#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
বোনাস পর্ব
🍂🍂🍂
খাবার টেবিলে নাস্তা দিতে দিতে লম্বা শ্বাস নিলো রেনু। কেমন গুমোট এক পরিবেশ। প্রয়োজন না হলে এখন আর কেউ তেমন কথাও বলে না। নাস্তা করতে করতে জমেলা বললো,
~শুভ্রতা কি কাল রাতেও কিছু খায়নি?
অনিকা মাথা নাড়ালো। উমার ঘরের দিকে চেয়ে উসমানকে বললো,
~সারাক্ষণ উমার ঘরে বসে থাকে। আজ পর্যন্ত একটুও কান্না করেনি। ডাকলেও রেগে যায়। ঠিক মত খাওয়া দাওয়াও করে না। এভাবে করলে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। আপনি গিয়ে একটু বুঝান না মেয়েটাকে।
উসমান একটু খেয়ে উঠে দাড়ালেন। ইদানিং গলা দিয়ে খাবার নামে না। অনিকা পেছন থেকে ডাকলো,
~কোথায় যাচ্ছেন?
উসমান পেছন না ফিরেই জবাব দিলেন,
~বাহিরে।
অনিকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ চোখে চিত্রার দিকে তাকালে চিত্রা চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলেন।
______________________________________
~শুভ্রতা নিজেকে কেমন একাকীত্বের চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিচ্ছে। এমন সময়ে তুই মেয়েটার পাশে গিয়ে এক মিনিটের জন্যও বসলি না কেনো?
~উত্তরটা তোর অজানা নয় অরণ্য।
~জানিস যখন তবে যাচ্ছিস না কেনো? ওর জন্য এই মুহূর্তে কান্নাটা জরুরী। এভাবে কষ্ট নিজের মধ্যে চেপে রাখলে সে তো মানসিক রোগীতে পরিণত হবে।
~আমার ভয় করে। ওর চোখের পানি আমার সহ্য হয় না।
অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললো,
~ওকে মানসিক রোগীতে রূপান্তর হতে দেখলে নিশ্চয় খুব সহ্য হবে?
চন্দ্র বেশ অপ্রসন্ন হলো। মনে ফুটে উঠলো ঘোর আতঙ্ক। দৃষ্টি স্থির করলো শুভ্রনীলাম্বরে। অরণ্য ছাদ থেকে নীচে নেমে এলো।
______________________________________
~শুভ্রতা মা? আসবো?
ঘরের ভেতর থেকে কোনোরূপ জবাব না আসায় উসমান আবার ডাকলেন। তবে এবারও জবাব এলো না। অনিকা দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলেন। দিনের বেলায়ও মনে হলো অমাবশ্যার রাত নেমে এসেছে। কুচকুচে কালো অন্ধকার। সে দেয়াল হাতড়ে ঘরের লাইট জ্বালালো। আলো জ্বালাতেই কানে এলো শুভ্রতার বিরক্তি মিশ্রিত গলার স্বর,
~কতবার বলেছি আমাকে বিরক্ত না করতে!
শুভ্রতা চেঁচিয়ে উঠে বসলো। চোখ পিটপিট করে সামনে মামা মামীকে দেখে শান্ত হলো। নিস্প্রভ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মামার মুখের পানে। শুভ্রতার মনে হলো তার মা দাড়ি, গোঁফ লাগিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মামার দিকে চেয়ে শুভ্রতা মুচকি হাসলো। উসমান বুঝলেন না শুভ্রতার সেই হাসির কারণ। শুভ্রতার পাশে বসে শুভ্রতার হাত থেকে উমার ছবির ফ্রেমটা নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
~তুই এভাবে থাকলে আমরা যেমন কষ্ট পাচ্ছি তোর মাও তেমনি কষ্ট পাচ্ছে শুভ্রতা। কাল তোর মায়ের মৃত্যুর ৩য় দিন। বাড়িতে মিলাদ করতে হবে। আর এদিকে তুই নিজেকে ঘর বন্দী করে, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে বসে আছিস। এতে কি তোর মা ফিরে আসবে? আসলে বল আমিও তোর মত বসে থাকি।
শুভ্রতা মাথা নিচু করে বসে আছে। উসমান কাঁপা গলায় আবারো বলতে লাগলেন,
~গত দুইদিনে নিজের কি হাল করেছিস তুই? ওপারে গিয়ে আমি উমার কাছে কি জবাব দিবো শুভ্রতা? এটাই যে তার অবর্তমানে আমি তার একমাত্র মেয়ের খেয়াল রাখতে পারিনি।
~মা..মা
~আমাকে মামা ডাকবি না তুই। কোনো কথা শুনিস না তুই আমার। আমি তোর মামা না।
শুভ্রতা ফিক করে হেসে দিলো। শীতল গলায় বললো,
~মা যেতে না যেতেই সম্পর্ক শেষ করে দিচ্ছেন মামা?
উসমান আহত চোখে তাকালেন। অনিকা ছুটে এলেন শুভ্রতার কাছে,
~কি বলিস এসব কথা? তুই আমাদের মেয়ের মত। মেয়ের সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গা যায়?
শুভ্রতা হাসছে। উসমানের চোখ দিয়ে অশ্রুধারা পড়তে লাগলো। শুভ্রতা মামার চোখের পানি মুছে দিতেই উসমান অবাক হলেন। তার মনে হলো গরম কিছু তার গালে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে শুভ্রতার হাত ধরে কপালে হাত রাখতেই বুঝলেন শুভ্রতার গায়ে ভীষণ জ্বর। আন্দাজ করে নিলে ১০৩°/১০৪° হবে হয়তো। কিন্তু মেয়েটা কি সুন্দর বসে আছে। ওকে দেখে ধারণা করারও উপায় নেই যে ওর জ্বর।
~এই মেয়ে! তোর এত জ্বর বলিসনি কেনো?
অনিকা আতকে উঠলেন। শুভ্রতার কপাল গলা ছুঁয়ে দেখতে দেখতে বললেন,
~আল্লাহ, ও মা? তোর এত জ্বর কি করে উঠলো? ওগো, জলদি অরণ্যকে ডাকো।
উসমানকে ডাকার সুযোগ না দিয়ে আবার নিজেই চিল্লিয়ে অরণ্যকে ডাকতে লাগলেন। অরণ্য মাত্রই ছাদ থেকে নেমেছে। মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে ঘরে এলো।
~বাবা দেখ তোর বোনের কত জ্বর এসেছে। মেয়েটা আমাদের বলেওনি।
অরণ্য অস্থির চিত্তে শুভ্রতার কাছে এলো। কপালে হাত লাগিয়ে দেখলো জ্বর অনেক। শুভ্রতা বেপরোয়া ভাবে বলতে লাগলো,
~আমার কিছুই হয়নি। অযথা টেনশন করবেন না তো।
অরণ্য জোরে এক ধমক লাগালো। খাটের পাশের ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে থার্মোমিটার দিয়ে চেক করে দেখলো জ্বর ১০৩°। অরণ্য এবার ভীষণ রেগে গেলো। বাড়ির সকলের সাথে শুরু করলো চিল্লাচিল্লি। বোনের খেয়াল রাখতে না পারায় নিজের প্রতিও জমলো আকাশচুম্বী ক্রোধ। রাগ উঠলো চন্দ্রের প্রতিও। একটাবার মেয়েটার পাশে এসে বসলে হয়তো মেয়েটার এমন অবস্থা হতো না। চিত্রা দ্রুত খাবার বেড়ে নিয়ে এলো শুভ্রতার জন্য। রাত্রি জল পট্টি দিচ্ছে। চন্দ্র আর মাহতাব ঘরে আসতেই অরণ্য রেগে গেলো। শুভ্রতার কাছে যেতে নিতেই অরণ্য চন্দ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তার কাছ থেকে। চন্দ্র অবাক চিত্তে চাইলো তার দিকে। অরণ্য তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
~আমার বোনের কাছেও আসবি না তুই।
চন্দ্র শুনলো না সেই বারন। আবার শুভ্রতার কাছে যেতেই অরণ্য তাকে টেনে দূরে সরালো। উসমান রাগী কণ্ঠে বললেন,
~এসব কি অরণ্য? দেখছো মেয়েটা অসুস্থ আর তুমি ওর সাথে এরকম শুরু করেছো। সরো ওকে বসতে দাও।
~ও আমার বোনের কাছে যাবে না। এই কয়েকদিন দূরে ছিল। এখনও থাকুক। আমার বোনের জন্য আমরা আছি।
চন্দ্র ভ্রু কুচকালো। থমথমে গলায় বললো,
~আমি কেমন তা মোটেও তোর অজানা নয় অরণ্য। আমার প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে পরিচিত তুই। বোনের সুস্থতা চাইলে আমাকে ওর কাছ থেকে দূরে না সরিয়ে ওর কাছে যেতে দে।
অরণ্য সরে দাড়ালো। চন্দ্র একবার অরণ্যকে আপাদমস্তক দেখে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসলো। চিত্রা আর অনিকা শুভ্রতাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে তবে শুভ্রতা খাবার মুখেও তুলছে না। চন্দ্র প্লেটটা নিয়ে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসলো। এক টানে তাকে শোয়া থেকে নিজের কোলে এনে বসালো। শুভ্রতাসহ ঘরের সবাই অবাক। একমাত্র মাহতাব আর রাত্রি ঠোঁট চেপে হাসছে। উসমান আর অরণ্য লজ্জায় ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো। ইশারায় অনিকাকেও বেরিয়ে আসতে বললো। শুভ্রতাকে অসুস্থ দেখে রেনু এতক্ষণ কান্না করছিল। চন্দ্রের কাজে সে এখন হা করে চেয়ে আছে। অনিকার সাথে সাথে চিত্রাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই চন্দ্র মাহতাবদের বললো,
~ভাই ভাবির রোমান্স দেখতে লজ্জা করে না তোদের? বের হ ঘর থেকে। আউট!
তিলোত্তমা মাত্রই এসেছিল। ওদের এভাবে দেখে ঘরে ঢুকতে নিয়েও পা ঘুরিয়ে বাহিরের দিকে হাটা ধরলো।
~চন্দ্র ছাড়ুন আমাকে।
খাবার খাচ্ছো না কেন তুমি?
~খাবো না। ভালো লাগছে না।
~না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে। আর অসুস্থ হলে আম্মুর জন্য দোয়া করার শক্তি থাকবে না গায়ে। সন্তানের দোয়া যে মা বাবার জন্য কতটা কার্যকরী তুমি জানো না?
শুভ্রতা মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ সে জানে। শুভ্রতা চন্দ্রের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো।
~মা আমাকে এত দ্রুত কেনো ছেড়ে গেলো চন্দ্র?
~মানুষ মরণশীল শুভ্রতা। কার কখন মৃত্যু আছে আমরা কেউই জানি না। এইযে আমি এখন তোমার কাছে বসে আছি। দুমিনিট পর হয়তো আমিও থাকবো না। মানুষের একদিন না একদিন যেতেই হবে শুভ্রতা। এতে কারো জীবন থেমে থাকে না। থামিয়ে রাখা উচিতও না। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে হয়। যারা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যায়, আমাদের উচিত তাদের জন্য দোয়া করা। ভেঙে পড়লে চলবে না শুভ্রতা।
শুভ্রতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। চন্দ্র শুভ্রতার মাথায় হাত রাখতেই কান্নার বেগ বাড়লো। সময়ের ব্যবধানে ফুপিয়ে কান্নাটা রূপ নিলো তীব্র আর্তনাদে। মা হারানোর কষ্টে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো শুভ্রতা। চন্দ্র শুভ্রতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো না। যত ইচ্ছে কাঁদুক। কাঁদলে মন হালকা হয়। না কাঁদতে পারলেই সমস্যা। মন হয়ে থাকে ভার। তখন বুকে হয় তীব্র যন্ত্রণা। বেচেঁ থাকাটাও শাস্তির ন্যায় লাগে। শুভ্রতার মা হারানোর আর্তনাদে বাড়ির প্রত্যেকের হৃদয় কেঁপে উঠলো। শুভ্রতার কান্নার আওয়াজ শুনে অরণ্য দরজার কাছ থেকে সরে এলো। তিলোত্তমা কান চেপে, চোখ মুখ খিচে দরজার পাশের দেয়াল ঘেঁষে বসে রইলো। অনিকা আর জমেলা শুভ্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে উমার জন্য কাঁদতে লাগলো। শুভ্রতার কান্নায় যেমন সকলের হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তেমনি সস্তিও মিলেছে যে শুভ্রতা নিজের মধ্যে চেপে রাখা কষ্টটা প্রকাশ করছে। কষ্ট মনের মধ্যে চেপে রাখলে মানুষ হয়ে উঠে কঠোর মনের। এরা না পারে কান্না করতে আর না পারে খুশি মনে বাঁচতে।
____________________________________
বিকেলের মিলাদের পর সন্ধ্যায় সকলে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল। রেনুর থেকে কফি মগ নিয়ে যেই না কফিতে চুমুক দিলো তখনই কল এলো নুরের। শুভ্রতা ফোন নিয়ে উঠানে চলে এলো। ঠোঁটে রাখলো জোরপূর্বক হাসি। সে চায় না তার জন্য নুরদের মনটা খারাপ হোক। কথা শেষ হতেই তিলোত্তমা সামনে এলো,
~ওরা যখন এসে জানতে পারবে আন্টির ব্যাপারে তখন কতটা রাগ করবে জানিস না তুই?
~আমি চাই না আমার জন্য আর কারো খুশির আমেজ মাটি হোক।
তিলোত্তমা হতাশ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। অন্যদিকে রুপা দূরে দাঁড়িয়ে ওদের থেকে নজর সরালো। ফোন কানে রেখে প্রশ্ন করলো,
~আমি যা করছি তা কি ঠিক করছি?
ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠ এলো,
~কিছু পেতে হলে, কিছু হারাতেই হয়।
~~~
চলবে~