নীরবে তুমি রবে পর্ব -০৮

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৮

.
বাবার কথায় সেদিকে তাকালো তাসফি। বিরক্তি ভাব ফুটে উঠলো। রেহেনা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“তাই তো তাসফি, বিয়ের পরেরদিন সকালে এভাবে চলে যাবার মানে কি? তোর না ছুটি আছে।”

“ছিলো মা, কিন্তু এখন আর নেই। ফোন করে জানিয়েছে, যেতে হবে।”

কেউই ঠিক বিশ্বাস করতে চাইলো না তাসফির কথা। মনে মনে সবাই ভেবেই নিলো, মুখে বললেও রূপার সাথে বিয়েটা ঠিক মেনে নিতে পারে নি তাসফি, রূপাও সহজভাবে নেয় নি তাকে। গত রাতে দুজনের মাঝে ঠিক কিছু একটা হয়েছে, আর সেটার রেশ ধরেই নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে তাসফি। সবার নিশ্চুপতার মাঝে তাসফির বাবা বেশ জোরেই বলে উঠলেন,

“যেতে হবে না কোথাও, বাহানাও দিতে হবে না। তুমি যে ইচ্ছে করেই যেতে চাইছো সেটা বেশ বুঝতে পারছি। মেয়েটাকে একা ফেলে যাবার মানে কি বুঝি না ভাবছো?”

“আশ্চর্য! তোমরা সবাই থাকতে ও একা কেন হবে? আর এই বাসা কি ওর জন্য নতুন, যে থাকতে ভালো লাগবে না।”

“এতকিছু আমি শুনতে চাইছি না তাসফি। গতকাল বিয়ে হয়েছে, আজকে তোমার চলে যাওয়াটা সোভা পায় না।”

“বললাম তো আমার যেতে হবে, কাজ আছে ও….”

“তোর বাবা ঠিক কথায় বলছে তাসফি। যাওয়া ঠিক হবে না তোর। এখন বিয়েটা হয়েছে তোর। মানতে না চাইলেও মানতে হবে, দ্বায়িত্ব নিতে হবে ওর। এভাবে এড়িয়ে যেতে…..”

মায়ের কথা আর শুনতে ইচ্ছুক নয় তাসফি, মাঝখানেই থামিয়ে দিলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপার দিকে তাকিয়ে,

“ওরর সম্পন্ন দ্বায়িত্ব এখন আমার, যে দ্বায়িত্ব আমি কখনোই এড়িয়ে যেতে পারবো না। পারবো না কি, চাইও না। এরপর তোমাদের যা ভাবার সেটাই ভাবো।”

বলেই আর দাঁড়ালো না তাসফি। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। এদিকে নিরাশ হয়ে বসে রইলো সবাই। ক্ষণ সামান্য পর রূপার বড় বাবা উঠে চলে গেলেন। তাসফির বাবাও রাগে গজগজ করতে করতে ডাইনিং রুম ছাড়লেন। সবটায় চুপচাপ দেখো গেল রূপা। তার কিছু বোঝার আগেই যেন সবটা ঘটে গেল। সামনে এসে দাঁড়ালো বড়মা। বড়মার দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠলেন,

“কি হয়েছে তোদের মাঝে?”

“কই? কিছু তো হয় নি বড়মা।”

“আমার কাছে কিছু লুকাস না মা। কিছু না হলে তাসফি কখনোই এভাবে যেতে চাইবে না। জানি, বিয়েটাতে তোর মত ছিলো না, আমাদের খুশিতেই রাজি হয়েছিস। এখন এই সম্পর্ক’টাও এগিয়ে নে, মেনে নে তাসফি কে।”

“সত্যিই কিছু হয় নি বড়মা। উনি তো…..”

আমলে নিলো না রূপার কথা। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“রাতে কি হয়েছিলো তোদের মাঝে? কিছু বলেছিস ওকে, সেটা নিয়ে রাগারাগি করেছে তাসফি? সকালেও ওভাবে বের হলি রুম ছেড়ে।”

“এসব কিছু না বড়মা, সবটাই তো ঠিক আছে।”

তবুও যেন শাহানা বেগম ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না রূপার কথা। ভেবেই নিলেন তাদের কিছু বলতে চাইছে না মেয়েটা। রেহেনা ইশারায় চুপ করতে বললো বড় ভাবীকে। রূপাকে যেতে বললো তাসফির কাছে। যদি তার কথায় আজকের দিনটা অন্তত থেকে যায়।

এদিকে রূপা ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না। বাড়িসুদ্ধ লোকের ধারাণা’টা যে ভুল, সেটাও বোঝাতে পারলো না। সকালে তো নিত্যদিনের মতোই বেড়িয়েছিলো রুম ছেড়ে। সবাই তো ঠিক আছে তাদের মাঝে।

.
সবেই রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং রুম পেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে রূপা। তখনই সামনে পড়লো তার বড়মা। রূপাকে দেখেই উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলো। বলে উঠলো,

“কি রে রূপা, এভাবে কেন বেরিয়েছিস তুই?”

“কেন বড়মা, কি হয়েছে? আমি তো এভাবেই থাকি।”

“থাকিস, কিন্তু আজকে? আজকের দিনটা অন্তত এভাবে থাকিস না?”

ঠিক বুঝতে পারলো না রূপা। নিজের অবুঝপনার পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”

“শোন মেয়ের কথা। কেন মানে কি? কালকেই তোর বিয়ে হয়েছে, বাড়িতে এখনো আত্মীয় স্বজনরা রয়ে গেছে। আর তুই বলছিস কেন?”

এবার হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো রূপা। বড়মা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবারও বলে উঠলেন, “কামিজ পড়ে বেড়িয়েছিস ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে হাত কান খালি করে বের হবি, এটা কোন কথা? যা, একটা শাড়ি পড়ে কিছু গয়নাগাটি পড়ে আয়। যতই হোক এবাড়ির মেয়ে, তবুও আজকের দিনটা একটু।”

“ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি।”

তখন আর কোন কথা বাড়ায় না রূপা, বড়মার কথায় রুমে চলে যায় শাড়ি পাল্টাতে। বড়মার কথাটা যে কতটা যুক্তিসম্মত সেটা তখনই বুঝতে পারে। যতই হোক সে এই বাড়ির মেয়ে, তবুও বাড়িতে আসতে থাকা প্রতিবেশীদের কিছু বলতে তো সময় লাগবে না।

সে সময় নিজের রুমে গিয়ে আর তাসফির দেখা পেল না রূপা। সে রুম ছাড়া অবধি ঘুমিয়েই ছিলো মানুষটা, এখন হয়তো নিজের রুমেই গেছে। সেদিকে আর মাথা ঘামালো না সে। দরজাটা আটকে দিলো, হালকার মধ্যে একটা সুতির মতো শাড়ি নিয়ে পড়ে নিয়েছিলো। তারপর হালকা কিছু গহনা পড়ে বেড়িয়ে এসেছিলো রুম ছেড়ে।
ডাইনিং রুমে আসতেই দেখে বড় বাবা, ফুপা সহ তার দুই চাচা ও আরও এক ফুপা বসে পড়েছে ডাইনিং টেবিলে। সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে চাচি ফুপির সাথে দাঁড়িয়ে যায় সেও। তখনও বাড়ির ছোটরা, মানে কাজিন মহলের কেউই উঠে নি। সকালের নাস্তা দিতেই আগমন ঘটে তাসফির। সবার সাথে বসে পড়ে চেয়ার টেনে। তখনই পাশে থেকে চাচী ফুপুরা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলে রূপাকে, ছেলেটার কি লাগবে তা দেখতে বলে। অগ্যতাই তাসফির পাশে এসে দাঁড়াতে হয় রূপার, সাথে তার দুই ফুপিও এসে বসে পড়ে চেয়ার টেনে।
সামান্যক্ষণ যেতেই ছেলেকে ভালোভাবে খেয়াল করেন রেহেনা। সকাল সকাল এভাবে কোথায় যাচ্ছে ছেলেটা সেটা ভাবেন, মনে প্রশ্নটা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলেন, এভাবে যাচ্ছে’টা কোথায়। তখনই এই ছোটখাটো ঝামেলার সৃষ্টি।

.
তাসফির রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রূপা। বড়মা ও ফুপির কথাতেই আসতে হয়ছে তার। যদিও সে জানে তাসফি তার কথা শুনবে না, তবুও তাদের মন রক্ষার্থে’ই এসেছি।
আর কিছু না ভেবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো রূপা, কিন্তু দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে গেল। মুহুর্ত ব্যায় না করে চোখ মুখ খিঁচে সাথে সাথেই বেরিয়ে এলো। বেশ শব্দ করেই দরজা আটকে দিলো। কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে রূপা। পড়ারই কথা। তার নিজেরই তো বোঝা উচিত ছিলো, এই রুম এখন কিছু মানুষরুপী বান্দরের দখলে। আর তারা ঘুমালে যে ঠিক কিভাবে থাকে, সেটাও বোঝা উচিত ছিলো। ভাইদের একেক জনের জামাকাপড় বিহীন ঘুমাতে দেখে আর থাকলো না রূপা। ভাবলো তাসফি ভাইয়া কোথায় যেতে পারে? তার রুমে? যদিও সিওর না, তবুও এগুলো তার রুমের দিকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই পেয়েও গেল তাকে। বিছানায় বসে মোবাইলে কিছু করছে। তার সামনে এসে দাঁড়ালো রূপা৷ তখনো তাসফির পুরো ধ্যান মোবাইলই নিবদ্ধ। কিন্তু মেয়েটা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

মিনিট পাঁচের অতিক্রম হলেও যখন রূপাকে কোন কথা বলতে শুনলো না, তার সামনে থেকে সরতেও দেখলো না তখন মোবাইলেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠলো,

“কি বলবে?”

“হু!”

ছোট করে জবাব দিলো রূপা। তাসফি তার দিকে না তাকিয়েই বললো,
“কি? বলো।”

“বাসার সবাই ভাবছে আমাদের মাঝে কিছু হয়েছে। আমি আপনাকে কিছু বলেছি, আপনি রাগারাগি করেছেন। আর সেজন্যই চলে যেতে চাইছেন।”

এবার মোবাইল থেকে মনোযোগ সরলো তাসফির। সুপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে মাথা তুললো, দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রূপার পানে। মেয়েটাকে দেখে যেন একটু চমকেই উঠলো তাসফি। এভাবে যে কখনো দেখা হয়নি তাকে। রমনীর সুশ্রী মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো, কিন্তু স্থির রাখতে পারলো না। তবুও লাল শাড়ি পড়া তার বউয়ের মুখপানে থেকে চোখ সরালো না। সত্যিই তো মেয়েটাকে লাল শাড়িতে বউ বউ লাগছে, পরিপূর্ণ নারী বলে মনে হচ্ছে। কিছু একটা আছে। এই মেয়েটার মাঝে নিশ্চিত কিছু একটা আছে, যা গত দুই দিন থেকে তাকে নীরবে খুব গোপন ভাবে ঘায়েল করে যাচ্ছে।

“বড়মা আর ফুপি পাঠালো আপনার কাছে, আপনাকে আটকাতে।”

ঘোর কাটলো তাসফির, ছুটে গেল ভাবনা। রূপার দিকে তাকিয়েই আবারও সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। বলে উঠলো,
“আশ্চর্য! তারা কি বুঝতে পারছে না, আমার কাজ থাকতে পারে। এভাবে জেদ করার মানে কি?”

“ওই যে, সবাই ভাবছে আমার সাথে….. ”

“তোমার সাথে রাগারাগি করেছি, এই তো? আরে বিয়ে করেছি বউের সাথে রাগারাগি করার জন্য? না-কি বউয়ের সাথে ঝগড়া করার জন্য? আমার বউ আমি দেখবো, আমিই সামলাবো। যেখানে আমার বউ কিছু বলছে না সেখা ওদের এতো মাথা ব্যাথা কেন আমি যাওয়াতে।”

কথাগুলো বেশ জোরেই বলে উঠলো তাসফি। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রূপা। এতটা স্বাভাবিক ভাবে তাসফি যে ওকে ‘আমার বউ, আমার বউ’ বলবে সেটাই যেন ভাবতে পারে নি। সত্যিই তো, সে তাসফি নামক এই ব্যাক্তিটির বউ। তা বলতে দ্বিধা নেই। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো রূপা। বলতে লাগলো,
“কিন্তু সবাই যখন বলছে, তখন….. না, মানে খুব জরুরি কাজ কি?”

জবাব দিলো না তাসফি। সহসায় কিছু বললোও না। সামান্যক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“তুমি? তুমি কি চাও?”

“হু?”

“তুমি কি চাও, থেকে যাই?”

“আমিইই তো….. বাসার সবাই যখন এত করে বলছে, তখন আজকের দিনটা অন্তত থেকে যেতেন।”

“উহুঁ! সবার কথা বলছি না আমি। তুমি কি চাও সেটাই জানতে চাইছি।”

অবাক হলো রূপা। তার কাছে কেন জানতে চাইছে, তার মতামত কি এতটাই গুরুত্ব তাসফির কাছে? কি বলবে বুঝতে পারলো না। তাসফি আবারও একই কথা জিজ্ঞেস করলো, জানতে চাইলো তার কাছে। দ্বিধায় পড়লো রূপা। কি বলবে সে? সত্যি বলতে কোন এক অদ্ভুত কারণে সে নিজেও চায় না তাসফি চলে যাক, থাকুক আরও একটা দিন তাদের সাথে। কিন্তু সেই বাক্য মুখে আনতেও যেন অস্বস্তি হতে লাগলো। তাসফি আবারও একই কথা জিজ্ঞেস করলো, শুনতে চাইলো রূপার মুখে। অনেকটা ইতস্তত করলো রূপা, শেষমেশ মিনমিনে গলায় বলেই উঠলো,

“আজকের দিনটা থেকে যেতেন।”

কিছু বললো না তাসফি। আবারও নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে কিছু করতে লাগলো। মিনিট পাঁচের পর কাউকে ফোন দিয়ে উঠে গেল বিছানা ছেড়ে, বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে কথা বললো কারোর সাথে। কথা শেষে এগিয়ে এলো, বিছানায় মোবাইলটা রেখে রূপার দিকে তাকালো। ততক্ষণেও রূপা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো, পর্যবেক্ষণ করছিলো তাসফিকে। যদিও বুঝতে পারে নি কার সাথে কথা বললো সে।
তাসফি রূপার দিকে একবার তাকিয়ে শার্টের ইন খুলতে লাগলো। বলে উঠলো,

“যাও, তোমার ফুপি আর বড়মাকে বলে আসো, কোথাও যাচ্ছি না আমি।”

.
.
চলবে…..

শব্দসংখ্যা ১৪৫০+
আজকের পর্বটা মনে হয় এক্টু ছোটই হয়েছে, তার জন্য দুঃখিত। রি-চেক দেওয়া হয়নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই একটু রেন্সপন্স করবেন, প্লিজ!🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here