#আমার_সংসার
পর্ব-১৩
Sara Mehjabin
“অসভ্য ইতর! আপনি এখানে কি করছেন? ছোটলোক কোথাকার” রাগে ফুসছে আজমী।
“স্কুলে ভর্তি হতে আসছি। ঐদিন না আপনিই বললেন স্কুলে ভর্তি হয়ে আদব-কায়দা শিখতে। ঐজন্য আপনার কাছে পড়তে এসেছি ম্যাডাম।”রিফান দাঁত বের করে উত্তর দিল।
ওদের কথাবার্তায় চেম্বারে উপস্থিত স্কুলের সব টিচাররা যেমন অবাক হচ্ছে তেমন এটাও বুঝতে পারছে ওদের মধ্যে ভালো একটা পরিচয় আছে। নাহলে রিফানের মতো সিরিয়াস মানুষ কারো সাথে এভাবে কথা বলার কথা না বিশেষ করে মেয়েদের।
দুইদিন আগে। আজমী ব্যাংকে গিয়েছে। ওদের স্কুলে বেতন একাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই টাকাটা তুলতে এসেছিল। বাবার বাসায় টাকা পাঠাতে হবে। আজমী তার বেতন সম্পুর্নটাই বাড়িতে পাঠায়। ফারহান ও এই বিষয়ে কিছুই বলে না। সেদিন লাইনটা খুব লম্বা ছিল। প্রচণ্ড চাপাচাপি হচ্ছিল। তারমধ্যে সেখানে একমাত্র আজমীই ছিল মেয়ে। সামনে-পিছনে দাঁড়ানো লোকগুলো ইচ্ছা করেই আজমীর গায়ে ধাক্কা দিচ্ছিল। আসস্তি লাগলেও কিচ্ছু বলল না আজমী। হঠাৎ আজমী খেয়াল করল আশেপাশের লোকগুলো তার দিকে কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে। ছেলেলোকেরা আজমীর দিকে কেমন বাকা চোখে তাকাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। আজমীর খারাপ লাগলেও কিছু বলল না। পাবলিক প্লেসে একা যাওয়া মেয়েদের কাছে এগুলো খুব স্বাভাবিক বিষয়। তারা কখনোই এগুলোর প্রতিবাদ করতে পারে না।
ধীরে ধীরে আজমীর সিরিয়াল আসল। চেক জমা দিতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে কাউন্টারে চেক দেওয়া লোকটা আজমীকে দেখে বিশ্রীভাবে হেসে দেয়। সাথে সাথেই যারা এতক্ষণ মুখ টিপে নিজেরা নিজেরা হাসছিল সবাই জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। পুরো জায়গাটায় হাসাহাসির রোল পড়ে যায়। সবার হাসাহাসির কেন্দ্রবিন্দু আজমী। আজমী খেয়াল করল তার ওড়না একপাশে একদম সরে গিয়েছে। দুই হাতে অনেকগুলো ব্যাগ থাকায় খেয়াল করে নি। ওড়না সরে গিয়ে বুকের একপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যা নিয়েই এতো হাসাহাসি। কিন্তু আজমীর ওড়নায় সবসময় পিন করা থাকে,
“এক্সকিউজ মি ম্যাডাম আপনার সেফটিপিন”
রাগ সামলাতে না পেরে সামনে দাঁড়ানো লোকটা কে ঠাস করে থাপ্পড় মারল আজমী। লোকটার হাতে ওড়নার সেফটিপিন। ভিড়ের মধ্যে এই লোকটাই পিঠে হাত দিয়ে তার সেফটিপিন খুলে নিয়েছে!! দেখে তো ভদ্রসভ্য লোক-ই মনে হয় ; কিন্তু এত অসভ্য কেন? রাগে আজমী মনে যা আসে তাই শুনিয়ে দিল লোকটাকে। লোকটা পুরোটা সময় হা করে আজমীর কথাগুলো শুনল। আজমীর কথা শেষে অসহায় কন্ঠে শুধু বলল, “সেফটিপিন টা ফ্লোরে পড়া ছিল। দেখে ভেবেছিলাম আপনার সেফটিপিন। তাই…
“হোয়াট,,,ভেবেছিলেন? কেন ভেবেছিলেন আমার সেফটিপিন? তারমানে আপনি এতক্ষণ আমাকে দেখছিলেন? আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন? লজ্জা নেই আপনার? পাব্লিক প্লেসে মেয়ে দেখলেই ঢলাঢলি করতে মন চায়? এতো ঢলাঢলি শখ থাকলে বিয়ে করে ঘরে বৌ নিয়ে ঢলাঢলি করুন।”
“ওকে চলুন ( আজমীর হাত টেনে ধরে) আমার কোন আপত্তি নেই ম্যাডাম। শুধু আপনি রাজি হলেই ডিরেক্ট কাজী অফিস। তারপর ঘরে গিয়ে ঢলাঢলি করব, ওকে?”
“সাট আপ অসভ্য লোক। কোন শিক্ষা-দিক্ষা নেই আপনার। স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শিখে আসেন। যত্তসব স্টুপিড।”
আজমী টাকা না তুলেই ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায়।
আজ আবার স্কুলে সেই লোকের সঙ্গেই দেখা। রাগে আজমীর গা কাঁপছে। এই লোক এখানে এসেছে কি জন্য?
“আজমী তুমি কাকে কি বলছ? উনি রিফান স্যার; ওনার বাবা এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান উনি। কথা বলার আগে একটু চিন্তা করবে তো কার সম্পর্কে কি বলছ।”
প্রিন্সিপাল স্যারের আজমী এইবার একটু দমে গেল। তারমানে এই অসভ্য লোকটাই স্কুলের মালিক? রাগের বশে তো অনেক কথাই বলে ফেলেছে। এখন কিভাবে ম্যানেজ করবে কে জানে।
আজমী ভেবেছিল সেদিন তার চাকরিটাই থাকবে না। অথচ রিফান ঐ বিষয়টা আর এতটুকুও বাড়ালো না। বরং সবাইকে ডেকে মিটিং বসালো। আজমীর প্রমোশন দিল নিজে। যা আজমী স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। লোকটার সঙ্গে যা সে করেছে তারপর তার চাকরি ঘচাং করে কেটে নেওয়ার কথা তার বদলে প্রমোশন দিচ্ছে! লোকটাকে এই প্রথম একটু ভালো মনে হলো ওর।
তবে সেই ভালো ধারণা খারাপ হতে একদিনের বেশি লাগল না। এই অসভ্য লোক পুরো স্কুলে রটিয়েছে আজমী তার ছোটবেলার বেস্টু। বলেছে প্লে-তে পড়ার সময় দুইজনে একত্রে পেয়ারা গাছে ঝুলত। আরো বলেছে বেন্চের নিচ দিয়ে লাভলেটার দিত দুইজন দুইজনকে। স্কুলের সবার সামনে সে আজমীকে তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে। প্রতিদিনই আজমীর সঙ্গে দেখা করতে আসে। সাথে আবার খাবার-দাবার,,, আজমী বুঝত না তার কখন খিদা পায় আর কোন খাবারটা খেতে ইচ্ছা করে এই লোক বুঝে কিভাবে। কিন্তু লোকটাকে তার একদম-ই সহ্য হতো না। আজমীকে প্রথম কয়েকদিন রিফান নিজের গাড়ি দিয়ে বাসায় দিয়ে আসতে চেয়েছে। আজমী রাগারাগি করায় স্কুল থেকে সব টিচারের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল রিফান। আজমী কিছুতেই বুঝতে পারছে না লোকটা এগুলো করছে কেন? এই লোকের আসল উদ্দেশ্য কি? আজমী সবসময় চেষ্টা করে লোকটাকে এড়িয়ে চলার। কিন্তু আজকে বাসায় ফেরার সময় ঝুম বৃষ্টি নেমে গেল। আজমীর ড্রাইভার জানাল সে আজকে আসবে না। বৃষ্টির দিন। রিকশা-গাড়ি কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। রিফান আজমীকে রাস্তায় দাঁড়ানো দেখে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলো। বাসায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য কোন জোরাজুরি না করে সোজা গাড়ি থেকে নেমে আজমীকে টেনে পাশের সিটে বসিয়ে ড্রাইভ শুরু করল। আজমী সমানে চিল্লাচ্ছে” আরে থামুন থামুন কি করছেন আপনি? আমি যাব না আপনার সাথে। গাড়ি থামান। আমি নেমে যাব।”
“হুশ” আজমীর ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল রাখে রিফান।
“আই অ্যাম নট ইওর হাজবেন্ড যে বৃষ্টির মধ্যে অভিমান করে গাড়ি থেকে নেমে যাবে আর আমি তোমাকে কোলে তুলে গাড়ির সীটে বসাব। আই অ্যাম ইওর বস। সো যতক্ষণ যেভাবে যেখানে বসে থাকতে বলব সেভাবেই থাকবে, ওকে।”
বলেই আবার গাড়ি ড্রাইভ শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর রিফানের গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে। এদিকে বৃষ্টির পরিমাণ-ও বাড়ছে। বাধ্য হয়ে দুইজন আশ্রয় নিল একটা চায়ের দোকানের ছাপড়ায়।
“আচ্ছা আজমী আপনি যে বিবাহিত স্কুলে সেটা লুকিয়েছেন কেন? আপনার ফর্মে লেখা আপনি অবিবাহিত। আমাদের ভুল ইনফরমেশন দিয়েছেন আপনি। কিন্ত কেন?”
রিফান প্রশ্ন করে।
“কারন আমি ডিভোর্সি। আমার স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
“ডিভোর্সের পরেও স্বামীর সঙ্গে সংসার করছেন? অদ্ভুত তো আপনার সংসার।”
“মানে? আমার ব্যাপারে আপনি এতো কথা কিভাবে জানলেন?”
“আমি কিভাবে জানলাম সেটা বড় কথা নয়। আমি জানতে চাই আপনার জীবনের রহস্যটা কি। আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গেছে। আপনি কোথাও স্বামীকে পরিচয় দেন না। কিন্তু দুইজনে আবার এক-ই সঙ্গে থাকেন। আপনাদের একটা ছেলেও আছে। যদিও ছেলেটাকে আপনি জন্ম দেন নি।”
“আপনি আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করেছেন? এতো খারাপ একটা লোক আপনি। আমি তো আপনার স্কুলের একজন সামান্য ইমপ্লয়ি। আমার পারসোনাল লাইফ নিয়ে আপনার এতো ইন্টারেস্ট কেন?”
“আমার কি নিয়ে ইন্টারেস্ট সেটা আপনার ভাবতে হবে না। আপনাকে আমাকে নিজের বিষয়ে সব বলতে হবে। বাট আমি জোর করব না। ইচ্ছা হলে বলবেন না হলে নাই। আমি যা করব তা হলো ভুল ইনফরমেশন দেওয়ার কারনে আপনার চাকরি নট করে দেব। আর সারাজীবন যাতে আপনার চাকরি না জোটে সেই ব্যবস্থা করা আমার বা হাত কা খেল। সো নিজের ভালো বুঝুন।”
বাধ্য হয়ে আজমীকে তার অতীত জীবনের সব কথা রিফানকে বলতে হয়।
আজমীর বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। আজমীর খুব চিন্তা হচ্ছে রিশানের জন্য। এতক্ষণ একা একা কিভাবে আছে কে জানে। ওর দাদি ঠিকমতো খাইয়েছে তো? রিশান ওষুধ একদম দেখতে পারে না। ওকে ওষুধ গিলানোর ক্ষমতা আজমী ছাড়া পৃথিবীর কারো নেই। আজমী বারবার ঘড়ি দেখছে। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে। রিশানের ওষুধের টাইম হওয়ার আগে। একবেলা ওষুধ বাদ পড়লেই রিশানের শরীর খারাপ হয়।
রিশান অন্যদিন একটু দেরি হলেই ইমার ফোন থেকে সমানে আজমীকে কল করে। আজকে একবারো ফোন দেয় নি। ওর শরীরটা বেশি খারাপ হয়ে গেল না তো? স্কুলে যাওয়ার সময় তো আজমী ভালোই দেখে গেল। হাসিখুশি খেলছিল। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠছে বারবার। মায়েদের মন কেমন যেন আগে থেকেই অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারে।
বাসায় ঢুকে আজমী দেখল পুরো বাড়ি ভর্তি অনেক মানুষজন। ওর শাশুড়ি মা সোফায় বসে কাঁদছেন। রিমা-ইমা ওরাও কাঁদছে। ফারহানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দৃশ্যটা দেখে বুকের মাঝখানে জোরে ধাক্কা লাগল আজমীর। কেন যেন খুব ভয় করতে লাগল। বাড়ির ভেতর এতো মানুষ একসাথে কান্নাকাটি করছে যেন কেউ মারা গেছে। ধুর্ এসব কি ভাবছে? কারো কিচ্ছু হয় নি। সবাই ঠিক আছে। আজমীর হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। কোনমতে কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করে, কি হয়েছে?
সাথে সাথেই ইমা দৌড়ে এসে আজমীকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার শুরু করে দেয়। তারপর হাতের আঙ্গুল ইশারায় উঠোনের দিকে দেখায়।
সেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ রাখা হয়েছে।
চলবে