নোনাস্বপ্ন পর্ব ২

#নোনাস্বপ্ন
#দ্বিতীয়_অংশ
#লেখা_মিম (Khadija Mim)

আতিকের বাসার ড্রইংরুমে ঢুকতেই তৌহিদের মুখোমুখি হলো পুষ্প। খানিকটা অবাক হলো সে। কিন্তু সেই প্রতিচ্ছবি মনের আড়াল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখলো। চেহারার ভাঁজে ফুটতে দিলো না৷ মায়ের হাত টেনে ধরে পিহু বললো,
– আম্মু, বাবাও এসেছে।
– হ্যাঁ, এসেছে। তুমি ভিতরে যাও। টিয়া-নীলের সাথে খেলা করো।

মায়ের হাত ছেড়ে বাচ্চাদের রুমে ছুটলো পিহু। আচমকা পাশ থেকে এসে পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলো নীলা। অভিযোগ ভরা কন্ঠে বললো,
– তুমি কি হ্যাঁ? একবারও তো আমাকে দেখতে আসো না।
– ইশ! দোষ খালি আমার। তুমিও তো যাও না৷
– সময় পাই না একদম। সারাটাদিন এই দুইটার পিছনে ছুটতে হয়।
– তো আমি কোথায় সময় পাই বলো দেখি? জানোই তো সারাদিনে কি পরিমান ছুটোছুটি করতে হয়। আম্মা যতদিন ছিলো গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরেছি। এখন দম ফালানোর সময় পাই না।
– হুম, খালাম্মা তো তোমাকে মেয়ের মত করেই আগলে রাখতো। কোনোদিন কাওকে বলতে শুনিনি তুমি উনার ছেলের বউ।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো পুষ্প। সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো,
– রান্না শেষ তো?
– হ্যাঁ সব শেষ। শুধু ভাত আর পোলাউটা রান্না করা বাকি।
– শুধু ভাতই করতে। পোলাউ করতে গেলে কেন?
– ওমা করবো না! পোলাউ ভাত দুটোই খাবা।
– আতিক ভাই তো আমাকে শুটকির কথা বলে নিয়ে আসলো। শুটকি ভর্তা করোনি?
– হুম, করেছি তো। এজন্যই তো ভাত রান্না করেছি। আর নয়তো শুধু পোলাউ করতাম।
– পোলাউ টোলাউ খাবো না। আমি ভাতই খাবো। গরমের মধ্যে পোলাউ খেতে ভালো লাগে না৷
– নীলা, নাস্তা নিয়ে আসো এখানে। বাচ্চাদেরও ভিতরে নাস্তা দিয়ে আসো৷

নীলা উঠে চলে গেলো নাস্তা আনতে। আতিকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো পুষ্প। জিজ্ঞেস করলো,
– আতিক ভাই?
– হ্যাঁ?
– কোনো সমস্যা?
– মানে?
– হাত কচলাচ্ছেন একটু পর পর। মনে হচ্ছে টেনশনে আছেন।

খানিকটা নড়েচড়ে বসলো আতিক। হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
– টেনশন না ঠিক। বন্ধু সাত সকালে বাসায় এসে হাজির। আমাকে এসে ধরলো তোমাদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। কোত্থেকে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না।

মুচকি হাসলো পুষ্প। গলার স্বর উঁচিয়ে নীলাকে বললো,
– ভাবী? একগ্লাস পানি দিও তো। বরফ আছে না ঘরে?
– হ্যাঁ, আছে তো।
– তিনটা বরফ দিও গ্লাসে।
– দিচ্ছি।

পা দুটো সোফার উপর উঠিয়ে বসলো পুষ্প। একটা কুশন কোলে নিয়ে হেলান দিয়ে বসলো সোফায়। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা এখনো লেগেই আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুষ্পকে দেখছে তৌহিদ। পুষ্পের এভাবে মিটমিটিয়ে হাসা তার কাছে রহস্য রহস্য লাগছে। হাসছে কেন এই মেয়ে?

পানির গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকলো নীলা। হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে একটু একটু করে তাতে চুমুক দিচ্ছে পুষ্প। পুষ্পের পাশে নীলা বসতেই আতিক জিজ্ঞেস করলো,
– তোমাকে না বললাম নাস্তা আনতে?
– টুনি নিয়ে আসছে।
– তারপর আতিক ভাই, আপনার বন্ধু কি ব্যাপারে কথা বলতে বললো আমার সাথে।
– তোমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে।
– সম্পর্ক নিয়ে কি কথা? কোনো অভিযোগ আছে তার এই সম্পর্ক থেকে?
– হ্যাঁ। অভিযোগ তো আছেই।
– কি অভিযোগ শুনি তো?
– ও তোমার কাছে আসতে চায়। স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক চায় তুমি সেটা হতে দিচ্ছো না। নিজের মত করে আলাদা একটা জগত তৈরি করে নিয়েছো৷ সেই জগতে ওর কোনো জায়গা নেই৷ পিহুও নাকি ওর কাছে কম যায়। তুমিও মেয়েকে তেমন একটা বাবার সাথে সময় কাটাতে দাও না৷ মেয়েকে তোমার কাছেই রাখো। ওর জন্য তোমার কোনো সময় নেই। বউ বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও একা জীবন কাটাতে হচ্ছে ওকে৷ তাছাড়া তুমি নাকি……
– থেমে গেলেন কেন? আমি কি?
– আসলে,,,,, কি বলবো? ও সন্দেহ করছে তোমার কারো সাথে এ্যাফেয়ার চলছে।

টি টেবিলে নাস্তা রেখে গেছে টুনি। টেবিলের উপর থেকে একপিস কেক নিয়ে টুকরো করে ফিরনির সাথে মিক্স করছে পুষ্প। বেশ আয়েশ করে ফিরনি মুখে নিয়েছে সে। আতিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আর কোনো অভিযোগ?
– না।
– একতরফা শুনে বিচার করতে চান নাকি দুতরফের কথাই শুনবেন?
– দেখো, প্রথম কথা হচ্ছে আমি কিন্তু বিচার করতে বসিনি৷ শুধু তোমাদের দূরত্বটা কমাতে চাচ্ছি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে তোমার কি অভিযোগ আছে সেগুলো শোনার জন্যই তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি।
– ভাইয়া বহুদিন হয় কারো সাথে মন খুলে কথা বলি না। আজকে আপনার সাথে বলবো। জানি আপনি অনেক কথা জানেন আমার ব্যাপারে। তবে সব তো আর জানেন না৷ যেগুলো আপনি জানেন সেগুলোও বলবো যেগুলো জানেন না সেসবও বলবো। শুনবেন?
– হুম শুনবো। বলো।
– কথা শুধু আপনার আর আমার মাঝে হবে। আপনার বন্ধু কোনো কথা বলতে পারবে না। সে আজকে শুধু শুনবে।
– আচ্ছা আমি কোনো কথা বলবো না৷ তোমার যা অভিযোগ আছে বলো। তবু প্লিজ মন থেকে সমস্ত অভিমানগুলো বের করে দাও।

ফিরনি খেতে খেতে পুষ্প বলতে শুরু করলো,
– গ্রামে থাকতাম৷ ওখানেই জন্মেছি, বড় হয়েছি৷ একদম সাদামাটা আর ঘরকুনে মানুষ ছিলাম। আব্বার বাজারে কাপড়ের দোকান ছিলো তিনটা৷ এখনো অবশ্য আছে। হিসেবছাড়া সম্পত্তি আমাদের৷ বড় গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে আমি৷ আশপাশের পাঁচ ছয় গ্রাম পর্যন্ত নাম ডাক আমাদের বংশের। বাবা চাচাদের একডাকে সবাই চিনে। বড় দুই বোনের বিয়ে হওয়ার পর কত মানুষ যে প্রতিদিন আসতো আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আব্বা রাজি হতো না। সবসময়ই বলতো মেয়েকে শহরে বিয়ে দিবো৷ সরকারী চাকরী করে এমন ছেলে দেখে বিয়ে দিবো।
আম্মা যখন প্রথম আমাকে দেখে তখন আমার বয়স ছিলো ১৭ বছর। এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি খালার বাসায়। আগে তো খালারা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো। ওখানেই আমার শ্বাশুড়ি আমাকে প্রথম দেখেন। প্রথমদিনই উনি আমাকে পাশে বসিয়ে কত কিছু জিজ্ঞেস করলেন। সেদিন আবার আমি খালার বাসায় ভুনা খিঁচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করেছিলাম। খালা আম্মাকে খেতে দিলো৷ কি যে তৃপ্তি নিয়ে আম্মা খাবারটা খাচ্ছিলো! মনে হচ্ছিলো বহুদিন হয় উনি মনমতো খেতে পারেননি। খাওয়া শেষে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলো, “তোমার রান্না একদম আমার আম্মার মতো৷ মনে হলো বহুদিন পর মায়ের হাতের রান্না খেয়েছি।”
পরদিনই আম্মা আব্বা দুজনই এলো খালার ঘরে। উনার ছেলের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। খালা সেদিনই আমার আব্বাকে ফোন করে জানালো। পাত্র বি সি এস ক্যাডার। বর্তমানে সরকারী অফিসার। পাত্রের বাবাও সরকারী অফিসার। মায়ের জমজমাট শাড়ীর ব্যবসা। ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে দুইটা। গাড়ী আছে। গ্রামের অবস্থাও একমাত্র ছেলে। দেখতেও সুদর্শন। ব্যস, আমার আব্বাকে আর পায় কে? পরদিনই বড় দুলাভাই আর মেজো চাচাকে নিয়ে খালার বাসায় এসে হাজির। বিশ্বাস করেন আতিক ভাই, আব্বা যখন পিহুর বাবাকে দেখে খালার ঘরে আসলো উনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো হাতের মুঠোয় বুঝি আকাশের চাঁদটা পেয়েছেন৷ সেদিন যে কতবার আমার মাথায় আব্বা হাত বুলিয়েছিলেন! আম্মাকে ফোন করে বলতে শুনেছিলাম,
– আমাদের মেয়েটা অনেক ভাগ্য নিয়া আসছে গো পারুলের মা৷ আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই এমন চান্দের টুকরা জামাই আমি পাবো। আমি কালকেই পাকা কথা দিয়ে বাড়ি আসবো৷ বিয়ের তারিখ জলদিই রাখবো। দেরী করলে না আবার পাত্র হাতছাড়া হয়া যায়।

পরদিন বিয়ের তারিখ ঠিক হলো৷ সেদিনই আমি উনাকে দেখলাম। ফর্সা লম্বা গড়নের একজন মানুষ। একদম আমার স্বপ্নের মতন। কি যে খুশি লাগছিলো! ঘোমটার আড়াল দিয়ে বারবার উনার দিকে তাকাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো উনার সামনে দাঁড়িয়ে বলি, এই যে শুনছেন? আমার নাম পুষ্প। আমার সাথে আপনার বিয়ে হবে ১৫ দিন পর। কত যে স্বপ্ন দেখেছি একটা রাজপুত্রকে বিয়ে করার। রাজপুত্রের বেশে আপনি এসেছেন। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরন করেছেন।

১৫ দিন পর বিয়ে। আব্বা যে কত এক্সাইটেড ছিলো এই বিয়ে নিয়ে! আয়োজনের কোনো কমতি আব্বা রাখেননি। দেড় হাজার লোক দাওয়াত করেছিলেন। ঢাকার বিয়ের মেন্যু আর গ্রামের মেন্যু তো এক হয়না৷ আব্বা ঢাকা থেকে বাবুর্চি আনালেন। বাবুর্চি যা যা রান্না করার কথা বললেন আব্বা সব রান্নার আয়োজন করালেন। গ্রামে তো গরমের সময়টাতে ফুলকপি, গাজর পাওয়া যায় না। আর ক্যাপসিকামের তো নাম নিশানাও পাবেন না। ঢাকার মানুষ বিয়েতে চায়নিজ টাইপ ভেজিটেবল করে। বাবুর্চির কাছে শুনে আব্বা ঢাকা থেকে এগুলোও আনিয়েছিলো।
স্টেজে যখন আমাকে আনা হলো লোকজন আমাকে দেখার জন্য জটলা পাকিয়ে ফেলেছিলো আমার আশপাশে। দুই পক্ষের স্বর্ন মিলিয়ে ৪৫ ভরি হয়েছিলো৷ এত ভারী শাড়ী আর এত গহনা পড়ে মনে হচ্ছিলো আমার জান যায় যায় অবস্থা। বয়সটাই বা কত ছিলো বলেন! তবু আনন্দ হচ্ছিলো খুব৷ আর আম্মা তো আমার বিয়ের শপিংয়ে নূন্যতম কার্পণ্য করেননি। ইন্ডিয়া থেকে শাড়ী আনালেন। ইউরোপ থেকে কসমেটিকস আনালেন। আমার বিয়ের লাগেজ যখন আত্মীয়দের সামনে খোলা হলো তখন তো সবাই ‘থ’। এত ভালো বিয়ের বাজার আর কারো বিয়েতে কখনো ছেলেপক্ষ দেয়নি৷ আশপাশের গ্রামে এই কথা চড়াও হয়ে গেলো। কমবেশি সব মহিলাদের মুখে এক কথা পুষ্পের শ্বশুরবাড়ির থেকে যেই জিনিস দিছে রে বাবা! আর পাত্র দেখে তো কারো মুখে কোনো কথাই নেই৷ আমার চাচীরা তো রীতিমতো হিংসা শুরু করে দিলেন তৎক্ষনাৎ। সেজো চাচী মুখটা কালো করে আমার শাড়ীতে হাত বুলাচ্ছিলেন আর বলছিলেন,
– নে, আল্লাহ তোরে সর্বদিকে মিলায়া দিলো৷ আমাগো মাইয়্যা হইলো পোড়া কপাইল্যা।

বিয়ে খেতে এসে সবাই আমার ভবিষ্যৎ বর্ণনা করতে লাগলো পুষ্পের সুখের সীমা নেই৷ স্বর্নে মোড়ানো কপাল৷ শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি এত ভালো জামাই তো আরও ভালো হবে৷ আরও কত কি? বিয়ের আসরে বসে আমি সুখের জোয়ারে ভাসছিলাম। আহ কি কপাল আমার! এত সুখ রাখি কোথায়!

বলেই অট্টহাসি দিলো পুষ্প। ঘরের সবাই চুপ করে পুষ্পের সেই হাসি দেখছে। নীলার হাতের উপর পুষ্প হাত রেখে বললো,
– ভাবী, তোমার ফিরনিটা খুবই ভালো হয়েছে। কেকটা কি হোমমেইড ছিলো?
– হুম।
– এটাও খুব ভালো ছিলো। খুব সফট হয়েছে।
– গল্প বলো পুষ্প।
– হুম বলছি তো৷ আমাকে শ্বশুরবাড়ি আনা হলো। আসতে আসতে রাত সাড়ে নয়টা হয়ে গেলো৷ শাশুড়ী আমাকে বরণ করে সোজা আমার ঘরে নিয়ে এলো৷ প্রচুর ক্লান্ত ছিলাম৷ শরীর একদম চলছিলো না। আম্মা আমার হাতে থ্রি পিস ধরিয়ে বললেন,
– ফ্রেশ হয়ে এটা পড়ে আসো।
– আমার আম্মা বলেছে বিয়ের পর শাড়ী পরতে হয়।
– এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি না। এটা তোমার নিজের বাসা। আমরা তোমার বাবা মা৷ এখানে শাড়ী না পরলেও চলবে৷ শুধু আমার ছেলেটার জন্য একটু সেজেগুজে থেকো। তাহলেই হবে৷

হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখি আমার রাজপুত্র নেই। চুপচাপ রুমে বসেছিলাম অনেকক্ষণ৷ কিছুক্ষণ বাদে আম্মা আমাকে নিয়ে গেলো খাবার খাওয়ার জন্য। ঘরভর্তি মানুষ৷ ডাইনিংরুমে বসে চতুর্দিকে একবার চোখ বুলালাম। দেখি আমার রাজপুত্র ড্রইংরুমের এককোনায় বসে ফোন টিপছে। মনে মনে একটু রাগ হচ্ছিলাম৷ কেমন মানুষরে বাবা! আমার সাথে বিয়ের পর একটা কথাও বললো না৷ খানিকবাদে উনাকে আমার পাশে এনে বসানো হলো খাওয়ার জন্য। বড় একটা ডিশে আমাদের দুজনকে একসাথে খেতে দেয়া হলো। উনি ঠিকমতো খাচ্ছিলো না৷ পোলাউগুলো নাড়াচাড়া করছিলো। অনেকক্ষণ পরপর একটা করে লোকমা মুখে তুলছিলো। আমি চুপচাপ খেয়াল করছিলাম। তখন হুট করেই কেনো যেনো মাথায় আসলো উনি বোধহয় বিয়েতে রাজি ছিলো না। মনের মধ্যে যে খুশিটা ছিলো ভয়ের নিচে সেটা ধামাচাপা পড়তে লাগলো। লুকানো সুখগুলো বিবর্ণ হতে লাগলো।

বাসরঘরে আমাদের দুজনকে পাঠানো হলো। বিয়ের আগে উনার সাথে শুধু একদিন কথা বলেছিলাম। তাও তিনমিনিট বাইশ সেকেন্ড। চেনাজানা তেমন নেই বললেও চলে। হাত পা প্রচুর কাঁপছিলো৷ কাঁপাটা খুব স্বাভাবিক৷ ধারনা ছিলো রাজপুত্র এসে আমার ভয় ভাঙাবে। কিসের কি? বলা নেই কওয়া নেই আমার শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো৷ একে তো সে আমার ভয় ভাঙায়নি তার উপর এমন ভাবে আমাকে স্পর্শ করছিলো মনে হচ্ছিলো কারো রাগ ঘৃনা আমার শরীরের উপর মিটাচ্ছে। সেইরাতে আমার মনে হচ্ছিলো উনি কেনো রাজপুত্র না৷ আপাদমস্তক একটা দানব৷ সারাটারাত ধরে কি যে টর্চার করেছিলো আমাকে! মুখ ফুটে বলতেও পারছিলাম না আমার কষ্ট হচ্ছে৷ আগের রাতে বড় আপু, ভাবীরা আমাকে ধারনা দিয়েছিলো বাসর কেমন হয়। ওদের কথা শুনে মনে হয়েছিলো বাসর রাতটা একটা স্বপ্নে মুখরিত রাত। আমার ধারনাটা আপনার বন্ধু একদম দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো৷ সেদিন সারারাত একটা কথাই মাথায় ঘুরছিলো বাসর রাত একটা ভয়ানক রাতের নাম। স্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর৷ বারবার আল্লাহর কাছে খুব করে চাচ্ছিলাম রাতটা জলদি শেষ হোক। ভোর হলেই বুঝি আমার কষ্টের শেষ হবে। অথচ সেদিনের রাতটা কাটতেই চাচ্ছিলোনা৷

কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পুষ্প। নীলার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাবী বরফ মিশিয়ে একগ্লাস পানি দাও না।

খুব দ্রুত পুষ্পের সামনে একগ্লাস বরফ মিশানো পানি এনে দিলো নীলা। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটা খেয়ে শেষ করলো সে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো,
– অবশেষে ভোর হলো৷ নিজের সমস্ত কামনা মিটিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি আমার মত বিছানায় পড়ে রইলাম। বিছানা ছেড়ে উঠার তিল পরিমাণ শক্তিটুকু আমি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো শরীরের রোমে রোমে বুঝি ব্যাথা হচ্ছে৷ প্রায় ঘন্টাখানেক ওভাবেই শুয়ে ছিলাম৷ রাজপুত্র একবারও পাশ ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো না তোমার কি শরীরটা খারাপ লাগছে? কোনোমতে গোসলটা সেড়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। আধাঘন্টা পর টের পেলাম শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। চোখ জ্বালা করছিলো ভীষন। সেইসাথে মাথাটাও ব্যাথা হচ্ছিলো প্রচুর। আর শরীর ব্যাথা তো আছেই। এত কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন! মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি মারা যাবো। বারবার চোখের সামনে আব্বা আম্মা, ভাইবোন, আমার স্কুলের বান্ধবী সবার মুখটা এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো কেও আমার মাথায় একটু হাত রাখুক। কোনোমতে হাতটা বাড়িয়ে রাজপুত্রের পিঠে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে ডেকেছিলাম৷ রাজপুত্রের কোনো হুঁশ নেই৷ থাকবেই বা কি করে। সারারাত তো কুস্তি খেলেছে। ক্লান্ত হয়ে সবে ঘুমিয়েছে৷ কারো ডাকে কি সেই ঘুম ভাঙবে নাকি। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সমস্ত কিছু ঘোলা হয়ে আসছিলো৷ ঘোলা থেকে আরো বেশি ঘোলাটে৷ একটা পর্যায়ে সব অন্ধকার। যখন চোখ মেলে আলো দেখলাম তখন দেখি আমার চতুর্দিকে মানুষের জটলা। খালা আমার একপাশে বসা৷ শ্বাশুড়ি আমার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে৷ আত্মীয় স্বজন খাটের আশপাশে জায়গা দখল করে রেখেছে৷ এত মানুষের ভীড়ে আমার রাজপুত্র নেই৷ রাজপুত্র আমার উধাও। এই লোকটা সারারাত আমাকে এত কষ্ট দিলো অথচ এই লোকটাকেই আমার চোখজোড়া খুঁজছিলো। খু্ঁজবোই তো। অনেক সাধের রাজপুত্র আমার! কত স্বপ্ন দেখেছি এমন রাজপুত্রের! পুরো সকাল গড়ালো, দুপুর গড়ালো রাজপুত্র আর এলো না৷ এদিকে আম্মা তোড়জোড় চেষ্টা চালাচ্ছেন আমাকে সুস্থ করার। আজ বাদে কাল বৌভাত৷ আমি অসুস্থ থাকলে অনুষ্ঠান হবে কি করে? বিকেলের দিকে বিছানায় হেলান দিয়ে উনার কাজিনদের সাথে কথা বলছিলাম। এমন সময় উনি এলেন৷ সবাইকে বললেন ঘর থেকে বের হতে। তাদের সে কি হাসি! কত রসের কথা! আমাদের দুজনকে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ওরা। আমার মুখোমুখি বসে উনি বলতে লাগলেন,
– দেখো আমি সোজাসাপ্টা কথা পছন্দ করি৷ প্রথমত তোমাকে আমার পছন্দই হয়নি। আমি একজন বিসিএস ক্যাডার। আর তুমি সবে এস এস সি দিয়েছো। পাশ করবে না ফেল করবে তার কোনো ঠিক নেই। আমার ২৯ আর তোমার ১৭। বয়সের এত পার্থক্য। আমাদের চিন্তা ধারা কখনোই এক হবে না৷ বড় হয়েছো গ্রামে৷ সর্বক্ষণ ইয়া লম্বা এক বেনী করে ঝুলিয়ে ঘুরাঘুরি করো। নামমাত্র স্মার্টনেস নেই তোমার মাঝে৷ জামাকাপড় তো আহামরী ক্লাসি না৷ আমার পাশে তুমি প্রচুর বেমানান৷ তবুও আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেছি। এখন যা দেখছি তুমি আমাকে বিছানাতেও ওভাবে সাপোর্ট দিতে পারবে না যেমনটা আমি চাই। একরাতেই বেহুঁশ হয়ে গেলে। আমার চাহিদা মিটানোর এ্যাবিলিটি তোমার মোটেও নেই। সারারাত কি আমি মানুষের সাথে কাটিয়েছি নাকি কোনো রোবটের সাথে কাটিয়েছি এটাই বুঝলাম না৷ তুমি যদি আমার চাহিদা পূরন করতেই না পারো তাহলে তুমি আমাকে বলো তোমার সাথে সংসার কিভাবে সম্ভব?
আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো জানো। অসম্ভব সুন্দরী আর স্মার্ট। আমার সাথে যায়। আমার সমস্ত চাহিদা মিটানোর মত এ্যাবিলিটি ছিলো ওর। হোক সেটা মানসিক বা শারীরিক। বাবা মা অনেক মেয়ে দেখেছে আমার জন্য। কিন্তু ওর মত কাউকে পাইনি৷ আর তুমি? তুমি তো ওর পায়ের নখের যোগ্যও না। কোনোদিক দিয়ে তো আমাকে একটু শান্তি দাও৷

উনার কথা শুনে আমার কান বন্ধ হয়ে আসছিলো। নিজেকে মনে হচ্ছিলো সত্যিই আমি উনার অযোগ্য৷ উনাকে আমি কখনো সুখী করতে পারবো না। কান্নাকাটিও শুরু করেছিলাম উনার কথা শুনে। আমি প্রচুর বোকা ছিলাম আতিক ভাই৷ উনি আমাকে সরাসরি বলেছে উনার গার্লফ্রেন্ড শারীরিক চাহিদা মিটাতে পারে৷ তারমানে ওরা ফিজিক্যালি ইনভলভড ছিলো। অথচ আমি বুঝতেই পারলাম না। নিজের খুঁতগুলো খুঁজতে লাগলাম। রুম থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে বলে গেলো,
– ছিঁচকাঁদুনে মানুষ আমার অসহ্য লাগে৷ কথায় কথায় আমার সামনে কাঁদবা না৷ আর প্লিজ জলদি সুস্থ হও। এভাবে বিছানায় পড়ে থেকে আর লোক হাসিও না৷ কাজিনরা আমাকে দেখে ইতরের মত হাসছে।

-সহজে দমে যাওয়ার মানুষ কখনোই আমি ছিলাম না৷ উনি কথাগুলো বলার পর বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলাম ঠিক। আসলে হয়েছিলো কি হুট করে এই কথাগুলো আমি হজম করতে পারিনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত চোখ মুখ কাঁথা দিয়ে ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদেছি। মনটা যখন একটু হালকা হলো তখন নিজের মনকে বুঝাতে লাগলাম, ভালো না লাগাটা একপ্রকার স্বাভাবিক৷ সত্যিই তো আমি একটু বেশিই সাদামাটা। এত সাদামাটা তো কোনো শহরের ছেলে পছন্দ করবে না। সন্ধ্যায় শোয়া থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া শুরু করলাম৷ নিজের শরীরের বিরুদ্ধে যেয়ে শুধু মনের জোরটা কাজে লাগিয়ে সুস্থ হওয়ার প্রানপন চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। মাথায় একটা কথা কাজ করছিলো রাত গভীর হওয়ার আগে আমাকে সুস্থ হতে হবে। যদি উনি আমাকে আবার কাছে টানতে চায়? উনাকে উনার পছন্দমতো সাপোর্ট তো দিতে হবে। জানেন ভাইয়া ঐ ছোট বয়সেই আমার মনে উনার গার্লফ্রেন্ডের প্রশংসা করাটা আমাকে খুব খোঁচাচ্ছিলো। তখন আমার কথা হচ্ছে বিয়ের পরও আমার রাজপুত্র কেনো আরেক মেয়েকে স্মরন করবে? কোনোভাবেই ঐ মেয়েকে স্মরন করতে দেয়া যাবে না৷ আমার জায়গা তো আমি অন্য কাউকে নিতে দিবো না৷ আমার মাথায় একটাবারের জন্য এই কথাটা এলো না যে উনার মনে জায়গা তো আমার ছিলোই না৷ কখনোই না। তাহলে সেখানে আমি কেনো আমার জায়গায় তাকে বসতে দিবো না সে কথা ভাবছি? পিহুর আব্বুর মন জুড়ে ঐ মেয়ে আগে থেকেই বসে ছিলো। বরং উনাদের মাঝে থার্ড পার্সন ছিলাম আমি।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে একটু থামলো পুষ্প। সামনে থাকা চানাচুরের বাটিটা হাতে নিলো সে। চানাচুর থেকে বেছে বেছে বাদামগুলো মুখে নিচ্ছে। তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমরা সবাই খাচ্ছি আপনি কেন হাত গুটিয়ে বসে আছেন? নিন ফিরনিটা খান। খুব ভালো হয়েছে।
– অনেক অন্যায় করেছি আমি তাই না পুষ্প?

মুচকি হাসলো পুষ্প। প্লেট থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে বাদামগুলো বেছে হাতের মুঠোবন্দি করে নিচ্ছে।

– অন্যায় করেছেন কি করেননি সেটা গল্পের শেষে বলবো।
– তারপর কি হলো?
– ভাবী তুমি বোধহয় খুব এক্সাইটেড পরের গল্পগুলো শোনার জন্য তাই না?
– হ্যাঁ, এক্সাইটেড। এখন জলদি বাকি কথা বলো।
– আমার ধারনা সত্যি করে সেদিন আবার আমার কাছে এলো। সেই আগেরদিনের মতো দানবের রূপটা আমাকে দেখালেন। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছিলাম৷ কোনোমতেই অভিযোগ করতে যাবে না৷ আমি অসুস্থ জানা সত্ত্বেও উনার মাঝে নূন্যতম নমনীয়তা আমি খুঁজে পাইনি। সেই থেকে প্রতিরাতেই উনার এমন হিংস্ররূপ দেখতাম। ঘরে যে উনার বউ আছে সেটা উনার সারাদিন মনে থাকতো না৷ রাত গভীর হলে উনার মনে পড়তো ঘরে তো তার বউ আছে। প্রতিদিন কি যে অপমান করতো! কথায় কথায় আমি আনস্মার্ট, উনার সাথে আমার যায় না, আমি সুন্দর না এগুলো বলতো। যখন বলতো তখন খুব কষ্ট পেতাম। কাঁদতাম। কান্নাকাটি শেষে মন হাল্কা হলে আবার উনার পিছু পিছু ঘুরতাম। সপ্তাহখানেক পর আব্বা আম্মা ব্যাপারগুলো খেয়াল করতে লাগলেন। একদিন আব্বা আম্মা দুজনকেই শুনলাম উনাকে আড়ালে নিয়ে বেশ বকাঝকা করছে উনার এসব আচরন নিয়ে। আব্বা উনাকে বেশ হুমকি ধমকিও দিচ্ছিলেন এমন আচরন চলতে থাকলে আমাকে বাসায় রেখে উনাকে বাসা থেকে বের করে দিবেন। মাথা নিচু করে চুপচাপ উনি কথাগুলো শুনছিলেন। কোনো উত্তর উনি দেননি। সেই ঝাল পরে এসে মিটিয়েছে আমার উপর। রাতের বেলা ঘরে এসে কিছুক্ষণ গলার স্বর নিচু করে আমাকে ঝাড়লেন। শুধু বকাঝকাতে উনার রাগ মিটছিলো না। আচমকা এসে আমাকে দেয়ালে ঠেকিয়ে আমার হাত মুচড়ে ধরলেন। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে দিলাম চিৎকার। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে আব্বা আম্মা দুজনই এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। তখনও উনি আমার হাত ছাড়ছিলেন না। আর ওদিকে আমিও চিৎকার করেই যাচ্ছিলাম৷ পুরো সাত আট মিনিট উনি এভাবে আমার হাত মুচড়ে ধরে রেখেছিলো। ওদিকে আব্বা অকথ্য ভাষায় উনাকে গালিগালাজ শুরু করে দিলো। আম্মাও উনাকে পুলিশে দেয়ার হুমকি দিতে লাগলো। এরপর কি ভেবে হাতটা ছেড়ে দিলো। ব্যাথায় আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। মাথাটা এমনভাবে ঘুরিয়ে উঠেছিলো আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিলাম। উনি গিয়ে গেটটা খুলতেই আম্মা উনার গালে সজোরে থাপ্পর দিলেন। এরপর আম্মা আমার হাত ধরে হয়তোবা বুঝেছিলো অবস্থা বেগতিক। ঐ মাঝরাতেই আমাকে নিয়ে ছুটেছিলেন হসপিটালে৷ এক্সরে করা হলো। হাতে ফ্র্যাকচার ধরা পড়লো। হসপিটাল থেকে প্লাস্টার করা হাত নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে দেখি উনি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। আব্বা উনাকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন। বাপ ছেলের মধ্যে তুমুল তর্ক বিতর্ক চললো। এরপর আব্বা উনাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন। রাত তখন বাজে সোয়া তিনটা৷ বিশ্বাস করেন আতিক ভাই উনাকে যখন দেখলাম চোখে ছলছল পানি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। এই মানুষটা একটু আগে আমার হাতের বারোটা বাজিয়েছে সেটা আমার মাথা থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। আমার হাতের ব্যাথা তখন উধাও। উনার কষ্টে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। উনার হাত জড়িয়ে ধরে কতবার রিকুয়েষ্ট করলাম না যাওয়ার জন্য। আব্বার পা ধরে বসে রইলাম কতক্ষণ উনাকে আটকানোর জন্য। কোনো লাভ হলো না। কেও আমার কথা শুনলো না৷ কাঁদতে কাঁদতে পরদিন দুপুরে আবার অসুস্থ হলাম। জ্বর চলে আসলো গায়ে। জোরের ঘোরে এক বিলাপ করছিলাম আমার রাজপুত্র আমি ফেরত চাই৷ শেষমেষ আব্বা কোত্থেকে যেনো খুঁজে বের করে বাসায় এনেছিলো।
– সেদিন ও আমার বাসায় এসেছিলো। আংকেল আমার বাসা থেকে ওকে নিয়ে গিয়েছিলো।
– অহ্৷ সেটা অবশ্য আমি জানতাম না। যাই হোক, এরপর উনাকে পেয়ে পরদিনই সুস্থ হয়ে গেলাম। প্লাস্টার খোলার আগ পর্যন্ত পাঁচদিন আম্মা আমাকে উনার রুমে যেতে দেয়নি৷ উনার রুমেই রেখে দিয়েছিলো৷ ঐ পাঁচদিনে আম্মার কাছে উনার অনেক গল্প শুনেছি। উনি মানুষ কেমন, ছোটবেলায় কেমন ছিলেন, কি পছন্দ করেন, কি অপছন্দ করেন, উনার প্রাক্তন প্রেমিকার গল্প সব শুনেছি৷ যখন উনার প্রাক্তন প্রেমিকার গল্প শুনলাম, মেয়েটা উনাকে ফেলে একটা প্রবাসী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছে শুধু বেশি টাকার লোভে তখন মনে হচ্ছিলো উনার প্রতি প্রেম আমার আরো উথলে পড়ছিলো৷ উনাকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচাইতে অবহেলিত এবং দুঃখী প্রানী৷ এই দুঃখী মানুষটার জীবন কানায় কানায় সুখে ভরিয়ে দিবো এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেদিন৷ এরপর উনার হাত জড়িয়ে উনার প্রাক্তনের সামনে দাঁড়িয়ে বলবো,
– খুব ভালো করেছো ছেড়ে দিয়েছো৷ আর নয়তো অমন রাজপুত্র পেতাম কোথায়?

শব্দ করে হাসছে পুষ্প। কারো মুখে হাসি নেই। এখানে হাসার মতো কি ছিলো সেটাই কেও খুঁজে পাচ্ছে না৷ হাসি থামালো পুষ্প। আবার বলতে শুরু করলো,

– আম্মা হাতে ধরে আমাকে শিখাতো কিভাবে স্টাইল করতে হয়, সাজতে হয়, মানুষের সামনে নিজেকে মার্জিতভাবে প্রেজেন্ট করতে হয়, হাজবেন্ডের গলা জড়িয়ে আহ্লাদ করে কথা বলতে হয়, ছোট ছোট আবদারগুলো কিভাবে ঢঙ করে আদায় করতে হয়৷ প্রথম প্রথম যখন আম্মা উনার ছেলের সাথে কিভাবে চলবো সেগুলো শিখাতেন আমি লজ্জায় শেষ হয়ে যেতাম। আর আম্মা হাসতেন। বলতেন,
– বাসায় আমি ছাড়া আর কে আছে বল তোকে এসব শিখাবে? আর তুই তো আমার মেয়েই। কোনো কিছু না জানলে সেটা তো শিখানোর দায়িত্ব আমারই তাই না?

আম্মার সমস্ত কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম৷ বিয়ের মাসখানেক বাদে যখন আয়নায় নিজেকে দেখতাম তখন নিজেই নিজের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পেতাম৷ আম্মা যেভাবে শিখিয়ে দিতো সেভাবেই উনার সাথে ঢঙ করতাম। বিনিময়ে কড়া ধমক খেতাম। এরমাঝে বিয়ের দেড়মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট। পিহু আমার পেটে৷ ভেবেছিলাম উনি বাবা হবেন শুনলে বোধহয় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে কোলে তুলে নাচানাচি শুরু করবেন। ঐ হয়না ওরকম হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে? নিজেকে তো তখন সিরিয়ালের নায়িকা ভাবতাম আর উনাকে নায়ক।
তখন ভোরবেলা। বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন। একবার ভাবলাম ঘুম থেকে উঠলে বলবো৷ কিন্তু তখন তো আমার মনে তুমুল এক্সাইটমেন্ট! এক্সাইটমেন্ট তো আর আটকে রাখতে পারি না। শেষমেষ উনাকে ঘুম থেকে তুলেই ফেললাম৷ উনার কাছে যেয়ে বললাম,
– শুনছেন, আমাদের না একটা বাবু হবে।

কথাটা বলেই অর্ধেক মুখ ওড়না দিয়ে ঢেকে ফেললাম লজ্জায়। উনার দিকে তাকাতে পারছিলাম না । মাথা নিচু করে রেখেছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম উনি বোধহয় বিস্ময়ের শেষ সীমানায় চলে গেছেন। খবরটা শুনে ঘোরের মাঝে ডুবে আছেন তাই চুপ করে আছেন। ঘোরটা কাঁটা মাত্রই আমাকে জড়িয়ে ধরবেন। অথচ উনি কি করলো জানেন?
– কি?
– আমাকে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে বললো,
বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এখানে এত আহ্লাদে গদগদ হয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলার কোনো মানে ছিলো না। এসব ব্যাপারে বাবা মায়ের ইন্টারেস্ট আছে অনেক। উনাদের সাথে শেয়ার করো। যতসব ফালতু কাজ-কারবার।

কথাটা বলে উনি আবার শুয়ে পড়লো৷ আমার আর সিরিয়ালের নায়িকাদের মত কোলে উঠা হলো না আতিক ভাই।

ঘর কাঁপিয়ে হাসছে পুষ্প। হাসতে হাসতে হেলে পড়লো নীলার গায়ে। হাসি থামিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিঃশ্বাস নিলো সে। নীলার গা থেকে সরে ঠিকঠাক মতো বসলো। গালে হাত রেখে বলতে লাগলো,
-দুই ফ্যামিলির লোকজন প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে খুব খুশি। আর আমি? খুশি হয়েও ঠিক খুশি হতে পারছিলাম না৷ তবে আমার শ্বাশুড়ী খুশি হলেও আমাকে নিয়ে বেশ টেনশনে ছিলেন একদম প্রথম দিন থেকেই। বয়স একদম কম ছিলো আমার। ঐ বয়সে একটা বাচ্চাকে জন্ম দেয়া খুব রিস্ক। তারউপর আমি যে মানসিক ভাবে আহামরী খুশি ছিলাম না সেটা আম্মা ভালো করেই জানতো। আর উনার ছেলে প্রেগন্যান্সির টাইমে আমাকে কতটা মেন্টাল সাপোর্ট দিবে সেটা আম্মা প্রথমদিনই বুঝে গিয়েছিলেন৷ উনার নির্লিপ্ততা আম্মাকে ঠিক ততটাই ভোগাচ্ছিলো যতটা আমি ভুগছিলাম। প্রথমদিনই পাঠানো হলো ডক্টরের কাছে। উনি তো যাবেই না আমার সাথে। আব্বার পীড়াপীড়িতে আমাকে নিয়ে গেলেন হসপিটালে। ডক্টর উনাকে বলেছিলো, আপনার ওয়াইফের বয়স কম। উনার প্রতি খেয়াল একটু বাড়তি প্রয়োজন। আর প্রথম তিনমাস যতটা সম্ভব ইন্টিমেট কম হওয়ার চেষ্টা করবেন। না হলেই ভালো। আর যদি হয়েও থাকেন একটু কেয়ারফুল থাকবেন।

ডক্টরের কথা এক কান দিয়ে উনি ঢুকালো আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। সেদিন রাতেই আবার বাসায় এসে,,,,,,,,

কথা পুরোপুরি শেষ না করেই থেমে গেলো পুষ্প। কয়েক সেকেন্ড বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– উনাকে আমি বারবার সতর্ক করতাম। উনি আমার কথা শুনতোই না৷ আমি কিছু বলতে গেলে উত্তর দিতো, এই মোমেন্ট গুলো কিভাবে এনজয় করতে হয় তুমি সেসব বুঝোই না৷ খুব মেজাজ দেখাতো আমার সাথে৷ মনে মনে অবাক হতাম সন্তানের চেয়ে নিজের এনজয়মেন্ট এত মূল্যবান?
কখনো এটা নিয়ে উনার সাথে তর্ক করতাম। কখনো চুপ থাকতাম অজানা এক ভয়ে। ভয়টা কি ছিলো জানেন?
-কি?
– উনার এক্স গার্লফ্রেন্ড নামক ভয়। আমি যদি চাহিদা পূরন না করতে পারি তাহলে তো আবার প্রেমিকার ভূত মাথায় চাপবে। সেই মূহূর্ত্বগুলোতে খুব দ্বিধায় ভুগতাম। কার কথা ভাবা উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারতাম না৷ কখনো মনে হতো বাচ্চাকে নিয়ে আগে ভাববো এরপর হাজবেন্ড। আবার ভাবতাম বাচ্চা গেলে যাক। হাজবেন্ড থাকলে বাচ্চা আরো আসবে৷
প্রেগন্যান্সির তিনমাস তিনদিনের মাথায় হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হলো। মনে হচ্ছিলো আমার দুনিয়াটা বুঝি কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে৷ বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো কষ্টে। আমার বাচ্চা বোধহয় আমি কোলে নিতে পারবো না৷ পেটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে৷ সেই মূহূর্ত্বে বাচ্চার মর্মটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম৷ খুব করে চাচ্ছিলাম পিহুর বাবার বুকে মুখ ঢেকে ঘাপটি মেরে বসে থাকি। তখন একটা সান্ত্বনার হাত খুঁজছিলাম। পরম প্রিয় মানুষের হাত। কি যে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে আমি আর আম্মা আটকে ছিলাম! উফফ! আব্বা ছিলো ঢাকার বাহিরে৷ পিহুর বাবা অফিসে৷ বাসায় শুধু আমি, আম্মা আর কাজের মেয়ে। এমনিতে আম্মা কিন্তু প্রচন্ড স্ট্রং মাইন্ডেড৷ অথচ সেদিন যখন আম্মা শুনলো আমার ব্লিডিং হচ্ছে আম্মা কেমন যেনো হয়ে গেলো। পাগল পাগল টাইপ। সে মূহূর্ত্বে আম্মার মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো উনিও একটা হাত খু্ঁজছেন৷ ভরসার হাত। পিহুর বাবাকে দুই তিনবার ফোন করে খুব রিকুয়েষ্ট করেছেন বাসায় এসে যেনো আমাকে হসপিটাল নিয়ে যায়৷ উনি আসেনি৷ বারবার এক কথাই বলছিলেন, আমি পারবো না আসতে। তুমি নিয়ে যাও।
উনি ফোন কেঁটে দিচ্ছিলো। আম্মা আবার কল করছিলো৷ এরপর একটা পর্যায়ে উনি ফোনের সুইচটাই অফ করে দিলেন। আম্মা আমাকে একা হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলো না৷ দুশ্চিন্তায় কেমন জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলো৷ পাশের ফ্ল্যাট ছেড়ে ততদিনে খালারাও চলে গিয়েছে। আম্মা কাকে ডাকবে নাকি আমাকে নিয়ে একাই বের হয়ে যাবে এসব ভাবতে ভাবতে নিজেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বের হওয়ার সময় আমার মাথায় রেখে বলেছিলো,
– চল। কারো দরকার নেই৷ তুই আর আমিই যাবো। আল্লাহ ভরসা৷ তোর আর বাচ্চার কিচ্ছু হবে না।

আল্লাহর রহমত ছিলো আমার আর পিহুর উপর। সে যাত্রায়,আমার পিহুর কিছু হয়নি। হসপিটালে আমাকে দুদিন রাখা হলো। এরমাঝে আব্বা চলে আসলো। আমার বাড়ির লোকজনও এলো। পিহুর বাবা সৌজন্যস্বরূপ দুইবার আমাকে হসপিটালে দেখতে গেলো। বাসায় আসার পর আম্মা আমাকে উনার ঘরে রেখে দিলেন ১৭ দিন। পিহুর বাবার রুমে আমাকে যেতে দেয়নি। সেই কয়দিনে পিহুর বাবার সাথে একটা কথাও আম্মা বলেননি৷ শেষমেষ ১৭ দিন পর একপ্রকার জোর করেই আমি চলে গেলাম পিহুর বাবার ঘরে৷ পুরো ১৯ দিন পর সেদিন আম্মা উনাকে কড়া গলায় বলে এসেছিলো,

সময় থাকতে শুধরে যা তৌহিদ। তোর কারনে পুষ্প বা বাচ্চার কোনো ক্ষতি হলে বুঝে রাখিস তুই। সম্পত্তির কানাকড়িও তোকে দিবো না৷ আর তোর ঐ সরকারী চাকরী? ওটাও তোর হাতছাড়া করাবো দেখে রাখিস।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here