#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১২
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
সমুদ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
” যদি বলি দুটোই বিশ্বাস করবি? ”
” মানে?”
” কিছু না। ”
” কিছু না বললেই তো হবে না। আমার বিয়ের ঘর দেখছে সমুদ্র। ব্যাপারটা তুই ভাবতে পারছি?”
” হুম পারছি। ”
আমি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
” তুই কী মানুষ? না-কি জানোয়ার? এতটা নিষ্ঠুর,এতটা পাষান তুই কী করে হতে পারিস? কষ্ট হয় না তোর? যন্ত্রণার আগুন জ্বলে ওঠে না তোর ভেতর?”
” আস্তে কথা বল। চারিদিকে কিন্তু মানুষ রয়েছে। ”
” কিসের আস্তে কথা বলব। আর মানুষ….. মানুষ দেখলে আমার কী আসবে যাবে রে? আমার জীবন তো মানুষের হাতের খেলার পুতুলই হয়ে রয়েছে। নতুন করে মানুষ দেখলে কী হবে?”
” দেখ ইউশরা এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করিস না। এরকম লোকদেখানো কান্ড আমার কিন্তু মোটেও পছন্দ না। তাই নিজেকে সংযত কর। ”
আমি বড় করে তিন দুয়েক নিঃশ্বাস নিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে বললাম,
” বিয়ে করতে চাচ্ছিস না কেন?”
” তোকে কি বলেছি আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না? না-কি অন্য কাউকে বলেছি? ”
” বিয়ে করবি না যেরকম বলিসনি, বিয়ে করবি সেরকম কিছুও তো বলিস নি।”
” আশ্চর্য তো! বিয়ে বললেই কী করা যায় না-কি? এর আগে পড়ে কোনো রেস্পনন্সিবিলিটি নেই? ”
” কিসের রেস্পনন্সিবিলিটির কথা বলছিস? আমার পেছনে খরচ করার রেস্পনন্সিবিলিটির কথা? না-কি সংসার চালানোর রেস্পনন্সিবিলিটির কথা? কোনটা? ”
” কেন? তুই বুঝতে পারছিস না?”
” না, আমি বুঝতে পারছি না।আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। যেখানে তোর বাবা বলছেন উনি সব দেখবে সেখানে তুই কোন রেস্পনন্সিবিলিটির কথা বলছিস বা ভাবছিস আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
“আমি সবকিছু মিলিয়ে বলছি ইউশরা। এ টু জেট বুঝিস? আমি তার কথা বলছি আর ভাবছি। মানলাম বাবা সব দেখবে। কিন্তু কতদিন? কতদিন বাবা দেখবে? আর আমিই বা কতদিন বাবার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকব? অসুস্থ হয়েছিস বাবাকে বলতে হবে। বাপের বাড়ি যাবি বাবাকে বলতে হবে। পরীক্ষার ফী বাবাকে বলতে হবে। এভাবে দিনের পর দিন চলা কী আদৌ সম্ভব ইউশরা? তুই-ই বল সম্ভব? হয়তো অনেকেই চলে। কিন্তু আমি অনেকের মাঝে পড়ি না। অন্য কেউ চলতে পারলেও আমি পারব না। আমার পক্ষে সম্ভব না এভাবে প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মুহূর্তে কারো মুখাপেক্ষী হওয়া। ”
সমুদ্রের কথাগুলো আমার দিক থেকে বিবেচনা করলে ভুল হলেও ওর দিক থেকে বিবেচনা করলে শতভাগ সত্য। সত্যিই এভাবে চলা অসম্ভব। আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে ক’দিনই বা চলা যায়! তবে আমারও করার কিছুই ছিল না। তাই অপারগ হয়েই বললাম,
” তাহলে কী করতে বলছিস তুই?”
সমুদ্র বড় এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” নতুন করে কী বলব? তোর বাবা তো যা করার করছেই। আমার কথায় কী বা আসবে যাবে!”
” তারপরও তোর কী কিছুই বলার নেই?”
” থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। তবে সেগুলো শোনার মানুষের সংখ্যা বড্ড সংকট।”
” তুই কী জব নিবিই না সমুদ্র?”
” আশ্চর্য! বারবার কেন এক কথা বলছিস বল তো? আমি কী চেষ্টা করছি না? এখন সেই চেষ্টা যদি কাজে না লাগে আমি কী করব?এখানে আমার কী-ই বা করার আছে?”
সমুদ্রের কথা শুনে সীমিত সময়ের জন্য নিশ্চুপ ছিলাম আমি। ক্ষানিকটা সময় বাদে বললাম,
“আচ্ছা, সঠিক করে বলতো তোর আর কতদিন সময় লাগতে পারে এই জব, বিয়ে সবকিছুর জন্য? আর হ্যাঁ, একদম পারফেক্টলি বলবি।”
” আমি কিন্তু কখনোই আন পারফেক্টলি কথা বলি না ইউশরা। রিলেশনের শুরুতেই বলেছিলাম আমার সময় লাগবে। আর এখনো সেই একই কথা বলছি যে,আমার সময় লাগবে। এখন তোর বাবা যদি সেটা না মানে আমার তো করার কিছু নেই। ”
” বুঝলাম, এখন আমি তোকে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দেয়।”
” আহা….নতুন করে উত্তর দেয়ার কী আছে আমি তো সেটাই বুঝলাম না। তোকে আগেও বলেছি আর এখনো বলছি যে, চাকরি ছাড়া আমি বিয়ে করব না? আমার পক্ষে সম্ভব না।”
” সেতো বুঝলাম কিন্তু কতদিন, কত বছর সেটা তো বল?”
” এটা এখন তোকে আমি কী করে বলব? এটা তো শিউরিটি দেয়ার মত কোনো কথা না। আল্লাহ যদি চান কালই চাকরি হতে পারে, আবার আল্লাহ যদি বা চান আগামী দু বছরেও হবে না। পুরো টাই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। এভাবে আগাম তো আমি কিছু বলতে পারব না।”
” তুই এদিকও পারবি না, সেদিকও পারবি না।তুই কিছুই পারবি না। সব পারা একা আমাকেই পারতে হবে। এটা কী কোনো ন্যায়ের কথা সমুদ্র? ”
সমুদ্র চোখ বুজে বলল,
” তোকে তো কিছু পারতে বলিনি। আর না আমার জন্য বসে থাকতে বলেছি। তোর যদি ইচ্ছে হয় তোর বাবার ঠিক করা পাত্রের সাথে বিয়ে করে নিতে পারিস। আমাকেই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর আমাদের মাঝে এমন কিছু হয়ওনি যার জন্যে তোর আমাকে ভুলতে সময় লাগবে কিংবা যার সাথে বিয়ে হবে সে তোকে চরিত্র নিয়ে কথা শোনাবে। অর্থাৎ তুই নিশ্চিন্তে বিয়ের আসরে বসতে পারিস। ”
” সমুদ্র!”
” আমি যে ভুল কিছু বলিনি সেটা তুই ভালো করেই জানিস। তাই অবাক হওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। ”
” আসলে কী জানিস, আমি হলাম সবচেয়ে বড় বেহায়া যে, আজও তোর মত অনুভূতিহীন মানুষের জন্য পথ চেয়ে বসে আছি। ”
বলেই আমি সেখান থেকে হন্তদন্ত হয়ে চলে এলাম। তবে আসার আগে একটা জিনিস খুব ভালো করেই খেয়াল করলাম। সমুদ্রের চোখে চিকচিক করা ভরপুর কিছু তরল পদার্থ আনাগোনা করছে। যার রঙ হবে পানি রঙ। আর স্বাদ লবণাক্ত।
_________________
রুবাইয়ার বুকের ভেতর টা কেমন যেন খচখচ করে উঠল। চোখে জল টইটুম্বুর। তবে আঁধার খেলায় ইউশরা বুঝতে ও দেখতে অক্ষম হলো। রুবাইয়া শান্ত গলায় বলল,
” ছেলেরা তো শত ঝড়ঝাপটা বুক দিয়ে আগলে ধরেও চোখের জল অদৃশ্য রাখতে পারে।আল্লাহ তা’য়ালা নিজেই সেই ক্ষমতা ছেলেদেরকে উজাড় করে দিয়েছেন। তাহলে সমুদ্র সেদিন কেন কেঁদেছিল মা? ওর তো কাঁদার কথা নয়। এই অবধি তোমার মুখে ওর যতটা বেখেয়ালীপনা শুনেছি তাতে তো ওর পক্ষে কাঁদা অসম্ভব। ”
” কিছু কিছু অসম্ভবও পরিস্থিতির স্বীকারে পরে সম্ভব হয়ে যায়। তবে প্রকাশটা করা টাই হয়ে উঠে দুঃসাধ্য। ”
” হয়তো! আচ্ছা মা, তারপর কী আর তোমাদের মাঝে কথা হয়নি? দেখা হয়নি? সেদিনই কী সম্পর্কের টানে ইতি শব্দটি জুড়ে গিয়েছিল? ”
ইউশরা স্মিত হাসল। বলল,
” আমাদের সম্পর্ক টা কী এতটাই ঠুনকো ছিল যে এক কথায় শেষ হয়ে যাবে? মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম শেষ অবধি অপেক্ষা করব। হয়তো সমুদ্রও মনে মনে তা ঠিক করেছিল। তাই হয়তো এতকিছুর পরেও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পেরেছিলাম দু’জন । এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম সম্পর্কের বাঁধনকে আরও ৫ মাস।”
” তারমানে তখনও তোমার বিয়ে হয়নি? ”
” কালো মেয়েদের বিয়ে বড্ড জ্বালারে। মা হতেও বোধহয় এত কষ্ট না,যতটা কষ্ট হয় কালো মেয়েদের বিয়ের ঘর ঠিক করতে। ”
” তারপর? ”
” সেদিন গুলোতে নামাজে বসে আল্লাহর কাছে কত যে সমুদ্রের একটা জবের জন্য ভিক্ষে চেয়েছি হিসেব নেই। অগণিত হিসেবে চেয়েছি। নামাজে বসলেই চোখ ভরে আসতো। কিন্তু তাও কোনো লাভ হতো না। আল্লাহও হয়তো নাকোচ ছিল। নারাজ ছিল আমার কোনো কাজকর্মে। বড্ড হতাশায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি।আর এভাবেই ভালোমন্দ মিলিয়ে দিন পার হচ্ছিল আমার। এরই মাঝে ভার্সিটির পিকনিকের ডেট ঘনিয়ে আসল। তাই সবকিছু ভুলে পিকনিকটা ইনজয় করতে চেয়েছিলাম। যদি এরপর আর কখনো সমুদ্রকে কাছ থেকে না পাই সেই জন্যে। তার অবশ্য শক্তিশালী একটা কারণও ছিল। মা বলেছিল আমার জন্যে একটি বিয়ের ঘর এসেছে। যেখানে স্বয়ং ছেলে নিজে আমাকে পছন্দ করেছে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। তারউপর ভালো চাকরিও করে। দেখতেও লাখে একজন। ফলস্বরূপ ছেলের টাকা পয়সা, জমিজিরাত কোনো কিছুর অভাব নেই আর না আছে লোভ। ছেলের চাওয়া ছিল কেবল একটিই। আর তা হলো স্বয়ং আমি।
এতে আমার পরিবারের সকলের তো খুশির শেষ ছিল না। অবশ্য এর মাঝে যদিও মায়ের খুশি পরিলক্ষিত হয়নি, তারপরও বাকিরা যেন আকাশ ছোঁয়া খুশি হাতের নাগাল পেয়েছে। আর পাবে নাই বা না কেন? যে মেয়েকে শত ছেলে দেখিয়েও বিয়ের আসরে বসাতে পারেনি, সেই মেয়ের এরকম বিয়ে বাড়ি বয়ে এসেছে। সে কি কম কথা! আর বাবার তো ছেলের অর্থ সম্পদের কথা শুনে জিহবে সাঁন ধারানোর মত অবস্থা। যার ফলে আমাকে না জানিয়েই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে। যা ছিল পিকনিক থেকে আসার দু সপ্তাহ পরেই। ”
রুবাইয়া চোখ দুটো বড় বড় করে বলল,
” তারমানে সেই লোকটিই আমার বাবা। তাই না মা?”
ইউশরা মুচকি হাসল। বলল,
________________________
বুধবার, সকাল ৭টা। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মোট ৪ টি বাস নিয়ে রওনা হলাম আমরা কক্সবাজার ট্যুরের উদ্দেশ্যে। সিট নাম্বার অনুযায়ী আমার পাশের সিটে আফরোজা বসার কথা হলেও বসেছে সমুদ্র। তখন অবধি আমি সমুদ্রকে বলিনি আমার বিয়ে ঠিক হবার কথা। আর না বলেছি অন্যদের। কারণ আমি চাইনি এই ট্যুরটা কোনো কারণে নষ্ট করতে কিংবা ভেস্তে যেতে দিতে। আমি সর্বক্ষণ চেয়েছি এই ট্যুরটা স্মরণীয় করে তুলতে। শেষ স্মৃতি টুকু মধুময় করে তুলতে। হাসিমুখে সমুদ্রের সঙ্গকে উপভোগ করতে। নিজের ইচ্ছেমত সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র বিলাসীনি নামে খ্যাতি অর্জন করতে। যার দরুণ ব্যাগে একটি লাল রঙা সুতি শাড়িও নিয়েছিলাম। আমার যে খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর সমুদ্রের হাত ধরে, পায়ে পা মিলিয়ে লাল রঙা শাড়ি পড়ে সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র স্নান করব। কিন্তু তা হয়তো কপালে ছিল না। ফলস্বরূপ এই সুযোগটিকে হাতছাড়া করতে মোটেও ইচ্ছে করেনি। লোভ কাজ করেছিল। প্রচন্ড রকমের লোভ কাজ করেছিল এই সুযোগটির মাঝে। শুধু একটি জিনিসই বারবার ভেবেছি, ছোট্ট একটি শখই তো……পূরণ করলে কী বা ক্ষতি হবে! ভেবেছিলাম বিয়ের পর পূরণ করব, এখন না’হয় কপালের দোষে বিয়ের আগেই পূরণ করে ফেলব!
.
.
চলবে…….