নীরবে তুমি রবে পর্ব -০৯

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৯

.
সুখপাখিটা হুট করেই যেন ধরা দিলো তার মনে, ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে শুরু করলো মুহুর্তেই। সুখ সুখ অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো, সেই সুখময় অনুভূতি’টা স্পষ্ট হলো ঠোঁটের কোণে। সেভাবেই ঠোঁটে একরাশ হাসি ঝুলিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে এলো রূপা। সোজা হয়ে যেতে লাগলো ডাইনিং রুমে। তার আগেই বসার ঘরে বড়মা ও ফুপিকে দেখে থেমে গেল, এগিয়ে এলো সেদিকে। বড়মা ও ফুপির সাথে আরও দুই ফুপি ও চাচীকে দেখতে পেল। তাদের সামনে দাঁড়িয়েই মুখের হাসিটা বন্ধ করে ফেললো রূপা। তার কথাতে তাসফির থেকে যাওয়াটা যেন সে কল্পনাও করতে পারে নি, যখন করতে পারলো তখন চোখে মুখে এক উচ্ছ্বাস নেমে এলো। সেটায় যেন নিজেকে সামলে নিলো রূপা। তাকে দেখে রেহেনা বলে উঠলো,

“কি হয়েছে মা? তাসফি কি আবারও তোকে বকাবকি করেছে?”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠলো রূপা, বোঝালো কিছু বলে নি। তিনি আবারও, “তাহলে?”

বলতেই চোখে মুখে বিষন্নতা ছেয়ে গেল রেহেনার। আবারও বলে উঠলেন,

“ও কি বেড়িয়ে পড়ছে রূপা? ইস্! ছেলেটা আমার কিছু মুখেও দিলো না, এভাবেই বেড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন তো খাওয়াটাও হবে না ঠিকঠাক।”

“চিন্তা করো না ফুপি, তোমার ছেলে কোথাও যাচ্ছে না।”

“মানে?”

বিষ্ময় দিয়েই বলে উঠলেন রেহেনা। রূপার কথাটা যেন মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারেন নি তিনি। ফুপির পাল্টা প্রশ্নে সামান্য হাসলো রূপা। বলে উঠলো,
“মানে তোমার ছেলে ঢাকায় যাচ্ছে না ফুপি। কোথাও যাচ্ছেন না উনি, বাসাতেই আছেন।”

“কি বলছিস মা? সত্যিই যাবে না। কি বললো তোকে?”

“বললো যাচ্ছি না কোথাও, ওদের বলে দাও।”

চোখ দুটো হালকা ভিজে উঠলো রেহেনার। রূপার দিকে তাকিয়েই জড়িয়ে ধরলো তাকে। কপালে আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলো, “আমি জানতাম, তোর কথা ঠিকই শুনবে। দেখিস এভাবেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। রাতের জন্য কষ্ট পাস না।”

“কিন্তু ফুপি, রাতে আমাদের মাঝে কিছু হয় নি। উনি তো রাগারাগি করেন নি আমার উপর।”

“তোমার ফুপিকে সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। নিজের ধারণায় নানান কিছু বুঝে নিয়েছে, সেটা না হলেও ফলাতে চাইছে।”

ডাইনিং রুমে এসে হুট করেই কথাটা বলে উঠলো তাসফি। সেদিকে তাকালো সবাই। জামা কাপড় পাল্টে এসেছে তাসফি। সেটা দেখে সবাই যেন নিশ্চিত হলো এবার। রূপা কে উদ্দেশ্য তাসফি বলে উঠলো,
“এতকিছু না বুঝে খেতে দিতে বলো তোমার ফুপিকে খেতে দিতে বলো।”

“তোরা ভালো থাকলে আমাদের আর ভাবতে হবে না। আয়, বস। খাবার দিচ্ছি।”

হালকা হাসলো তাসফি। এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বাসলো। রেহেনাও এগিয়ে এলেন ছেলের কাছে, মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে,
“একে অপরকে সময় দে বাবা, বোঝার চেষ্টা কর, এগিয়ে নিয়ে যা তোদের এই সম্পর্কটা। তখন আর আমাদের কোন চিন্তা থাকবে না।”

বলেই রান্না ঘরে চলে গেল রেহেনা। তাসফি মাথা ঘুরিয়ে রূপার দিকে তাকালো, মেয়েটাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। হাসলো তাসফি, মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে ঠোঁটের হাসিটা প্রসস্থ হলো।

.
“কি রে রূপা, এই লকেট’টা কবে কিনলি? সুন্দর লাগছে কিন্তু।”

রিমার কথা কর্ণপাত হতেই একহাত গলায় গেল রূপার, আর দৃষ্টি গেল তাসফির দিকে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে আড্ডায় মেতেছিলো সবাই। বাইরে কোথাও যাবার প্ল্যান করলেও তা হয় নি। বিয়ের পরেরদিন রূপাকে কোথাও যেতে দিবে না বাড়ির সবাই। যতই হোক বাড়ির মেয়ে, নতুন বউ তো। গ্রমের এই প্রচলন মেনেই না করে দেয় শাহানা বেগম। যেতে হলে তারা যাক, কিন্তু রূপা কে কোথাও যেতে দিবে না। এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহস পায় নি। যাবার প্ল্যানও আগামীকাল করে বাসাতেই আড্ডায় মেতে উঠে সবাই। এর মাঝে রূপার গলায় নজর যায় রিমার। হঠাৎ নতুন কিছু দেখেই বলে উঠে সবার মাঝে।
এতক্ষণে সবার নজর পড়েছে রূপার দিকে, কিন্তু রূপার নজর রয়ে গেছে তাসফির দিকে।

“আরে তাই তো, আগে তো দেখি নি এটা। কবে নিলি?”

রিফার কথায় এবার যেন বেশ বিপাকে পড়লো রূপা। তাকালো তার দিকে। কি বলবে রিফাপু কে? যে এটা তাসফি ভাইয়া দিছে, কি ভাববে তখন? ভেবেই যেন অস্তিত্ব শুরু হলো রূপার মাঝে। তাসফির সাথে যে এখন তার ভাইবোন ছাড়াও অন্য সম্পর্কে জুড়ে গেছে, সেটা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পারলো। কই? এর আগে যখন তাসফি তাদের টুকটাক কিছু কিনে দিয়েছে তখন তো এতটা অস্বস্তিতে পড়তে হয় নি। নিরদ্বিধায় বলে দিয়েছে যে —এটা তাসফির দেওয়া। কিন্তু এখন? এখন কি বলবে সেটা নিয়েই দ্বিধায় পড়ে গেছে।

লকেট’টা গতরাতে তাসফি’ই তাকে দিয়েছে। তাকে অজু করে আসতে বলে যখন রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যায় তাসফি, তখন বেশ অবাক হয়েছিলো রূপা। মিনিট দুয়েক পর ফিরে এসে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি রূপাকে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠেছিলো,
“তোমাকে না বললাম অজু করে আসতে, এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

“আপনি হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলেন? হাতে কি ওটা?”

তাসফির হাতে ছোট প্যাকেট দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো। তার কথার জবাব দেয় না তাসফি। বরং, “আগে অজুটা করে আসো।”

বলেই তাড়া দেয় রূপাকে। তখন আর দাঁড়াতে পারে না মেয়েটা। চটপট অজু করে বেড়িয়ে আসে। নামাজের উদ্দেশ্য দাঁড়াতে চাইলে বাঁধা দেয় তাসফি। তার হাতটা টেনে নিয়ে লকেট’টা তার হাতে ধরিয়ে দেয়। প্রচন্ড অবাক হয় রূপা, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, এটা কি? তাসফি বলে উঠে—দেখো। লকেট’টা ভালোভাবে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায় নেয়। বুঝতে পারে সেটা সোনার সাথে ডায়মন্ডের পাথর বসানো। আর সবচেয়ে যেতে যেটা অবাক করা বিষয়, সেটা হলো তার নামের প্রথম অক্ষর ডিজাইন করা।
বেশ অবাক হয়েই দেখে রূপা। তাসফি কে বলে —এটা কেন? তাসফি তখন সময় না নিয়েই বলে উঠে,
“বিয়ের প্রথম রাতে না কি বউয়ের মুখ দেখে কিছু দিতে হয়। রিং দেখতে গিয়েছিলাম তোমার জন্য, কিন্তু এটাতে যেন হঠাৎই আমার নজর আটকে গেল।”

রাতের করা ভাবনাগুলো থেমে যেতেই চোখে মুখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাসফির দিকে তাকালো রূপা। বোঝাতে চাইলো —কি বলবো ওদের আমি। মেয়েটার না বলা কথাটা হয়তো খুব সহজেই বুঝে গেল তাসফি। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“হঠাৎ কি নিয়ে পড়লি তোরা? এগুলো সব বাদ। কালকে কোথায় যাবি বলে ভাবছিস?”

মুহুর্তেই রূপার কথা যেন ভুলে বসলো সবাই। রাহাত বলে উঠলো,
“মমোইনে চলো ভাইয়া। নতুন কাপল তোমরা, প্রেম করার জন্য হেব্বি জায়গা তোমাদের জন্য।”

“তুই কেমনে জানলি? প্রেম করার জন্য হেব্বি জায়গা। গিয়েছিলি না কি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে?”

সাগর কথাটা বলতেই সবাই তীক্ষ দৃষ্টিতে নজর ফেললো রাহাতের দিকে। আমতাআমতা করতে লাগলো রাহাত। মুহুর্তেই সবাই বুঝে গেল ব্যাপারটা আসলেই সত্যি। সবাই মিলে জেড়া করতে লাগলো রাহাত কে। রিফা বললো,
“এ্যাই! তোর কত নাম্বার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে গিয়েছিলি? ওই বাচ্চা’টাকে? যে প্রথম দিন তোর সাথে দেখা করতে এসে কান্নাকাটি করেছিলো।”

“সে কি আর বাচ্চা আছে? আমাকেই তো কতকিছু শেখায়…..”

বলতেই নিজের ভুল বুঝতে পারলো রাহাত, চুপ হয়ে গেল। হেঁসে উঠলো বাকিরা। বিভিন্ন ভাবে খোঁচাতে লাগলো রাহাত কে।

এর মাঝেই আড়চোখে তাসফির দিকে তাকালো রূপা। উনিও হাসছেন সবার সাথে, সেই হাসিতেই যেন বেশ প্রাণবন্ত লাগছে মানুষটাকে। হাসির দমকে সামান্য গজদাঁত বেড়িয়ে আসছে। ওনার গজদাঁত আছে? কথাটা ভেবেই যেন বিস্মিত হলো রূপা, অতি আশ্চর্য! হয়ে তাকিয়ে রইলো তাসফির পানে। কই? আগে তো দেখে নি সে, না কি কখনোই খেয়াল করে নি? সামান্য চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারও তাকালো তাসফির পানে। না…. এখন তো বোঝা যাচ্ছে না। মনোযোগ দিলো রূপা, দেখলো তাসফির হাসিটা। হ্যাঁ! এই তো। ব্যাপার’টা মুহুর্তেই যেন ধরতে পারলো রূপা। খুব কাছ থেকে মানুষটাকে দেখলেই যেন ব্যাপারটা নজরে আসে। ভেবেই কিঞ্চিৎ হাসলো রূপা। মনে মনে অজান্তেই বলে উঠলো,
“মাশাআল্লাহ! নজর না লাগুক।”

.
রূপার বিয়ের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সবাই আপন নীড়ে ফিরেও গেছে। তাসফি একদিন থাকতে চেয়েও আরও দু’দিন কাটিয়ে গেছে এখানে। টানা কয়েকদিন ছুটির পর ভার্সিটিতে রেগুলার ক্লাস পড়েছে তার। থাকা সম্ভব হয়ে ঐঠে নি। তাসফি যাবার পর রূপার ফুপি সহ সাহিল, সাগর, রাহাত, রিমা সহ বাকি কাজিনরাও চলে গেছে। সকালে রিমি শ্বশুর বাড়ি আর রিফা পড়াশোনার জন্য রাজশাহী চলে গেছে, রয়ে গেছে শুধু তার ফুপি রেহেনা। তিনিও ঢাকা চলে যাবেন আজ রাতের গাড়ি তে।

ব্যাগপত্র দিয়ে বেরিয়েছে রেহেনা, তাকে নিতে এসেছে তাসফির বাবা। রূপারও সাথে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু তাকে নিচ্ছে না রেহেনা। তার কলেজ এখনও সপ্তাহ দুয়েক পর থেকে শুরু, তাছাড়াও তিনি চান না মেয়েটা তাদের সাথে যাক। ক্লাস শুরুর দু’দিন আগে তাসফি এসে যেন তাকে নিয়ে যায়, মনে মনে সেই প্ল্যান করে রইলেন। এতে ছেলেমেয়ে দু’টো আরও একটু কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে বলে।

যাবার আগ মুহুর্তে রূপাকে জড়িয়ে ধরলো রেহেনা, নানান কিছু উপদেশ দিতে লাগলো। ফুপির আদরে চোখ ভিজে উঠলো রূপার। রেহেনা উপদেশ বাণী দিয়ে বলে উঠলো,
“সাবধানে থাকবি। কলেজের কোন কাজে যেতে হলে রাহাত কে সাথে নিবি, একা একা যাবি না কোথাও।”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো রূপা। ফুপির কথা শুনবে বলে জানালো। রেহেনা আবারও বলে উঠলো,
“জামা-কাপড় খুব একটা নিবি না, তোর যেগুলো বেশি’ই প্রয়োজন সেগুলো সাথে নিবি। তাসফি এসে নিয়ে যাবে তোকে।”

বলেই একটু থামলেন। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“আর হ্যাঁ! তাসফি কে পাঠাতে চাইলে একদম না না বলবি না, মুখ ফুটে একদম উচ্চারণ করবি না ‘বড় বাবাইয়ের সাথে যাবো’ । এই সুযোগে আরও একটু কাছাকাছি আসতে পারবি।”

এবার আর কিছু বললো না রূপা, তাসফির কথায় যেন কিছুটা লজ্জা এসে ভীড় জমালো তার কাছে। রেহেনা সবাইকে বিদায় দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো তাসফির বাবার সাথে।

.
.
চলবে…..

ছোট হবার জন্য প্রথমেই দুঃখিত। আগামী পর্ব থেকে বড় করে দিবো, ইনশাআল্লাহ! রি-চেক দেওয়া হয় নি, বানান ভুল থাকতে পারে, ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here