এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ৩২

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-৩২♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

—- হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ!
আগামীকালই আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আম্মু!

নিশান্তের কথায় ভগ্নহৃদয়টা মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণের চরম পর্যায়ে পৌঁছালো আফসানার। নিজের একমাত্র ছেলে এভাবে কোল খালি করে ভিনদেশে পাড়ি জবাবে তা মন থেকে আজীবনেও চায় না কোনো মা’ই! আফসানা বেগমও তার ব্যতিক্রম নন মোটেই। ছেলে দেশ ছেড়ে যাবে যদিও একেবারের জন্য নয় তবু সংবাদটা কানে পৌঁছোতেই হৃদয় ভারী হয়ে এসেছিল তার। তবে তিনি জানতেন এমন একটা দিন আসবে যেদিন নিশান্তকে পড়াশুনোর খাতিরে বিদেশে পিএইচডি কমপ্লিট করতে যেতে হবে। হোক সেটা কয়েকমাস পূর্বে কিংবা নির্দিষ্ট করে রাখা দিন-ক্ষণের ভিত্তিতে। তাই তুলনার দিক থেকে ততোটা ভেঙে পড়েন নি আফসানা। আক্ষেপ একটাই থেকে যাচ্ছে এই ব্যস্ততার মাঝে ছেলেটা যেতে চাইছে বলে। কী এমন হবে আর দুটো দিব বাদে গেলে? অনুষ্ঠানগুলো শেষ হয়ে যাক। পরিবেশ ঠান্ডা হোক তারপর নাহয় বাকিটা দেখা যেতো। ধীরেসুস্থে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে তবে ছেলেকে বাহিরে পাঠানো যেতো! অথচ এই ভরা মৌসুমে এরকম কঠিনতম একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড্ড বিপাকে পড়েছেন রফিক আহমেদ সাথে আফসানা বেগম। আফসানা বেগমকে উপরোক্ত উক্তিটির বিপরীতে ছলছল চোখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশান্ত। মা’কে বিছানায় বসিয়ে ডান হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

—- আমায় তুমি ক্ষমা করো আম্মু। আমি সারাজীবন তোমার কথা শুনে চলেছি। যেখানে বসতে বলেছ সেখানে বসেছি, যেভাবে উঠতে বলেছ সেভাবেই উঠেছি। তোমার মানা কথা ডিঙিয়ে কক্ষনো কিছু করিনি। তুমি চেয়েছিলে তোমার ছেলে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হোক তা সচক্ষে দেখতে। আমি তোমার কথা ভেবেই কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি! তোমার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।

এটুকু বলেই থামলো নিশান্ত। আফসানা বেগনের চোখের কোণে জমা স্বচ্ছ নোনাজল সযত্নে মুছে দিয়ে ধরা গলায় বললো,

—- আমি কোনোদিনও তোমার কাছে কিছু চাইনি আম্মু, প্রতি ঈদে তোমার পছন্দ করে কিনে আনা পোশাক বিনাবাক্যে পড়েছি। হয়তো দেখা গেলো পোশাকটা আমার সাইজের হয়নি কিংবা কালারটা আমার পছন্দ নয় তবুও মুখ থেকে একটা টু শব্দ করিনি। তুমি প্রতিদিন যা যা রান্না করো তাই তাই বিনাবাক্যে খেয়েছি। কখনোও বায়না করি নি এটা-ওটা বানিয়ে খাওয়ানোর। তবে আজ চাইছি আম্মু! জাস্ট একটা জিনিস! আমায় তুমি আর আটকিয়ো না। যেতে দাও আমায় প্লিজ! আর একদম কান্না করবে না, তোমার কান্না আমি সহ্য করতে কখনোও পারিনি ভবিষ্যতে পারবোওনা। আর না পারবো এখানে থাকতে! মরে যাবো আমি আম্মু, শেষ হয়ে যাবো!

এতোক্ষণ ছেলের পানে অবাক চোখে চেয়ে থাকলেও শেষের দুটো লাইন শ্রবণগোচর হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আফসানার। হাত ছুটিয়ে চটজলদি নিশান্তের মুখ চেপে ধরে চিন্তিত গলায় তিনি বললেন,

—- চুপ! একদম চুপ! এসব কী বলছিস তুই? কেনো বলছিস? কি হয়েছে আমায় বল নিশান্ত! কেনো তোর কালই চলে যেতে হবে? আর দুটো দিন থাকলে কী ভেসে যাবে তোর বল!

নিশান্ত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উঠে দাঁড়ালো। উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা গলায় বলল,

—- ওকথা আমায় জিজ্ঞেস করো না আম্মু। এর উত্তর আমার নিজেরই অজানা। শুধু এটুকু জানি, আ..আমি সহ্য করতে পারবো না। কিছুতেই না!

কথাটা বলে একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিশান্ত। আফসানা বেগম চেয়ে রইলো ছেলের বেরিয়ে যাওয়ার দরুন হাল্কা ধাক্কায় দোদুল্যমান দরজাটার দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও পলক ফেললেন না তিনি! অজান্তেই চোখ দুটো বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা নোনাজল। নাড়ির টান প্রকৃতির এক বড়ই আশ্চর্যজনক টান। এ মায়া পৃথিবীর সবথেকে কঠিনতম মায়া! ১০ মাস ১০ দিন হাজারো প্রতিকূলতা কাটিয়ে সন্তান গর্ভে ধারণ কী চারটি খানি কথা? মায়া ত্যাগ করে থাকাটা বুঝি এতোটাই সহজ? উহুম! কক্ষনও না।

_____________________

আজ রফিক আহমেদের হাজারো ভালোবাসা দিয়ে গড়া বাড়িটার অবস্থা অনেকটা দুমুখো সাপের মতো! একদিকে খুশির বন্যা তো আরেকদিকে এক বুকভরা হাহাকারের জোয়ার! কেউ হাসছে তো কেউবা আঁচলে মুখ গুঁজে দীর্ঘশ্বাস লুকোচ্ছেন।

বাড়িটা আজ সেজেছে নতুন আমেজের উচ্ছ্বাসে। চারিদিক ঝলমল করছে মরিচ বাতির মিটমিটে আলোয়। নীল এবং সাদা! এই দুটো রং পরস্পরের সাথে মিলে গেলে বরাবরের মতোই চমৎকার এক সৌন্দর্যের জন্ম দেয়। প্যান্ডেলটা বাগানেই করা হয়েছে। আমজাদ হোসেন চেয়েছিলেন কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করতে কিন্তু সময় স্বল্পতায় আগে থেকেই সেন্টার বুক করা হয়ে ওঠেনি। তবে আফসানা বেগম এবং রফিক আহমেদে চেয়েছিলেন বিয়েটা তাদের বাড়িতেই হোক। অন্বিতা তো তাদের মেয়ের মতোই! মেয়ের বিয়ে কি কোনো বাবা-মা নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অন্য কোথাও সম্পন্ন করাতে চাইবে? একদম না!

দাওয়াত করা লোকেদের দিনে খাওয়া-দাওয়ার করানো হয়ে গেলেও অন্বিতা এবং শাহীনের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো দিনে হচ্ছে না বরং বিয়েটা হবে সন্ধ্যের পরপরই! এতো তোড়জোড় করে ব্যবস্থা করতে গিয়ে সামান্য হলেও সময়ের হেরফের ঘটে গিয়েছে অগত্যাই। পাত্রপক্ষ রওনা দিয়েছে। সময়ের হিসেবে আসতে আসতে আরো ঘন্টা খানিক লেগে যাবে।

কিছুক্ষণ আগেই পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে বধূ সাজাতে। অন্বিতাকে নিয়ে ব্যস্ত তারা প্রত্যেকেই। বিয়ের বাড়িটা লোকেদের ভীড়ে জমে উঠেছে। চারিদিকে হৈচৈ! অথচ যার বিয়ে তারই কোনো হুশ জ্ঞান নেই। পাথরের ন্যায় চুপটি করে বসে আছে অন্বিতা। মেয়েরা তাকে সাজিয়ে চলেছে নিজেদের মতো করে। মাঝেমাঝে কেমন করে সাজিয়ে দেবে তা জিজ্ঞেস করলেও বরাবরের মতো “আপনাদের ইচ্ছেমতো সাজান, এতে আমার কোনো মতামত নেই!” বাক্যটাই উচ্চারণ করেছে স্রেফ! তারাও আর কথা বাড়ায়নি। বিয়ের দিন পরিবার ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে প্রতিটা মেয়ে’ই পাথরের ন্যায় মূর্তি সেজে বসে থাকে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভেবেই চুপচাপ সাজিয়ে চলেছে তারা। তবে তারা কী জানে অন্বিতার মনে ঠিক কি চলছে? কতশত কঠিন অনুভূতির খেলা চলছে তার মাঝে? নাহ! জানেনা! আর জানেনা বলেই হয়তো এতোটা স্বচ্ছল তারা।

হাতে সুটকেস, কাঁধে ট্রাভেলর ব্যাগ নিয়ে শেষ বারের মতো বাড়িটার আনাচে কানাচে চোখ বোলাচ্ছিল নিশান্ত। খুব চেষ্টা করেছিলো ফ্লাইটটা যেনো সকাল সকালই আকাশে উড়াল দেয়। বিয়ের ব্যস্তব সময় আসন্নের পূর্বেই যেনো যেতে পারে দেশ ছেড়ে, বহুদূর!না না কথাটা ভুল হলো। সে সকালের ফ্লাইট চাইছিলো পাহাড় সমান তীব্র কষ্টগুলোর থেকে পালাবার তাগিদে। তবে নিয়তি এবারেও সাথে ছিলো না, যার দরুণ সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ ফ্লাইট ছাড়ার কথা রটেছে জনে-জনে!

চারিদিকে কোলাহল! অথচ নিশান্তের বুকে চাপা নিস্তব্ধতা! আজ এতো এতো মানুষের ভীরে নিজেকে নিতান্তই পিঁপড়ে সমতুল্য লাগছে তার। কী অদ্ভুত অনুভূতি! কী নিদারুণ জ্বালাপোড়া! এই সব কষ্ট বুকে চেপে রেখেই পাড়ি জমাতে হবে তাকে। পরিবারের চুপসে যাওয়া মুখটা বড্ড বুকে এসে লাগছে তার। বোনটার আকুতি মাখা চোখে আজারো অভিযোগ কিংবা অভিমানের ছড়াছড়ি! দিন শেষে বাড়ি ফিরে হাত পেতে চকলেট চাইবার তীব্র আনন্দময় অভ্যেসটা কী করে বদলানো যায় তা জানা নেই নূহার। ভাই তাকে বুঝিয়েছে সে অতি শীঘ্রই ফিরবে। তবু ফেরার কথা যখন উঠছে শূণ্যতাও ষোল আনা থাকবে, এটাও বাস্তব।
“পিছুটান” শব্দটা বরাবরের মতো বাস্তবিক সাথে চূড়ান্ত ভয়াবহ! পিছুটান একটা মানুষকে দোটানায় ফেলে দিব্যি মুচকি মুচকি হেসে চলে। অথচ ভুক্তভোগীর অলিন্দ নিলয়ের সমাহারে গড়া হৃদপিন্ডটা যে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে চলে সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ থাকে না তার।

আজ আকাশটা সারাটা দিনই পরিষ্কার ছিলো।
গোধূলির আলোয় আকাশটার নিস্তব্ধতা স্পষ্টরূপেই প্রকট হয়ে রয়েছে। ডানা মেলে শতশত পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। এই শেষ সময়ে এসে মেঘেরা ভীড় জমাতে হুট করেই ব্যস্ত হয়ে পড়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে সবাই। তবে কী ঘরেই বিয়েটা পড়ানো হবে? এতো এতো আয়োজন বুঝি বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে বিলীন না হলেও অকেজো হয়ে পড়বে? ভাবতেই সকলের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠছে। নিশান্ত ছোট্ট ধাপ ফেলে অন্বিতার সাজঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রতিটা ধাপ যেনো সুষম হারে বাড়িয়ে চলছিলো তার হৃদয়ের স্পন্দন! আচ্ছা বউ সেজে কেমন লাগবে অন্বিতাকে? প্রায়ই তো হাল্কা রাঙা শাড়িতে নিজেকে মুড়িয়ে রাখতো মেয়েটা। হয়তো গাঢ় রঙটা তেমন পছন্দ নয় তার! কিন্তু আজ তো ভারী শাড়ি গয়নায় নিজেকে আবিষ্ট করে রাখতে হবে তাকে। অন্যরকম লাগবে বুঝি তবে? আচ্ছা নিশান্তের কী ভেতরে ঢোকাটা ঠিক হবে? মেয়েটা যদি অন্যকিছু মনে করে? তাছাড়া ভেতরে তো সাজানোর জন্য আসা মেয়েগুলোও রয়েছে। তারাও বা কী ভাববে! শেষ ইচ্ছেটা বুঝি আর পূরণ হবে না তবে? শেষ দেখাটা বুঝি তার আর প্রতিফলিত হবে না চোখে?
ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশান্ত। ফ্লাইটের সময় অতিসত্বর ঘনিয়ে আসছে। বেরোতে হবে তাকে শীঘ্রই। নিশান্ত দরজায় কড়া নাড়বার জন্য বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিলো। উল্টোদিকে ধাপ ফেলবার উদ্দেশ্যে পা উঠাতেই দরজায় খট করে আওয়াজ হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চটজলদি নিজেকে আড়াল করতে দরজার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে লুকলো সে। ভেতর থেকে চাপা হাসির আওয়াজ ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী হতে লাগলো। একটা সময় দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজ সাথে মেয়েগুলোর কথাবার্তার বিলীনতায় নিশান্ত বুঝলো তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অন্বিতা তো এখনোও ঘরেই। এই সুযোগে মেয়েটাকে কি এক ঝলক দেখার বাসনা পূরণ করা যায়? হয়তো যায়! অন্যায় হলেও শেষ সময়ে এটুকু ভুল তো করাই যায়! ভেবেই নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেই দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল নিশান্ত।

অন্বিতার কোনো ভাবাবেগ হলো না। মেয়েগুলোর মাঝেই কেউ এসেছে ভেবে বধূর বেশে ফাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আগের মতোই চেয়ে রইলো আয়নায়। অথচ নিজেকে কেমন দেখতে লাগছে তা নিজরই চোখে ধরা দিতে পারেনি তার। ঝাপসা চোখদুটো ঘোলাটে দেখছে সবকিছু! দরজা লাগিয়ে উল্টো দিকে ফিরে দ্বিধান্বিত চোখে চেয়ারে বসা অন্বিতাতে দৃষ্টি ফেলতেই থমকে গেল নিশান্ত। সাথে একমুহূর্তের জন্য বোধকরি থমকে হৃদস্পন্দনও। অন্বিতা লাল টুকটুকে বেনারসিতে মুড়িয়েছে নিজেকে আজ। গাঢ় সবুজ রঙের কম্বিনেশনে তৈরি শাড়ির আঁচলটা মেঝে স্পর্শ করেছে অজান্তেই। ফেস টোনের সাথেই ম্যাচ করে হাল্কা সাজে সেজেছে। তবে আজকে চোখদুটো যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছে তার। কাজলে লেপ্টে থাকা অবিশ্রান্ত চাহনি! ঠোঁটে কখনো লিপস্টিক লাগানো দেখে যায়নি অন্বিতাকে। আজ লাল রঙে মোড়ানো হয়েছে ঠোঁট’টাকেও। গলায় ভারী নেকলেস, কানে বড়বড় একজোড়া ঝুমকো, মাথায় টিকলি, সাথে সোনালী কাজে চাকচিক্যময় ওড়না! সব মিলিয়ে কোনো হুরের থেকে কম লাগছেনা অন্বিতাকে। এই মেয়েটাই আজ অন্য কারো বউ হতে চলেছে। কথাটা নিজের মনে আলোড়নের সৃষ্টি করতেই বুকের বামপাশে ছুড়ির ন্যায় শতশত আঘাতের বন্যা বয়ে চলেছে নিশান্তের।

নিশান্ত পলকহীনভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নিলো। যা তার নয় তাতে তার বিন্দুমাত্রও অধিকার নেই জেনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পকেটে হাত ডুবিয়ে কিছু একটা বের করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো অন্বিতার নিকটে। অন্বিতা এখনও আগের মতোই বসা। তার আশেপাশে অন্য কোনো অবয়বের অস্বস্তি বিচরণ করছে অথচ নির্বিকার সে। নিশান্ত অন্বিতার কাছাকাছি পৌঁছে হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসলো। উদ্দেশ্য হাতে থাকা রূপালী আবেশে ঘেরা পায়েলটা অন্বিতার পায়ে পড়িয়ে দেওয়া। সেবার শখের বসেই মল থেকে কিনেছিল পায়েলটা। কার জন্য কিনেছে বা কেন কিনেছে তা তার নিজেরই অজানা! হঠাৎ বোনের জন্য চুলের ব্যান্ড নিতে গিয়েই পায়েরলটার ওপর নজর পড়েছিল তার। কোনো কারণ ছাড়াই ভালোলাগার দরুন কিনে নিয়েছিল সে। বোনের পা তো ছোট, সাইজে হবার ছিলোনা। মা’ও পায়েল পড়ে না যার দরুন নিজের কাছেই রেখেছিল পায়েলটাকে নিশান্ত। তবে আজ খুব করে ইচ্ছে জাগছে প্রিয় কারো পায়ে পায়েলটা পড়াতে! আর “প্রিয়” শব্দটা যে অন্বিতাকেই ঘিরে! তাইতো অন্বিতার দুধে-আলতা পা’টাকেই পায়েলে মোড়াতে চাইছে নিশান্ত।

হঠাৎ পায়ে কারো উষ্ণ হাতের ছোঁয়া অনুভব করতেই ভ্রম কাটলো অন্বিতার। চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠার পূর্বের ডান হাত উঠিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো নিশান্ত। চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলতেই নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নেবার চেষ্টা চালালো অন্বিতা। নিশান্ত অন্বিতার মুখ ছেড়ে স্মিথ হাসলো। পায়েলের হুক লাগিয়ে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

—– আমি তো তোমায় কোনো উপহার দেইনি। যদিও আম্মু-আব্বু দিয়েছে বাট আমি চেয়েছিলাম নিজে থেকে তোমায় কিছু দিতে। বিয়েটা এতো জলদি জলদি ঠিক হয়ে গেলো যে তেমন কিছু দিতেই পারলাম না। পায়েলটা আগে থেকেই কেনা ছিল, তোমায় বেশ মানাবে। খুলিও না প্লিজ!

অন্বিতা একবার নিজের বাম পায়ে পড়ানো পায়েলটার দিকে তাকালো। শাড়ির কুঁচি ধরে দাঁড়িয়ে নিশান্তের চোখে চোখ রেখে বলল,

—– আমায় আলাদা করে কিছু দেবার প্রয়োজন ছিলোনা মি. নিশান্ত।

নিশান্ত জবাব দিলোনা। মুচকি হেসে উল্টো দিকে ফিরতেই পেছন থেকে আবারও ডেকে উঠলো অন্বিতা। নিশান্ত থমকাল। অন্বিতা চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

—– আপনি সত্যিই চলে যাচ্ছেন? আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আমি তো আর আপনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না। এরপরও কেনো যেতে চাইছেন আপনি?

নিশান্ত মুখ ফেরালো না। নোনাজলে ভরা রক্তিম আভা ছড়ানো চোখদুটো আড়ালে রেখেই বলল,

—– আপনি ভুল ছিলেন, আপনি আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন ভেবে যাচ্ছিনা আমি। যাচ্ছি আমি আপনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারি এই সন্দেহে।

একথা বলেই চটজলদি ঘর ছেড়ে লাগেজ হাতে বেরিয়ে গেলো নিশান্ত। অন্বিতা ছলছল নয়নে চেয়ে রইলো নিশান্তের প্রতিচ্ছবি বিলীন হবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত। কী বলে গেলো নিশান্ত? কী অর্থ জ্ঞাপন করে তার মুখ নিসৃত বাক্যটা? এতো চেষ্টার পরও তাকে আটকানো সম্ভব হলোই না অবশেষে! কি চায় নিশান্ত? মেয়েটাকে কী সে খুঁজে পেলো তবে? নাকি বিদেশেই তার ভালোবাসার ঠিকানার খোঁজ মিললো যার দরুন পরিবারের কথা চিন্তা না করে, সব মায়া ত্যাগ করে সবকিছু ভুলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে সে?

___________________________

এয়ারপোর্টে সব ইনফরমেশন কমপ্লিট করে লাগেজটা হাতে উঠালো নিশান্ত। রফিক আহমেদ, সানি-রিভানের জলসিক্ত চাহনির দিকে একবারের বেশি দু’বার তাকালোনা। আফসানা বেগম এবং নূহা অনেকটা অভিমানের বশেই এগিয়ে দিতে আসেনি তাকে। যার দরুন ছেলেকে এগিয়ে দিতে রফিক আহমেদকেই একা আসতে হলো অবশেষে। সানি-রিভান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামাবার প্রচেষ্টায় ব্যহত করছিলো সময়। তবে নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা সানি। নিশান্তের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। রিভানও জড়িয়ে ধরলো তাকে। সানিকে থামাবার জন্য সান্ত্বনা দিতে দিতে ছাড়িয়ে নিলো নিশান্ত। ফ্লাইট আর ২৫ মিনিটের মাঝেই ছাড়বে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রফিক আহমেদ চোখের জল মুছে সময়টা দেখে নিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে করতে একটা সময় গিয়ে উত্তর দিতে পারলোনা নিশান্ত।

—– ওহ শিট! এটিএম কার্ডটা তো ড্রয়ারেই ফেলে এসেছি আব্বু!

রফিক আহমেদ চিন্তায় কপাল চেপে ধরলেন। ঘড়ির দিকে আবারও দৃষ্টি ফেলে বললেন,

—– এটা একটা কাজ করলি তুই? এটিএম কার্ড ওয়ালেটে রাখার বদলে ড্রয়ারে কোন হিসেবে রেখেছিলি! উফফ! এখন তো সময়ও হাতে নেই গিয়ে নিয়ে আসার। যেতে যেতেই ১৫ মিনিট পাড় হবে। মানে ফ্লাইট মিস!

সানির চোখ-মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো মুহুর্তেই। রফিক আহমেদের কথাটা পুরোপুরি শেষ না হতেই সে বলে উঠলো,

—– বাদ দে মামা! যেতে হবে না আজ অন্য কোনোদিন চলে যাস! চিল না ইয়ার!

নিশান্ত কপালে ভাঁজ ফেলে কঠিন চোখে তাকালো। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—– লাগবে না এটিএম কার্ড! যথেষ্ট ক্যাশ আছে, আব্বু ছেড়ে দাও। আমি চললাম!

রফিক আহমেদ হাত দেখিয়ে থামতে ইশারা করলেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কারো নম্বরে ডায়াল করে কানে ধরলেন,

—– ভাই বরযাত্রী কী এসেছে?

ওপাশ থেকে হয়তো কেউ জবাব স্বরূপ বলল কিছু। বিনিময়ে আশাভরা হাসি হেসে রফিক আহমেদ আবারও বললেন,

—– তাও ভালো! আচ্ছা ভাই একটা বিপত্তি ঘটে গেছে। নিশান্ত ভুলে এটিএম কার্ডটা নিজের ড্রয়ারে ফেলে এসেছে। আপনি যদি একটু সময় করে এসে দিয়ে যেতেন তবে খুব ভালো হতো। ফ্লাইট ১৫ মিনিটের মাঝেই ছেড়ে দেবে।

ওপাশের ব্যক্তিটার উত্তরে নিশ্চিন্ত হলেন রফিক। “অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই সাহেব!” কথাটা বলেই ফোনের লাইন কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
১৫ মিনিটের জায়গায় প্রায় ১০ মিনিটের মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছলেন আমজাদ হোসেন। নিশান্তদের নিকট পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,

—– লাখ লাখ শুকরিয়া আল্লাহ! ঠিক সময় আসতে পারলাম! আমি ভেবেই বসেছিলাম হয়তো ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে।

বলেই একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলেন নিশান্তের দিকে। নিশান্ত আমজাদ হোসেনকে সালাম করে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,

—– ব্যাগ কেনো? কি আছে এতে?

আমজাদ হোসেন আমোদিত গলায় বললেন,

—– তোমার কার্ডটা সাথে গাজরের হালুয়া। ভাবী নাকি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।

নিশান্ত ঘড়ি দেখলো। সময় আসন্ন, সকলকে ভেতরে যেতে আহ্বান জানাচ্ছে কর্তৃপক্ষ! নিশান্ত কুশল বিনিময় করে হাটা ধরলো। যাওয়ার সময় সানি-রিভানের পিঠে দুটো কিল বসাতে ভুললো না অবশ্য।
সবাই যে যার স্থান থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিশান্তকে বিদায় জানিয়ে ছুট লাগালো অন্বিতার বিয়ের ব্যস্ততায় ডুব দেবার তাগিদে।

____________________________

টিকিটের সিট নম্বর অনুযায়ী নিজের আসন গ্রহণ করে জানালার বাহিরে এক পলক তাকালো নিশান্ত। তপ্ত শ্বাস ফেলে লাগেজ, ট্রাভেলর ব্যাগটা জায়গা মতো রেখে হাতে থাকা ব্যাগটায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। গাজরের হালুয়া বানিয়েছে মা! যা বরাবরই নিশান্তের অতিমাত্রায় প্রিয়! মা’কে মনে মনে শতশত বার “ভালোবাসি আম্মু” বলে নিয়ে এটিএম কার্ডটা বের করবার জন্য হাত ডুবালো। হাতে ভিন্ন কোনো আকৃতির কিছু ঠেকতেই ভ্রু কুঁচকে টেনে বের করলো। এ কী! এতো আমজাদ হোসেনের ওয়ালেট! ইশশস গাড়ি ভারা দিয়ে গিয়ে নির্ঘাত ওয়ালেটটা ভুলবশত ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছেন! ভেবেই চিন্তিত চোখে চেয়ে মানিব্যাগটা খুললো। নেমে যাওয়ার মতো ক্যাপাসিটি নেই, যতো টাকা আছে তা পাঠিয়ে দিলেই হিসেব মিটে যাবে ভেবেই টাকা গুণতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত চালালো। কিন্তু টাকায় হাত ছোঁয়াবার পূর্বেই থমকে গেলো নিশান্ত। চোখদুটো বন্দী হলো ওয়ালেটের এক কোণে সযত্নে রাখা ছোট্ট ছবিটার ওপর। পা দু’টো ভার ছেড়ে আসার হয়ে আসতে শুরু করলো তার। হৃদয়ের ডিবডিবে আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগলো ঘাম। আনমনেই অস্ফুটস্বরে ঠোঁট ভেদ করে বেরোলো একটি মাত্র নাম,

—– “আয়ু!”

#চলবে_______________

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here