#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬২)
সময় চলছে গন্তব্যে। রাতের অন্ধকার আর সবেগি হাওয়ার সাথে গতির বিরাট পাল্লা তার। নিরন্তর ছুটছে ঘড়ির কাঁটা। রাত্রীর দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলো কেবল। ধূসর-পিউয়ের বিয়ের পাঠ চুকেছে অনেকক্ষণ হবে। অথচ এখনও সবাই রাজ্যের ব্যস্ত পথিক। হাত,মুখ,পা, দেহ জিরোচ্ছেনা কারো।
এমনিতে বিয়ে হলে, মেয়ে বাড়ি গুটিয়ে থাকে বিষন্নতায়। কন্যা বিদায়ের, আজীবনের জন্যে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর হাহাকারে বাবা মায়ের বক্ষ ছি*ড়েখুঁড়ে আসে। যেমনটা সেবার পুষ্পর বিয়েতে হয়েছিল।
মিনা বেগম অজ্ঞান ছিলেন। বনিয়াদ ভে*ঙে কেঁ*দে ফেলেছিলেন শ*ক্তপোক্ত আমজাদ সিকদারও।
কিন্তু পিউয়ের বিয়ের ঘটনা উলটো। তার শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ির দরজা,ছাদ, দেয়াল সবই একটা। সে আমৃত্যু এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। সেইজন্যে কান্না*কাটি তো দূর,বাড়ির লোকজন থেকে একটু -আধটু দামও পাচ্ছেনা।
একবারও এসে খবর নিচ্ছেনা ওর! সে যে সন্ধ্যে থেকে না খেয়ে আছে কারোর হুশ নেই । ভীষণ খিদেয় পেটে চলছে ইঁদুর ছোটার প্রতিযোগিতা। বিকেলের পর দাঁতে কিচ্ছু পরেনি। এতক্ষণ না খেয়ে থাকা যায়? মা-ও একবার এলোনা। বিয়ে হতে না হতেই ওকে পর করে দিলো? পিউয়ের এমন শান্ত হয়ে বসে থাকা পোষাচ্ছে না। বসার ঘর থেকে বাতাসে, কোরমা-পোলাওয়ের ঘ্রাণ ছুটে আসছে। ক্ষুদা বেড়ে প্রকান্ড হয়েছে তাতে।
কিন্তু বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ঘরে রেখে যাওয়া সময় সুমনা,পুষ্প সবাই মিলে বলে গিয়েছে,
‘ একবার বাসর ঘরে ঢুকলে আর বের হওয়া নিষেধ।’
পিউ পেট চে*পে বাধ্য হয়ে বসে রইল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে অসহায় শ্বাস ফেলল। বিয়েরও এত জ্বালা!
বসার ঘরে খেতে বসেছেন অতিথিরা। বিশাল জায়গা জুড়ে ছয়- সাতটার মত লম্বা লম্বা টেবিল পাতা হয়েছে। দফায় দফায় লোক বসছে খেতে। মেহমানদের আধিক্য না থাকায়, অসুবিধে হচ্ছেনা।
সিকদার বাড়ির তিন কর্তা,সাদিফ, ইকবাল তদারকি আর খাদিম দিতে ব্যস্ত । আনিস রিক্তকে নিয়ে বিপাকে পরেছেন। ছেলেটার জ্বর উঠছে হয়ত। তাপমাত্রা উষ্ণ হচ্ছে গায়ের। অসুস্থতায় খুনখুন করছে একটু পরপর। সুমনা ব্যস্ততায় ওনার কাছে রিক্তকে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আপাতত বাড়িময় ছেলেকে কাঁধে চড়িয়ে ঘুম পাড়ানোই তার কাজ।
সৈকত জামাই বলে তাকে কোনও দায়িত্ব দেয়া হচ্ছেনা। নিতে এলে টেনেটুনে খেতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ইকবালের বেলায় এই নিয়ম টিকলো না। সে এক বাটি রোস্ট সমেত হেলেদুলে আসার সময় ধূসর বলল, ‘ আমাকে দে,তুই খেতে বোস।’
ভালো একটা প্রস্তাবেও,
ইকবাল রুষ্ট চোখে চাইল। কড়া কণ্ঠে বলল,
‘ নতুন জামাইয়ের এত কথা বলতে হয়না। মানুষজন খারাপ বলবে। চুপচাপ বসে থাকো যাও।’
পাশ কাটিয়ে চলে গেল তারপর। তার মুরুব্বি হাবভাব দেখে, ধূসর হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ।
***
খাওয়ার পর সুপ্তির লিপস্টিক উঠে গিয়েছে। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিপুণ যত্নে ঠোঁটে লাগাচ্ছে সে।
ঘুরে চাইতেই দূরে দাঁড়ানো ধূসর হাত উঁচিয়ে ডাকল। চোয়াল ঝুলে গেল সুপ্তির। ঘাবড়ে গেল। মনে পড়ল, তাদের গ্রামে ধূসরের বাঁধাই করা অতীত। শিহাব কে পি*টিয়ে আসার ঐতিহাসিক কান্ড। তার ছোট্ট আদোলে আতঙ্ক দেখা গেল। ভয়ে-ভয়ে এসে বলল, ‘জি ভাইয়া!’
‘ এদিকে এসো।’
ধূসর সোজা রান্নাঘরের দরজায় এলো। বূয়া বটিতে শসা কাটছিলেন। ওকে দেখেই শুধালেন,
‘ কিছু লাগব ভাইজান?’
‘ যা যা খাবার আছে একটু একটু করে একটা প্লেটে দিন তো। মাংসের ঝোল দেবেন না। আর ইলিশ মাছ দু-পিস দেবেন।’
তিনি ঘাড় কাঁত করলেন। তড়িঘড়ি, ব্যস্ত হাতে প্লেট,বাটি নিলেন। বড় বড় ড্যাকে, হাড়ি-পাতিলের ভেতর থেকে আদেশ মত সব তুললেন।
সুপ্তি পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে দেখছিল। ভাবছিল, এসব কার জন্য?
ধূসর প্লেট নিয়ে ওর হাতে দিলো। নরম কণ্ঠে বলল,
‘ একটু কষ্ট করে এটা আমার রুমে দিয়ে এসো।’
সুপ্তির ভ্রু মিলিয়ে গেল এবার। ওনার রুমে তো পিউ আপু আছে। খাবার নিশ্চয়ই ওর জন্য? কত ভালোবাসা বউয়ের প্রতি! হেসে ফেলল সে। ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা।’
পিউ নিঃসহায়ের মত বসে। নখ দিয়ে চাদর খুঁটছে। ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাটাতন বসিয়ে ফুলের টানেল দিয়েছে চারপাশে৷ সাদা চাদরের ঠিক মধ্যখানে লেখা “ধূসর-পিউ”।
ঘরে ঢুকে,এসব দেখেই পিউয়ের বুক ধ্বক করে উঠেছিল। ‘বাসর রাত’ কথাটা মনে করলেও ম*রে যাচ্ছিল লজ্জায়।
কিন্তু সেই লজ্জা ধীরে-সুস্থে গায়েব হলো খাবার সংকটে। বলেনা, ‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়! পূর্নিমার চাঁদ সেখানে ঝলসানো রুটি ।’
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে সবাই নিশ্চয়ই সব খেয়ে দেয়ে শেষ করে ফেলেছে? ওকে কী খেতে দেবেনা? সে নিরুপায় হয়ে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেল।
রুমটা ধূসরের। কোথায় কী রাখা জানেনা! খাবার দাবার কিছু থাকলে ভালো হোতো। আগে বুঝলেও ওর রুম থেকে কয়েকটা চিপ্সের প্যাকেট এনে রেখে দেয়া যেত৷
সেই সময় সুপ্তি ঘরে ঢুকল। চাপানো দোর ঠেলে দেওয়ার শব্দে তাকাল পিউ। ওর মুখের আগে তার নজর পৌঁছাল হাতের খাবারের ওপর। চোখ দুটো চকচক করে উঠল ওমনি। সুপ্তির হা করার আগেই কে*ড়ে নিলো প্লেট৷
অল্পস্বল্প ভ্যাবাচেকা খেলো মেয়েটা । পিউ রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পরেছে থালায়। তাড়াহুড়োয় দাঁনা তালুতে উঠে গেলে সুপ্তি পানি এনে দিলো। পুরো থালা পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন করে থামল পিউ। যুদ্ধ জেতার মত হাসি ফুটল ঠোঁটে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কৃতজ্ঞ চোখে চাইল সুপ্তির দিক। সে তখন পাশে বসে। পিউ বড় শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ তোকে আনলিমিটেড ধন্যবাদ। আরেকটু হলে খিদেতে ম*রেই যেতাম।’
সুপ্তি বলল,
‘ ধন্যবাদ টা আমাকে না দিয়ে, নিজের বরকে দিও। সে-ই মনে করে সব পাঠিয়েছে, নাহলে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত।’
পিউ আঙুল চাটছিল। কথাটায় থেমে তাকাল। নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ ধূসর ভাই?’
সুপ্তি সব দাঁত দেখিয়ে বলল, ‘ না,ধূসর জামাই।’
বিস্মিত চোখে কয়েক পল চেয়ে রইল পিউ। ধূসর ভাই এত কিছু মনে করে পাঠালেন? পুনরায় বউ বউ ভাবটা চেহারায় ফুটে উঠল তার। ভালো লাগার তোপে ফুলল লালিত কপোল। লজ্জা পেল ভীষণ! মানুষটা খেয়েছে কী না একবার জানতে না চেয়েই ও গপগপ করে খেয়ে ফেলল? এত বাজে বউ তো সে নয়। এতক্ষণ খেয়ে যেটুকু আনন্দ লাগছিল,এবার ক*ষ্ট লাগল পিউয়ের। মিহি কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ উনি খেয়েছেন? জানিস কিছু? ‘
****
অনুষ্ঠানের রেশ মোটামুটি কমেছে। কোনও রকম শান্ত হয়েছে হুটোপুটি। চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ আপাতত নেই। খাওয়া দাওয়া শেষে, কাছাকাছি নিবাসের অতিথিরা বেরিয়ে গিয়েছেন। তন্মধ্যে ইকবালের বাড়ির লোক অন্যতম। তাদের রাখার জোরাজোরি তে পরাস্ত হয়েছেন আমজাদ।
ইফতি আজ সারাটা বিয়ে বাড়ি তানহাকে খুঁজেছে৷ পায়নি কোথাও। আসেনি না কী? পিউকে যে জিজ্ঞেস করবে ওই সাহসে কূলোয়নি ওর। ধূসরের নীরব হু*মকি, আর বড় ভাইয়ের চোখ রা*ঙানোর পর সে মেয়ের দিকে তার তাকাতেও ভ*য় লাগে। ইফতি
মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখেছে তানহা এক্টিভ নেই।
মন খারাপ হয়েছে ওর। আজকাল যেই মেয়েকেই পটাতে যায়,হাত ফস্কে মাছের মত বেরিয়ে যায় সেটা।
এদিকে তানহার জ্বর উঠেছে। যাকে বলে হাড়মজ্জা কাঁ*পিয়ে দেওয়ার মত জ্বর। ইদানীং এই জ্বরের প্রকোপটা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে চারপাশে। ঘরের কেউ না কেউ অসুস্থ হতে শোনা যায়।
তানহার গতকালই আসার কথা ছিল বিয়েতে। পিউয়ের গায়ে হলুদ নিয়ে তাদের কতশত পরিকল্পনা!
কিন্তু ধুম জ্বর ছুটল দুপুরের পর। বিছানা রেখে উঠতে না পারার মতোন দশা।
পিউ শ’খানেক ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে। এত জ্বর নিয়ে তানহার মা আসতে দেননি। সেই অবস্থাতেই ছিলো না মেয়েটা। ঘর শুদ্ধ দাওয়াত,কিন্তু মেয়ের শরীরের কথা ভেবে তারাও যেতে পারেননি। বিয়ে বাড়িতে, যেখানে সবাই ব্যস্ত থাকবে, সেখানে অসুস্থ মানুষ না নেয়াই ভালো। তানহা জ্বর ভুলে শুয়ে শুয়ে কাঁদল। একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে যেতে না পারার দুঃখে কাহিল সে। পিউয়েরও সমান মন খারাপ। বিয়ে নাহলে ছুটে গিয়ে দেখে আসতে পারত। তবে যতটুকু পেরেছে, করেছে। সেজেগুজে সবার আগে ওকেই ভিডিও কল দিয়েছে। তানহার মা মেয়ের সামনে ফোন ধরেছেন, রুগ্ন চোখে শুয়ে শুয়ে দেখেছে মেয়েটা।
****
ঘড়ির কাঁটায় তখন ১টা বেজে ১০মিনিট।
ধূসরের চারপাশে পুরুষ মহলের আড্ডা। এক হালি চাচা, পিউয়ের দুই মামা, সুমনা,জবা সবার বাপের বাড়ির লোকজন। এদের হৈহৈ আলাপে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারছে না ধূসর। এত রাত হলো,
ঘরে যাবেনা, না কী? আর কতক্ষণ বসে থাকবে? তার সুপ্ত মেজাজ চটে যাচ্ছে।
এদিকে ইকবাল, সাদিফ,পুষ্প, মারিয়া কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটু আগেও তো ছিল এখানে। সবগুলো একসাথে গেল কোথায়?
ধূসর অধৈর্য, বিদ্বিষ্ট হয়ে কপালে আঙুল ঘষল। রুবায়দা দেখতে পেয়েই কাছে এসে শুধালেন,
‘ মাথাব্যথা করছে? কফি খাবি?’
ধূসর চোখ তুলল। তার শ্যামলা চেহারার আনাচে-কানাচে বিরক্তি। কোথায় বলবে,ঘরে যাবি? এই রাত দেড়টার সময় কফি খায় কে?
সে উঠে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ।
সংক্ষেপে বলল ‘ না। রুমে যাচ্ছি।’
অবিলম্বে হাঁটাও ধরল। মুরুব্বিরা খানিক থতমত খেলেন ব্যাপারটায়। কেউ কাউকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক রাখলেন চোখ-মুখ।
কিন্তু রুবায়দা স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না। তিনি ত্রস্ত পায়ে মিনা বেগমের কাছে এলেন। চাপা কণ্ঠে বললেন,
‘ আপা, ধূসরতো ঘরে চলে গেল। পায়েস, শরবত কিছুইত…’
পথিমধ্যেই, বুয়া থালায় মাজুনি ঘষতে ঘষতে বললেন,
‘ তয় কী করব আম্মা? রাইত বাজে দুইটা,আমনেরা হেরে অহনও বহাইয়া রাকছেন। নুতোন বউ রাইখা কেউ এমবায় থাহে?আরও ভাইজানের বালোবাসার বউ। কত যুদ্দ করল হেদিন দেকলাম তো!’
মিনা কিছু বললেন না। রুবায়দার কনুই টেনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দ্রুত। এক কোনায় এসে বললেন,
‘ একটা কথা বলব রে রুবা?’
ভদ্রমহিলা অবাক হয়েছেন। এভাবে টেনে-টুনে আনা,আবার এত কাতর কণ্ঠে বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ… বলোনা!’
মিনার চোখে-মুখে ইতস্ততার চিহ্ন। সময় নিয়ে,রয়ে সয়ে বললেন,
‘ আমি জানি, ধূসর তোর একমাত্র ছেলে। ছেলের বউ নিয়ে প্রতিটি মায়ের শখ-আহ্লাদ থাকে। তোরও ছিল। কত কথা, স্বপ্ন এসে আমাকে বলতি তুই। সেই ধূসরের আল্লাহর হুকুমে মনে ধরল আমার মেয়েকে। তার হুকুমেই বিয়ে হলো আজ। তুইত জানিস,পিউ ভালো-মন্দ তেমন বোঝেনা। আঠের বছর চলছে কিন্তু পরিপক্কতা একটু কম। লাফালাফি করে অনেক। সংসার যে কী ওর ধারণাই নেই। গভীরতা বোঝাতো বহু দূর। না বুঝেই অনেক ভুল করবে, তোর মন মতো পারবেন না হয়ত। তুই একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিস? যেমন ভাবে গড়লে তোর মনে হবে ও তোর যোগ্য বউমা তেমন করেই শাসন করিস।
তুই শেখালেই ও শিখবে। ছটফটে হলেও আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী! বড়দের অসম্মান করেনা কখনও।’
রুবায়দা কিছুক্ষণ আশ্চর্য চোখে চেয়ে রইলেন। হতবিহ্বল হয়ে বললেন,
‘ আপা! তুমি এসব, আমাকে বোলছো? ‘
মিনা হা করলেন,পূর্বেই তিনি ঝাড়া মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। রেগে বললেন,
‘ কিছু বলতে হবে না আপা, সব বুঝেছি! মুখেই আমাকে বোন বলো। সামনেই এত ভালোবাসা!
পিউ তোমার একার মেয়ে তাইনা? আমার মেয়ে না ও? ও কেমন আমি তা জানিনা?’
‘ রাগ করছিস কেন? আমি তো…’
‘ তুমিতো তুমি। বুঝিয়েই দিলে আমি পিউয়ের শুধু চাচিই রয়ে গেলাম, মেজ মা হতে পারিনি। কেন আপা? আমি কি কোনও দিন কম ভালোবেসেছি ওকে? আলাদা চোখে দেখেছি? তাহলে এসব কীভাবে বলতে পারলে?
মিনা অসহায় চোখে চাইলেন। কী বলতে, কী বলে ফেলেছেন! রুবায়দা উলটে চেঁতে গেল। তিনি বাহুতে হাত ডলতে ডলতে বললেন,
‘ ও মেজো,শোন না! একটু মাথাটা ঠান্ডা কর বোন। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। তুইতো চিনিস তোর আপাকে। আচ্ছা ভাই, ভুল হয়েছে। মাফ চাই।’
রুবায়দা মুখ বেকিয়ে আরেক দিক তাকালেন। মিনা ঠোঁট ওল্টালেন শিশুর ন্যায়। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন,
‘ মেয়ের মা হিসেবে না হয় একটু বলেই ফেলেছি। তাই জন্যে…’
পরপর কণ্ঠে দুষ্টুমি এনে বললেন,
‘এখন এই রাগে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন বেয়াইন সাহেবা? ছেলেপক্ষ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? এ কেমন অবিচার বলুন তো!’
চোটপাট আর টিকল না রুবায়দার৷ হেসে ফেললেন। পরপর ভ্রু গুটিয়ে বললেন, ‘ এরকম আর কখনও বলবে?’
মিনা বিশ্রান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ না বাবা, ঘাট হয়েছে আমার! মুখেও আনব না এসব।’
রুবায়দা মিনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ আপা! পিউ আমার কাশ্মিরী আপেলের মত সুন্দরী বউমা। এমন বউমা বিনা পরিশ্রমে পেয়ে আমি তো সৌভাগ্যবতি মনে করছি নিজেকে।’
মিনা মাথা নাঁচিয়ে বললেন,
‘ আর আপনার বাহাদুর ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে আমিও সমান সৌভাগ্যবতী।’
দুজনেই হেসে উঠলেন৷ জবা দেখেই, সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
‘ একী! তোমরা কী নিয়ে হাসছো? আমাকেও বলো, আমিও শুনব।’
পরপর সুমনা ভিড়লেন সেখানে। সব কাজ ফেলে,ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চার জায়ের হাস্যরসের সভা বসল।
বুয়া তখন রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে বললেন,
‘ খালাম্মা! খাওন তো পইছা যাইবে,ফিরিজে রাখলেন না?’
খোশগল্প স্থগিত। মিনা মনে করার ভঙি করে বললেন,
‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ।’
রান্নাঘরে যেতে গেলেই জবা টেনে ধরে বললেন,
‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ নেই। সারাদিন তুমি আর মেজ আপা অনেক খেটেছ! এখন সোজা ঘরে যাবে। বাকীটা আমরা দেখছি।’
‘ আহা,তোরা পারবিনা।’
সুমনা বললেন, ‘ বলে দিলে সব পারব। তুমি দেখিয়ে দিয়ে যাও,আমরা চুটকিতে শেষ করছি।’
বাধ্য হয়ে ওনাদের সবটা বুঝিয়ে দিলেন মিনা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন ভাবলেও,দুজন মিলে দুই জা’কে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলেন ঘরে।
****
ধূসর কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে। হতভম্ব হয়। নীচে মনে মনে খোঁজা বিচ্ছুর দলগুলো সব এখানে হাজির। রীতিমতো দরজার সম্মুখে সাড়ি বেঁধে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসেছে একেকজন। প্রথমে সাদিফ,তারপর ইকবাল,পাশে পুষ্প,মারিয়া,শান্তা, সুপ্তি। হাসাহাসি করছিল কিছু নিয়ে,ওকে দেখেই সবাই তটস্থ হয়ে ফিরল। ইকবাল প্রমোদ কণ্ঠে বলল,
‘ আরেহ! আসুন আসুন ভায়রা ভাই। আপনারই অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলাম।’
ধূসর প্রশ্ন ছুড়ল ‘ তোরা এখানে?’
পুষ্প ছটফটে গলায় জবাব দেয়, ‘ আমরা গেইট ধরেছি।’
সাদিফ বলল, ‘ ভাইয়া, তুমি একই বাড়িতে বিয়ে করে গেইট ধরা,জুতো চুরি, হাত ধোঁয়া, এইসব কিছু থেকে বেচে গিয়েছ। কিন্তু কথায় বলে সবার জন্য আঈন সমান। ইকবাল ভাই যা যা ভুগেছেন,তোমাকেও ভুগতে হবে। আর তাই, আমরা সবাই মিলে, তোমার বাসর গেট ধরেছি। আভি আন্দার যানে মে, প্যায়সা দেনা পারেগা।’
ইকবালের ঠোঁটে হাসি।
ভ্রু উঁচিয়ে উঁচিয়ে বলল,
‘কী শালা সমন্ধি? কেমন লাগছে এখন? ‘
পরপর গুরুতর ভঙিতে বলল, ‘ আমার সময় তুই সাহায্য করিসনি। করলে এখন তোর সাপোর্টে থাকতাম৷ সাদিফ আমাকে বাচিয়েছিল,তাই আমি ওর সাপোর্টে। ‘
দুজন হ্যান্ডশেক করল তারপর। ধূসর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি খুব টায়ার্ড ইকবাল! ভালো লাগছে না এসব। সর।’
পুষ্প আপত্তি জানিয়ে বলল,
‘ না না,এসব বললে তো হবে না। এটা আমাদের অধিকার। টাকা না দিয়ে আপনি যেতে পারবেন না।’
সাদিফ তাল মলিয়ে বলল,’ হ্যাঁ। টাকা না দিলে প্রবেশ নিষিদ্ধ।’
ধূসর কপাল কুঁচকে বলল, ‘ তোরা দুটো না পিউয়ের বড় ভাই-বোন? লজ্জা করছেনা ওর বাসর রাতে গেট ধরছিস?’
পুষ্প-সাদিফ মুখ দেখা-দেখি করল। পরপর দাঁত বের করে সমস্বরে বলল, ‘ একটুও না।’
সাদিফ কাঁধ উঁচিয়ে জানাল,
‘ আমরা পিউকে চিনিইনা? কে ও? কী নাম ওর? আমরাতো তোমাকে চিনি ভাইয়া। তুমি আমাদের বড় ভাই। বড় ভাইয়ের বাসরের গেট ধরা ছোট ভাই বোনদের কর্তব্য। আমি আবার কর্তব্য নিয়ে হেলাফেলা করতে পারিনা।’
ইকবাল বলল,’ আমিও না।’
টাকা আদায়ের এই আন্দোলনে শান্তা আর সুপ্তি নিরব৷ তারা দল ভারি করতে বসলেও টু শব্দ করছেনা। শান্তার ভেতর ভেতর খারাপ লাগছে। কখনও এই লোকটার ওপর মারাত্মক ক্রাশ ছিল ওর। আচ্ছা,সে তো পিউয়ের থেকে অল্প একটু ছোট। উনি চাইলে বিয়েটা তো ওকেও করতে পারতেন।
মারিয়া মুখ খুলল এবার। ধূসরকে বলল,
‘ ভাইয়া থাক,এদের সাথে বার্গেইনিং না করে বিষয়টা মিটিয়ে নাও। দর-কষাকষি তোমার সাথে যায়না।’
তার পামপোট্টিতে ধূসর গলল কী না বোঝা গেল না। বুকে হাত বেঁধে ভ্রু নাঁচিয়ে শুধাল,
‘ তা কত দাবি তোমাদের?’
সবাই এক জোটে হৈচৈ বাধিয়ে জানাল,
‘ ৩৫ হাজার। ‘
পুষ্প হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হিসেব দিলো,
‘ দেখুন ভাইয়া! আমরা মোট ছয়জন। সবাই ছ ‘হাজার করে নিলে ৩৬ হাজার হচ্ছে। আপনাকে তো আমরা অনেক ভালোবাসি, তাই এক হাজার টাকা ডিসকাউন্ট দিচ্ছি। ‘
ধূসর মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ ও আচ্ছা।’
তার নিরুদ্বেগ ভাবভঙ্গি দেখে ইকবাল- সাদিফের কানের কাছে গিয়ে বলল,
‘ আমারা কি কম বলে ফেললাম সাদিফ বাবু?’
সে দ্বিধাদন্দে ভুগে বলল, ‘ পঞ্চাশ চাইলে মনে হয় ভালো হোতো। ‘
ধূসর বিনাবাক্যে পকেটে হাত ভরল। পরপর ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল,
‘ শীট! মানিব্যাগ তো রুমে। নিয়ে বের হইনি। জায়গা দে,গিয়ে নিয়ে আসি।’
ইকবাল ওমনি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ একদম না। গেলে আর আসবিনা তুই৷ ‘
ধূসর ততোধিক শান্ত ভঙিতে বলল, ‘ তাহলে টাকা দেব কোত্থেকে? ‘
সবাই একটু দোটানায় পড়ল। সাদিফ ফিসফিস করে বলল, ‘ আমি গিয়ে নিয়ে আসব?’
ইকবাল তেমন করেই জবাব দিলো,’ দরজা খুললেই যদি দৌড়ে ঢুকে যায়? গায়ে তো মহিষের মতো শক্তি। আমি ধরে রাখতে পারব না।’
সাদিফ চিন্তিত ভঙিতে ঠোঁট কাম*ড়াল। ধূসর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘ যা করবি তাড়াতাড়ি! ‘
ইকবাল দুষ্টুমি করে বলল, ‘ কেন? বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য তর সইছেনা?’
ধূসর মুখের ওপর বলল, ‘ না।’
মারিয়া আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ আরে, ভাইয়া যখন বলছেন, রুম থেকে এনে দেবেন তখন নিশ্চয়ই দেবেন। পৃথিবী উলটে গেলেও কিন্তু ধূসর ভাইয়ার কথা নড়চড় হয়না।’
ইকবাল মনে মনে ভাবল,কথাটা ঠিক।
এদিকে সবাই ওর মুখের দিকেই চেয়ে। দলের সিনিয়ির সদস্য বলে কথা! পুষ্প সন্দেহী কণ্ঠে শুধাল,
‘ সত্যি দেবেন তো ভাইয়া?’
ধূসরের উত্তরের আগে, মারিয়া বলল,
‘ আরে দেবে দেবে। ভাইয়া ওমন না কী! নাও জায়গা ছাড়ো, ওনাকে যেতে দাও।’
তার কণ্ঠে দৃঢ় বিশ্বাস গলেগলে পরছে।
ইকবালও মাথা হেলিয়ে স্বায় দিলো। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার সরিয়ে রাস্তা দিলো ওকে। খুলে দিলো দরজার তালা। ধূসর বক্র হাসল। সবার সামনে দিয়ে টানটান বক্ষে, লম্বা পায়ে ঢুকল রুমে। তারপর পেছন ঘুরে চাইল । সব কটা দরজায় ঝুলে এসেছে প্রায়। ধূসর ঘাড় ডলে, আচমকা ফট করে দরজা লাগিয়ে দেয়। টেনে দেয় ছিটকিনি। ভড়কে গেল ওরা। তব্দা খেয়ে হা করে মুখ দেখা-দেখি করল। তারপরই শুরু করল ধাক্কানো।
পুষ্প আর্তনাদ করে বলল ‘ এ কী! এটা কী হলো?’
সাদিফ বলল,’ ভাইয়া দিস ইজ চিটিং! ‘
ইকবাল বলল, ‘ শালা, সম্বন্ধি,ভায়রা, অসভ্য,চিটিংবাজ। ‘
ধূসর ঠোঁট কামড়ে হাসল। উদ্বেগহীন জানাল,
‘ ধা*ক্কিয়ে লাভ নেই। কাল সকালে দেখা হবে।’
‘ সকালে দেবেন?’ ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ঠিক তো?’
ধূসর বলল, ‘ বিশ্বাস করলে কর,নাহলে দাঁড়িয়ে থাক সারারাত। সকালের আগে দরজা খুলছি না।’
মারিয়ার বড় মুখ এবার ছোট হয়ে গেল। ধূসরের টান টানতে গিয়ে চেহারায় লেপ্টে গিয়েছে অদৃশ্য চুন-কালি। চোর চোর ভাব করে চুপ রইল সে। সাদিফ কটমটে চোখে চেয়ে বলল,
‘ সব আপনার জন্য হয়েছে। ‘
তারপর ওর মত করে বলল,
‘ পৃথিবী উলটে গেলেও ধূসর ভাইয়ার কথার নড়চড় হয়না।’
এবার হলো তো?’
মারিয়া মাথা নুইয়ে বলল, ‘ আমি কী করলাম?’
পুষ্প মন খারাপ করে বলল , ‘ এখন কী হবে? শুধু শুধু আধ ঘণ্টা ধরে বসে ছিলাম।’
ইকবাল তার বিফল চেহারা দেখে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ ডোন্ট বি স্যাড মাই লাভ! হতচ্ছাড়াটা দিন-দিন বাটপার হয়ে যাচ্ছে। যখন বলেছে আজ খুলবেনা,খুলবেইনা।’
পরপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তবে সকালে দেবে বলল যখন, দেবে। ভেবোনা এত। চোর হলেও লোকটা ভালো। কথা একটা বললে রাখে কিন্তু। ‘
‘ তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো যাই, ঘুম পাচ্ছে আমার। শান্তা,সুপ্তি তোরাও ঘুমা গিয়ে।’
ওরা মাথা দোলাল। পুষ্প হাই তুলল। তার কাঁধ পেঁচিয়ে রুমে রওনা করল ইকবাল। শান্তা- সুপ্তি আজ পিউয়ের ঘরে শোবে,সাথে মারিয়াও। সে ওদের পেছনে,পা বাড়াতে গেলেই আচমকা হাতটা টেনে ধরল সাদিফ।
মারিয়া চমকে তাকাল। সাদিফ ভ্রু গুটিয়ে শুধাল,
‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ রু রুমে…’
বলতে বলতে তার নেত্রদ্বয় সতর্ক ভাবে আশপাশ দেখে নেয়।
সাদিফ বলল, ‘ এখন রুমে যেতে হবেনা।’
‘ তা তাহলে?’
সাদিফ দুষ্টু হেসে হুবহু ওকে নকল করে বলল,
‘ তা তাহলে, আমার একটা প্রস্তাব আছে, রাখবেন?’
মারিয়া লজ্জা পেল। নিম্নাষ্ঠ চেপে, আস্তে করে শুধাল,’ কী?’
‘ ছাদে যাব।’
সে ভ্রু কপালে উঠিয়ে বলল,
‘ এত রাতে ছাদে?’
‘ কেন? ভয় লাগছে?’
মারিয়া মুচকি হাসল। নরম কণ্ঠে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ আপনি পাশে থাকলে কীসের ভয়?’
সাদিফের অভিব্যাক্তি বদলায়। বৃহৎ হয় চেহারার ঔজ্জ্বল্য। ওষ্ঠপুটে চকচকে হাসি বহাল রেখে দূর্বোধ্য চোখে চাইল সে। কণ্ঠ নীচু করে বলল,
‘ তাহলে যাওয়া যাক?’
***
সবাই চলে গিয়েছে বুঝতেই শব্দহীন, বিজয়ী হাসল ধূসর। হাঁপ ছাড়ল। শরীরের রগে রগে ক্লান্তি ছুটছে। ভোর পাঁচটায় উঠেছিল,তারপর থেকে বিছানা ছুঁয়েও দ্যাখেনি। মিটিমিটি হাসি ঠোঁটে রেখে পেছন ঘুরল সে। ওমনি স্তব্ধ হলো চক্ষুদ্বয়। স*জোরে তীর এসে বসল ঠিক হৃদপিন্ড বরাবর।
বউ বেশে, এক লাল টুকটুকে অপ্সরী ঘুমোচ্ছে বিছানায়। কী সুখভীর নিদ্রা! কী ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ! সাথে ললিত একটি মুখ। মাথার নীচে রাখা চুড়ি পরা হাতগুলো লাইটের কড়া আলোতে জ্বলছে। দীপ্তি দিচ্ছে নাকের পাথুরে ফুল। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর নেই। নিষ্পাপ মুখখানি এসে যখন সামনে দাঁড়ায়,ধূসর এই জগত ভুলতে সক্ষম। সক্ষম ওই রাঙা ওষ্ঠযূগলের হাসির জন্য,ধরিত্রীর সকল নিয়ম ভা*ঙতে। ধূসর অভিভূতের ন্যায়, নিষ্পলক চেয়ে রইল। নিদ্রিত ওই ছোট্ট মেয়েটা ওর বউ! ওর ভালোবাসা! পার্থিব জগতের মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারীনি, তার হৃদয়হরনী পিউ!
ধূসরের তুষাতুর দুটো নিশ্চল আঁখি একসময় পলক ফেলল। ঠোঁট দুটো সরে গেল দুদিকে। বিস্তর বক্ষপট ওঠানামা করল তুষ্টিতে,তৃপ্তিতে।
আচমকা চোখ মেলল পিউ। তন্দ্রাচ্ছন্ন, নিভু নেত্রযূগল প্রথমেই খুঁজে পেলো একটু দূরে দাঁড়ানো ওই মানুষটিকে। বহু প্রতীক্ষার,অনেক সাধনার,আর ভীষণ ভালোবাসার ধূসর ভাই!
পিউ তড়াক করে উঠে বসল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ভেবেই লজ্জা পেলো,বিস্মিত হলো। কিন্তু ওর কী দোষ? এতক্ষণ কুণ্ঠায় অধীর,অস্থির হয়ে পায়চারি করেছিল! আই -ঢাই করে একবার এদিক থেকে সেদিক গিয়েছে রুমের। ধূসর ভাই আসবেন, তারপরের টুকু ভেবেই তরতরিয়ে ঘেমেছিল। নার্ভাস-নেসে দিশা হারিয়ে বারবার ওয়াশরুম অবধি ছুটেছে। শেষে একটু বিছানায় শরীর ছাড়তেই রাজ্যের ঘুম নামল। এমন ঘুম যে,টেরই পেলোনা কিছু? ওর তো এই খাটের মধ্যমনিতে বসে থাকার কথা। যেমনটা ও কল্পনায় দেখতো। তার মাথায় টানা বড়সড় ঘোমটা স্বযত্নে এসে তুলবেন ধূসর ভাই। ওর নীচু মুখ তুলবেন আঙুলে। কপালে চুমু আঁকবেন ভালোবেসে।
পিউ অনুচিন্তনের রেশ বেশি দূর গড়াতে দেয় না। ধূসর দাঁড়িয়ে আছে দেখেই ব্যস্তভাবে উঠে এগিয়ে যায় কাছে। ওকে আসতে দেখে সে থামল,বাড়ানো কদম পিছিয়ে আনল। পিউ ঝটপট ওর পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুমনা বেগম শিখিয়ে দিয়েছিলেন যাওয়ার সময়।
ধূসরের ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ পড়ল। অবাক হলো খানিক। পিউ সাফাই দেওয়ার ভঙিতে বলল,
‘ আমি একদম ঘুমোতে চাইনি ধূসর ভাই। কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল!’
ধূসরের মন নেই ওতে। সে প্রখর, মনোযোগী চোখে পিউয়ের পা থেকে মাথা অবধি দেখে নেয়। পিউ অতটা লম্বা নয়,ছোটখাটো,আদুরে আনন। কিন্তু শাড়ির ভারে আজ ওকে ছোট তো দূর,পূর্নাঙ্গ নারী লাগছে। যে নারী ধূসরের ব্যক্তিগত,ওর বাম প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে রাখা একান্ত প্রেম।
ধূসর একটু এগোয়। পিউয়ের ক্ষুদ্র মুখবিবরটা তুলে নেয় অমসৃণ অঞ্জলিপুটে৷
বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দেয় নাকের পাথরের ওপর৷ তাকে চুপ দেখে পিউ ফের বলতে গেল,
‘ আপনি কি রাগ করে….’
সহসা একটা আঙুল লিপস্টিক পরিহিত ঠোঁটে চেপে ধরল ধূসর। থামল পিউ।
ধূসর হ্যাঁ -না কিচ্ছু বলল না। একটা টু শব্দও এলো না বাইরে। আচমকা, চট করে ওকে কোলে তুলে ফেলল। পিউ চমকে গেল। কিছু বোঝার আগেই মাথা এসে ঠেকল তুলতুলে বালিশে। ধূসর গায়ের ওপর আধশোয়া হতেই গাত্রের রক্ত ছোটাছুটি তৎপর থেমে গেল তার।
কী হবে! কী হতে পারে! ভাবতেই কাঁটার মতন শক্ত হয়ে গেল লজ্জায়। ফেরত এলো চিরচেনা সেই কম্পন,সেই হাত পায়ের টাল-মাটাল তান্ডব।
তার-ওপর ধূসরের দুটো নেশাল চোখ। তীরের মত চাউনী, মদ্যক অক্ষিপট। এসব পিউকে সুস্থ থাকতে দিলো না। পেটানো শরীরের নীচে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সে। কণ্ঠস্বরে ভূমিকম্প নামিয়ে বলতে যায়,
‘ আমি..একটু মানে..’
ধূসর কথা সম্পূর্ন করতে দিলো না। ওর গরম ওষ্ঠপুট কানের পাশে যেতেই আপনা-আপনি মুখ বন্ধ হয়ে গেল পিউয়ের। শুনতে পেলো একটি ফিসফিসে কণ্ঠ,
‘ এই রাত আমার,বলেছিলাম না? আজ তুই কাঁপলেও ধূসরের,না কাঁপলেও ধূসরের। ‘
বলতে বলতে ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে গেল ওই রক্তাভ গাল। পিউ লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠল। একে একে কপাল,চোখের পাতা,নাকের ডগা সমস্ত কিছু সিক্ত হয় ধূসরের চুম্বনে। পিউ চোখ দুটো খিঁচে নিলো তখন, যখন মানুষটার উষ্ণ অধর ঘূর্নিঝড় বইয়ে দিলো তার গলার ভাঁজে। এতটা অস্থির,অশান্ত ধূসর কখনও হয়নি,কখনও না।
পিউ একটা সময় সয়ে নিলো। বিলম্ব হলেও আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের কাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায় ধাতস্থ করল নিজেকে। তিন বছর ধরে, তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় অপেক্ষা করা মানুষটার নিকট সহাস্যে সমর্পণ করল নিজেকে। তার দুটো শীর্ণ হাত, আকড়ে ধরল ধূসরের উন্মুক্ত, চওড়া, শ্যামলা পিঠ। রাত্রির তিন প্রহরে রচিত হলো তাদের ভালোবাসার বিস্তর রচনা,নতুন সূচনা।
চলবে।