নোনাস্বপ্ন পর্ব ১

#নোনাস্বপ্ন
#প্রথম_অংশ
#লেখা_মিম (Khadija Mim)

রাত সাড়ে নয়টা। পুরো ঘরময় পায়চারী করছে তৌহিদ। বারবার বারান্দা দিয়ে নিচে তাকাচ্ছে৷ রাত বাড়ছে অথচ পুষ্প আসার কোনো খবর নেই৷ সাথে করে বাচ্চাটাকেও নিয়ে গেছে৷ কখন থেকে ফোন করছে অথচ ফোনটা পর্যন্ত রিসিভ করছে না। এতটা বেপরোয়া হওয়ার আদৌ কোনো মানে আছে কি? দুশ্চিন্তা এবং রাগ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে। এটলিস্ট বলে তো যেতে পারতো কোথায় গিয়েছে। কতধরনের দুর্ঘটনাই তো আজকাল ঘটে৷ ঢাকা-শহরের রাস্তাঘাটে আজকাল মেয়েদের কোনো সেইফটি আছে নাকি?

দশটার দিকে বাসা ছেড়ে নিচে এসে দাঁড়ালো তৌহিদ৷ বাসায় বসে আর ভালো লাগছিলো না৷ দুশ্চিন্তাটা যেনো ক্রমশ বাড়ছিলো৷ কোথায় খুঁজবে কার কাছে খোঁজ নিবে সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না। এই শহরে পুষ্পের আত্নীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই। খালা আছে একজন৷ তার বাসায় ফোন করে পুষ্পকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাকি রইলো পুষ্পর বন্ধু -বান্ধব। কারো নাম্বার এড্রেস জানা নেই তৌহিদের। বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারী করে টং দোকানের সামনে এলো সিগারেট কিনবে বলে৷ হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিতেই দেখলো একটা সাদা গাড়ী থেকে পুষ্প বেরিয়ে আসছে। পরনে মোটামুটি ভারী কাজের কাতান শাড়ী, খোপায় ফুল৷ বেশ ভালোই সেজেছে৷ খুব সম্ভবত কোনো পার্টিতে গিয়েছিলো৷ পুষ্পের পিছুপিছু বেরিয়ে এসেছে একটা ছেলে৷ তাদের একমাত্র মেয়ে পিহু ছেলেটার কাঁধে মাথা ফেলে ঘুমুচ্ছে৷ ছেলেটাকে আগেও দুই তিনবার বাসায় আসতে দেখেছে তৌহিদ৷ ছেলেটা নাকি পুষ্পর ক্লাসমেট। তখন অতটা খেয়াল দেয়নি সে৷ দিতে ইচ্ছে হয়নি। তবে আজ ছেলেটাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে৷ সিঁড়ি বেয়ে পুষ্পর পিছন পিছন উপরে যাচ্ছে ছেলেটা৷ দেখতে বেশ সুদর্শন। একদেখাতেই যেকোনো মেয়ে ঘায়েল হয়ে যেতে পারে৷ যেভাবে হেসে হেসে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো দেখে তো মনে হলো তার বউটাও হয়তো ঘায়েল হয়েছে। পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেটটা জ্বালিয়ে নিলো তৌহিদ। ধীর পায়ে বাসার দিকে এগুতেই দেখতে পেলো ছেলেটা নেমে এসেছে৷ তৌহিদের ইচ্ছে হচ্ছিলো ছেলেটাকে আরেকবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে। নিজের সাথে একটাবার ছেলেটার তুলনা করতে। তৌহিদকে সেই সুযোগ না দিয়েই খুব দ্রুত গাড়ীর ভিতর ঢুকে পড়লো ছেলেটা৷ নিরাশ হলো তৌহিদ। মুখের সিগারেটটা ফেলে দিলো মাটিতে৷ মাঝেমধ্যে জীবনে এতটাই ধূসর হয়ে যায়, তখন বোধহয় সিগারেটটাও আর ফুঁকতে ইচ্ছে হয় না। ধীর পায়ে হেলেদুলে বাসায় গেলো তৌহিদ৷ সদর দরজাটা খোলা। ডাইনিং রুমে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটু একটু করে পানি খাচ্ছে পুষ্প। বরফ ঠান্ডা পানি৷ পুষ্পের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো তৌহিদ৷ চেহারায় বিরক্তি বিষন্নতা রাগ একসাথে ভর করেছে। সেদিকে খেয়াল নেই পুষ্পের। একগ্লাস পানি খাওয়া শেষে আরেকগ্লাস পানি নিলো সে। ডাইনিং টেবিলের উপরে থাকা আইস ট্রে থেকে গোটা তিনেক বরফ ঢেলে নিলো গ্লাসে৷

-এত ঠান্ডা পানি খাচ্ছো কেন?
– যা গরম পড়েছে। পানি খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছি না৷ মনে হচ্ছে পিপাসা বুঝি রয়েই গেছে।
– আমার দিকে তাকিয়ে কি উত্তর দেয়া যায় না?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কোথায় ছিলে?
– বান্ধবীর বিয়ে ছিলো আজকে৷
– বিয়ের পর হাজবেন্ডসহ মেয়েদের দাওয়াত দিতে হয় এটা বোধহয় তোমার বান্ধবী জানে না।
– জানে। ও আপনাকে সহ দাওয়াত দিয়েছিলো। কার্ডে আপনার নামটাই লিখা ছিলো।
– কই তুমি তো আমাকে বলোনি?

চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো পুষ্প। রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– যে ব্যাপারে আপনার ইন্টারেস্ট নেই সে ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলার কোনো মানে আছে কি?

পুষ্প রুমে গিয়ে গা থেকে শাড়ী গহনা ছেড়ে বাথরুমে গেলো গোসলটা সেড়ে নিতে৷ পুষ্পের ঘরে এলো তৌহিদ। সচরাচর এই ঘরটাতে আসা হয়না তার। পুষ্প আলাদা থাকছে সাড়ে সাত বছর হলো৷ পিহু হওয়ার মাস তিনেক আগে থেকেই আলাদা রুমে থাকা শুরু করেছিলো ও। সেই থেকে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো রুমে পা দেয়নি৷
ছোট্ট মেয়েটা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। মুখের উপর কতগুলো চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। মেয়ের পাশে একটা বালিশ টেনে শুয়ে পড়লো তৌহিদ। কপালের উপর থেকে চুলগুলো খুব সাবধানে সরিয়ে দিচ্ছে৷ মেয়েটা অতটাও তার ভক্ত না। সর্বক্ষণ মায়ের আঁচল ধরেই ঘুরে। কখনো ইচ্ছে হলে নিজে থেকে তার কোলে আসে। আর নয়তো জোর করেও তাকে কোলে নিতে পারে না তৌহিদ। ভুলক্রমে জোর করে একবার কোলে নিলেই হলো, অমনি মা মা করে চিৎকার দিয়ে উঠে। মা মেয়ের জগতে তৌহিদের পায়ের নিচের মাটি কতটা শক্ত সেটা বিগত কিছুদিনে বেশ ভালোই আন্দাজ করে নিয়েছে তৌহিদ। দুজনকে দুজনকে আঁকড়ে ধরে বেশ ভালোই বাঁচতে শিখে গেছে। সেখানে তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

গোসল সেড়ে মাত্রই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে পুষ্প। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুলগুলো ভালো করে মুছে নিচ্ছে। তৌহিদ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে পুষ্পের দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে চুল মোছা দেখছে। দিনদিন সুন্দরী হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। ছয়বছরের একটা বাচ্চা আছে এটা কি ওকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে? কখনোই করবে না। একটা মানুষ হুট করে এত সুন্দর কি করে হতে পারে? কিভাবে সম্ভব? নাকি দোষ তার নজরের? অবহেলার নজরে বোধহয় তীব্র সৌন্দর্য্যও ফিকে হয়ে যায়!

হাতজোড়ায় শিরশির অনুভূতি হচ্ছে৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছে ভেজা চুলগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে দিতে। চুলের গোড়ায় গোড়ায় স্পর্শ করতে। ইচ্ছেটাকে সংবরণ করা অতি জরুরী। সম্পর্কের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে সামনেরজনের কাছ থেকে শারীরিক কিছু আবদার করাটা অসভ্যতামী ছাড়া আর কিছুই না। খুব দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তৌহিদ৷ রুম থেকে বের হতে হতে বললো,
– পুষ্প, টেবিলে খাবার দাও।
– খাবার তো নেই৷ আজ বৃহস্পতিবার। আপনি তো কখনো বৃহস্পতিবারে বাসায় খান না। বাহিরে থাকেন। বাহিরে খান। এজন্য আমি শুধু দুপুরের রান্নাটাই করেছি।
– গত একমাসে আমাকে দেখেছো বাহিরে কোথাও থাকতে বা বাহিরে ডিনার করতে?
– গত সপ্তাহেও তো বাহিরে খেয়েছিলেন।
– হ্যাঁ, ঐটা বন্ধুদের সাথে খেয়েছি। খাওয়া শেষে বাসায় চলেও এসেছি। বাহিরে সারারাত থাকিনি।
– হ্যাঁ, আপনি তো প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বন্ধুদের সাথেই ডিনার করেন। বাহিরে থাকেন। বন্ধুর নাম করে অন্য কারো সাথে তো আর থাকেন না তাই না?
– অন্য কার সাথে থাকবো? কি আশ্চর্য!
– তো এখন কি খাবেন?
– কি রান্না করবে করো।
– এইরাতে কি রান্না করবো? এলাকার মোড়ে যে বিরিয়ানির দোকানটা আছে সেখান থেকে বিরিয়ানি খেয়ে আসেন।
– বাহিরে যাবো না৷ ঘরেই খাবো। ভাত, ডিম ভাজি আর ডাল রান্না করো।
– আধাঘন্টা দেরী হবে কিন্তু।
– আসো আমি হেল্প করি তোমাকে। দ্রুত শেষ হবে।
– আপনাকে আসতে হবে না৷ আমি একাই করে নিবো।
– আমি হেল্প করলে সমস্যা কোথায়?
– কোনো প্রয়োজন নেই।
– সবকিছু প্রয়োজন মোতাবেকই হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।

কথা বাড়ালো না পুষ্প। তৌহিদকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। পিছন পিছন গেলো তৌহিদ। খুব দ্রুত কাজ করার চেষ্টা করছে সে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পুষ্পের কাজ করা দেখছে। সেই কখন থেকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা। একবারের জন্যও তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়নি পুষ্পের। ব্যাপারগুলো বড্ড পীড়াদায়ক। কাছের মানুষের অবহেলার পীড়াগুলো বোধহয় এমন অসহ্য যন্ত্রণারই হয়! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার রঙীন দুনিয়ায় খুব ভালো আছো তাই না পুষ্প?

ভ্রু কুঁচকে তৌহিদের দিকে তাকালো পুষ্প। বললো,
– রঙিন দুনিয়া মানে?
– এই যে একদল বন্ধু-বান্ধব, পিহু, বাহিরে ঘুরাফেরা, হৈ-হুল্লোড়, ভার্সিটি, বিজনেস সব মিলিয়ে ভালোই তো আছো তাই না?
– কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
– বুঝেও না বুঝার ভান করছো কেন?
-দেখুন, ২০-২২ দিন যাবৎ আপনার নাটকগুলো হজম করছি। আপাতত নাটক হজম করার মত মানসিক শক্তি আমার একদম নেই। সারাদিন দৌঁড়ের উপর ছিলাম৷ আপাতত কাউকে রান্না করে খাওয়ানোর মত এনার্জি আমার নেই। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। মাথাটাও ব্যথা করছে বেশ। তবু ঘুম আরাম ফেলে রান্না করছি। আমাকে শান্তিমতো রান্না করতে দিন। এ সমস্ত কথা বলে আমার গায়ে আগুন লাগাতে আসবেন না।
– কে বলে তোমাকে বিজনেস করতে? তাছাড়া একটা কাজের লোকে যদি নাহয় তো বলো আরেকটা এনে দিচ্ছি। এসব বিজনেস বাদ দাও৷ আমার টাকা তো মাস শেষে পড়েই থাকে৷ খাওয়ার লোক নেই৷ এগুলো কে খাবে শুনি?
– আম্মার অনেক যত্নের বিজনেস এটা। একটু একটু করে আম্মা এটাকে এতখানি টেনে এনেছে। ভালোবেসে এটার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে। এটাকে আমি ছাড়ছি না৷ তাছাড়া আপনার টাকার আশায় যাতে আমাকে বসে থাকতে না হয় এজন্যই আম্মা আমার হাতে ব্যবসায়ের দায়িত্ব দিয়ে গেছে।
– টাকার আশা করার কথা এখানে আসছে কেন? আমার টাকায় কি তোমার হক্ব নেই?
– আপনি কি রাতে ঘরে খেতে চান?
– চাই।
– তো চুপ থাকেন। এসব নিয়ে আর একটা কথা বললে আমি আর রান্নাই করবো না।

পুষ্পের ধমক শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো তৌহিদ। টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে খাবারের৷ ডাইনিংরুম থেকেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে রান্নাঘরের দিকে৷ আপনমনে কাজ করে যাচ্ছে পুষ্প৷ এদিক সেদিক নজর দেয়ার সময় তার নেই।

মিনিট বিশেক বাদে টেবিলে খাবার নিয়ে এলো পুষ্প। প্লেটটা তৌহিদের সামনে রেখে বললো,
– প্লিজ একটু নিজে নিয়ে খেয়ে নিবেন৷ আজকে খাবার বেড়ে দিতে পারবো না। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারছি না।
– পুষ্প, আমি তোমাদের সাথে ঘুমাবো৷ দরজাটা খোলা রেখো৷ আমি খেয়ে আসছি।

তৌহিদকে কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো পুষ্প। সজোরে শব্দ করে দরজাটা আটকে দিলো সে। তৌহিদ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটার দিকে।

সকাল সাড়ে সাতটার দিকে চোখ কচলাতে কচলাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো পুষ্প। ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই দেখতে পেলো তৌহিদ বসে আছে৷ গতরাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে যে অবস্থায় তৌহিদকে দেখে গিয়েছিলো ঠিক একই অবস্থায় এখনো বসে আছে। চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট৷ খাবারগুলো আগের মতই পড়ে আছে৷ কিছুই মুখে দেয়নি সে। বেশ অবাক হলো পুষ্প৷ ঘুম জড়ানো কন্ঠে তৌহিদকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি ডিনার করেননি?
-না।
– সারারাত এখানেই বসে ছিলেন?
– হুম।

কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো পুষ্প। অহেতুক রান্না করানোর কোনো মানে ছিলো? তৌহিদকে কিছু না বলেই টেবিল গোছাতে শুরু করলো সে। চুপচাপ বসে পুষ্পের টেবিল গোছানো দেখছে তৌহিদ। এতটা নির্লিপ্ত একটা মানুষ কি করে হতে পারে? সারারাত একটা মানুষ না খেয়ে না ঘুমিয়ে এখানে বসেছিলো কেন তা কি একটাবারও জানতে ইচ্ছে হলো না পুষ্পের? তবে কি তার প্রতি সমস্ত আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলো মেয়েটার? আকর্ষণের জায়গাটায় কি এখন অন্য কেও বিচরন করে? রাগ হচ্ছে তৌহিদের। নিয়ন্ত্রণ সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে রাগটা।

চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে ডাইনিং রুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছিলো পুষ্প। আচমকা তৌহিদ এসে ওর বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। একরাশ বিস্ময় নিয়ে পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
– আমার দিকে কি তোমার নজর পড়ে না?
– সুস্থই তো আছেন৷ তাহলে নজর কেন দিবো?
– এমন করছো কেন?
– কি করলাম?
– আমি সম্পর্কটা আবার ঠিক করতে চাচ্ছি কিন্তু তুমি সেটা ঠিক হতে দিচ্ছো না। কেন?
– আবার ঠিক করতে চাচ্ছেন মানে? সম্পর্ক কোনোকালে ঠিক ছিলো?
– পুরোনো কথা কেন ঘাঁটাচ্ছো?
– আপনি আমাকে ঘাঁটাচ্ছেন তাই আমি পুরোনো কথা ঘাঁটাচ্ছি।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তৌহিদের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো পুষ্প। রান্নাঘরের দিকে এগুতেই পুষ্পকে বাহুবন্দী করে হেঁচড়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো তৌহিদ। ঘরের দরজা আটকে ধাক্কা মেরে পুষ্পকে বিছানায় ফেলে দিলো। মেজাজ চরমে যেয়ে পৌঁছাচ্ছে পুষ্পের। দাঁত মুখ শক্ত করে তৌহিদকে বললো,
– সমস্যা কি? হ্যাঁ? সকাল সকাল এমন অশান্তি শুরু করেছেন কেন?
– আমি শান্তিতে নেই৷ এসব সকাল সন্ধ্যা হিসেব করে কোনো কাজ আমি করতে পারবো না।
– আমি তো আপনার শান্তি নষ্ট করিনি। যার জন্য শান্তি নষ্ট হয়েছে তার সাথে ঝামেলা করেন। শুধু শুধু আমার সাথে এমন করছেন কেন?
– আমার সংসার ঠিক নেই৷ এটাই এখন আমার বড় অশান্তি৷ তুমি সংসার ঠিক হতে দিচ্ছো না।
– কোন দিক দিয়ে মনে হচ্ছে সংসার ঠিক নেই৷ সর্বদিক থেকে সংসার ঠিকাছে। ঘরের জন্য বাজার করছেন। কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল পে করছেন৷ আমি রান্না করছি। ঘর গুছাচ্ছি৷ মেহমান আসলে আপ্যায়ন করছি। গোটা সংসারটাকে বুকে আগলে ধরে রেখেছি৷ প্রতিনিয়ত সংসারটার যত্ন নিচ্ছি। এরপরও আপনার অভিযোগটা কোথায় শুনি?
– আমার যত্ন নিবে কে?
– কেন? আমি কি নিচ্ছি না? যখন যা ফরমায়েশ করছেন রেঁধে খাওয়াচ্ছি৷ অসুস্থ হলে সেবা করছি। কাপড় চোপড় ময়লা হলে সেগুলো ধুয়ে আয়রন করে আবার আপনার আলমারীতে ভাঁজ করে রাখছি। এমনকি আপনাকে কখনো টাকা পয়সার জন্যও প্রেশার দেইনি। আমার টাকা দিয়েই আমি আমার যাবতীয় খরচ চালাই। পিহুর ম্যাক্সিমাম খরচ আমি নিজের পকেট থেকেই দেই৷ আপনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা আমি দিয়ে রেখেছি৷ যেখানে খুশি যাচ্ছেন। ইচ্ছে হলে বাসায় আসেন, ইচ্ছে না হলে বাহিরে কাটিয়ে দেন। যখন যা খুশি তাই করেন। আমার নিজের বা পিহুর হাজার অসুখ বা প্রয়োজনে কখনোই আপনাকে টানি না৷ নিজেরটা নিজেই সামাল দিই। এরপরও যদি বলেন আপনি স্যাটিসফাইড না এই সংসার থেকে বা সংসারটা আপনার কাছে বেঠিক মনে হচ্ছে তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।
– আর আমাদের দুজনের সম্পর্ক? এটা কি তোমার কাছে ঠিক মনে হয়?
– হ্যাঁ। আমি তো বেঠিক কিছু দেখি না৷ আট বছর ধরে তো আমাদের সম্পর্ক এভাবেই চলছে৷ এতদিন তো আপনার মনে হয়নি সম্পর্কটা স্বাভাবিক না। আজ হঠাৎ কি ভেবে সম্পর্কটাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আপনার?
– শুরু থেকেই অস্বাভাবিক ছিলো৷ আমি রিয়েলাইজ করতে দেরী করে ফেলেছি।
– কই আমার কাছে তো অস্বাভাবিক লাগে না। ঠিকই তো আছে সবকিছু।
– তুমি এমন কেন করছো পুষ্প? তুমি নিজেও ভালো করে জানো আমাদের মাঝে দূরত্ব কতখানি।

বাহির থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ছে। কচি একটা কন্ঠ ভেসে আসছে দরজার ওপাশ থেকে।
– আম্মু দরজা খুলো। আমি তোমাকে খুঁজি।
মেয়ের গলার স্বর পেয়ে পুষ্প খুব দৃঢ় কন্ঠে তৌহিদকে বললো,
– চুপ। মেয়েকে শুনিয়ে কোনো ধরনের ঝগড়া করবেন না৷ আমার মেয়ে এসব ভয় পায়। আর চেহারার নকশা ঠিক করেন। এমন প্যাঁচামুখ নিয়ে মেয়ের সামনে দাঁড়াবেন না।

ঠোঁটের কোনে মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো পুষ্প। দুহাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সে৷ মায়ের কাঁধে মাথা ফেলে কি যেনো বিড়বিড় করে বলছে পিহু৷ সেসব তৌহিদের কান পর্যন্ত স্পষ্ট পৌঁছাচ্ছে না৷ ওদের মা মেয়ের সম্পর্কের গভীরতা দেখলে মনটা ভীষণ বিষিয়ে উঠে আজকাল৷ এত ভালোবাসার মাখামাখিতে তার কোনো স্থান নেই। পুষ্প কি পারে না অতীতটা ভুলে গিয়ে একটাবার তাকে মনের কোণে একটু জায়গা দিতে? মা মেয়ের ভালোবাসার মাখামাখিতে তাকে একটু অংশ দিতে? পারে৷ অবশ্যই পারে৷ এসব ভাবলে দমবন্ধ হয়ে আসে তৌহিদের। এই মুহূর্তেও ঠিক একই অনুভূতি হচ্ছে। ড্রেসিংটেবিলের উপর থাকা ওয়ালেট আর গাড়ীর চাবিটা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো সে।

মেয়েকে নাস্তা খাওয়াচ্ছে পুষ্প। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো ওর৷ বেশ তড়িঘড়ি করেই কলটা রিসিভ করলো সে।
– কেমন আছেন আতিক ভাই?
– হুমম, ভালো। তুমি ভালো আছো?
– জ্বি ভালো আছি।
– পিহু? ও কেমন আছে?
– এইতো ভালো।
– শোনো, তোমার ভাবী বললো তোমাকে বাসায় আসার দাওয়াত দিতে।
– কেন? আজকে কি বাচ্চাদের জন্মদিন?
– না।
– তাহলে? আপনাদের এ্যানিভার্সারী?
– সেটাও না।
– তাহলে উপলক্ষ্যটা কি?
– আমার বাসায় আসতে কি এখন তোমার উপলক্ষ্য লাগবে পুষ্প? নীলা বলছিলো অনেকদিন হয় তোমাকে দেখে না তাই তোমাকে বাসায় আসতে বলেছে।
– ওহ্। তাহলে ভাই আমি বিকেলের দিকে পিহুকে নিয়ে আসবো ঠিকাছে?
– কিসের বিকেল! তুমি এখন আমার বাসায় আসবে৷ দুপুরে নীলা তোমাকে ছাড়া খেতে বসবেনা। স্পেশাল শুটকির ভর্তা বানানো হবে আজকে। তোমাকে সাথে নিয়েই সে ভর্তা দিয়ে ভাত খাবে। দাঁড়াও নীলাকে দিচ্ছি৷ ও দাওয়াত না দিলে বোধহয় তুমি আসবে না।
– না, না৷ আপনি বলেছেন এতেই হবে৷ ভাবী আমাকে না বললেও চলবে।
– আসছো তো তাহলে?
– হ্যাঁ আসবো।
– এক্ষুনি?
– হাতে সামান্য কাজ আছে। ওগুলো সেড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে যাবো আপনার ওখানে।

কলটা কেটে তৌহিদের দিকে তাকালো আতিক। বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে তৌহিদ জিজ্ঞেস করলো,
– ও আসবে বলেছে?
– হ্যাঁ। এগারোটা নাগাদ চলে আসবে।
– প্লিজ ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস কথাগুলো।
– এখন কেন তুই এমন অস্থির হচ্ছিস৷ বহুবছর আগেই তোকে আমি খালাম্মা খালু সতর্ক করেছিলাম। তুই শুনিসনি৷ এখন বুঝ কেমন লাগে। প্রেমিকাকেও হারালি নিজের বউকেও হারালি৷ তবু আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় কর পুষ্প এখনো তোর অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে কিছু জানে না৷ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুযোগ তোর হাতে আছে৷ ও জেনে ফেললে কখনোই তোর সংসারে থাকতো না৷ কবেই চলে যেতো৷ তখন আর সম্পর্ক ঠিক করার আবদার ধরতি কার কাছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here