অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -১৬

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৬ (লুকোচুরি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“ম্যাম, জীবনটা সুন্দর! আরেকটা সুযোগ দিন!”

তনুজা হাসি মুখটা হুডতোলা রিকশা থেকে বের করে পিছে তাকাল। মিষ্টি কণ্ঠে বলে উঠল, “সুযোগ দিয়েছি বলেই, বেঁচে আছি, শুদ্ধ। লাইফের প্রতিটি মোমেন্ট ইনজয় করছি। নিজেকে ইনজয় করছি। আই লাভ মাই লাইফ, আই লাভ মাইসেলফ্!”

“ম্যাম, জীবনের শেষ বয়সে এসে একা লাগবে আপনার! একজন সঙ্গী থাকুক না, যে সবেতে পাশে থাকবে।”

তনুজা মাথা ফেরাল। নিচু স্বরে বলল, “সঙ্গ প্রয়োজন নেই, শুদ্ধ। প্রয়োজন নেই। আমি একাই বাঁচতে পারব পুরুষ ছাড়া।”

শুদ্ধ তা শুনতে পেল না। আরও একবার চিৎকার করে উঠল, “আপনাকে আমার চোখ-ভাঙা ঘুমে সকালের চা হিসেবে চাই, রোজ চাই।”

_______
ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ে প্রাপ্তিকে বসে থাকতে দেখে শুদ্ধ এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বসল প্রাপ্তির পাশেই। প্রাপ্তির উলটো দিক থেকে রোদ এসে লাগল শুদ্ধর গায়ে। চোখ-মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কীরে! এখানে কী করছিস? ক্লাস হচ্ছে তো!”

প্রাপ্তি শুদ্ধর চোখের অর্ধাংশ রোদে ঝলমল করতে দেখে একটু ডানে ঝুঁকে বসল। খেয়াল করল এখন আর শুদ্ধর মুখে রোদ লাগছে না, কোঁচকানো চেহারা সোজা হয়েছে। তা দেখে আনমনে হেসে বলল, “তুই দেরি করলি কেন এত? একা ক্লাস করতে ভালো লাগছিল না, তাই এখানে বসে ছিলাম।”

“কেন? তুহিন কই?”

“আসেনি আজ। আঙ্কেল ধরে নিয়ে অফিসে বসিয়ে দিয়েছে। বেচারা কাজে ব্যস্ত।”

“তুই আজ এত সুন্দর করে কথা বলছিস কেন? কয়টা ভর করল?”

প্রাপ্তি পুকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভ্রু কুঁচকে অধর কোনে হাসি রেখে বলল, “একটা ধরেছে; সেই কলেজ লাইফ থেকেই।”

“বলিস কী! নাম?”

“শুদ্ধ জিন সাহেব!”—বলেই প্রাপ্তি সোজা ঘাসের উপর সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে হাসতে লাগল। যেই সেই হাসি নয়, সেই হাসি থামারও নয়। শুদ্ধ প্রাপ্তির কথাটা কৌতুক হিসেবেই নিল। ঘাসের উপর হাতের কনুইয়ের ভর দিয়ে, সেই হাতে মাথা ঠেকিয়ে হেলে শুয়ে পড়ল ঘাসের উপর। প্রাপ্তির থেকে অনেকটা দূরেই আছে। প্রাপ্তির হাসি থামছে না। চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে। সেই জমাটবাঁধা অশ্রু নিয়ে আড়চোখে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর অপ্রেমের খবর কী?”

“ধুর শালি! তোর গোড়াতেই গলদ! একে তো অপ্রেম বললি, তার উপর আবার খবর চাইলি! অপ্রেমের খবর কেমন হয়, জানা নয় তোর?”

প্রাপ্তি কিছু না বলে উঠে বসল। আসন করে বসল শুদ্ধর দিকে ঘুরে। শুধাল, “ম্যাম ঢাকা থেকে এই শহরে ট্রান্সফার করল কেন? বলতে গেলে এই শহরে তো তার কেউই নেই!”

শুদ্ধ ঠোঁট উলটিয়ে বলল, “আমি কী জানি!”

প্রাপ্তি হাতের তর্জনী উঁচিয়ে শাসালো, “এই একদম মিথ্যা বলবি না। আমি জানি, তুই সব জানিস। না জেনে-বুঝে প্রেমে পড়লেও, প্রিয় নারীর ব্যাপারে কোনো বিষয় তুই অজানা রাখবি না। বিশেষ করে ম্যাম ডিভোর্সি জানার পর!”

শুদ্ধ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওহ্, জানিসই তাহলে!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। এমনি এমনি তোর ফ্রেন্ড হইনি আমি।”

“বুঝেছি!”

“এবার বল।”

“কী?”

“ম্যামের ব্যাপারে!”

“এত আগ্রহ কেন?”

“আরে তুই কীভাবে এত কথা খুঁজে বের করলি, বলিসনি আমাদের। এখন বল। কিউরিওসিটি বলেও তো কিছু আছে, রাইট?”

“হ্যাঁ, আছে।”

“বল।”

“আচ্ছা, শোন।”

“হুঁ।”

“ম্যামের ম্যারিড জানার পর ওই যে অসুস্থ ছিলাম না কিছুদিন?”

“হুঁ।”

“৮ দিন পর হসপিটাল থেকে বাসায় এসেই দাদাইকে কল দিয়েছিলাম। দাদাইয়ের সাথে আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপালের সম্পর্ক ভালো, ভীষণ ভালো। দাদাইকে ভঙচঙ বুঝিয়ে ম্যামের ইনফো কালেক্ট করি। কিন্তু তা পুরোটাই আকাম ছিল। তেমন আহামরি কিচ্ছু ছিল না ওতে। তাই ম্যামের কলেজে চলে যাই; যেটা ঢাকায়। কলেজে ম্যামের ব্যাচের ছবি-টবি খুঁজতে থাকি। ম্যামকে চিনতে অবশ্য অনেক বেগ পোহাতে হয়েছিল। চিনতেই, গ্রুপ ফোটোগুলোতে ম্যামের আশে-পাশে যারা যারা ছিল, তাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। সৌভাগ্যবশত তন্মধ্যে একজন ছিল সেই কলেজেরই লেকচারার। উনি আমাকে তনুজা ম্যামের বেস্ট ফ্রেন্ডের এড্রেস জোগার করে দেন। দুইদিনে এসব করি। ৩য় দিনে মিসেস শিখা.. আই মিন ম্যামের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাসায় যাই। উনি প্রথমে কিচ্ছু বলতে চাননি। তারপর চলে এসেছি। শেষমেষ দাদাইয়ের পাওয়ারের ইউজ করেছি; যেটা এই অবধি কোনোদিন করিনি! ফাইনালি উনি বলেছেন।”

“কী করেছিস?”
প্রাপ্তি চোখ ছোটো ছোটো করে শুধাল। শুদ্ধ মিহি হেসে চোখের পাতা ঝাপটিয়ে বলল, “সিক্রেট!”

“আচ্ছা! কী জানলি সেটা তো বল!”

“ওটাও সিক্রেট! ম্যামের সিক্রেটগুলো এখন থেকে আমারও সিক্রেট! খুব যত্নে বুকের গভীরে পুষব; রহস্যময়ী পাষণ্ডীর রহস্য কেউ ভেদ যাতে করতে না পারে।”

প্রাপ্তি মুঝ ভেঙচি কেটে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর সোজা হেঁটে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংয়ের দিকে এগোল।
শুদ্ধ সোজা হয়ে সেখানটাতেই ঘাসের উপর শুয়ে রইল। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। ভাবতে লাগল প্রিয় নারীকে। কী স্নিগ্ধ সে! কী স্নিগ্ধ সে নারীর চক্ষু-দৃষ্টি, ওষ্ঠ-হাসি! এত মায়া তাতে না থাকলেও তো হতো!
বন্ধরত চোখ খুলল সময় নিয়ে। দেখতে পেল শরতের আকাশে ভাসমান টুকরো টুকরো মেঘ কুচি। সেখানটাতেই শুদ্ধর অর্ধ-অচেতন মস্তিষ্ক আঁকতে লাগল তাকে। একটা ফুল হাতে নিয়ে তনুজা শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছে। শুদ্ধ তনুজার বিনুনি গাঁথা চুলের ভাঁজে ভাঁজে একটা করে ফুল গেঁথে দিচ্ছে।

_______
ওই গুনগুন সুরে মন হাসে না!
জানি ফাগুন আমার ভালোবাসে না!
তারে বলে দিয়ো—সে যেন, আসে না!
আমার দ্বারে!
তারে বলে দিয়ো..

তনুজা আজ ক্লাসে পুরো দশ মিনিট লেট। এই নিয়ে শুদ্ধর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ক্লাসরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল ক্রমাগত। দেখতে পাচ্ছে না কাউকেই। ঠিক আর কিছুক্ষণ বাদে সিঁড়ির ধারে তনুজার দেখা পেল। শুদ্ধ লুকিয়ে গেল। হাতে পুকুরপাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের কিছু ভীষণ ছোটো ডাল রয়েছে। শিখা বলেছে, তনুজার প্রিয় ফুল কৃষ্ণচূড়া। মনে পড়তেই সেখান থেকে একটা পাপড়ি ছিঁড়ে সিঁড়িতে ফেলল। এভাবেই করিডোরে ফেলতে ফেলতে ক্লাসের দিকে এগোল। কারো নজরে এলো না বিষয়টা। ধরতে গেলে, সবাই ভাববে—শুদ্ধ আনমনেই এটা ফেলেছে।

এভাবেই ক্লাসরুমের ধারে গেল। সাথের দেয়ালে একটা ফুল স্কচটেপ দিয়ে লাগাল। সেই স্কচটেপের উপর রেড মার্কার দিয়ে লিখল, “তি আমো!”

তারপর হেসে ক্লাসে চলে গেল। সামনে থেকে ব্যাগটা নিয়ে একদম লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসল। তনুজা এসে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে লেকচার দিতে শুরু করল। শুদ্ধ জানালা দিয়ে বাইরে খেয়াল করে দেখল, ফুলসহ স্কচটেপটা ওখানে লাগানো নেই। বিক্ষিপ্ত নজরে সেটা খুঁজতে লাগল। দৃষ্টি স্থির হলো করিডোরের ফ্লোরে। ছেঁড়া স্কচটেপের সাথে মোচড়ানো ফুল দেখে হেসে ফেলল মোহময় হাসির শুদ্ধপুরুষ।

এরপর কী যেন মনে করে, হাতের কৃষ্ণচূড়ার একটা পাপড়ি নিজের কানে গুঁজল। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল তনুজার দিকে। একদম নিষ্পলক। কোঁকড়ানো চুল, ঘোর লাগানো দৃষ্টি, গালে হাত, অধর কোনে লেপটানো অনিমন্ত্রিত হাসি—তনুজা চেয়েও এড়াতে পারল না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোর্ডের এক কোণায় ব্লু মার্কার দিয়ে লিখল, “Mppl bxbz!”

তারপর আবার পড়ানো শুরু করল। ক্লাসের কেউই এই সংকেতের মানে বুঝল না, যেটা শুদ্ধ বুঝতে সময় নিল না। তৎক্ষনাৎ ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করল। একটা পেইজে বেশ বড়ো বড়ো করে লিখল, “J dbo opu!!”

এরপর ওটা নিজের মুখের সামনে এনে ধরল। তনুজা দেখেই চোখ সরিয়ে ফেলল। সে হতাশ! ভীষণ হতাশ! এই ছেলেটা এত ধুরন্ধর না! সে একটি ইংরেজি বাক্যের সব অ্যালফাবেটের স্থান পরিবর্তন করে পরবর্তী অ্যালফাবেটের জায়গা দিলো। এভাবে এক সাংকেতিক বাক্য তৈরি করল। শুদ্ধ সেই ধরন অনুসরণ করেই পরবর্তী বাক্য বোঝাল, অর্থাৎ, “I can not!!”

পরপরই শুদ্ধ আবার আরেকটা কাগজ মাথার উপর রাখল। তাতে লেখা, “আই লাভ ইউ মোর, মোর অ্যান্ড মোর দ্যান মাই গিটার, অলকানন্দা।”

তাৎক্ষণিক ভাবে কাগজটি নিচে রেখে দিলো। তনুজা এক ঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। পুরো ভরা ক্লাসের মধ্যে একজন বাদে তাদের এই লুকোচুরি কেউ দেখল না, কারো নজরে পড়ল না। সেই একজনটা প্রাপ্তি! প্রাপ্তির ঠোঁটের কোনেও হাসি।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here