#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_১২
#Saji_Afroz
.
.
.
দুপুরে খাবারের পর রান্নাঘরে থালাবাসন ধোয়া ও গুছিয়ে রাখার কাজ করছে সায়নী, মুনিরা।
মুনিরা হঠাৎ সায়নীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো-
মেহেনুবা মেয়েটা বেশি সুন্দরী। শুধু সুন্দর না, আদব কায়দায় দিকেও সেরা। দেখেছো আপু আমেরিকা থাকে তাও আমাদের দেখার সাথে সাথেই পায়ে ধরে সালাম করলো।
-হুম।
-তাসুর মাঝে যদিও বিদেশিদের মতো ভাব আছে তবে অন্তর পরিষ্কার। মেহেনুবাকে সালাম করতে দেখে সেও এসে করেছে। দুইটা মেয়েই সেরা। তাইনা?
-হ্যাঁ।
-না জানি উপমা টা কেমন হয়।
.
মুনিরার কপালে চিন্তার ভাজ দেখতে পেলো সায়নী।
মৃদু হেসে সে বললো-
আরাফের পছন্দ সে। নিশ্চয় ভালো হবে। তোর মন মেহেনুবা বা তাসুর দিকে পড়ে আছে। তাই তো হাবিজাবি ভাবছিস তুই।
-সব ভালো হবে তো আপু? আমাদের একমাত্র ছেলে আরাফ….
-সব ভালো হবে। ভরসা রাখ।
.
.
.
ঘরে প্রবেশ করেই তাসুকে খুঁজতে খুঁজতে আরাফের পাশের রুমে পেয়ে গেলো মেহেনুবা।
মেহেনুবা কে দেখেই তাসু বলে উঠলো-
আতিক ভাইয়াকে কেমন লেগেছে?
-সবার ভালো লেগেছে যখন আমার আর কি বলার আছে।
-মানে কি! আব্বু বাংলাদেশী ছেলে চায় তার মেয়েদের জন্য। তুই রাজীও হয়েছিস তার ডিসিশন এ। কিন্তু যে ছেলে বলবে তাকেই বিয়ে করতে হবে বলে কথা নেই আপু। আমি তো আমার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। আমেরিকায় সেটেল আছে এমন কাউকে। তুইও আতিক কে ভালো না লাগলে বলে দে।
.
তাসুর কথা শুনে চোখ জোড়া বড়বড় করে মেহেনুবা বললো-
মানেটা কি! তাহলে আরাফ?
-হোয়াট আরাফ?
-তুই না আরাফকে পছন্দ করিস?
-হুম করি। তো? ওয়েট ওয়েট আপু। তুই কি আরাফকে আমি লাভ করি ভেবেছিস? সিরিয়াসলি?
-করিস না? না মানে আরাফের জীবনে স্পেশাল কেউ থাকলে তুই কষ্ট পাবিনা?
-নো! হি ইজ মাই ক্রাশ আপু। আরে সালমান, সিয়াম, জাস্টিন ওদের উপরেও আমি ক্রাশ খাই। তাই বলে কি সবাইকে ভালোবাসি?
-তবে যে তুই বলতি, আরাফ এমন একটা ছেলে যে কেউ তার প্রেমে পড়বে?
-হু পড়বে। তাই বলে প্রেম করতে হবে কথা আছে নাকি! আসলে আমার প্রেম ট্রেমে ইন্টারেস্ট নেই। ফ্লাট করতেই ভালো লাগে।
বাই দ্যা ওয়ে এসব কেনো আস্ক করছিস তুই?
-না এমনিতেই।
.
.
আরাফ কে তাসু ভালোবাসেনা শুনে মনের ভেতর শান্তি অনুভব করছে মেহেনুবা।
কিন্তু কেনো!
নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে মেহেনুবা এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে ফ্রেশ হবার জন্য।
.
.
.
ঝামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে আরাফ।
উপমার চিন্তায় অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে তার।
ফ্যানের নিচে বিছানার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে।
ফুল স্পীডে ফ্যান চললেও ঘেমে চলেছে আরাফ।
উপমার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে সে।
তবে কি খারাপ কিছু হলো!
ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো আরাফের।
এক লাফে বসে পড়ে বিছানার পাশ থেকে মোবাইল টা হাতড়িয়ে নিলো সে।
উপমার কল দেখে এক সেকেন্ডও দেরী না করে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো উপ? ঠিক আছে সব?
-আম্মু আব্বু তোমাকে এখুনি বাসায় আসতে বলেছে।
-কেনো?
-কথা বলার জন্য। আসবে তুমি?
-কেনো নয়! নিশ্চয় আসবো।
উনারা কি মেনে নিয়েছে আমাদের সম্পর্ক?
-এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।
-বাসায় জানলো কিভাবে?
-তোমার আমার একটা ছবি বের করে দেখছিলাম। কখন যে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল ছিলোনা। মা আমার রুমে এসে দেখে ফেলেছে।
-ভালোবাসো বেশি, তাইনা?
-এক বছরেও বুঝোনি?
-হু। তুমি অপেক্ষা করো। আমি এখুনি আসছি।
-সব ঠিক হবে তো?
-হবে।
.
.
আরাফ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে লাগলো ঘর ছেড়ে।
আচমকা সায়নী ডাক দিয়ে বললো-
কোথায় যাচ্ছিস? মাত্রই তো বাসায় এলি।
.
সায়নীর ডাকে থেমে গেলো আরাফ। তার পাশে এসে বললো-
উপমার বাসায় সবটা জেনে গিয়েছে আমাদের ব্যাপারে। আমার বাসায় যেভাবে সম্পর্ক টা মেনে নিয়েছো তোমরা, তারাও মেনে নিবে তো?
.
ছেলেকে শান্তনা দিয়ে সায়নী বললো-
কেনো মানবে না! নিশ্চয় মানবে। কিন্তু তুই ওখানে যাচ্ছিস কেনো?
-ডেকেছে আমাকে।
-আমি যাই তোর সাথে?
-আগে আমি গিয়ে কথা বলি।
-কিন্তু…
-ছোট আম্মুকে জানিও। আমি আসি এখন।
.
কথাটি বলেই আরাফ এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।
সায়নীও এগিয়ে গেলো মুনিরার রুমের দিকে। তাকে সবটা জানানো প্রয়োজন।
.
.
.
চেম্বারে বসে আছে আতিক।
রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো কিন্তু মনটা মেহেনুবাতেই আটকে আছে তার।
মেহেনুবা শুধু সুন্দরী নয়, অতি ভদ্রও।
আজ আতিকের নিজের উপর গর্ব হচ্ছে সে ডাক্তার বলে। যদি ডাক্তার না হতো, তবে কি মেহেনুবা কে পেতো!
উহু, এখনো পায়নি। তবে পাবে খুব তাড়াতাড়ি।
আপনমনে এসব ভেবে হেসে চলেছে আতিক।
.
.
.
আফরান মাত্রই পাবেলের সাথে আড্ডা শেষ করে শুতে এসেছে।
এরইমাঝে মুনিরাও তার পিছুপিছু এসেছে।
আফরান তাকে দেখে বললো-
মনে হচ্ছে কিছু বলবে আমাকে?
-আপনি রাগ করবেন না বলেন?
-আগে শুনি?
-ইয়ে মানে সায়নী আপুই আমাকে বলতে পাঠিয়েছে।
.
মৃদু হেসে আফরান, বললো-
ঘটনা কি?
-আমাদের আরাফ, উপমা নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসে।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে আফরান বললো-
সত্যি?
-হুম।
-কে বলেছে? আর মেয়ে কি করে?
.
মুনিরার মুখে সবটা শুনে আফরান বললো-
ভালোই হলো আমাদের জানিয়েছে। আমার মতো ভালোবাসার কথা চেপে রাখেনি।
-হু। তো আফরান সাহেব, এবার শ্বশুড় হবার প্রস্তুতি নাও। দুঃখিত শ্বশুড় হবার প্রস্তুতি নেন।
.
আফরান হেসে বললো-
তুমি করে বললেই পারো।
-নাহ। ছোট থেকে ইচ্ছে, নিজের স্বামীকে আপনি করেই বলবো। আমাদের গ্রামের মেয়েরা এমনি বলে।
-আচ্ছা! তোমারাও শ্বাশুড়ী হবার প্রস্তুতি নাও। তবে বিয়ের আগে আরাফকে ব্যবসার কাজে হাত লাগাতে হবে। যাকে তাকে বেকার বলতে না পারে।
-হ্যাঁ। ও আসার পরেই কথা বলিয়েন ওর সাথে। আজ তো উপমার বাসায় কথা বলে আসবে। আমাদের কষ্ট কমে গেলো তাইনা?
-হু।
-আচ্ছা আমি যাই। সায়নী আপুদের সাথে আড্ডা দিবো।
.
.
ছেলের জন্য ভীষিণ খুশি আফরান। সে যে ভুলটা করেছিলো তার ছেলে অন্তত এই ভুল করলোনা ভেবে ভালোই লাগছে তার।
.
.
.
উপমার বাবা ফখরুল মোবারক ও মা রুপা আক্তার এর সামনে বসে আছে আরাফ।
উপমাকে দেখা যাচ্ছেনা।
সে হয়তো আড়াল থেকেই তাকে দেখছে।
ফখরুল মোবারক হালকা কেশে বলে উঠলেন-
নাম কি?
-আরাফ খান।
-বাহ! খান বংশের ছেলে।
-জ্বী।
-কি করো?
-সবে মাত্র বুয়েট পাস করলাম। কিছুদিন পর বাবার বিজনেস এ জয়েন করবো।
-ফ্যামিলি বিজনেস?
-জ্বী।
-মা কি করে?
-গৃহিনী। তবে বড় আম্মু প্রায় ১৬বছর শিক্ষকতা করেছেন সরকারী কলেজে।
-তোমার বড় আম্মুর কথা শুনে লাভ নেই। তা বাসায় জানে উপমার কথা?
-বড় আম্মু আর ছোট আম্মু জানে।
.
রুপা আক্তার ভ্রু জোড়া কুচকে বললেন-
কি বড় আম্মু, ছোট আম্মু লাগাইছো! নিজের মায়ের কথা বলো?
-আমি তাদের কথায় বলছি।
-মানে কি! তোমার চাচীরাই তোমার অভিবাবক? মা নাই তোমার?
-মা আছেন। দুইজন মা আছেন আমার। তাই তো বলছি বড় আম্মু, ছোট আম্মু।
-মানে সতীন?
.
সতীন কথাটা শুনতে কেনো যেনো ভালো লাগেনা আরাফের। তাও সে মাথা নেড়ে সাই দিলো।
.
রুপা আক্তার আরো জিজ্ঞাসা করলেন-
এক সাথে থাকে?
-জ্বী।
.
রাগে গিজগিজ করে রুপা আক্তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন-
দেখেছো আমি বলেছিলাম না? আমার মেয়ে সহজ সরল। এই ছেলেই আমার মেয়েকে পটাইছে। আরে আমার মেয়ের জন্য কতো ছেলে পাগল। আর সে কিনা এমন একটা ঘরে যেতে চায় যে ঘরে দুইটা শ্বাশুড়ী আছে! এরা তো জ্বালায় খাবে আমার মেয়ে কে।
-আমার আম্মুরা এমন নয় আন্টি। তারা খুব ভালো মনের মানুষ।
-তবে খুবই নোংরা মনের মানুষ।
.
ফখরুল মোবারকের মুখে কথাটি শুনে যেনো থমকে গেলো আরাফ।
ফখরুল মোবারক আরো বললেন-
যে ছেলের বাবা দুইটা বিয়ে করে দুই বউ কেই এক ছাদের নিচে রাখতে পারে সে ছেলে কেমন হবে আমার জানা আছে। হাজার হোক, বাবার রক্তই তো শরীরে বইছে তোমার। তুমিও যে পরে আরেকটা বিয়ে করবেনা এর গ্যারান্টি কি?
.
নিজের রাগ সংযত করে আরাফ বললো-
আঙ্কেল আমার আব্বু পরিস্থিতির স্বীকার ছিলেন। কিন্তু পরে আমার আব্বু দুই বউকেই সমান অধিকার দেন৷ কাউকে ছাড়েন নি বা কাউকে কষ্ট পেতে দেননি৷ এইরকম কতোজন পারে? অন্য কেউ হলে একজনের সাথে অন্যায় করতো।
-কিন্তু তোমার মায়েরা আসলেই সুখে আছে তো? নাকি তোমার বাবার ভোগবিলাসীর বস্তু তারা শুধু? আর তোমার মায়েরা বোধহয় বাজে ফ্যামিলির মেয়ে। নাহলে কিভাবে মানলো এসব!
.
এপর্যায়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো আরাফ-
যেটা জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলবেন না প্লিজ।
.
ফখরুল মোবারক দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন-
তোমার সাহস তো কম না? আমার বাসায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে এভাবে কথা বলছো তুমি।
অবশ্য বলবে নাই বা কেনো! যেমন ফ্যামিলির ছেলে তেমনি বেয়াদব হবার কথা।
.
আরাফও দাঁড়িয়ে বললো-
আঙ্কেল আপনি আমাকে নিয়ে যা খুশি বলুন। ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলবেন না প্লিজ।
-একশো বার বলবো, হাজার বার বলবো। যেটা সত্যি সেটাই বলবো। কি করবে তুমি?
আরে যাকে জিজ্ঞাসা করবে সেই বলবে তোমার ফ্যামিলি কতোটা নোংরা।
-আঙ্কেল অতিরিক্ত বলছেন আপনি৷ আমার ধৈর্য্যের সীমা পার হলে কিন্তু…
.
কথাটি বলেই থেমে গেলো আরাফ।
উপমা এসে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-
কি করবে তুমি ধৈর্য্যের সীমা পার হলে? হাত তুলবে?
.
আরাফ উপমার কাছে এসে বললো-
উপমা আমি এমনটা বুঝাইনি।
.
ছলছল চোখে তাকিয়ে উপমা বললো-
তাহলে কেমন টা বুঝিয়েছো?
-তুমি সবটা শুনোনি উপমা।
-আমি সবটাই শুনেছি। যাই খুশি বলুক না আব্বু, শুনে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো?আব্বু তো ভুল কিছু বলছেন না৷ তাহলে হজম করতে অসুবিধে কিসের?
.
উপমার কথা শুনে যেনো আরাফ বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
চোখের কোণায় পানি চলে এলো আরাফের।
হাতের আঙুল দিয়ে মুছে উপমার উদ্দেশ্যে বললো-
ভুল বলেনি আঙ্কলে? আমার আব্বু, আম্মুদের নিয়ে এসব বাজে কথা আমাকে সহ্য করতে হবে?
-তুমি যদি আমাকে ভালোবাসতে তাহলে তাই করতে।
-আমার পরিবার আমার কাছে আগে নয় কি উপমা?
-ওহ তাই! পরিবার আগে তোমার কাছে? তাহলে এখানে কি করছো? যাওনা ওই দুই সতীনের আঁচলে মুখ লুকিয়ে রাখো। একটা বাবার পছন্দে আর দুইটা দুই মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নাও।
.
পেছন থেকে রুপা আক্তার বললেন-
বাবা দুইটা করছে, ছেলে তিনটা করলে সমস্যা কি!
.
আরাফ শান্ত গলায় উপমার দিকে তাকিয়ে বললো-
তোমার মা বাবার নামে কেউ উল্টো পালটা কথা বললে সহ্য করতে তুমি?
-না।
-তাহলে আমি কি করে করবো?
-কারণ এসব মোটেও উলটো পালটা কথা ছিলোনা। তাই তোমার করা উচিত ছিলো। তুমি আমার জন্য তোমার থার্ড ক্লাস বাবা মায়েদের নামে দুইটা খারাপ কথা শুনতে পারছো না। যদিও এসব সত্য কথা। তাহলে ফিউচারে কি করবে বোঝায় যাচ্ছে।
.
উপমার কথাটি শুনে নিজের রাগ আর সংযত করতে পারলোনা আরাফ।
কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো তার বাম গালে।
আরাফের এমন কান্ডে
উপমা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
আর তার বাবা এসে আরাফের কলার ধরে বললো-
তোর এতোবড় সাহস তুই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছিস? তুই জানিস আমি কে?
.
রুপা আক্তার এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নিলেন আরাফকে স্বামীর কাছ থেকে।
আরাফের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন-
আর কোনো ঝামেলা হবার আগেই এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে। নাহলে আমি আর উনাকে আটকাবো না।
.
.
.
মিশিকাদের আগমণে পুরো বাড়ি গমগম করলেও আরাফের অনুপস্থিতিতে সায়নী ও মুনিরার মনটা অস্থির হয়ে আছে।
সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এখনো আরাফ এলোনা। কারো ফোনও রিসিভ করছেনা সে।
সব ঠিক আছে তো!
.
(চলবে)