেট করছিলাম, তারপর এমনভাবে পিছে পড়ছিল, আর ছাড়ার নামই নেয় নাই। কী একটা সমস্যায় পড়ছিলাম, জানিসই তো! আজ কল দিয়া কয়, ‘শাওন, তুমি খুশি তো? আর জ্বালাব না। কার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছি। বিয়েতে এসো।’ তারপর থেকে আমি আমার ক্যাটের গানে ঝিঙ্গালালা ঝিঙ্গালালা নাচতাছি, ভাইইইই।”

শুদ্ধ বলল, “মেয়েটা তোকে ভালোবাসত। একটা চান্স দিলেই পারতিস!”

“হুরু, ব্যাটা! তুই জানিস না? আমার ওসব সিরিয়াস রিলেশন-টিলেশনে পোষায় না। দিশা তো জানতই, আর জাইনাই আসছিল। তাইলে?”

“মেয়েটা যে কষ্ট পেল? কাউকে কষ্ট দিয়ে কি ভালো থাকা যায়?”

শাওন হাসল। অধরকোনে হাসির রেশ রেখে কিছু সময় বাদে বলল, “আমি অভিশাপ কুড়াতে ভালোবাসি। ভালো থাকতে ঠিক ভালো লাগে না রে।”

শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে শাওনের কাঁধে চাপর দিয়ে বলল, “সেন্টি খাস না, প্লেট ভরে ভাত খা। রান্না করে গেছে?”

“না, আসেই নাই।”

“হুরু! মা যে কেমন হেল্পিং হ্যান্ড রেখে গেল! একদিন আসে; দেন, এরপরের সাতদিন আসে না।”

শাওন হাসতে হাসতে বলল, “চেতিস না। চেতলে তোরে হেব্বি সুন্দর লাগে৷ আর এখানে ইম্প্রেস করার মতো কোনো গোরু নাই।”

শুদ্ধ আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “ক্যান? তুই আছিস না?”

শাওন ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, “ওহ্! আমারে পটাইতে চাস, আগে কইলেই হইতো! আমি তো, ইয়ে মানে, বেইবিইই!”

শুদ্ধ কুশনটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ছিঃ! অশ্লীল!”

শাওন হেসে দিলো, শুদ্ধও হাসতে লাগল। তারপর বলল, “ফ্রেশ হয়ে আসি, এরপর দুজন মিলে রান্নাটা সেরে ফেলব।”

“আচ্ছা, যা। আমি পেয়াজ কাটতে থাকি ততক্ষণে।”

“হুঁ, সাবধানে। হাত যেন না কাটে।”

শাওন মাথা নাড়ল, বোঝাল—সাবধানেই কাজ করবে। শুদ্ধ হেসে উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল। শাওন ফোনের স্ক্রিন আনলোক করতে করতে শুদ্ধর দিকে তাকাল। মুহূর্তেই কপাল কুঁচকে এলো। উচ্চস্বরে বলে উঠল, “ওরেএএএএ! পিঠে সিল মারল ক্যারা?”

শুদ্ধ পিছু মুড়ল, না বুঝে শাওনকে জিজ্ঞেস করল, “কী?”

শাওন চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, “শার্ট খোল।”

শুদ্ধর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে এলো, “কী বলিস! মাথা ঠিক আছে? শালা, অসভ্য!”

শাওন চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “যার মনে যা, ফাল দিয়া ওঠে তা। বাল, শার্ট খোল। পিছে কোন মাইয়ারে নিয়ে ঘুরছোস? সিল মাইরা দিছে, দ্যাখ।”

তৎক্ষনাৎ শুদ্ধর মনে পড়ল তনুজার সেই কথাটা, ‘বাড়ি গিয়ে শার্টটা ধুয়ে দিয়ো।’
কী হয়েছে—শুদ্ধর আর বুঝতে বাকি রইল না। বোকার মতো সেকেন্ড কয়েক দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেল। দরজাটা ভালো করে আঁটকে শার্টটা খুলে ফেলল। সাদা শার্ট, তার মাঝে হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁটের ছাপ। শুদ্ধ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে জায়গাটা ছুঁয়ে দেখল। হাসল সে। এরপর অগুনতি শুষ্ক চুমু শেষে শার্টটা বুকে জড়িয়ে ধরল। বরাবরের মতোই সে তনুজার কথা শুনল না। শার্টটা সে ধুলো না। চরম যত্নে কাবার্ডের এক ড্রয়ারে রেখে দিলো। যেখানে একসময় এক নারীর খোঁপায় শোভা পাওয়া বেলি ফুলের শুকিয়ে যাওয়া মালাটা, ‘T’ অ্যালফাবেট দেওয়া একটা ব্রেসলেট, জোড়া ছাড়া মাঝারি আকারের একটা ঝুমকো, আর কিছু হেয়ার-ক্লিপস স্বযত্নে পড়ে আছে। শুদ্ধ ঠিক সেখানটাতেই নিজের শার্টটি রাখল। সে এই ড্রয়ারের একটা নাম দিয়েছে, ‘শান্তিকুঞ্জ’।

শুদ্ধ শাওয়ার নিয়ে কিচেনে গিয়ে দেখে, শাওন কান্না করছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। দরজায় দাঁড়িয়েই শুধাল, “কী হইছে রে?”

শাওন বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নাক টানতে টানতে বলল, “কিছু না। পানিটা চুলায় দে।”

শুদ্ধ দেখল—শাওন পেয়াজ কাটছে। বুঝতে পেরে মাত্র বেরিয়ে আসা হাসিটা চেপে নিল। মজা করার উদ্দেশ্যে বলল, “আহারে, সোনা গো আমার! ছ্যাকা খাইছো, জান? থাক, কান্না কইরো না। আমি আছি না, বাবু?”

শাওন কান্না করতে করতে হাতের ছুরিটা সামনে তুলে ধরে বলল, “বালডা, খুন হইবি রে তুই।”

শুদ্ধ হেসে ফেলল। তারপর শাওনকে বলল, “কী খাবি?”

শাওন বিরক্তি নিয়ে বলল, “এমন ভাব নিয়া কইতাছোস, যেন সব রান্না পারি। যা মন চায়, তাই খাওয়া যাইব!”

“আজকের জন্য ধরে নে, তাই।”

“কেমনে?”

শুদ্ধ নিজের ফোনটা দেখিয়ে বলল, “এমনে।”

“ওহ্! ইউটিউব কাকু?”

শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসল। ভেজা চুলগুলো দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। একহাত দিয়ে ওটা মুছে, অন্য হাত দিয়ে কন্ট্যাক্টে গিয়ে প্রিয় নম্বরটিতে কল লাগাল। শাওন দেখল, স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা নাম, “অলকানন্দা ফুল”।

চলবে?
আজ একটু ছোটো পর্ব ছিল, না? এককাজ করব, এখন থেকে নিচে শব্দ সংখ্যা উল্লেখ করে দেবো। সময় করে লিখতে পারছি না বলে দেরি হচ্ছে, ছোটো হচ্ছে। সব অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম। পরের পর্বটা না-হয় বড়ো করেই দেবো!

শব্দ সংখ্যা–১২১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here