বৈধ সম্পর্ক সিজন ২ পর্ব ১৩

#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_১৩
#Saji_Afroz
.
.
.
ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষকে উপেক্ষা করে, তাদের নজরের আড়ালে আরাফ সোজা এগিয়ে গেলো উপরের দিকে।
তবে সায়নী ও মুনিরার নজর এড়ালো না। তার এমন আচরণ দেখে সায়নী ও মুনিরার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।
মুনিরাকে ইশারায় সায়নী তার সাথে উপরে যেতে বললো।
দুজনেই একসাথে পা বাড়ালো আরাফের রুমের দিকে।
.
.
মেঝেতে বসে আছে আরাফ।
সারা শরীরে ঘাম, চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।
আরাফকে এমন অবস্থায় দেখে মায়েদের মনটা ধুক করে উঠলো।
দুজনিই তার পাশে এসে বসলো।
সায়নী শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো-
কিছু হয়েছে?
.
চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে আরাফ। তা দেখে মুনিরা বললো-
মেয়ের বাসায় কি মেনে নেয়নি?
.
আরাফের কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে সায়নী বললো-
তাতে কি হয়েছে! উপমা ঠিক থাকলেই হলো। আমরা এক কাপড়েও ঘরের বউ করে আনতে রাজি। শুধু তোরা ভালো থাকলেই হলো।
.
ছেলে হয়েও তার খুব করে কান্না আসছে।
তার মায়েরা কতো ভালো! আর উপমা কিনা তাদের নামেই যা তা বলেছে!
নিজেকে সামলিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে আরাফ বললো-
উপমা কে আমি ভুলে যাবো। সে তোমাদের পুত্র বধু হবার যোগ্য নয়।
.
কথাটি শুনতেই সায়নী ও মুনিরা একসাথেই বলে উঠলো-
মানে টা কি? হয়েছে কি খুলে বল?
.
ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আরাফ।
আফজাল খানের মৃত্যুর সময় প্রথম আরাফকে কাঁদতে দেখেছিলো তারা। আর আজকে আবার দেখছে। তাহলে নিশ্চয় এমন কিছু হয়েছে যা সহ্য ক্ষমতার বাইরে ছিলো।
সায়নী ও মুনিরার দুজনেই আরাফকে বাধ্য করলো সত্য বলার জন্য। সবটা শোনার পরে দুজনেই যেনো থমকে গেলো।
এক জন চেয়ে রইলো আরেকজনের মুখের দিকে।
তাদের অতীতের জন্য তাদের ছেলের ভালোবাসা টা হেরে গেলো!
.
.
আড়াল থেকে সবটা শুনে মেহেনুবার চোখেও অশ্রু চলে এলো।
এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো সে।
দরজা খোলা থাকাই আরাফের অশ্রুসিক্ত মুখটা তার চোখে পড়লো।
তাকে এমন অবস্থায় দেখে না চাইতেও কি হয়েছে তা জানার জন্যই আড়াল থেকে সবটা শুনেছে সে।
আরাফের কষ্টে যেনো সেও কষ্ট অনুভব করছে।
উপমা আরাফকে বুঝলো না। বুঝলোনা এই পরিবার কে। হয়তো একদিন বুঝবে। সেদিন কি তার এই ব্যবহারের জন্য আরাফ তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে!
.
.
.
নিজের রুমে বসে আছে উপমা।
আরাফ তার গায়ে হাত তুলেছে! এটা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেনা সে।
রুপা আক্তার এসে উপমার উদ্দেশ্যে বললেন-
যে ছেলে বিয়ের আগেই তোর গায়ে হাত তুলতে পেরেছে সে ছেলে বিয়ের পরে কি করবে ভেবে দেখেছিস?
.
নিশ্চুপ হয়ে আছে উপমা। তার পাশে বসে রুপা আক্তার বললেন-
পুরো দুনিয়া ওই ফ্যামিলির নামে এসব কথা বলে। তবে আমাদের মুখে কেনো সে এসব শুনে সহ্য করতে পারলো না! আসলে সে তোকে ভালোই বাসেনা। বাসলে চুপচাপ সব সহ্য করে বসে থাকতো। না সে তা করলো না। তর্ক করলো তোর বাবার সাথে। তুই বুঝাতে এসেছিস আর তোর গায়ে হাত তুললো। দেখেছিস? তোর আব্বুই কিন্তু এর প্রতিবাদ করেছে। ওই ছেলের ঘরে এমন কিছু হলে দুই মা মিলে তাল দিতো আরো। ভালোই ভালোই ওই ছেলের আসল রূপ চলে আসলো সামনে।
.
রুপা আক্তার খেয়াল করলেন উপমার হাতের মুঠোয় আরাফ ও তার ছবিটা।
উপমার হাত থেকে রুপা আক্তার ছবিটা নিয়ে ছীড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন-
তোর জন্য ছেলের অভাব নেই। ভুলে যা এই ছেলেকে।
.
মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো উপমা।
কাঁদতে কাঁদতেই বললো-
আরাফ এমন হবে আমি ভাবিনি আম্মু। ভেবেছি আমার জন্য সে সব করতে পারবে।
-ভুলে যা মা ওকে। ওদের বাসায় দুই বিয়ে প্রাধান্য দেয় দেখছিস ই তো। তোর পরে আরো কয়েকটা বিয়ে করলেও কেউ কিছু বলবেনা। কষ্ট পাবি শুধু তুই।
.
.
.
সায়নীর মুখে সবটা শোনার পর আফরান বুকের ভেতরে অন্য রকম কষ্ট অনুভব করছে।
তার ভুলের জন্য তার ছেলের সাথে এসব হলো।
কি করে সমাজ কে বোঝাবে আফরান! পরিস্থিতি যে বড় অসহায়। তার জীবনে যা ঘটেছে আরাফের জীবনে তা ঘটার নয়। কেননা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবার হয়না।
আরাফ কে সেই চাপে তারা পড়তেই দিবেনা যার ফলে সে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগবে।
শুধুমাত্র তার ভুলের জন্য নিজের ছেলের জীবনে এভাবে প্রভাব পড়বে ভাবেনি আফরান।
সবার জীবনের কাহিনী তো এক হয়না। এটা কেনো সমাজ বুঝেনা! কেনো মা বাবার জন্য তাদের সন্তানদের কথা শুনতে হবে!
সারারুমে পায়চারী করছে আফরান।
দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললো-
বাবা? তুমি তো সব জানো। কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আমার জীবনে দুইজন নারী এসেছে।
আজ এটার জন্যই আমার ছেলে তার ভালোবাসা হারাতে বসেছে।
আজ আমার প্রচুর আফসোস হচ্ছে। কেনো জীবনে এতো ভুল করলাম! যার খেসারত আমার ছেলেকে দিতে হচ্ছে!
.
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে মেহেনুবা।
তাসু এসে বললো-
আরাফ ছেলেটার দরজা বন্ধ সেই কখন থেকে। ঘরে মেহমান আছে সেই খেয়াল নেই তার।
.
তাসু খেয়াল করলো মেহেনুবার চোখে পানি। সে বললো-
আপু তুই কাঁদছিস কেনো?
.
আসলেই তো! সে কাঁদছে কেনো! তার নিজেরই অজানা।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে তাসু বললো-
তোকে আতিক ভাইয়া কিছু বলেছে?
-উহু।
-তাহলে তাকে তোর পছন্দ হয়নি?
-এসব কিছু না তাসু। ভালো লাগছেনা। একটু একা থাকতে দে আমাকে।
-সেটা তো দিতে পারিনা মাই ডিয়ার আপ্পি। আচ্ছা তুই কান্না কর। আমি তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।
-কেনো?
-বারেহ! আমার আপুকে এভাবে আমি একা রেখে যেতে পারিনা।
.
আচমকা তাসুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো মেহেনুবা।
তাসু তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-
বুঝেছি। সামনে বিয়ে বলে মন খারাপ হচ্ছে তোর?
-উহু! কেনো কাঁদছি নিজেও জানিনা। তবে কাঁদতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
.
বোনের মুখে কথাটি শুনে ফিক করে হেসে দিলো তাসু।
হাসতে হাসতেই বললো-
ওলে বাবালে…
আচ্ছা কাঁদ কাঁদ।
.
.
.
সায়নী রান্নাঘরের এক কোণায় পিড়ি পেতে বসে আছে।
এই খানে দরকার ছাড়া কেউ আসেনা। বাড়িতে মেহমান থাকার সময়ে এই জায়গা টাই মনেহয় একা থাকার জন্য সেরা।
কিন্তু মুনিরা কি তাকে একা থাকতে দিবে! দুজনের মনেই তো একই ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
মুনিরাও তার পাশে এসে বসলো।
শান্ত গলায় বললো-
আমার মনে যা চলছে তোমার মনেও তা চলছে তাইনা আপু?
-হুম। আরাফ হবার পরেই যদি আমি চলে যেতাম তোদের মাঝ থেকে, তাহলে এমন দিন দেখতে হতোনা।
-ওহ তাই! তোমার কি মনেহয়? তুমি যেতে চাইলেই উনি যেতে দিতো তোমাকে? পাগলের মতো ভালোবাসেন উনি তোমাকে। মাঝখানে তো আমিই এসেছি। আমারি উচিত ছিলো চলে যাওয়া। আরাফকে তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাওয়া।
-ও বুঝি তোকেও যেতে দিতো!
.
দুজনেই চুপ হয়ে গেলো।
শান্ত গলায় সায়নী বললো-
আমাদের জীবনে যা ঘটেছে সবটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা এক সুতোয় বেধে গিয়েছি। তবে সমাজ এটা মানবে না আমাদের অজানা ছিলোনা। এতোদিন তো দেখে এসেছিই। কিন্তু আরাফের জীবনে যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে আমার জানা ছিলোনা। ভাবিই নি কখনো এমন।
-আমিও ভাবিনি আপু। আর কেমন মেয়ে এই উপমা টা!
আরাফ কে সে ভালোই বাসেনা। বাসলে তাকে বুঝতো সে।
-আমার মনেহয় মেয়েটার মনে একটা ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে। যেটা আমরা ভাঙাতে পারি। সে আরাফ কে ভালোবাসে। তাই আমার বিশ্বাস মাথা ঠান্ডা হলেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে সে।
-কিন্তু…
-না মুনিরা। এবার আর কোনো ভুল হবেনা। প্রতিটা পদক্ষেপ নিতে হবে ভেবে ভেবে। আমরা যাবো উপমার কাছে। তাকে বোঝাবো। আমাদের ভুলের শাস্তি আরাফকে দিতে বারণ করবো। সে সুখে থাকবে তার গ্যারান্টি দিবো।
-মানবে উপমা?
-সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু আরাফের জন্য এটা আমাদের করতেই হবে।
.
কথাটি বলেই সায়নী দাঁড়িয়ে পড়লো।
মুনিরা জিজ্ঞাসা করলো-
এখুনি যাবে?
-ঠিকানা নিতে যাচ্ছি রুমানার কাছ থেকে। আরাফ নিশ্চয় এখন উপমার ঠিকানা আমাদের দিবেনা।
-হুম।
.
.
.
সায়নীর মুখে সবটা শুনে রাগে গিজগিজ করে রুমানা বলে উঠলো-
এই উপমা মেয়েটাকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগতো না। কতো বুঝিয়েছিলাম আরাফ ভাইকে। এতো মাথায় তুলিস না এই মেয়েকে। হলো তো এখন!
-বাদ দে। আমাকে ঠিকানা টা দে উপমার।
-ওখানে যাওয়া টা ঠিক হবে? না মানে এতো কিছুর পরে কি দরকার! বাদ দাও। আমাদের আরাফ ভাই এর জন্যও ভালো মেয়ের অভাব হবেনা। দেখিয়ে দাও তাদের।
-কিন্তু আরাফ যে উপমা কেই ভালোবাসে।
.
কথাটি শুনে শান্ত ভঙ্গিতে রুমানা বললো-
দিলে তো ইমোশনাল করে আমাকে! নিজেও ভালোবেসেছি তাই ভালোবাসা কি জিনিস বুঝি আমি। ঠিক আছে আমি দিচ্ছি ঠিকানা।
.
.
-সায়নী কোথায়?
.
মিশিকার মুখে প্রশ্নটি শুনে মুনিরা বললো-
পাশের বাসায় গিয়েছে। চলে আসবে।
-তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সব ঠিক আছে?
-হ্যাঁ আপু আছে।
-তোমাদের দেখলে অবাক হয়ে যাই আমি। কি সুন্দর মিলেমিশে থাকছো দুজনে এতো বছর।
-এটাই তো আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
-মানে?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুনিরা বললো-
কিছুনা। বসো। তোমাদের কথা বলো।
.
.
.
সকাল সকাল সায়নী ও মুনিরাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মিশিকা ডাক দিলো।
মিশিকার ডাকে দাড়িয়ে পড়লো তারা।
মিশিকা বললো-
আমাদের জোর করে রেখে কোথাও যাওয়া হচ্ছে এতো সকালে?
.
সায়নী জবাব দিলো-
এখুনি চলে আসবো। দোকানে তোদের জন্য নাস্তা কাল রাতেই অর্ডার করে রেখেছি।
-ওই! নাস্তা সে আমি বানিয়ে খেতে পারি। তোরা কই যাচ্ছিস?
-এসে বলি?
-কোনো সমস্যা?
.
মৃদু হেসে সায়নী বললো-
নাহ।
আসিরে।
.
.
সায়নী ও মুনিরার উপমার কাছে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক, উপমার ভুল ধারনা ভাঙাতে হবে তাদের। আরাফ যে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটিকে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here