নোনাস্বপ্ন শেষ পর্ব

#নোনাস্বপ্ন
#তৃতীয়_অংশ
#লেখা_মিম (Khadija Mim)

-হসপিটাল থেকে আসার পর ম্যাক্সিমাম টাইমই অসুস্থ থাকতাম। প্রথম তিনমাস যেমন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারতাম তেমন আর ছিলাম না। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ৷ বমি করতাম প্রচুর। শরীর দূর্বল লাগতো। এমনিতেই হ্যাংলা ছিলাম৷ এরপর আরো হ্যাংলা হয়ে গেলাম৷ আম্মা ব্যবসা বানিজ্য ছেড়ে সারাদিন পিছনে পড়ে থাকতেন। খেতে পারতাম না৷ জোর করে মুখে খাবার তুলে দিতেন৷ বমি করে সব ফেলে দিতাম। এরপর আবার খাওয়াতেন। তিল পরিমান যত্নের ঘাটতি আম্মা হতে দেয়নি৷ আর সেদিনের পর থেকে পিহুর আব্বু আমার কাছে তেমন একটা আসতোও না৷ কেমন যেনো আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। এই যেমন ধরেন রাতে ঘুমানোর সময় উনার গায়ে হাত পা লাগলে উনি খুব দ্রুত সরিয়ে ফেলতেন৷ ভাবতাম আম্মা ঐ কথা বলাতে বুঝি উনি এমন দূরত্ব রেখে চলছেন৷ মানসিক দূরত্ব তো ছিলোই। এবার শারীরিক দূরত্বও তৈরী হতে লাগলো। প্রেগন্যান্সির সাত মাসে যখন পড়লো তখন থেকে শুরু হলো ব্যাকপেইন৷ যন্ত্রণায় সারারাত ঘুমাতে পারতাম না। কাঁদতাম। একদিন উনি বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি আম্মার সাথে থাকো। রাতে তোমার জন্য ঘুমাতে পারি না। সকালে অফিস করতে কষ্ট হয়।
আমিও বাধ্য স্ত্রীর মতো আম্মার রুমে শিফট হয়ে গেলাম। রাজপুত্রের কষ্ট হবে তা কি করে মেনে নেই। উনি উনার মত আর আমি আমার মত থাকতাম। মাঝে মধ্যে দেখতাম কল আসতো উনার ফোনে৷ বাসার বাহিরে যেয়ে রিসিভ করতো৷ কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে বাসায় চলে আসতো৷ আব্বা দুই তিনদিন জিজ্ঞেস করেছিলো কার সাথে কথা বলিস বাহিরে গিয়ে? উনি উত্তর দিতো অফিসিয়াল কথাবার্তা। আমরা বিশ্বাস করে নিতাম।
ডেলিভারি ডেট চলে এলো৷ শরীরের অবস্থা আমার খুবই খারাপ। ডক্টরও বলে দিলেন মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে৷ খারাপ কিছু হলেও হয়ে যেতে পারে। অবশ্য কথাগুলো আমি জানতাম না৷ আম্মা আমাকে তখন বলেনি৷ আমি পরে শুনেছি এসব। কিন্তু আমার বাড়ি আর এই বাড়ির সবাই জানতো। যেদিন আমার সিজার করানো হবে সেদিন রাজপুত্রের হাতটা আমি ছাড়তে চাচ্ছিলাম না৷ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম৷ মনে হচ্ছিলো ও.টি. তে একবার আমাকে ঢুকালে আমি আর জীবিত ফিরে আসবো না৷ মরণের ভয়টা একদম জেঁকে ধরেছিলো৷ পিহুর বাবাকে শেষবারের মত একবার জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছিলাম। সুযোগ ছিলোও৷ আম্মা সবাইকে রুম থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের আলাদা কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য৷ উনার হাত ধরে আমি কিছু বলতে পারছিলাম না৷ ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম শুধু। আর উনি নির্বিকারভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ উনার হাতটা ছেড়ে আমি উনাকে জড়িয়ে ধরতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
– তোমাকে ও.টি. তে নিয়ে যাবে এখন৷ ছাড়ো।
আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জড়িয়ে না ধরতে পারুক এটলিস্ট মাথায় হাত রেখে বলতে তো পারতো, পুষ্প তোমার কিচ্ছু হবে না৷ আল্লাহ ভরসা।
উনি কিছুই বলেনি। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো৷ আমি তাকিয়ে তাকিয়ে উনার চলে যাওয়া দেখছিলাম৷
ডেলিভারি হলো। পিহু সুস্থ ছিলো। ঝামেলা হলো আমাকে নিয়ে৷ জমে মানুষে টানাটানি চললো দুইদিন আমাকে নিয়ে। কান্নার রোল পড়ে গেলো হসপিটালে৷ আমার এখনো একটা কথা কানে বাজে। আমার পুরোপুরি সেন্স ছিলো না৷ হুটহাট আশপাশের কথাগুলো শুনতে পেতাম। কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর বা কথা বলার মতো সেন্স ছিলো না৷ তখন আম্মা আমার কানে কানে বলেছিলো,
– মা রে, সুস্থ হো। তোর একটা মেয়ে হয়েছে। দেখতে একদম পরীর মতন৷ মেয়েটাকে দেখবি না? একটু কোলে নিয়ে আদর করবি না? আমার ছেলে তো পরীকে দেখে রাখবে না। তুইও কি পরীকে ছেড়ে চলে যাবি? সুস্থ হো শিগগির। মেয়ের দায়িত্ব নিতে হবে তোকে।

গলা ধরে এলো পুষ্পের। চোখে পানি ছলছল করছে। কন্ঠনালীতে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে। টানা কথা বলতে বলতে গলাটাও শুকিয়ে এসেছে। একটু পানি খাওয়া দরকার। মাথা নিচু করে নীলাকে বললো,

– ভাবী একটু পানি হবে? বরফ মিশানো পানি?

নীলা চুপচাপ উঠে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এলো। একটু একটু করে পানি খাচ্ছে পুষ্প। খানিকটা বিরক্তির স্বরে বললো,

– এত্ত গরম পড়েছে না! উফফ! ঠান্ডা পানি খেয়েও কোনো কূল-কিনারা করতে পারছি না৷ গলাটা বারবার শুকিয়ে আসে৷
যেটা বলছিলাম,,,, আম্মার ঐ কথাটা এখনো মনে হয় যেনো আমি শুনতে পাচ্ছি। বাসায় এলাম। সুস্থ হতে প্রচুর সময় লেগেছিলো। আম্মার রুমেই থাকতাম। পিহুর আব্বু মাঝেমধ্যে এই রুমে আসতো৷ পিহুকে কোলে করে নিয়ে যেতো৷ আবার পাঁচ দশমিনিট পর এসে দিয়ে যেতো৷ ব্যস, এতটুকুই। আমি কেমন আছি, আমার কোনো কিছু প্রয়োজন কিনা সেগুলো দেখার কোনো প্রয়োজন উনার ছিলো না। কিছুক্ষণ বসে আমার সাথে কথা বলার সময় পর্যন্ত উনার ছিলো না। আবার এমনও সময় যেতো পিহুকেও দেখতে আসতো না৷ নিজের মত করে সময় কাঁটাতো। আব্বা কত যে চেঁচামেচি করতো উনার সাথে এসব ব্যাপারে! উনার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা ছিলো না। প্রায়ই আকারে ইঙ্গিতে কি একটা বিষয় নিয়ে আব্বা উনাকে খুব বকতেন। আমি ঠিক বুঝতাম না কি নিয়ে কথা বলতেন। আর আম্মা উনাকে উনার মত ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ আব্বাকে মাঝেমধ্যে আম্মা বুঝাতো, তোমার ছেলে কুকুরের লেজের মত হয়ে গেছে। হাজার কিছুতেও ও আর শুধরাবে না। ওকে ওর মত ছেড়ে দাও।

পুরো চারমাস আম্মার সাথে থাকলাম। এরপর উনার রুমে শিফট হতে চাইলাম। শুনে উনি একদম চেঁচিয়ে উঠলেন। রাত বিরাতে বাচ্চার কান্নাকাটি উনি সহ্য করতে পারবেন না৷ কি যে কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন! বুঝে পাচ্ছিলাম না কেমন বাবা উনি! আস্তে আস্তে আব্বা উনার সাথে ঝগড়া কমিয়ে দিলো। দিনদিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো। আজকে ভালো তো কালকে খারাপ। এমন দুইমাস যাওয়ার পর আব্বা একদিন বিকেলে হুট করে মারা গেলো। তখন পিহুর সাতমাস।

থেমে গেলো পুষ্প। কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলো,
জানেন আতিক ভাই, আব্বা মারা যাওয়ার এক মাস আগে উনার প্রপার্টি আর ব্যালেন্সের ফিফটি পার্সেন্ট আমার নামে আর ফিফটি পার্সেন্ট পিহুর বাবার নামে ট্রান্সফার করে দিলেন। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে এক বিলাপ শুরু করলেন,
– পুষ্প আমাকে মাফ করে দিও। নিজেদের ভালো ভাবতে গিয়ে এমন কুলাঙ্গারের সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছি।
আব্বাকে কত বুঝাতাম আপনি তো আর ইচ্ছা করে এমন করেননি। উনি আমার কথা শুনতোই না৷ আর আম্মা উনার কথা শুনতে পিহুকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদতেন।
ওহ্! একটা কথা তো বলাই হয়নি৷ পিহু পেটে থাকা অবস্থায় আমার রেজাল্ট বের হলো৷ গ্রামে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট আমার ছিলো৷ কমার্স থেকে এ প্লাস পেয়েছিলাম। ঐ বছর আর কলেজে ভর্তি হইনি৷ পরেরবছর আম্মা নিয়ে আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলো। আমি ক্লাস করতাম আর কাজের মেয়ে পিহুকে নিয়ে টিচার্স রুমে বসে থাকতো। একটা মজার কথা শুনবেন?
– কি?
– আমি কোন কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করেছি সেটা পিহুর বাবা এখন পর্যন্ত জানে না।
– তুমি তো কখনো আমাকে বলোনি তুমি কোন কলেজে পড়ো?
– আপনাকে মাঝখানে কোনো কথা বলতে না করেছি আমি।
পুষ্পের কড়া কন্ঠস্বরে চুপ হয়ে গেলো তৌহিদ৷ পুষ্পের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বাকি অভিযোগ শোনার জন্য। তৌহিদকে থামিয়ে পুষ্প নিজের কথায় ফিরে এলো,

কত কেঁদেছি পিহুর বাবার কথা ভেবে। এমন কেন উনি? একটাবারও কি আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছা হয় না? আমার দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় না? ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়না? স্বামী থাকা সত্ত্বেও বিধবার মত জীবন কাঁটিয়েছি। বয়সটা আমার প্রেম করার ছিলো৷ খুব ইচ্ছে হতো কেউ আমাকে মনটা ভরে দেখুক। একটু প্রশংসা করুক৷ নিজ হাতে একটু সাজিয়ে দিক৷ কন্ঠে একরাশ আহ্লাদ ঢেলে দিয়ে আমাকে ডাকুক৷ আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাক৷ মানুষটা এত অবহেলা করতো৷ তবু অকারন প্রেম জাগতো মনে। কতরাত না ঘুমিয়ে কাঁটিয়েছি৷ বিছানায় সারারাত এপাশ-ওপাশ করেছি। মনে হতো রাজপুত্র এসে একটাবার আমাকে ছুঁয়ে দিলেই ঘুমটা চলে আসবে। পিহু হওয়ার সাড়ে তিনমাস আগে লাস্ট আমরা ইন্টিমেট হয়েছিলাম। এরপর থেকে আজ অব্দি একবারের জন্যও হইনি৷ পিহু এক বছরের হওয়ার পর রাতে আর বিরক্ত করতো না৷ সারারাত ঘুমাতো৷ মাঝে একবার ঘুমের মধ্যেই মুখে ফিডার দিয়ে দিতাম। ওটা খেয়ে আবার ঘুমাতো৷ আগে অযুহাত দেখাতো পিহু ডিস্টার্ব করবে৷ এখন তো আর কোনো অযুহাত নেই৷ মেয়েকে নিয়ে চলে গেলাম উনার রুমে৷ কিছুক্ষণ ধানাই-পানাই করে রাজি হলো আমাদের সাথে ঘুমাবে। মেয়েকে মাঝখানে রাখলাম। আমরা দুজন দুইপ্রান্তে৷ ঘুম আসছিলো না৷ বারবার মন চাচ্ছিলো পিহুর বাবার সাথে ঘেষে শুয়ে থাকি৷ মনের কথাটা মুখ ফুটে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না৷ শেষমেষ মাঝরাতে দেখলাম উনি উঠে আরেক রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো৷ কষ্টে ভিতর ফেটে যাচ্ছিলো আমার৷ মানুষ এত নিষ্ঠুর কিভাবে হয়? সেদিন ভোর পর্যন্ত পিহুর বাবার একটা শার্ট জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলাম। এরপরদিন আবার আম্মার রুমে চলে গেলাম৷ আম্মা শুধু নীরব দর্শকের মত এসব দেখতো। উনাকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনোমতেই হিসেব মিলাতে পারতাম না ঘরে বউ রেখে দিনের পর দিন এই লোক কিভাবে আলাদা দিন কাটাচ্ছে? তার কি কোনো চাহিদাই নেই? আগে তো শারীরিক চাহিদাটুকু ছিলো। এখন কি এটাও শেষ? দিনদিন উনাকে কাছে পাওয়ার অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। একদিন রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম জোর করে উনার গায়ে পড়বো কতক্ষণ আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে? উঠে গেলাম উনার রুমের দিকে। রাত তখন তিনটা। দরজার কাছে যেতেই শুনতে পেলাম উনি কারো সাথে কথা বলছে। দরজায় আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম। ফ্যানের বাতাসের শব্দে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না উনি কি বলছেন৷ ফজর আজানের আগ পর্যন্ত উনার কথার শব্দ পেলাম৷ ততক্ষণ উনার দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম৷ বুঝে গেলাম উনার কারো সাথে কিছু চলছে। মাথা কাজ করছিলো না। মনে হচ্ছিলো কোন দুনিয়ায় যেনো ভাসছি৷ সেদিন সকালে উনি বেরিয়ে যাবার পর আম্মাকে বললাম,
– আপনার ছেলে কারো সাথে প্রেম করে৷ গতকাল সারারাত উনি কারো সাথে কথা বলেছে।
আম্মা কথাটা শুনে কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এরপর মুখ অন্যদিক ঘুরিয়ে বললো,
– জানি। পিহু হওয়ার আগে থেকেই চলছে।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না৷ আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি এই কথাটা আমার কাছে কি করে লুকাতে পারলেন?
– সাহস হয়নি পুষ্প। জগতে নিজের ছেলের পরকীয়া নিয়ে ছেলের বউয়ের সামনে মুখ খোলার সাহস কোনো মায়ের আছে বলে আমার মনে হয় না৷
– আপনি আমাকে মেয়ে মানেন৷ এটা কি আমাকে বলতে পারতেন না? শুরুতে জানলে তো আমি এটা শেষ করতে পারতাম। আপনি আমার সেই রাস্তাও বন্ধ করে দিলেন। আপনি শুরুতে মুখ খুললেই আমার এতবড় ক্ষতিটা হতো না।
– আমার চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে তোর? তুই ঐ স্বামীর জন্য কাঁদছিস যে কখনো তোর ছিলোই না৷ আর ওর জন্য আমি আমার সেই স্বামীকে হারিয়েছি যে আমাকে ৩২ টা বছর বুকে আগলে রেখেছে। এই ছেলের পরকীয়ার কথা জানার পর থেকে তোর আব্বা কম চেষ্টা করেনি ওকে ঘরে ফেরত আনার৷ তোর আব্বা পারেনি ওকে ফিরিয়ে আনতে৷ এই ছেলের কষ্টই তোর আব্বাকে কবরে পাঠিয়েছে।
আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন৷ আমি আম্মার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। চোখজোড়ায় ক্ষোভ, কষ্ট, হাহাকার সব একসাথে ছুটোছুটি করছিলো৷ অথচ একফোঁটা পানিও ছিলো না৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর আম্মা বললেন,
– মেয়েটা কে জানিস?
– কে?
– ওর প্রাক্তন। সুবর্না। ডিভোর্স নিয়ে দেশে এসেছে৷ এখন তৌহিদকে আবার ধরেছে।

আমি আর কোনো কথা বলিনি৷ কথা বলার মত কিছু পাচ্ছিলামও না। আমি পারিনি উনাকে আটকাতে। নিজের সন্তানের জীবন বাজি রেখে উনার চাহিদা মিটিয়েছি যাতে ঐ মেয়েকে আর না মনে করে। কোনো লাভ হয়নি। রাজপুত্র আমার ভিনদেশী ডাইনীর কাছে গেলোই৷ টানা চারদিন ঘরের এই কোনায় সেই কোনায় বসে চিৎকার করে কেঁদেছি। আর আম্মা নিঃশব্দে পিহুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন৷ চারদিন পর একদিন দেখলাম পিহুর বাবার দুই কাঁধে খামচির দাগ। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন৷ আমার সমস্ত প্রশ্নের হিসেব সেদিন ঘুঁচে গেলো। চাহিদা থাকবে কেমন করে? চাহিদা তো অন্য কেও মিটাচ্ছে৷ নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি আনন্দ দিয়ে মিটাচ্ছে। বলেছিলো তো একদিন সেই কথা, আমার গার্লফ্রেন্ড আমার সমস্ত চাহিদা পূরন করতে জানে৷ হোক সেটা শারীরিক বা মানসিক।
সেদিন থেকে আর একফোঁটা চোখের পানিও আমি ফেলিনি৷ ফেলিনি বলতে আমার আর কান্নাই আসেনি৷ সমস্ত আবেগগুলো মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো৷ প্রেম প্রেম ভাবটা মরে গিয়েছিলো৷ সম্ভবত অনুভূতিগুলোও মরে গিয়েছিলো৷ আর নয়তো আমার কান্না আসেনি কেনো বলুন তো? এরপর উনার আশা ছেড়ে দিলাম। আমি আমার জগত নিয়ে থাকতে শুরু করলাম আর উনি উনার মত৷ পিহুর একবছর হওয়ার পর থেকে প্রতি শুক্রবার রাতে উনি বাসায় থাকা বন্ধ করে দিলেন৷ আম্মা আর আমার বুঝতে বাকি রইলো না উনি বন্ধুর নাম করে কোথায় যেতেন। নিজের দুনিয়ায় কিভাবে সুখে থাকতে হয় সেই শিক্ষা আম্মা আমাকে দিতে থাকলো। বারবার আম্মা আমাকে একটা কথা বলতেন, অন্যের মাঝে সুখ না খুঁজে নিজের মাঝে খুঁজে নে৷ আমিও বাধ্য সন্তানের মত আম্মার কথামতই চলতে লাগলাম। মন দিয়ে পড়া লেখা চালিয়ে গেলাম৷ আম্মা আমাকে উনার ব্যবসায়ের দায়িত্ব একটু একটু করে দিতে থাকলো। ইন্টার পাশ করলাম। জগন্নাথে অনার্সে ভর্তি হলাম। নতুন নতুন বন্ধু, পড়া, পিহু, আম্মা, বিজনেস, ঘরের কাজ, বাহিরে ঘুরাঘুরি সব মিলিয়ে আমার চেয়ে ব্যস্ত মানুষ জগতে আর হয় না৷ এত ব্যস্ততার ভীড়ে রাজপুত্রকে স্মরন করার সময় কই? আম্মা মারা যাওয়ার বছরখানেক আগে থেকে প্রায়ই বলতো ওকে তালাক্ব দে৷ নিজে একটা বিয়ে কর৷ সামনে লম্বা জীবন পড়ে আছে৷ আমি এককানে কথা ঢুকাতাম আরেক কান দিয়ে বের করে দিতাম। মারা যাওয়ার একমাস আগে আম্মাও উনার সমস্ত প্রপার্টি আমাকে দিয়ে দিলো৷ পিহুর বাবাকে এক অংশও দিলো না। প্রায়ই বলতো তোর জন্য দোয়া আর কিছু সম্পত্তি রেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারলাম না৷ তোর জীবন আমরা নষ্ট করেছি। পারলে মাফ করে দিস। আমি শুনে হাসতাম আর আম্মা কাঁদতো। কেনো হাসতাম জানেন? কারন আম্মা ভুল ছিলো৷ উনার ধারনা ছিলো আমি বুঝি চাপা কষ্ট নিয়ে ঘুরি৷ অথচ বিশ্বাস করেন আতিক ভাই, নূন্যতম কষ্ট আর আমার মাঝে নেই৷ কারন আমার মাঝে ঐ মানুষটাকে নিয়ে আর কোনো চাওয়া পাওয়াই নেই।
আম্মার কথা একদম ঠিক ছিলো। নিজের মাঝে সুখ খুঁজে নেয়াটা হাজারগুনে ভালো। আমি এখন প্রকৃত সুখী মানুষ। জগতে না পাওয়ার কোনো পীড়া আমাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। ভালো আছি আমি। অনেক ভালো।

তৌহিদ হা হয়ে পুষ্পের কথাগুলো শুনছে৷ পুষ্প সব জানতো। কোনো কিছু তার অজানা নেই৷ তাহলে এতটা দিন না জানার ভান করে কেনো বসে ছিলো?
নীলার চোখে পানি। সে পুষ্পের হাত ধরে বললো
– তুমি উনাকে ডিভোর্স কেন দাওনি?
– আছে, থাকুক। আমার মেয়েটা বাবা বলে ডাকতে তো পারছে। প্রতিদিন একবার বাবার কোলে তো চড়তে পারছে৷ তাছাড়া মানুষটা আমার জীবনের ছোটবেলার প্রথম ভালোবাসা। মনের কোনো এক কোণে এই মানুষটা আজও বাস করে। আজও তাকে ভালোবাসি৷ তবে সেটা চাওয়া-পাওয়াহীন একতরফা ভালোবাসা৷ এই ভালোবাসায় আমার কোনো সুখও নেই, দুঃখও নেই।
– পুষ্প, আজকে যখন তৌহিদ বাসায় এসে বললো ও একটা নরমাল ম্যারিড লাইফ চায় তখনই চিন্তা করে দেখলাম ওর অন্যায়গুলো ওকে আগে দেখানো উচিত। আর কথাগুলো আমার চেয়ে তুমি ভালো করে বুঝাতে পারবে। এজন্যই তোমাকে ডাকা। কোনো সমাধানের জন্য আমি তোমাকে ডাকিনি৷ আমার বিবেক আছে৷ আল্লাহ আমার ঘরেও মেয়ে দিয়েছে৷ অন্যের মেয়ের কাছে অন্যায় আবদার ধরার কথা চিন্তা করতে গেলে নিজের মেয়ের মুখটা ভেসে উঠে। এখন এটা তোমাদের ব্যাপার তোমরা কি করবে।
– আমি যেমন আছি তেমনই থাকবো৷
– আমার জায়গাটা কি অন্য কেউ নিয়ে নিয়েছে পুষ্প?
– আপনার মুখে এসব কথাই মানায়৷ যে যেমন সে তো অন্যকে ওরকমই ভাববে।
– তুমি এসব জানতে অথচ আমাকে কখনো জিজ্ঞেস কেন করোনি?
– জিজ্ঞেস করলে ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যেতো৷ আর আপনি হয়ে যেতেন বেপরোয়া৷ তখন দেখা যেতো আমার সামনেই মেয়ের সাথে প্রেম করতেন। আবার এমনও হতে পারতো আমার সামনেই মেয়েকে নিজের বেডরুমে নিয়ে যেতেন৷ লোক জানাজানি হতো৷ নানানজনে নানান কথা বলতো। অহেতুক দরকার কি এসবের? এরচেয়ে ভালো লুকিয়ে প্রেম করেন৷ আমিও না জানার ভাব নিয়ে থাকি।
– এখন বললে কেন? এখন কি আমি বেপরোয়া হবো না?
– প্রেমিকা থাকলে তো বেপরোয়া হবেন৷ আপনার প্রেমিকা যে আরেকজনকে বিয়ে করেছে সেটা আমি জানি। প্রেমিকার শোকে যখন বিপি হাই করে অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে রইলেন তখনই খোঁজ নিয়েছি আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। পরে শুনলাম আপনার প্রাক্তন আবার প্রাক্তন হয়ে গিয়েছে।
-একটা সুযোগ কি আমাকে দেয়া যায় না?
– অনেক স্বপ্ন ছিলো আপনাকে ঘিরে৷ সব স্বপ্ন আপনি পা দিয়ে পিষে দিলেন৷ সেই সাথে আমার আবেগ, ভালোবাসা আর আগের সাদামাটা আমাকে। সুযোগ কিভাবে চান আপনি? লজ্জা করে না আপনার?
-ভালোবাসি তোমাকে। জানি একের পর এক অন্যায় করে গেছি। সুবর্না চলে যাওয়ার পর যখন অসুস্থ ছিলাম তখন তুমিই কিন্তু আমার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছিলে কি হয়েছে আমার। বিশ্বাস করো, ঐ মুহূর্তে আমি একটা ছায়া চাচ্ছিলাম। তোমার স্পর্শে আমি ছায়া খুঁজে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার ঘরে স্বস্তি রেখে বাহিরে কেন ছুটেছি? তোমাকে কেন জানতে চেষ্টা করিনি বুঝতে চাইনি। সীমাহীন আফসোস হতে লাগলো। প্রতিদিন তোমাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগলাম। তোমার প্রতিটা ব্যাপার ছিলো প্রেমে পড়ার মতো। প্রতিদিন একটু একটু করে তোমার প্রেমে পড়েছি। তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি৷ বারবার নিজের অন্যায়গুলো মনে হতো৷ আর ভাবতাম যার সাথে এত অন্যায় করেছি সে কি আমার ভালোবাসা বুঝবে? তবু ভালোবেসেছি৷ আমি আর দূরত্ব চাই না৷ একটা সময় আমার ভুলের কারনে আমরা এত দূরে চলে এসেছি। এখন প্লিজ রাগ করে থেকে আর দূরত্ব বাড়িও না৷ দুইটা মাস ধরে কোন কষ্টে আমি আছি তোমাকে বুঝাতে পারবো না৷ আমার বউ সন্তান থাকা সত্ত্বেও আমি সংসার করতে পারছি না। তোমার উপর কোনো অধিকার দেখাতে পারি না৷ আমার ভালোবাসা তোমাকে দেখানোর সাহস করতে পারিনা। খুব ইচ্ছে করে তোমাদের দুজনকে সারারাত বুকে জড়িয়ে রাখি। পারি না৷ অফিসে প্রায়ই দেখি কলিগের ওয়াইফরা খাবার নিয়ে আসে৷ একসাথে লাঞ্চ করে। বন্ধুরা বউ বাচ্চা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। আমি তোমাকে কোথাও যাওয়ার কথা বলতে সাহস পাইনা। আমার সব থেকেও নেই। আর পারছি না। এবার তো মাফ করো।
– নিজের মাঝে সুখ খোঁজার চেষ্টা করুন৷ দেখবেন আমার মত আপনিও সুখী মানুষ হয়ে যাবেন। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– বলো।
– আপনি আমাকে ডিভোর্স কেন দেননি?
– জানি না। বহুবার ভেবেছি দিয়ে দিবো। কেন যেনো দেয়া হয়নি। তবে সুবর্না কখনো ডিভোর্সের কথা বলেনি। তাই হয়তো ডিভোর্স নিয়ে অতটা মাথা ব্যাথা ছিলো না।
– ওহ্! সুবর্ণা বললে অবশ্যই এতদিনে আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যেতো৷ ভালোই হতো একদিকে। আপনি আর আমাকে প্রেম নিবেদন করার সাহস করতে পারতেন না।
– সন্তানের বাবা হিসেবে একটা সুযোগ তো আশা করতেই পারি।
– না পারেন না৷ আমি কখনোই আর পরিবর্তন হবো না৷
– তুমি তো আমাকে ভালোবাসো।
– হ্যাঁ, বাসি। তবে দূর থেকে চাওয়া পাওয়াহীন। এভাবেই আপনাকে ভালোবেসে আমি অভ্যস্ত। এখন অভ্যাস বদলাতে গেলে হয়তোবা ভালোবাসার মানুষও পরিবর্তন হবে৷
– এভাবে বাস করা কিভাবে সম্ভব?
-এখন আপনি যদি এভাবে আমার সাথে বাস করতে পারেন তো করেন৷ না পারলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করতে পারেন৷ আর অবশ্যই আমার বাসা থেকে বের হয়ে এরপর বিয়ে করবেন। যেহেতু ফ্ল্যাটটা আমার নামে আব্বা দিয়ে গেছেন আর ঘরের একটা ফার্নিচারও আপনার কেনা না, সবটাই আম্মা আর আব্বার টাকায় কেনা সেহেতু এগুলো সব আমার৷ এখান থেকে আমি যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা৷ গেলে আপনি যাবেন৷ সমাধান পেয়েছেন?
– এটা সমাধান না।
– আমার তরফ থেকে এটাই সমাধান। এখন আপনি সমাধান না মানলে অন্য উপায়ও আছে। সব বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে একদম উধাও হয়ে যাবো৷ কাকপক্ষীতেও টের পাবে না পুষ্প তার মেয়ে নিয়ে কোথায় গায়েব হয়েছে।
-আতিক ওকে বুঝা। প্লিজ।
– কেন বুঝাবো? ও তো অন্যায় কিছু বলেনি যে ওকে বুঝাবো৷ অন্যায় তুই করেছিলি। তোকে বুঝিয়েছিলাম। তুই বুঝিসনি৷ এখন ভোগ কর। ও আর বদলাবে না। ওর বদলানোর আশা ছেড়ে দে।
– আমি কি আশা করবো আর কি আশা করবো না সেটা তোর না বললেও চলবে আতিক৷ মনটা যেহেতু আমার সেহেতু এই মনে আমি কোন আশা করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার।

বাসা থেকে বের হয়ে গেছে তৌহিদ। আপাতত সে কোথায় যাবে সেটা তার জানা নেই৷ গাড়ি নিয়ে নিরুদ্দেশ ভাবে এলাকার গলি ধরে বেরুচ্ছে সে৷
পুষ্প তার জায়গায় অনড়৷ ওকে কোনোভাবে টলানো সম্ভব না সেটা ওর চোখের ভাষা আর কন্ঠের দৃঢ়তাতেই বুঝা হয়ে গেছে তৌহিদের। ওকে ডিভোর্স দেয়া বা ওর শর্ত মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার৷ ডিভোর্স দিয়ে সম্পর্ক চিরতরে মুছে ফেলার মত ভুল সে আর করতে চায় না৷ ওর শর্ত মেনে নিয়ে আজীবন পাপের শাস্তি ভোগ করাটাই আপাতত তার কাছে শ্রেয় মনে হচ্ছে। পাপগুলো দল বেঁধে চোখের সামনে ছুটোছুটি করছে৷ তার নিজের প্রতিটা নিঃশ্বাস বিষাক্ত মনে হচ্ছে।

কথা শেষে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লো পুষ্প। বরফ মিশানো পানি খেতে খেতে বললো,
– কথা বলতে বলতে ক্ষুধা লেগে গিয়েছে৷ আরেক পিস কেক আর একবাটি ফিরনি দাও তো ভাবী।

-সমাপ্তি-

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here