#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
রুহানীর সাথে টেরেসের দোলনাতে বসে আছে আরহান। অপরাহ্নের সূর্য বড়োই চঞ্চল। প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস। রুহানীর খোলা চুল বারংবার বাতাসের তরে এলোমেলো হচ্ছে সেইসাথে রোদের দীপ্ততায় ঝলকে ওঠছে। আরহান সম্মোহিতের মতো এই রৌদ্র-হাওয়ার খেলা উপভোগ করে চলেছে। মৌণতায় কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রুহানী তুড়ি বাজিয়ে আরহানের মোহতা কাটায়। আরহান বলে,
“তোমার চুলগুলো বড্ড অবাধ্য!”
রুহানী হালকা হেসে নিজের কেশাগ্র একপাশে নিয়ে নেয়। তৎক্ষণাৎ আরহান চুলগুলোকে পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
“আমি কি বলেছি, চুলগুলো আমায় বিরক্ত করছে? সরালে কেন?”
রুহানী কপালে হাত দিয়ে মৃদু হাসে। তদ্রুপ আরহানও হাসে। আরহান বলে,
“কালকে সন্ধ্যায় ফ্লাইট আছে। দুইদিন পর আসব। তুমি সতর্ক থাকবে। আহান তোমার সাথে কলেজে যাবে ও আসবে।”
রুহানী ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়। যার জবাবে আরহান বলে,
“আমার কাজিন। তোমার সমবয়সী হবে। ওর সাথে পরিচয় খুব কম দিনের হলেও অ্যাই ট্রাস্ট হিম। আরেকটা কথা। আমার মনে হচ্ছে, ফুপি তোমাকে মানতে পারছে না। তুমি একটু বাড়িতে যেও। তোমার সাথে পরিচিতি বাড়লে উনার মন বদলাতে বাধ্য।”
রুহানীর মনে হলো আরহানকে বিয়ের ব্যাপারে বলা উচিত। সে ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে চেয়েও বলল না। উঠে রুমে খাতা আনতে গেল।
“কী হলো রুহানী?”
রুহানী খাতা সহ ফিরে এসে তাতে লিখে,
“আমার মনে হয় আমাদের বিয়েটা সাফার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত পেন্ডিং রাখা উচিত। জানিনা তোমার মতামত কী? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা করা উচিত। সাফা সুস্থ হলে ওর খুশি, সন্তুষ্টি বিবেচনা করে বিয়েটা করা উচিত।”
রুহানী লিখে খাতাটা আরহানের হাতে দেয়। আরহান লেখাটা পড়ে ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমার তা মোটেও মনে হয় না। সাফা কোমাতে আছে। কোমার থেকে মানুষ কবে সুস্থ হয়ে ফিরবে তার কোনো সময় জানা নেই। আমরা তো এখন অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি না। তাছাড়া সাফার সন্তুষ্টি থাকুক বা না থাকুক, বিয়ে তো আমি তোমাকেই করব। বরং আমাদের আরো জলদি বিয়েটা সেরে ফেলা উচিত। যাতে আমি তোমাকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখতে পারি। যতটুকু বুঝেছি রাফাতের মন থেকে এখনো তোমার প্রতি বিদ্বেষ কমেনি। যদি ওর মন থেকে বিদ্বেষ কমে যেত তাহলে ও এখন পলাতক থাকতো না। এসে মাফ চেয়ে নিতে পারত।”
রুহানী আরহানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওষ্ঠ সঞ্চালন করে বলে,
“কাল একবার সাফার সাথে দেখা করে আসবো?”
“না। আমি ফিরে আসি তারপর। কাল অবশ্য আমি সাফার সাথে দেখা করেই এয়ারপোর্টে যাব। যেহেতু পথ ওদিকেই। তোমাকে নিয়ে ফ্লাইট থেকে ফিরে আসার পর যাব।”
“আচ্ছা।”
“তাহলে আজ আমি উঠি। কাজ আছে। তোমার জেদের কারণে এখন ত্রিমাত্রিক চাপে আমার পিষ্ট হওয়ার দশা!”
আরহান ভেবেছিল রুহানী হয়তো তাকে সহমর্মিতা দেখাবে। কিন্তু রুহানীর পানে দৃষ্টি যাওয়া মাত্রই লক্ষ্যে আসলো, মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে হাসছে।
“তুমি হাসছ! আরে ইয়ার! কোথায় একটু স্বান্ত্বনা দিবে। তা না করে মজা নিচ্ছ! সো ব্যাড রুহানী!”
রুহানী শব্দহীন উপায়ে বলে,
“আপনার বলার ধরনটাই ছিল যে তেমন।”
“ও আচ্ছা! তাই? এখন হাসো ঠিক আছে। বিয়ের পর যখন সময় কম পাবে তখন দুঃখ না করো!”
রুহানী ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করার প্রয়াস করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদর্শন করে। আরহান অভিমানের স্বরে বলে,
“ধ্যাৎ! থাকো তুমি। আমি গেলাম।”
সত্যি সত্যি আরহান উঠে চলে গেল। রুহানী ভেবেছিল হয়তো মজা করছে। কিন্তু আরহানকে চলে যেতে দেখে আর আটকালো না। মেসেজে লিখলো,
“আপনার সাথে এক মূহুর্ত সময়ও যেন দীর্ঘ নদীর মতো হোক। আমি অল্পতেই তুষ্ট। আপনার অল্প সময়েই আমার মনে যদি অভিমানের পাহাড়ও জমে তা ধসে যাবে।”
মেসেজটা সেন্ড করে মুচকি হাসলো রুহানী। তারপর উঠে টেরেসের কোণায় যায়। আরহান গাড়িতে বসে মেসেজটা দেখে একবার রুহানীর টেরেসের দিকে তাকায়। অতঃপর সুন্দর হাসি বিনিময় করে গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়।
——–
আলো খান ও তার স্বামী ব্যালকনিতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে। আলোর স্বামী স্টিভেন বলেন,
“হোয়াই ডোন্ট ইউ লাইক রুহানী?”
আলো খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“আমি রুহানীকে পছন্দ করি না, ব্যাপারটা এমন না। আমি আসলে একটা বোবা মেয়ের সাথে বিয়েটা মানতে পারছি না। তাছাড়া মেয়েটার শত্রুর অভাব নেই। মায়ের কাছ থেকে জেনেছি রুহানীর বাবা-মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে। এখন রুহানীর জন্য আরহানের বন্ধুও শত্রু হয়ে ওঠেছে।তুমি তো জানো ছোটবেলায় আমি আরহানকে অনেক আদর করতাম। ভাবী বেঁচে নেই। আর মা ও ভাইয়ারও বয়স হয়েছে। তাছাড়া আমরাও এখানে সারা জীবনের জন্য আসিনি। আরহাম যাতে একজন পারফেক্ট জীবনসঙ্গী পায় বিষয়টা দেখাও তো ফুফি হিসেবে আমার দায়িত্ব। এখন মা ও সবাই ভাবতেই পারে বাঙালি ফুফি হিসাবে নিজের মেয়েকে ভাতিজার সাথে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা! না আমার মোটেও ইচ্ছা নেই। আমি এও জানি আমার মেয়ে বাংলাদেশের মোটেও থাকতে চাইবে না। সে এখনই চরম বিরক্ত। তাছাড়া সেরিনা দিহানকে ভালোবাসে।”
স্টিভেন বলেন,
“অ্যাই থিংক, তুমি রুহানীকে সামনে থেকে জানলে বুঝলে মেনে নিতে পারবে। তুমি যেমন নিজের ক্ষেত্রে নিজের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছো, আরহানও কিন্তু তেমনটাই করবে।”
“হুম। তাও আমি চাইব ভেবে দেখুক। সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো।”
_________
পরেরদিন আরহান রুহানীকে কলেজে নিয়েও গেছে তারপর সাথে করে বাড়িও পৌঁছে দিয়ে গেছে। আরহান ভেবেছিল আজকে ব্রেক টাইমে রুহানীর সাথে একটু ঘোরাফেরা করবে। কিন্তু ব্রেক টাইমে হঠাৎ তার কাজ পড়ে যাওয়াতে তা আর হয়ে ওঠেনি। রুহানী গাড়ি থেকে নামতেই নিবে তখন আরহান তার হাত ধরে আটকায়। আর বলে,
“সরি। বলেছিলাম কিছু সময় বের করে একটু ঘোরাফেরা করবো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। এরপর দুইদিন তো থাকবোই না। তুমি কাজলের সাথে থেকো। আহান তোমাকে নিতে আসবে এবং বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবে। ওরও একটু সিলেটের ফেমাস কলেজ ঘুরে দেখা হবে।”
রুহানি এবার কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে ইশারায় বলে,
“আমি আহানকে নিয়ে সাফার বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসি। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
“উম, যেতে পারো। তবে বেশি সময় থেকো না।”
রুহানী মাথা নাড়ায়।
এদিকে সাফার বাবা-মায়ের সাথে রঞ্জু খন্দকার বসে আছেন। গতকাল সাফাকে দেখে যাওয়ার পর রঞ্জু খন্দকার একদিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুরের বেস্ট ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে ফেলেছেন। রঞ্জু খন্দকার বলেন,
“আঠারো বছর আগে ছোট্ট সাফাকে আমি আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আপনারা নিঃসন্তান দম্পতি নিজেদের সন্তানের মতোই ওকে আগলে নিয়েছেন। কিন্তু আজ আমি নিজের ভাতিজিকে নিজের কাছে ফেরত চাইছি।”
মিসেস শাহানা আঁতকে ওঠলেন,
“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ভাই? আমি আমার মেয়েকে আপনাকে দিয়ে দিতে পারব না। আঠারো বছর ওকে আমি নিজের সন্তানের স্থান দিয়েছি।”
মিস্টার ফয়সাল তাতে সায় দেন।
“এতো বছর পর তুমি এসব কেন বলছ রঞ্জু?”
রঞ্জু খন্দকার লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
“আমি সাফাকে সুস্থ করতে চাই। আর সুস্থ করে ওকে আমি এই দেশে আর আনবো না। কারণ এই দেশে ও যা চায় তা পাবে না। ওর অ্যা*ক্সিডেন্টের আগেও কিন্তু ও সবকিছু থেকে দূরে থাকা শুরু করেছিল।”
“আমরা তবে ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।”
রঞ্জু খন্দকার মিসেস শাহানার ব্যাকুলতা বুঝলেন। তাও বললেন,
“ও সুস্থ হলে ওর সত্যটা জানা উচিত। অতীত ওর জানা উচিত। তারপর ও যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে।”
মিসেস শাহানা এবার উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি তীব্র প্রতিবাদের স্বরে বললেন,
“নাহ্! আমার মেয়েকে আমি কোনো সত্য জানাবো না। আঠারো বছর যেভাবে চলেছে, বাকি জীবনটাও সেভাবেই চলবে। আপনি আমাদেরকে সাফাকে দত্তক দিয়েছেন। সকল আইনী কার্যকলাপ মেনেই সাফাকে আমরা গ্রহণ করেছি। আমাদের আর কোনো সন্তান নেই।”
“ভাবী একটু বোঝার চেষ্টা করুন…”
মিসেস শাহানা আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালেন না। তিনি হনহনিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিস্টার ফয়সাল ইসলাম অনুরোধের স্বরে বলেন,
“সাফাকে এসব জানানোর কী দরকার? ওর জন্মদাতা-জন্মদাত্রী তো জীবিত নেই। তাহলে যাদেরকে ও বাবা-মা হিসেবে জানে তাদেরকেই আজীবন জেনে যাক।”
রঞ্জু খন্দকার বুঝলেন এদের বোঝাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি সাফাকে সত্যটা বলবেন। সাফাকে সে ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারণ অবশ্যই জানাবেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
সকল রহস্যের জট খুলে গিয়েছে। এখন যার যার সামনে আসা বাকি।
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।