চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ২৫

0
560

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ২৫

🍂🍂🍂

ক্যাফেতে ঢুকেই ব্যস্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে মাহতাবকে খুজেছে শুভ্রতা। মা, বন্ধুবান্ধব সবার থেকেই লুকিয়ে এসেছে সে। ধরা পড়লে কি জবাব দিবে তার জানা নেই। এক কোণের টেবিলে মাহতাবকে দেখতেই সেদিকে পা বাড়ালো শুভ্রতা। শুভ্রতাকে দেখতেই মাহতাব উঠে দাড়ালো। ঠোঁট এলিয়ে হাসলে শুভ্রতাও বিনিময়ে হাসলো। সে ঠোঁট কামড়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে ব্যস্ত। সামনা সামনি চেয়ার টেনে বসতেই মাহতাব বললো,

~কি খাবে? কফি?

শুভ্রতা মাহতাব এর দিকে তাকালো। মাথা নেড়ে বললো,

~কিছু না। বাড়িতে বলে আসিনি। নুর, তিলো কাউকেই জানাইনি।

মাহতাব পাশ থেকে একটা ফাইল নিয়ে শুভ্রতার কাছে এগিয়ে দিতেই শুভ্রতা ফাইলটার দিকে তাকালো। মনটা কেমন কু ডাকছে তার। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে কাপাকাপা হাতে ফাইলটা নিতে নিলেই মাহতাব হাত পিছিয়ে নিলো। শুভ্রতা প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকাতেই মাহতাব প্রশ্ন করলো,

~এই ফাইলে যা আছে সব সত্য। তুমি কি বিশ্বাস করো?
~বিশ্বাস না থাকলে কাজটা অবশ্যই আপনাকে দিতাম না ভাইয়া।

শুভ্রতার নিঃসংকোচ জবাব। সে হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিয়ে নিলো মাহতাবের হাত থেকে। এসি চালু থাকলেও অসম্ভব রকম ঘামছে সে। মন সায় দিচ্ছে না ফাইলটা খুলে দেখতে। যা ভাবছে যদি তাই সত্যি হয়? মনে মনেই নিজেকে ধিক্কার জানালো শুভ্রতা। আন্দাজে কিছু ভেবে কষ্ট পাওয়ার মতো মেয়ে সে নয়। সব জেনে বুঝে তবেই রিয়েক্ট করে সে। তাই তো আজ এখানে আসা। সাহস যোগিয়ে ফাইলটা খুলতে নিতেই মাহতাব বাঁধা দিলো।

~ভার্সিটি থেকে সোজা এখানে এসেছো মনে হচ্ছে? বাসায় গিয়ে আগে রেস্ট নাও। পরে দেখে নিও…

শুভ্রতা সন্দিহান চোখে তাকালো,

~এখন দেখলে কি সমস্যা?

মাহতাব নড়ে চড়ে বসলো। চোখে মুখে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। শুভ্রতার উৎসুক চাহনী। উত্তরের আশায় এখনও মাহতাবের দিকেই দৃষ্টি স্থির। মাহতাব কি জবাব দিবে ভেবে পায় না। চুপ করে বসে থাকে। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাইল হাতে উঠে দাড়ায়। মুখে হাসি ফুটিয়ে ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু এবার মাহতাব হাসলো না। শুভ্রতাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাইলে সে রাজি হলো না। নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে আজ। নিজ গাড়িতেই ফিরে এলো।
__________________________________

বাড়ি এসেই ঘুম দিয়েছে শুভ্রতা। অধৈর্য হয়ে গাড়িতেই ফাইলটা সম্পূর্ণ দেখেছে সে। মাথাটা ভনভন করছে। চারদিকে কি চলছে সে জানে না। চোখের পলকেই যেনো সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ঘুমিয়ে নাহয় মনটাকে একটু শান্ত করা যাক। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ মেললো শুভ্রতা। বাবা বসে আছে। আর মা বাবার পাশে দাড়িয়ে শুভ্রতার দিকেই চেয়ে। শুভ্রতা উঠে বসতেই আবসার চিন্তিত কণ্ঠে বললো,

~কিরে মা? ভার্সিটি থেকে এসেই নাকি ঘুমিয়ে গেছিস। তুই তো সচরাচর দিনে ঘুমাস না। শরীর কি খুব বেশি অসুস্থ?

শুভ্রতা প্রত্যুত্তর করলো না। দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে চেয়ে সময়টা দেখলো। রাত ১০ টা বাজে। মাকে বললো রাতের খাবার দিতে। উমা স্বামীর দিকে তাকালে আবসার চোখ দিয়ে আশ্বাস দিতেই তিনি চলে গেলেন। শুভ্রতার দৃষ্টি গোচর হলো না সেসব। মা যেতেই শুভ্রতা চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। আবসার মেয়ের এমন শীতল চাহনী দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। এই চাহনী যে কারো রুহ কাপিয়ে দিতে সক্ষম। আবসার একটু নড়ে চড়ে বসলেন। শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই শুভ্রতার প্রশ্ন,

~ইতি কে?

মেয়ের প্রশ্নে আবসারের বুকে যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো। কপাল এ জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম শুভ্রতার নজর এড়ায়নি। আবসার বানোয়াট কোনো উত্তর মনে গড়ে নিয়ে শুভ্রতাকে বলার জন্য তার দিকে তাকাতেই শুভ্রতার উন্মত্ত গলায় বললো,

~মিথ্যা বলার চেষ্টা ভুলেও করবেন না। মিথ্যা আমার একদমই অপছন্দ। এটা অবশ্যই আপনার জানা আছে?

আবসারের অবস্থা এমন যেনো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। শুভ্রতার তীক্ষ্ণ চাহনী। আবসার সাহস যোগিয়ে কিছু সময় পর নিজেই বলতে শুরু করলো,

~ইতি আমার অফিসের একজন কর্মচারী ছিল। ৪ বছর আগে দেখা। সময়ের সাথে সাথে কিভাবে জানি না আমি তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি। বিয়ে করেছি ৩… ৩ বছর আগে।

শুভ্রতা বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের কাছে গেলো। কিছুই বললো না। একদম চুপচাপ। তার ভেতর যেনো চলছে ভয়ংকর তুফান। তবে সে শান্ত। আবসার আবারো নিজেকে ডিফেন্ড করে বললো,

~আমি জানি না কিভাবে এসব হয়ে গেলো। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি তোকে আর তোর মাকেও ছাড়ছি না। তোদেরও আমি খুব ভালো….ভালোবাসি। কিন্তু তুই বললে আমি তোর মাকে ডিভোর্স…

শুভ্রতার শরীর রাগে, ঘৃণায় শিরশির করে উঠলো। প্রয়োজনীয় কাজে কিনে আনা ধারা*লো ছুরি*টা হাতে নিয়ে বাবার দিকে পা বাড়ালো। মেয়ের হাতে ছুরি* দেখে আবসারের প্রাণ পাখি উড়ে যায় যায় অবস্থা। সে কপট রাগ দেখিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,

~এসব কি শুভ্রতা? হাতে ছুরি* কেনো? বা… বাবাকে ভয়* দেখাতে চাইছো?

শুভ্রতা জবাব দিলো না। বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখটা একদম শান্ত তবে চোখ দিয়েই যেনো অগ্নি নিক্ষেপ করছে সে। ছুরি হাতে নিয়ে খাটে বসলো। থমথমে গলায় শুধালো,

~আমি আমার মাকে ডিভোর্সী রূপের থেকে বেশি বিধবা রূপে দেখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।

~আমি তোর বাবা হই শুভ্রতা। আমাকে মারা*র ভয়* দেখাচ্ছিস?

শুভ্রতা হাসলো। এই হাসিতে মিশে আছে চাপা অভিমান, ঘৃনা, কষ্ট আর আকাশ সমান অভিযোগ। ফট করে দাড়িয়ে হাতের ছুরি*টা বাবার গলার সামনে ধরে বললো,

~আমার মাকে ধোঁকা দেওয়ার আগে বুক কাপেনি আপনার? আমার সামনে দাড়িয়ে আমার মা ব্যতীত অন্য নারীকে ভালোবাসেন তা বলতে ঠোঁট কাপেনি? জানের ভয়* কি নেই?

আবসার ভয়ে খিচে দাড়িয়ে রইলো। রয়ে রয়েই ঢোক গিলছে। নিজের মেয়েকেই ভয় পাচ্ছে সে। মেয়ের এমন ভয়ঙ্কর* রূপের সাথে মোটেও পরিচিত নয় সে। তবে জানা আছে শুভ্রতা তাকে প্রাণে না মারলেও জীবিত অবস্থায় তাকে কি করে মৃত্যু*র স্বাদ পাইয়ে দিতে হবে তা ভালো করেই জানে। মায়ের ডাক পড়তেই শুভ্রতা দরজার দিকে তাকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে পুনরায় আবসারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে তবে পারছে না। ধপ করে খাটে বসে মাথা চেপে ধরলো। নিভে যাওয়া গলায় বললো,

~আমার মা আপনাকে খুব ভালোবাসে, সম্মান করে, বিশ্বাস করে। আমাকে আর আপনাকে ঘিরেই তো তার দুনিয়া। তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আপনি। মানুষটা যদি শুনে আপনি মানুষটাই তাকে ধোঁকা দিচ্ছেন তবে ভাবতে পারছেন তার মনের ওপর দিয়ে কি যাবে? আদৌ কি বেচেঁ থাকতে পারবে সে?

আবসার মাথা নত করে দাড়িয়ে আছে। শুভ্রতার প্রশ্নের জবাব নেই তার কাছে। শুভ্রতার চোখ জ্বলে উঠলো। ঘৃণায় তার বুক ভার হয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফের বলতে লাগলো,

~যে পথে গিয়েছেন ফিরে আসুন। কিভাবে, তা আমি জানি না। আমার দেখার বিষয়ও না। সামনেই আপনার আর আম্মুর বিবাহ বার্ষিকী। তার আগেই যেনো ওই মহিলার সাথে আপনার ডিভোর্স পেপার সাইন করা হয়ে যায়। নয়তো আপনার ওই বউও বিধবা হবে। সাবধান! যা করবেন ভেবে করবেন।

গলার সামনে পুনরায় ছুরি*টা ধরে বললো,

~গট ইট?

আবসার তড়িৎ বেগে মাথা ঝাঁকালো।

~খাবার খেতে ডাকছে। নিচে যান। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

আবসার ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতা সেদিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুক ফেটে কান্না আসছে। যেই মানুষটাকে নিজের আইডল মনে করতো। যে মানুষটাকে সে বেস্ট বাবা, বেস্ট স্বামী ভাবতো আজ সেই মানুষটাই ধোঁকা দিলো। এই মুহূর্তে তার আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কাউকেই না….
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here