রিত্তর গালে টানা চারটা থাপ্পড় লাগিয়ে হাতদুটো দেয়ালে সজোরে আঘাত করল রিশাদ । রিত্ত সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । রিশাদের হাত বেয়ে রক্ত ঝরে যাচ্ছে ক্রমাগত । রিত্ত এগিয়ে আসতে চাইলেও এগোতে দেয় না রিশাদ । রিশাদের হাতের একটা ইশারায় পুতুলের ন্যায় থমকে দাঁড়িয়ে যায় রিত্ত । রিশাদের লোকেরা মিলে রিত্তর প্রেমিক দিব্যকে বেঁধে অমানবিক অত্যাচার করে চলেছে । সেদিকে এক পা এগোনোর অনুমতিও নেই রিত্তর । নিজের অসহায়ত্বকে এক সীমায় বেঁধে ফেলল রিত্ত । সে জানে এখন দিব্যর প্রতি মায়া দেখানো মানে নিজের হাতে দিব্যকে মেরে ফেলা । কয়েক মাস আগের সব ঘটনা যেন প্রতিচ্ছবি হয়ে চোখে ভাসতে লাগে রিত্তর।
অফিস জয়েন করার পরপরই রিত্ত বুঝে গিয়েছিল রিশাদ স্যারের নজর সবসময় তার উপর থাকে , এমনকি অফিসের বাইরেও । একপ্রকার রিশাদের নজরবন্দি থাকতে হত রিত্তকে । চাকরিটা প্রয়োজন ছিল বলে মেনে নিয়েছিল রিত্ত । রিশাদের চোখের আড়ালে কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা কখনোই হয়নি রিত্তের । তবে রিত্তের প্রতি রিশাদের এই অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো মেনে নেওয়া কঠিন রিত্তের জন্য । বারো ঘণ্টা রিশাদের সামনে বসে কাজ করা এবং এই সমস্ত সময় রিশাদের পলকহীন দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা অস্বস্তিকর লাগে রিত্তের কাছে ।
রিশাদের টেবিলে প্রতিদিনের ন্যায় ব্ল্যাক কফিটা আজ নেই । নিমেষেই মাথা ঘুরে উঠল রিশাদের । রোজ রিশাদ আসার দু’মিনিট আগে রিত্ত ব্ল্যাক কফি রেখে যায় । অথচ আজ তার ব্যতিক্রম । মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রিশাদের । টেবিলে পড়ে থাকা কালো রঙের সিম্পল ডিজাইনের কফি মগটা ছুঁড়ে মারল জানালার দিকে । সাথে সাথে জানালার কাঁচ ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে মগটাও ফ্লোরে পড়ে রইল । কুয়াশার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে শহর আর এই শহরের বুকেই রিত্ত নামক মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে নিজের অতীতকে ভুলতে বসেছিল রিশাদ কিন্তু বোধহয় তা আর হলো না ।
🖤
–মেয়েটার খোঁজ পেয়েছো?
–না স্যার!
–একঘণ্টার মধ্যে যদি মেয়েটা আমার সামনে এসে না দাঁড়িয়েছে তাহলে তোমাদের সবাইকে আমি কোন কথা ছাড়া শ্যুট করে দেব । আই ওয়ান্ট দ্যাট গার্ল ইন ফ্রন্ট অফ মাই আয়েস । ডু ইউ গেট ইট?
–ই….ইয়েস স্যার ।
রিশাদের ধমক শুনে অপর প্রান্ত থেকে কল কেটে দিল ছেলেটা । রাগে কপালের রগটা স্পষ্ট ফুটে উঠছে রিশাদের । মারাত্মক রেগে গেলেই রিশাদের কপালের রগটা ফুটে ওঠে । নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে রিশাদ কিন্তু প্রতারণা জিনিসটা সে কখনোই মেনে নিতে পারেনা । আর আজ দ্বিতীয়বারের মতো নিজের প্রিয়দের কাছে প্রতারিত সে ।
সময় নিজ গতিতে চলছে । টেবিলের উপর রিশাদের ফোনটা বেজে উঠল । কল রিসিভ করে কানে ধরল রিশাদ ।
–স্যার,পেয়েছি মেয়েটাকে । এক ছেলের সাথে পালানোর মতলবে ছিল । এখন আপনার দুই নম্বর হাইড-আউট বাংলোটাতে আছি আমরা ।
–ছেলেটাকে বেঁধে রাখো । আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি । রিত্তকে রুমে লক করবে ।
রিশাদ বেশ শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে কল কেটে দিল । ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে অফিস থেকে বেরোল ।বিশ মিনিটের মাথায় সে মুখোমুখি হলো রিত্তর আর রিত্ত মুখোমুখি হলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ।
বর্তমান।
দু হাত পেছনে বাঁধা দিব্যর । সামনের চেয়ারে বসে আরামে ব্ল্যাক কফি খাচ্ছে রিশাদ তাও রিত্তর হাতের । পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে রিত্ত । এই ভয়টাই পাচ্ছিল রিত্ত । এজন্যই চায়নি সে দিব্যকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে । নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে দিব্যকে জড়িয়ে দিব্যর বেঁচে থাকাটা অবধি অনিশ্চিত করে ফেলল রিত্ত, ভাবতেই অশ্রুকণাগুলো চোখের কোণে এসে থমকে যাচ্ছে । দিব্যর জন্য যদি রিত্তর এক বিন্দু চোখের জলও মাটিতে পড়ে রিশাদ হয়তো দিব্যকে এখনি নির্মমভাবে মেরে ফেলবে । রিশাদের জারি করা সীমানায় রিত্তর কাঁদার অধিকার নেই । এক জোরপূর্বক হাসি হলেও ঝুলিয়ে রাখতে হবে ঠোঁটের কোণে । রিশাদের এই সীমানাকেই অতিক্রম করে বাঁচতে চেয়েছিল রিত্ত কিন্তু সেটাই যে তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে তা তো সে বোঝেনি ।
🖤
রিশাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিত্ত । পড়নে সাদা-নীল সালোয়ার-কামিজ ,ওড়নাটা চাদরের মতো গায়ে জড়ানো । কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে গেছে চারপাশ । শিশির বিন্দুর স্নিগ্ধতায় ঘাসগুলো যেন চিরসিক্ত । ঘরের জানালা দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা রিত্তকে দেখছে রিশাদ । মেয়েটা কাঁপছে কিন্তু বিন্দুমাত্র দয়াকে নিজের মনে স্থান দিচ্ছে না রিশাদ । মেয়েটা যা করেছে তার জন্য এই শাস্তিগুলো তার প্রাপ্য । কফির মগে চুমুক দিতে দিতে শিশিরে ভেজা রিত্তের চুলে নজর পড়লো রিশাদের । এই মায়াবী চুলের বাঁধনে রিশাদকে বাঁধলে কি ক্ষতি হত মেয়েটার?কেন সে অন্যকারোর প্রতি আকৃষ্ট হলো?কি করে পারল এটা করতে?শীতের প্রকোপে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা রিত্তের । এমনিতেই সামান্য ঠাণ্ডা পানিতেই তার জ্বর হয়,আর এই প্রচণ্ড শীতে তো সে রীতিমতো বরফ হয়ে জমে গেছে । আচমকাই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল রিত্ত । ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিল রিশাদ । আচমকা রিত্তের এভাবে পড়ে যাওয়া দেখে নিচে ছুটে এল রিশাদ । ঠাণ্ডার কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছে মেয়েটা । রিত্তকে কোলে তুলে শোবার ঘরে নিয়ে এলো রিশাদ । রিত্তকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিল । ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি গাল বেয়ে গলায় গড়াচ্ছে । অদ্ভুত এক নেশার্ত সে দৃশ্য কিন্তু নিজের ক্রোধের কাছে হার মানল রিত্ত । মায়ার দৃষ্টিতে আর তাকাতে পারল না রিত্তের দিকে । করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিত্তের দিকে । রিত্তর চুল মুছে দিয়ে অন্য রুমে চলে গেল রিশাদ ।
–হ্যালো!
–বলো।
–আমি আপনার কথামতো সব করেছি ।প্লিজ দিব্যর যেন কোন ক্ষতি না হয় ।
–হবে না।এরপর যা যা বলছি সব মেনে চলবে । রিশাদের সীমানা থেকে আমি বের করে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিব তোমায় আর দিব্যকে।
কলটা কেটে ফোনটা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখল রিত্ত । অবশেষে সে মুক্তি পেতে চলেছে রিশাদের থেকে । অতঃপর দিব্যর সাথে এক মুক্ত শান্তির জীবনে পদার্পণ করবে ।” তবে রিশাদের সাথে প্রতারণা করাটা কি ঠিক হবে?রিশাদ প্রতারণা সহ্য করতে পারে না । যদি হিতে বিপরীত হয়,তাহলে দিব্য আর রিত্ত কেউই বাঁচবে না ।”চিন্তিত কণ্ঠে রিত্ত শুয়ে রইল ।
🖤
“রিশাদ আফসান চৌধুরী!!ইউ আর ফিনিশড।তোমাকে শেষ করার সবচেয়ে দুর্বল কিন্তু সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার পেয়ে গেছি আমি।”বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে লোকটা । লোকটার হাতে থাকা রিভলবারটা ঘুরাতে থাকে সে । এক ভয়ঙ্কর খেলার সূচনা করেছে সে । ভালোবাসা আর প্রতারণার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক খেলা ।
🖤
রিশাদ রিত্তের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিল । রিত্তের ঘুম ভাঙতেই সে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সাজিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । রিত্ত নিচে নেমে আশেপাশে কাউকে খুঁজে পায় না । রিশাদ বাসাতে সবসময় একা থাকতেই পছন্দ করে । গার্ড অবধি রাখেনা সে । ডাইনিং টেবিলে বসতেই বাটার লাগানো ব্রেডের প্লেটের পাশে একটা চিরকুট পায় রিত্ত । চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করে রিত্ত ।
“ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে আসবে । আধঘণ্টার মধ্যে আমার টেবিলে ব্ল্যাক কফি যেন পাই আমি ।”
রিশাদের থ্রেটে রীতিমতো হাত-পা কাঁপতে শুরু করে রিত্তের । খাবার তো গলা দিয়ে নামবেই না কিন্তু এভাবে ফেলে গেলে রিশাদ তাকে আস্ত রাখবে না আর রিত্ত চায়ও না এখন এমন কিছু করতে যাতে এই বাড়ি থেকে তাকে বের হতে হয় । আপাতত রিত্তের সবচেয়ে বড় এবং রিস্কি কাজ হলো রিশাদের বিশ্বাস অর্জন করে এই বাড়িতে থাকাটা ।
জরুরি কিছু কাজ শেষ করে অফিসের দিকে যাচ্ছে রিশাদ । রিত্তের আধঘণ্টা সময় শেষ হতে আর আট মিনিট বাকি । রিশাদ বরাররই সময় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন । সে জানে আট মিনিটের মধ্যেই সে অফিসে পৌঁছে যাবে ।
অফিসে পৌঁছে কেবিনে ঢুকতেই রিশাদ দেখল ব্ল্যাক কফির সেই আগের ডিজাইনের মগটাতে কফি ঢালছে রিত্ত ।” এই মগটা এত কম সময়ে কই পেল এই মেয়েটা?”চিন্তিত দেখালেও কিছুটা ভালো লাগে রিশাদের । কফিতে চুমুক দিয়ে রিত্তের দিকে তাকাল রিশাদ । চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে রিত্তের,শরীর একদিনেই শুকিয়ে গেছে,কপালে ভাঁজ পড়া,মলিন চাহনি যেন কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না।রিত্তের এই অবস্থা রিশাদের বুকে এক অনাকাঙিক্ষত ব্যথা সৃষ্টি করছে । রিশাদ কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিতে যাবে ঠিক এমন সময় রিশাদের ফোনটা বেজে উঠল । ফোন কানে ধরতেই অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির কথায় চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করল রিশাদের । রাগান্বিত ভাবে চুপচাপ কথাগুলো শুনতে লাগল সে । রিশাদের হাতের চাপে মগে রীতিমতো ফাটল ধরে গেছে । চোখের পলকেই মগটা চূর্ণ চূর্ণ হয়ে রিত্তের সামনে পড়ে রইল । অগ্নিদৃষ্টিতে রিত্তের দিকে তাকিয়ে আছে রিশাদ । কপালের রগটা স্পষ্ট ফুটে উঠছে । রিশাদের দিকে তাকিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলল রিত্ত । লোডেড গানটা রিত্তের দিকে তাক করল রিশাদ ।
To be continued….
🖤Lover_Boss🖤
Part_1
Mihika_Rahman
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন । শুরু দেখে অবশ্যই সম্পূর্ণ গল্প বিবেচনা করবেন না । আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে গল্পটা । সবাইকে ধন্যবাদ ।]