মোনালিসা পর্ব ১৭

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৭
মোনা’কে দুই’টা বিষয় ভীষণ ভাবাচ্ছে। জ্যাক কেন ও’কে এত সাহায্য করছে? প্রিয়ম কেন মোনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে? জ্যাকের বিষয়’টা কিছুতেই ভেবে পেলো না। মোনার বার বার ইচ্ছে করছে জ্যাকের কাছে কারণ জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু নানা সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। প্রিয়মের কথা ভাবতেই মোনার মুখ ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে যায়। লিলি বেগম মোনাদের বাসায় আসে প্রায়ই। মোনা কে বার বার বলে,
-“মোনা তুই কি কোন কারণে আমার উপর রাগ করে আছিস?”
মোনা উত্তরে হেসে না বলে। আসলে মোনা লিলি বেগমের উপর রাগ করে নেই। লিলি বেগমের উপর কেন রাগ করবে? কিন্তু মোনা কেন জানি আগের মত সহজ আচরণ করতে পারছে না। বার বার সেই রাতের কথা মোনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মোনা নিঃশব্দে কেঁদে উঠে, মোনার চোখে কান্নার শুষ্ক রেখা।
__
মোনা প্রিয়মের মুখোমুখি বসে আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখাটা হয়েছে। মোনা বুক স্টোরে আসছে বই পড়তে। প্রিয়ম বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মোনা আড় চোখে তাকাচ্ছে।
-“মোনা আমি প্রচুর বই পোকা মানুষ। পার্টি,আড্ডা ওসব বাদে যে টাইম থাকে আমি বই পড়েই কাটাই। হয়ত রাতে নাইটক্লাবে যেতাম নয়ত বই পড়তাম।”
খুব সহজ গলায় কথা গুলো বলল প্রিয়ম। এমন ভাবে বলেছে বোধ হচ্ছে ওঁদের সাথে সম্পর্ক খুব উন্নত। মোনা’কে নিরুত্তর দেখে আবার বলল,
-“এখন আর নাইট ক্লাবে যাই না। ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছি। একটা চাকরির জন্য ট্রাই করছি। খুব ভালো একটা চাকরি।”
মোনার মনে হচ্ছে ও অন্য এক প্রিয়ম কে দেখছে। পরিবর্তনশীল একজন মানব। মোনা বলল,
-“ও।”
-“তুমি এখানে আজ প্রথম আসলে? আমি তো প্রায়ই আসি।”
মোনা বই থেকে চোখ তুলে বিরক্ত হয়ে বলল,
-“এখানে অনেক মানুষ বই পড়ছে , তাঁদের ডিস্টার্ব হচ্ছে। প্লীজ স্টপ।”
মোনা বুক স্টোর থেকে বের হয়ে যায়, প্রিয়মও পিছনে পিছনে বের হয়। মোনা দ্রুত পায়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে প্রিয়মের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রিয়ম লম্বা লম্বা পা ফেলে মোনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ।লম্বা সুরে মোনার নাম ধরে ডাকলো। মোনা কর্কশ গলায় কথা বলল না, বিরক্তও হলো না। খুব সহজ গলায় বলল,
-“কিছু বলবেন?”
-“হ্যাঁ।”
মোনা অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই আপনায় না আমার চিনতে কষ্ট হচ্ছে। উদ্দেশ্যে কি আপনার?”
-” পরিবর্তন হওয়া, তোমার মনের মত হওয়া,তোমায় ভালোবাসা।”
খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল প্রিয়ম। মোনার মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
-“আর কিছু?”
-“মোনা তুমি আমার কথা সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছো না। প্লীজ মোনা বি সিরিয়াস।”
মোনা উত্তর দিলো না। এসব কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। মোনার চোখে মুখে নির্লিপ্ততা, কোন পরিবর্তন নেই। একদম ভাবলেশহীন। প্রিয়মের চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে ও খুব অনুতপ্ত, অনুশোচনায় ভুগছে।
-“আমি তো ছোট বেলা থেকেই আমেরিকায় বড় হয়েছি। শুধু মা-বাবার কাছ থেকে বাংলা ভাষা’টা শিখেছি। বাংলাদেশের আর কিছুই শিখি নি, কিছুই জানি না। তোমরা যেমন কারো সাথে দেখা হলে হ্যান্ডশেক করো বা সালাম দিয়ে ভাব বিনিময় করো। আমি ছোট বেলা থেকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খেয়ে ভাব বিনিময় করা শিখেছি। এটা আমার ভুল? আমার কাছে নাইট ক্লাবে যাওয়া, ফুর্তি করা ওগুলো খুবই সাধারন ব্যাপার।‌‌‌‌‌‌‌কারণ আমি এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখান থেকে আমি এগুলো শিখেছি স্বাভাবিক আর পাঁচটা জিনিসের মত। এগুলো তে আমার কোন পাপবোধ হতো না।তুমি আমার কাছ থেকে তোমার কালচারাল আচরণ প্রত্যাশা করতে, আমিও ঠিক তোমার কাছ থেকে আমার কালচারাল আচরণ প্রত্যাশা করেছি। এটা আমার অন্যায়?”
খুব কঠিন ধাঁধার মুখোমুখি হলো মোনা। কথা গুলো যুক্তিনিষ্ঠ। মোনা চুপ করে থাকল। প্রিয়ম আবার বলল,
-“আমি পরে বুঝতে পেরেছি এ বিষয় গুলো তোমার কাছে খুব সেনসিটিভ।আমি হঠাৎ করে তোমার মাঝে অন্যরকম বিশেষত্ব খুঁজে পাই। যখন তুমি আমাদের বাসা থেকে চলে আসলে দূরত্ব সৃষ্টি হলো।আমি তোমার লজ্জা পাওয়া,তোমার বিরক্ত হওয়া, তোমার রাগ হওয়া, তোমার অসহায় চাহনি সব আমি বাজে ভাবে মিস করতে থাকি। আমি অনুভব করলাম তোমায় প্রয়োজন আমার। আমি তোমার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে পারব।”
কথা শেষে প্রিয়ম মোনার দিকে তাকায় মোনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।মোনা সহজ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ম মোনার উত্তরের জন্য আগ্রহী গলায় উতলা হয়ে বলে,
-“মোনা কিছু বলছো না কেন?”
-“আচ্ছা প্রিয়ম ভাই আমি বুঝলাম, আপনি আমার সাথে যা করেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আপনার উপর তাহলে আমার আর কোন রাগ থাকলো না।”
মোনা হাতের কব্জিতে দেওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার যেতে হবে।”
-“শুধু মাফ, আর কিছু না? মোনা তুমি সব কিছু বুঝেও অবজ্ঞা করছো।”
মোনা প্রিয়মের অস্থির হয়ে হয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বলে,
-“নাথিং এলস।”
মোনা দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। কিছুদূর এসে পিছনে তাকায়।না..প্রিয়ম পিছু পিছু আসে নি। মোনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রিয়মের বলা কথা গুলো মোনার কথায় তীব্র ভাবে আন্দোলিত হচ্ছে। প্রিয়মের উপর যে রাগ ছিলো তা চলে গেছে। এর বেশি কিছুই মোনা ভাবছে না। ভাবার প্রশ্ন আসে না। মোনা ধীরে ধীরে ওর বাসার দিকে এগিয়ে যায়।

বাসায় পৌঁছানোর একটু পর জ্যাকের ম্যাসেজ। জ্যাক ছোট একটা ম্যাসেজ করে বলল,
-“প্রিন্সেস অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
জ্যাক মোনা’কে যেতে বলেনি। কিন্তু এই ম্যাসেজে যাওয়ার আহ্বান স্পষ্ট। প্রিন্সেসের অসুস্থতার কথা শুনে মোনার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো। মোনা,নিশান কে নিয়ে জ্যাকের বাসায় আসলো। প্রিন্সেস চিৎকার দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মোনার সাথে জ্যাকের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছে সেদিনও এভাবে কেঁদেছিলো প্রিন্সেস। মোনার মনে হচ্ছে কান্না প্রিন্সেসের জন্য না, প্রিন্সেস সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মত হাসবে। জ্যাক’কে অস্থির দেখাচ্ছে। মেয়ের অসুস্থতার শোক চোখ মুখে তীব্র ভাবে প্রকাশিত। মোনা প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কান্না থামছে না। কিছুক্ষণ পর মেডিসিন নিয়ে আসে একজন। মেডিসিন খাওয়ানোর পর কান্না কিছুটা থেমে আসে। মোনা অনারাবত প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে হেঁটে পাঁয়তারা করছে। প্রিন্সেসের কান্না থেমে আসলে জ্যাকের চোখে মুখে স্বস্তি দেখা যায়। খুব বড় চিন্তা থেকে অবসান হয়েছে যেন। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে জ্যাক’কে একজন ডাকলো। বলল,
-” ক্লাইন্ট এসেছে।”
জ্যাক মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আপনি ও’কে নিয়ে বসুন, আমি আসছি।”
প্রিন্সেসের গোলাপী রঙা ঠোঁট দুটো কান্নার কারণে আরো গোলাপী হয়ে উঠেছে। চোখ গুলো ফুলে উঠেছে। মোনা প্রিন্সেস কে বিছানায় শুইয়ে দেয়। প্রিন্সেসের সয্যার পাশে বসে। নিশান বাসার এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এ বাসাটা এখন নিশানের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
মোনা প্রিন্সেসের চোখ অবধি লেপ্টে থাকা চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিচ্ছে। মোনার হঠাৎ চোখ যায় বেড সাইডে রাখা বেগুনি রঙের একটা ডায়েরির দিকে। ডায়েরি’টা তে মোটা আকৃতিতে গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লিখা ‘প্রেগন্যান্সির দিন গুলো।’ এটা কম্পিউটারে টাইপ করা লেখা না, কারো হাতে লেখা। মোনা ভ্রু কুঁচকে প্রচন্ড আগ্রহে হাতে নেয় ডায়েরি’টা। ডায়েরি’টার প্রথম পৃষ্ঠা উল্টানোর ইংরেজি তে লেখা,
“তুমি এই ডায়েরি তে কি লিখেছো আমি আজও বুঝি নি।তোমার দেশের ভাষায় লেখা। তবুও আমি প্রায় এই ডায়েরি খুলে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখি। এতে যে তোমার হাতের ছোঁয়া রয়েছে কুইন।”
(জ্যাক)
মোনার আগ্রহ বোধ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায় যেন। এটা জ্যাকের বউয়ের বাংলা ভাষায় লেখা একটা ডায়েরি। মোনা পৃষ্ঠা উল্টালো,
“আজ ডাক্তার বলল আমার মাঝে নতুন এক প্রান বেড়ে উঠেছে।এ আনন্দ প্রকাশ করব কিভাবে? মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি, পরিপূর্ণ এক নারী হতে যাচ্ছি।”
এক পৃষ্ঠায় শুধু এই টুকুই লেখা। মোনা পরের পৃষ্ঠা উল্টাতে উদ্যত হলেই রুমের দিকে আসতে থাকা পায়ের শব্দে অপ্রস্তুত ভাবে ডায়েরি’টা রেখে দেয়। জ্যাক এসেছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here