Mr_Husband৷ পর্ব ১২+১৩

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১২

মুন আর আঁধারের বিয়ের ছয় মাস পুর্ন হলো আজ। মুন কোনো ভুল করলেই আঁধারের নতুন নতুন পানিসমেন্ট আর আঁধার কে শায়েস্তা করতে মুনের নতুন নতুন টেকনিক। এরকম দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে ছয়টি মাস পেরিয়ে গেল। ওদের সম্পর্ক টা এই ছয় মাসে অনেকটা নরমাল হয়েছে। এখন আর আঁধার মুনের সাথে রুড বিহেভ করে না। কিন্তু আঁধারের কথার অবাধ্য হলে আবার ছেড়েও দেয় না। ওদের বিয়ের ছয় মাস পুর্ন হয়েছে তাই মুন ঠিক করলো আজ আঁধারের জন্য নিজ হাতে ওর পছন্দের কিছু রান্না করবে। কিন্তু কথা হলো মুন রান্না করতেই পারে না। ডিম ভাজি আর টুকটাক কিছু ভাজাপোড়া ছাড়া মুন কিছুই পারে না। পারবে কি করে? মুনের কখনো রান্নাঘরে যাওয়ার প্রয়োজন’ই পরে নি। তাহমিনা খান যখন বিদেশে ছিলেন তখন কবির খান আর রুনু খান মানে মুনের দাদি মাথায় উঠিয়ে রেখেছেন মুন কে। ওকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। ওর পরনের জামাটা পর্যন্ত ধুয়ে দিতেন রুনু খান। যখন যেটা চাইত সেটাই এনে দিতেন। বহুত আদরের নাতনি তার। কবির খান আর রুনু খান খুব আদরে বড় করেছেন মুন কে। মুন যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে তখন তাহমিনা খান বিদেশ থেকে ফিরেন। ফিরে এসে যখন মেয়ের এরকম বাঁধ ছাড়া অবস্থা দেখেন তখন খুব রেগে যান তিনি। তার মতে রুনু খান’ই আদরে আদরে বাঁদর বানিয়েছেন মুন কে। উনি অনেক চেষ্টা করেন মুন কে ঘরের কাজকর্ম, রান্নাবান্না শেখাতে কিন্তু মুনের এসবে কোনো ইনট্রেস নেই। তাহমিনা খান কিছু বলতে গেলেই ধমকে তাকে চুপ করিয়ে দিতেন রুনু খান আর কবির খান। মুনের এখন খুব আফসোস হচ্ছে রান্না না শেখার কারণে। হঠাৎ মুনের মনে পরে ইন্টারনেট আছে তো। এই ইন্টারনেটের যুগে ওর টেনশনের কি আছে। নেটে সার্চ দেওয়ার সাথে সাথে সব হাজির। কিন্তু এখন আরেক টা সমস্যা দেখা দেয় আর সেটা হলো আঁধারের পছন্দের খাবার কি তা তো মুন জানেই না। মুন মনে মনে ভাবে আরিফা রেজওয়ান জানে হয়তো। মুন এক মিনিট ও সময় ব্যায় না করে দৌড়ে রায় আরিফা রেজওয়ানের রুমে। আরিফা রেজওয়ান নিজের রুমে জামা কাপড় ভাঁজ করছিলেন। মুন উঁকি মারে মেটা আরিফা রেজওয়ানের চোখ এড়ায় না। আরিফা রেজওয়ান উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,

—“কে ওখানে?”

মুন ইতস্তত করতে করতে সামনে এসে মিনমিনে গলায় জবাব দিলো,

—“আমি”

আরিফা রেজওয়ান হেসে মুন কে কাছে ডাকলেন,

—“বিইরে দাঁড়িয়ে কেন ভিতরে এসো?

মুন পিঁপড়ের মতো হেঁটে আরিফা রেজওয়ানের রুমে ঢুকলো। আরিফা রেজওয়ান মুনকে বসতে বললেন। মুন বিনা বাক্য ব্যয়ে বসে পরলো। আরিফা রেজওয়ান কাপড় ভাঁজ করতে করতে আড়চোখে মুনের দিকে তাকালো। মুন কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু দ্বিধায় বলতে পারছে না। তাই আরিফা রেজওয়ান’ই জিজ্ঞেস করলেন,

—“কিছু বলবে?”

মুন আমতা আমতা করে বলল,

—“ইয়ে! না মানে হ্যা।”

আরিফা রেজওয়ান কাপড় রেখে মুনের পাশে বসলেন। মুন মিনমিনে গলায় বলল,

—“শাশুমা আমি কিছু জানতে চাই?”

—“বলো?”

মুন ইতস্তত করে বলল,

—“আসলে…..উনার পছন্দের খাবার কি? মানে উনি কি খেতে বেশি ভালোবাসে?”

আরিফা রেজওয়ান কিছুটা অবাক হলেন। তারপর বলেন,

—“চিকেন বিরিয়ানি। কিন্তু তুমি জানতে চাচ্ছো কেনো?”

সন্দিহান চোখে মুনকে জিজ্ঞেস করলেন। মুন জোড় পূর্বক হেসে বলল,

—“এমনি”

তারপর আরিফা রেজওয়ান কে কিছু বলতে না দিয়েই মুন দৌড়ে চলে গেল। মুনের কান্ডে আরিফা রেজওয়ান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রুলেন মুনের যাওয়ার দিকে। তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। মুন নিজের রুমে এসে ইউটিউব এ চিকেন বিরিয়ানির রেসিপি সার্চ দিলো। তারপর কিছুক্ষণ ভিডিও টা ভালো করে দেখলো। মুন আগে কখনো রান্না করেনি তাই ওর জন্য কিছুটা কঠিন। কিন্তু বলে না কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। মুন মোবাইল টা নিয়ে ছুটে রান্না ঘরে যায়। রান্নাঘরে চুমকি নামের কাজের মেয়েটা রান্নার জন্য সবজি কাটছিল। মুন কে দেখে কিছুটা অবাক হলো। চুমকির বয়স বেশি না। ছোট থেকেই এই বাড়িতে বড় হয়েছে। খুব ভালো ও বাধ্য মেয়ে। চুমকি কে কেউ কাজের মেয়ের মতো দেখে না। নিজেদের পরিবারের একজন সদস্য বলেই সবাই মনে করে। চুমকি আঁধার কে যমের মতো ভয় পায়। আঁধার প্রথম দিনেই বলে দিয়ে ছিল মুন যেন ভুলেও কিচেনে পা না দেয়। চুমকি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“আপামনি আপনে এহানে কিছু লাগবো?”

—“না তুই সর?”

—“কেন?”

—“এতো কথা করিস কেন তুই? সরতে বলছি সরবি। এই কোনো জিনিস কোথায় আছে রে?”

—“কেন আপনে কি করবেন?”

—“রান্না করবো। এখন প্রশ্ন না করে আমি যা যা বলবো তা তা বের করে দিবি।”

চুমকি যেন হার্ট অ্যাটাক করবে এমন অবস্থা। রান্না করতে গিয়ে যদি মুনের সামান্য তিল পরিমাণ ও কিছু হয় তাহলে আঁধার এসে বাড়ি মাথায় তুলবে। আর ওর অবস্থা তো বারো টা বাজাবে। চুমকি জোরে জোরে চিৎকার করে আরিফা রেজওয়ান কে ডাকতে লাগলো,

—-“বড়মা, ও বড়মা, বড় মা গো?”

চুমকির চিৎকার শুনে আরিফা রেজওয়ান একপ্রকার ছুটে কিচেনে এলেন। আরিফা রেজওয়ান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

—“কি হয়েছে তোর? এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?”

চুমকি ভীত গলায় জবাব দিলো,

—“আপামনি না কি রান্না করবো।”

আরিফা রেজওয়ান অবাক হয়ে বললেন,

—“তুমি রান্না করতে যাবে কেন? তোমার যদি কিছু খেতে ইচ্ছে হয় তাহলে চুমকি কে বলো ও বানিয়ে দিবে। নাহয় আমি বানিয়ে দিবো।”

মুন ফটাক করে জবাব দিলো,

—“না, না আমি নিজের খাওয়ার জন্য রান্না করছি না।”

—“তাহলে?”

—“আজ আমাদের বিয়ের ছয় মাস পুর্ন হয়েছে। তাই আমি ভাবলাম নিজ হাতে উনার জন্য উনার পছন্দের কিছু রান্না করতে।”

আরিফা রেজওয়ান নাকচ করে বললেন,

—“না মামনি। তুমি পারবে না। আর আঁধার ও নিষেধ করে দিয়েছে তোমাকে যেন রান্না ঘরে ঢুকতেই না দেই। সেখানে রান্না করা তো দূরের কথা।”

মুন অনেক বার করে বলল। কিন্তু আরিফা রেজওয়ান মানতে নারাজ। সে কোনো মতেই মুনকে রান্না করতে দিবে না। মুন এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে বলল,

—“নিজের মেয়ে মনে করো না তো তাই এরকম করছ। যদি নিজের মেয়ে মনে করতে তাহলে আর এরকম করতে না।”

আরিফা রেজওয়ান এবার আর না বলতে পারলেন না। কিন্তু উনার খুব ভয় করছে। উনি বললেন,

—“ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোমার পাশে থেকে তোমাকে হেল্প করবো।”

মুন খুশি হয়ে আরিফা রেজওয়ান কে জরিয়ে ধরলো। তারপর রান্না শুরু করলো। আরিফা রেজওয়ান মুন কে বেশি কিছু করতে দিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু মুন তো মুন’ই। মুন আরো আরিফা রেজওয়ান কে কিছু করতে দিচ্ছে না। চুমকি পিঁয়াজ মরিচ কেট ছিল। মুন ছো মেরে চুমকির হাত থেকে চপার টা নিয়ে নিল তারপর ওকে সরিয়ে নিজেই পিঁয়াজ কাটতে লাগলো। চুমকি দিতে চায়নি। কিন্তু মুন চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই চুমকি চুপ মেরে গেল। মুন পিঁয়াজ কাটতে কাটতে পিঁয়াজের সাথে সাথে নিজের আঙ্গুলেও কেটে ফেলে। মুন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মৃদু চিৎকার করে। আঙ্গুল থেকে গড়গড় করে রক্ত পরছে। চুমকি দেখে ভয় পেয়ে যায়। আরিফা রেজওয়ান রান্না ঘরে উপস্থিত নেই। আরমান রেজওয়ান ফোন করেছেন তার সাথেই কথা বলতে গেছেন। চুমকি চিৎকার করে আরিফা রেজওয়ান কে ডাকতে যাবে মুন তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরে। আর শাসিয়ে বলে,

—“হুসসস। একদম চিৎকার করবি না। তাহলে এই চাকু দিয়ে তোর পেট ফুটো করে দিবো।”

মুখ চেপে ধরার কারণে চুমকি মুখ দিয়ে উম উম শব্দ করছে। মুন বলল,

—“ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু চিৎকার করবি না। আর ভুলেও শাশুমা কে কিছু বলবি না।”

চুমকি মাথা নাড়ে। মুন ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। তারপর বলে,

—“শাশুমা আসার আগে তাড়াতাড়ি ফ্লোর টা পরিষ্কার করে ফেল। আমি পোলাওর চাল টা ধুয়ে নিচ্ছি।”

—“কিন্তু আপামনি আপনের আঙ্গুল তো কেটে গেছে। পানি লাগালে তো আরো জ্বলবে।”

—‘ও কিছু হবে না। তুই নিজের কাজ কর।”

চুমকি মাথা কাত করে কাজে লেগে পরে। মুন পোলাওর চাল ধুয়ে নেয়। কাঁটা জায়গায় পানি লাগার কারণে কিছুটা জ্বলছে। কিন্তু মুন তা পাত্তা দিলো না। এর’ই মধ্যে আরিফা রেজওয়ান কথা শেষ করে রান্না ঘরে এলেন। উনি চুমকি কে বললেন ফ্রিজ থেকে চিকেন বের করে ভেজাতে। চুমকি বাধ্যের মতো ফ্রিজ থেকে চিকেন বের করে ভেজালো। তারপর রান্না শুরু করলো।[আমি মুনের মতোই রান্না করতে পারি না। আর চিকেন বিরিয়ানির রেসিপি ও আমার জানা নেই। তাই ডিটেলসে কিছু বলতে পারলাম না] মুন বলল,

—“শাশুমা রান্না তো প্রায় শেষ’ই। আপনি বরং রুমে গিয়ে রেস্ট করুন। আমি আর চুমকি মিলে বাকি রান্না টুকু করতে পারবো।”

আরিফা রেজওয়ান কিছুতেই রাজি হতে চাইলেন না। কিন্তু মুন জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিলো। মুন রান্না করছিল হঠাৎ বেখেয়ালি হয়ে কিভাবে যেন হাত পুড়িয়ে ফেলল। মুনের চিৎকারে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠলো। আরিফা রেজওয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মুনের হাতের অবস্থা দেখে উনার যেন মাথা ঘুরে এলেন। খুব বাজে ভাবে অনেক খানি পুড়ে গেছে। উনি জলদি করে মুন কে ধরেলেন। চুমকি আর আরিফা রেজওয়ান মিলে ধরে মুন কে ড্রইং রুমে নিয়ে গেলেন। ভয়ে চুমকির জান বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। মুন কান্না ভুলে চুমকির উপর রাগ দেখিয়ে বলল,

—“গ্যাসের উপর বিরিয়ানি পুড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি গিয়ে নামা।”

আরিফা রেজওয়ান অবাক চোখে মুন কে দেখছে। যেখানে হাত পুড়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে সেখানে হাতের চিন্তা না করে এখনো বিরিয়ানির চিন্তা করছে। চুমকি দৌড়ে কিচেনে গেল। গ্যাসের উপর থেকে বিরিয়ানি টা নামিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে নিয়ে আবার দৌড়ে ড্রইং রুমে গেলো। মুনের হাতে প্রচুর পরিমাণে জ্বালা করছে। মুন তা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদছে ওর বাবা কে ডাকছে। এদিকে কবির খান মনটা কেমন জানি করছে। মেয়েকে এক নজর দেখার জন্য হঠাৎ করে চোখ দুটো তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে।তার কেন জানি মনে হচ্ছে তার মেয়ের কাজু হয়েছে। তাকে খুব করে ডাকছে। কবির খান আর দেরি করে না বেরিয়ে পরে। একবার নিজের চোখে মেয়েকে দেখলেই মনটা শান্ত হবে। আরিফা রেজওয়ান চুমকি কে তাড়া দিয়ে বলল,

—“জলদি বরফ টা দে।”

আরিফা রেজওয়ান মুনের হাতে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছেন আর মুন ব্যথায় আরো কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ ফুলে গেছে। নাকের ডগা ও গালের দুপাশ লাল হয়ে গেছে। চোখের বড় বড় পাপড়ি গুলো পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। আরিফা রেজওয়ান বুঝতে পারছেন না এখন কি করবেন। উনি তাড়াতাড়ি আঁধার কে ফোন দিলেন। উনার খুব ভয় করছে। আঁধার শুনলে কি করবে তা শুধু আল্লাহ্’ই ভালো জানেন। আঁধার ফোন সুইচ অফ বলছে। আরিফা রেজওয়ান এবার ওনাদের পরিচিত একজন ডক্টর কে ফোন করলেন। আধা ঘন্টা পর ডক্টর আসলেন। ততক্ষণ কোনো উপায় না পেয়ে ঠান্ডা পানিতে হাত ভিজিয়ে রেখে ছিলেন। ডক্টর হাত ড্রেসিং করে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। আর কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে যান। মুন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। মুন ঘুমিয়ে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা পর কবির খান রেজওয়ান মেনশনে আসেন। আরিফা রেজওয়ান কবির খান কে দেখে অবাক হন।

—“আরে ভাইয়া আপনি? আসেন আসেন ভেতরে আসেন।”

কবির খান বাড়ির ভেতরে যায়। আরিফা রেজওয়ানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে। তারপর জিজ্ঞেস করে,

—“মুন কোথায়? ওকে তো দেখছি না।”

—“রুমে। ঘুমাচ্ছে।”

—“ওওও। আমি ওর সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম।”

—“ডেকে দিবো?”

—“না থাক। এমনি এক নজর দেখেই চলে যাবো।”

আরিফা রেজওয়ান জোর পূর্বক হেসে বলল,

—“ঠিক আছে।”

কবির খান মুনের সাথে দেখা করতে যায়। উনি দূর থেকে মুন কে দেখে। মুনের ডান হাত পুড়েছে। আর ডান হাতটা ওই পাশে থাকায় কবির খান দেখতে পায় না। আরিফা রেজওয়ান কবির খানকে নাস্তা দেন। কবির খান খেতে চায় না। কিন্তু আরিফা রেজওয়ান বেশী জোড় করার কারণে খায়। তারপর কিছুক্ষণ পর চলে যায় কবির খান। আরিফা রেজওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

.

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। মুনের ঘুম ভেঙ্গে যায় আযানের ধ্বনিতে। মুন হাত নাড়াতে গেলে হাতে ব্যথা অনুভব করে। মুন আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে আরিফা রেজওয়ানের রুমে গেল। আরিফা রেজওয়ান শুয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে চিন্তিত। মুন কে দেখে আরিফা রেজওয়ান শোয়া থেকে উঠে বসলো। মুন গিয়ে আরিফা রেজওয়ানের পাশে বসলো। আরিফা রেজওয়ান নরম গলায় প্রশ্ন করলো,

—“এখন কেমন লাগছে?”

—“ভালো”

—“ব্যথা করছে?”

—“একটু একটু।”

মুন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—“উনি এখনো আসেনি?”

—“না। এলে তো দেখতেই পেতে।”

আনমনে কথাটা বলে হঠাৎ করেই আরিফা রেজওয়ান রেগে গেলেন। তারপর তখন কার ঘটনা নিয়ে বকাঝকা করতে লাগলেন মুন কে। বকা গুলো কিছুটা এরকম ছিলো,

—“কত বার বারন করে ছিলাম? শুনো নি আমার কথা। এখন দেখো কত টা কষ্ট হচ্ছে। কত টা পুড়ে গেছে। আমি ভাবছি যখন আঁধার এসে দেখবে তখন কি হবে।”

মুন মাথা নিচু করে কান ধরে ঠোঁট উল্টে বলল,

—“অ্যাম সরি। আর কখনো হবে না। আমি আর কখনো জেদ করবো না।”

আরিফা রেজওয়ান কিছু বললেন না। মুন আরিফা রেজওয়ানের কোলে শুয়ে পড়ল। তারপর আদুরে গলায় বলল,

—“তুমি চিন্তা করো না। কিছু হবে না। উনি কিছু বলবেন না। শুধু একটু বকাঝকা করবে।”

আরিফা রেজওয়ান টেনশনে মরে যাচ্ছেন।। আজ বাড়িতে যে একটা ঝড় শুরু হবে তার আশংকা সে এখন থেকেই পাচ্ছে। আলিয়া’ই এসে মুনের হাতের এই অবস্থা দেখে কতক্ষন চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। শেষে মেয়েটা প্রায় কেঁদেই দিয়ে ছিল। দু’জনের মধ্যে অনেক ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যাকে বলে ভালোবাসার বন্ধন। আলিয়া দেখেই এতোটা হাইপার হয়ে গেছে সেখানে আঁধার দেখলেতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। অন্য দিকে মুনের এসব নিয়ে কোনো ভাবান্তর’ই নেই। মুন শুধু চায় আঁধার কে খুশি করতে। মুন নিজের মনের আবেগ মিশিয়ে আঁধারের জন্য ভালোবেসে রান্না করেছে। এই ভালোবাসা আবার প্রেম ভালোবাসা না কিন্তু। এ ভালোবাসা তো একজন গুরুর প্রতি তার শিষ্যের ভালোবাসা। হ্যা মুন আঁধার কে নিজের গুরু নিজের শিক্ষক বলেই মানে। হসপিটাল থেকে আসার পর আঁধারের প্রথম দায়িত্ব হলো মুন কে জোড় করে ধরে বেঁধে পড়াতে বসানো। মুন এতো বিরক্ত করে আঁধার কে কিন্তু আঁধার কখনো বিরক্ত হয় না। মুন যদি কোনো ভুল করে তাহলে আঁধার তা শুধরে দেয়া। সব সময় ওর খেয়াল রাখে। ওর গায়ে কখনো ফুলের টোকাও লাগতে দেয় না। হ্যা শাস্তি দেয় কিন্তু সেই শাস্তি গুলো এমন হয় যাতে মুনের একটু কষ্ট হয় কিন্তু কোনো ক্ষতি না হয়। আঁধার মুনকে সবসময় ছোট বাচ্চাদের মতো আগলে রাখে। হসপিটালে থাকলে টাইম টু টাইম ফোন করে খোঁজ নিবে ও খেয়েছে কি না। আর বাসায় থাকলে তো নিজের সামনে বসিয়ে খাওয়াবে। এতটা কেয়ার কজন করে? মুনের সত্যি’ই নিজেকে অনেক সময় লাকি মনে হয়। কবির খান যেমন করে মুনের খেয়াল রাখতো ঠিক তেমন ভাবে আঁধার ওর খেয়াল রাখে। কবির খানের পর আঁধার’ই মনে হচ্ছে ওকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। এই ভালোবাসা টা অন্য রকম। যেটা বোঝার সাধ্য কারো নেই। মুন মনটা আজ অনেক শাড়ি শাড়ি করছে। একবার মুন আর আঁধার শপিং এ গেছিলো। সেখানে শুভ্র রং এর একটা শাড়ি মুনের খুব পছন্দ হয়। মুন সেটা নিতে চাইলে আঁধার সাম নিষেধ করে দেয়। আর বলে এসব শাড়ি টাড়ি যদি মুন কে পরতে দেখে তাহলে রুমের লাইট অফ করে মুন কে রুমে লক করে দিবে। তাই মুন ভয়ে ও কখনো শাড়ি পরে নি। কিন্তু আজ পরবে। কিন্তু সমস্যা হলো মুন শাড়ি পড়তে পারে না। আগে তো তাহমিনা খান পরিয়ে দিতেন। তখন মুন শাড়ি পরে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু বাইরে বের হতো না। মুন আরিফা রেজওয়ানের দিকে তাকাতেই তাকে শাড়ি পরা দেখে। আরিফা রেজওয়ান খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে। তার শাড়ি পরাটা মুনের খুব পছন্দ। মুন আরিফা রেজওয়ান কে ডাকলো,

—“শাশুমা?”

—“হুম বলো?”

—“আমারং না খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। পরিয়ে দিবে?”

—“আগে সুস্থ হও তারপর। এখন এই হাত নিয়ে তুমি শাড়ি সামলাতে পারবে না।”

—“প্লিজ প্লিজ না করো না। আমি পারবো।

আবারো জেদ করতে শুরু করলো মুন। আরিফা রেজওয়ান আবারো মুনের জেদের কাছে হেরে গেলেন। তারপর রাজি হলেন মুন কে শাড়ি পরিয়ে দিতে। হঠাৎ মুন মন খারাপ করে বলল,

—“কিন্তু আমার তো কোনো শাড়ি’ই নেই। এখন কি করবো?”

মুনের কথা‌ শুনে আরিফা রেজওয়ান হাসলেন। তারপর নিজের কাবার্ড থেকে অনেক গুলো শাড়ি বের করে মুনের সামনে রাখলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শাড়ি গুলো অনেক দামি। আরিফা রেজওয়ান হেসে বললেন,

—“এগুলোর মধ্যে থেকে যেটা পছন্দ হয় সেটা’ই পরো।”

মুন খুশি হয়ে শাড়ি গুলো দেখতে লাগলো। বলতে হবে আরিফা রেজওয়ানের চয়েজ খুব ভালো। সব গুলো শাড়িই দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু হঠাৎ কালো রঙ্গের কারুকাজ করা একটা শাড়ি মুনের চোখে’র দৃষ্টি কারেন। শাড়িটা বেশি ভারি না। বলতে গেলে পাতলাই। দেখতে খুব সুন্দর। মুনের খুব পছন্দ হয়। আর আঁধারের ও কালো রং টা খুব পছন্দ। তাই মুন ঠিক করলো এটাই পরবে।

.

আরিফা রেজওয়ান খুব সুন্দর করে শাড়ি টা মুনকে পরিয়ে দিচ্ছে। মুন সচরাচর কালো পরে না। ওর মনে হয় কালো পরলে ওকে পেত্নির মতো লাগবে। কিন্তু তা সত্যি নয়। এই কালো শাড়িতে মুনকে বেশ ভালোই মানিয়েছে। আরিফা রেজওয়ান মুন কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো। তারপর ওর মুখে হালকা মেকআপ করে দিলো। ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক। হরিনী চোখে গাড় করে টানাটানা কাজল। কোমর অবধি ঘন কিচকিচে চুল গুলো এক সাইডে নিয়ে বেনী করে দিলেন। তারপর কাবার্ড থেকে খুবই সাধারণ কিছু অরনামেন্টস বের করে নিয়ে এলেন। মুনের গলায় পাতলা ব্লাক ডায়মন্ডের একটা নেকলেস পরিয়ে দিলেন। কানে ম্যাচিং ঝুমকা। এই হালকা পাতলা সাজেই মুন কে অসম্ভব সুন্দরী মনে হচ্ছে। আলিয়া একটা কাজে মায়ের রুমে এসে ছিল। মুনকে দেখে আলিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। আর মুন মুখ টিপে হাসছে। আরিফা রেজওয়ান আলিয়া কে ধমক মেরে বলে,

—“ও ভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? নজর লেগে যাবে তো।”

আরিফা রেজওয়ান কাজল নিয়ে মুনের কানের পিছনে নজর টিকা দিয়ে দিলেন। আলিয়া মুখ বন্ধ করে মুনের কাছে এসে মুগ্ধ হয়ে বলল,

—“ওয়াও মিষ্টি তোমাকে কি সুন্দর লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। একদম কালো জামের মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি।”

আলিয়ার কথায় মুন খিলখিল করে হেসে উঠে।

.

মুন না খেয়ে সারাদিন আঁধারের জন্য অপেক্ষা করে। ধীরে ধীরে অপেক্ষার প্রহর লম্বা হতে থাকে। এই অপেক্ষা রাত ১২ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু আঁধার আসে না। মুন বেডের সাথে হেলান দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতটা কোলের উপরে রেখে ঘুমিয়ে পরে। ১২:৩০ এ আঁধার বাসায় ফেরে। আরিফা রেজওয়ান ড্রইং এ’ই বসে ছিলেন। আঁধার বাড়িতে ঢুকতেই আরিফা রেজওয়ান কে সোফায় বসা দেখে। আঁধার মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—“তুমি এখনো ঘুমাওনি মম?”

—“তোমার জন্য’ই অপেক্ষা করছিলাম।”

—“কিছু বলবে?”

—“হ্যা।”

আঁধার মায়ের দিকে তাকায়। আরিফা রেজওয়ান কে দেখে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে। আরিফা রেজওয়ান শক্ত হয়ে বলল,

—“আগে আমার পুরো কথা শুনবে তার পরে রিয়েক্ট করবে।”

আরিফা রেজওয়ান সাহস করে বলল,

—“মুনের হাত পুড়ে গেছে।”

আঁধার কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না।এক প্রকার চিৎকার করেই বলল,

—“হোয়াট? কিভাবে?”

আরিফা রেজওয়ান শান্ত স্বরে বলল,

—“রান্না করতে গিয়ে।”

—“আমি বারবার বলেছিলাম না ওকে যেন কিচেনের আশে পাশেও কেউ যেতে না দেয়। তাহলে ও রান্না করতে গেল কিভাবে?”

—“জেদ করছিল প্রচুর তাই শেষে না পেরে রাজি হতে হয়।”

—“মম ও জেদ করলো আর তুমিও তা মেনে নিলে?”

আরিফা রেজওয়ান নিশ্চুপ। আঁধার জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো। রাগে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। আঁধার নিজেকে শান্ত করে তারপর বলল,

—“এখন কোথায় ও?”

—“রুমে। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে।”

আঁধার বড় বড় পা ফেলে রুমে গেল। তারপর দরজা টা খুলেই যা দেখলো তাতে ওর মাথায় রক্ত উঠে গেলো।
#Mr_Husband
#লেগিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১৩

ঘুমের ঘোরে মুনের পেটের উপর থেকে শাড়ি টা সরে গেছে। যার কারণে মুনের হলুদ ফর্সা পেট কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে আঁধারের মাথায় রক্ত উঠে যায়। এই কারণেই আঁধার মুন কে আগেই সাবধান করে দিয়ে ছিল যাতে মুন শাড়ি না পরে। কিন্তু আঁধারের কথার অবাধ্য হয়ে মুন আজ শাড়ি পরলোই। মুন নিজেকে গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। এ জন্য কেটে যাওয়া আঙ্গুলে চাপ লেগে তার থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আঁধার খেয়াল করলো মুন কিছুক্ষণ পর পর হঠাৎ করেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। আঁধারের চোখ যায় মুনের কোলের উপর রাখা ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে। আঁধার সোজা গিয়ে খুব রুড ভাবে মুনের হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলো। মুন ঘুমের মধ্যে নিজের হাতে ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারছে না। শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। আঁধার ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলে দিতেই মুনের হাতের এই অবস্থা দেখে যেন ওর মাথায় ওঠা রক্ত গুলো টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। আঁধার মুনের হাত ধরে এক টানে ঘুমন্ত মুন কে উঠিয়ে দাঁড় করায়। মুনের হাতে কালো রেশমী চুরি ছিলো। আঁধার মুনের হাত এতো শক্ত করে ধরেছে যে চুরি গুলো মটমট করে ভেঙ্গে ওর হাতে ঢুকে যায়। মুন আধো আধো চোখে আঁধারের দিকে তাকায়। মুনের কোনো খেয়াল’ই নেই যে ওর হাতে চুরি ভাঙ্গা কাঁচ ঢুকে গেছে। আঁধার কে দেখে মুন হেসে বলল,

—“Mr.Husband আপনি এসে গেছেন?”

আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—“হাউ ড্যার ইউ?”

মুন অবুঝ স্বর বলল,

—“মানে?”

আঁধার হুংকার দিয়ে বলল,

—“তোমার সাহস কি করে হয় আমি বারন করার পরও কিচেনে যাওয়ার।”

মুন আঁধারের হুংকার শুনে ভয়ে চোখ, কান বন্ধ করে নেয়। আঁধার মুনের বাহু শক্ত চেপে করে ধরে
আবারো বলল,

—“আমি বারবার করে বলেছিলেন যে শাড়ি পরবে না। তারপর ও তুমি আমার অবাধ্য হয়ে তাই করেছ। বলো কে দিয়েছে তোমাকে এতো সাহস?”

মুন ব্যথায় প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। মুন কাতর কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—“আমার খুব লাগছে। প্লিজ ছাড়ুন।”

আঁধার মুনের পোড়া হাত টা ওর সামনে ধরে। তারপর চেঁচিয়ে বলল,

—“পাকামি করে হাত পোড়ানোর সময় মনে হয় নি যে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে? তাহলে এখন কেন লাগছে? আর যেটা করার যোগ্যতা নেই সেটা করতে যাও কেন?”

শেষ কথাটা মুনের ইগোতে গিয়ে লাগে। মুন শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে আঁধার কে ধাক্কা দেয়। আঁধার কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। মুন চিৎকার করে বলল,

—“কজ আমি শুধু আপনাকে খুশি করতে চেয়ে ছিলাম। আজ আমাদের বিয়ের ছয় মাস পুর্ন হয়েছে তাই আমি রান্না না জানার স্বত্বেও শুধু আপনার জন্য নিজ হাতে আপনার পছন্দের কিছু রান্না করতে চেয়ে ছিলাম। আরে আমার হাত পুড়ে গেছে তাতেও আমার কোনো ভ্রুক্ষেব ছিল না। বিশ্বাস করুন ততটা কষ্ট হয়নি যতটা এখন আপনার কথা গুলো শুনে হচ্ছে।”

—“যাস্ট স্যাট আপ। কে বলেছিল আমাকে খুশি করার জন্য এসব করতে? আমি নিজে বলে ছিলাম তোমাকে?”

মুন ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

—“আপনার কাছে কারো ফিলিংসের কোনো মূল্য’ই নেই। সত্যি’ই আপনি একটা হার্ট লেস পার্সন। যার মন বলতে কিছু নেই।”

আঁধার টি টেবিলে সজোরে লাথি মেরে গর্জন করে বলল,

—“হ্যা হ্যা! আমি হার্ট লেস পার্সন। আমি অনুভূতি শূন্য মানব। যার হৃৎপিণ্ড তোমাদের মতো নরম তুলোর মত নয় বরং শক্ত পাথরের মতো। যে পাথর লোহা দিয়ে আঘাত করেও কেউ ভাঙ্গতে পারবে না। আমি তোমাদের মতো মানুষের তুচ্ছ অনুভুতি গুলোকে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন বোধ করি না।”

বলেই আঁধার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুন কাঁদতে কাঁদতে ওভাবেই নিচে বসে পরে আর বলে,

—“আপনি সত্যিই খুব খারাপ Mr.Husband”

মুন চিৎকার করে করে কাঁদছে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেনো হচ্ছে তা ওর অজানা। মুন না পেরে চুরি ভিঙ্গা কাঁচ উঠিয়ে বাম হাতে একেরপর এক টান দিতে লাগলো। সাথে সাথে ফিকনি দিয়ে ডালিমের মতো লাল রক্ত গড়িয়ে পরতে লাগলো। সাদা টাইলসের ফ্লোর রক্ত লাল হয়ে গেল। মুন ছোটবেলা থেকেই এরকম। যখন’ই ওর রাগ হয় অথবা কষ্ট হয় ও তখন’ই নিজেকে আঘাত করে রক্ত ঝরায়। এটা ধীরে ধীরে বদভ্যাসে পরিনত হয়। মুন জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু এই চিৎকার কেউই শুনতে পায় না। এই চার দেয়ালের মধ্যে’ই আবদ্ধ থেকে যায়। শুধু এই চার দেয়াল আর রুমের জিনিস পত্র গুলোই সাক্ষী থেকে রায় মুনের কষ্টের। সারাদিন না খাওয়ার কারণে এমনিতেই শরীর দুর্বল। আবার হাত পুড়ে যাওয়ায় জ্বর এসেছে। তার উপর এখন আবার হাত কাটার কারণে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। সবকিছুর ধাক্কল মুন নিতে না পেরে ও ভাবেই জ্ঞান হারায়। চোখের কোণিশে বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল পরছে।

.

রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যায়। আবার সকাল পেরিয়ে রাত। কিন্তু আঁধার কাল রাতের পর আর বাসায় ফেরেনি। এদিকে ১১:৫৬ বাজে মুন সারা দিনেও দরজা খুলেনি। আরমান রেজওয়ান, আরিফা রেজওয়ান, আলিয়া, চুমকি সবাই খুব চিন্তিত। সকাল থেকে রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু মুন খুলছে না। দরজা ভাঙ্গতেও পারছে না। আর রুমের ডুবলিকেট চাবি ও আঁধারের কাছে থাকে। কি করবে কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। সকাল থেকে আঁধার কে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু ফোন সুইচ অফ। টেনশনে আরিফা রেজওয়ানের বিপি হাই হয়ে গেছে। তাই আরমান রেজওয়ান তাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আলিয়া জোর করে আরিফা রেজওয়ান কে রুমে নিয়ে গিয়ে রুয় পালিয়েছে। আরমান রেজওয়ান সিঙ্গেল সোফায় দু ভ্রুর মাঝে আঙ্গুল চেপে বসে আছে। আর আলিয়া বড় সোফায় বসে এখনো আঁধার কে ফোনে ট্রাই করছে। ঠিক ১২ টার সময় রেজওয়ান মেনশনে পা রাখে আঁধার। আরমান রেজওয়ান আঁধার কে দেখেই উঠে দাঁড়ালো তারপর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,

—“কাল রাত থেকে আজ রাত অবধি কোথায় ছিলে আর কি করছিলে?”

আঁধার দরজার কাছে দাঁড়িয়েই আরমান রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,

—“একটা কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিল।”

—“তাহলে ফোন কেন বন্ধ ছিল তোমার?”

—“ওখানে নেটওয়ার্ক ছিল না।”

—“এখন তাহলে কেন বন্ধ বলছে?”

—“আসার সময় ফোন চুরি হয়ে গেছে।”

—“নিজের স্ত্রীর খোঁজ খবর রাখার কোনো প্রয়োজন মনে করো?”

আঁধার ভ্রু কুঁচকে আলিয়ার দিকে তাকায়। আলিয়া বলল,

—“মিষ্টি কাল রাতে তুমি যাওয়ার পর থেকেই হয়তো এখন পর্যন্ত দরজা খুলে নি। অনেক ডেকেছি দরজা ধাক্কিয়েছি কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি।”

আঁধার আলিয়ার পুরো কথা শুনলো ও না। মুন কাল রাত থেকে দরজা খুলে নি শুনেই আঁধার ঝড়ের গতিতে রুমের দিকে গেল। তারপর দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ধমকের সুরে বলল,

—“মুন এক্ষুনি দরজা খুলো বলছি। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। মুন! আমি কিন্তু দরজা ভেঙ্গে দিবো। আর আমি যদি দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকি তাহলে তো জানোই সেটা খুব বেশী ভালো হবে না তোমার জন্য।”

ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স পাওয়া গেল না। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন ভয়েরা আঁধার কে জেঁকে ধরলো। ভয় বলতে কোনো শব্দ আঁধারের Dictionary তে ছিল না। ভয়েরা আঁধার কে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে’ই কাবু করতে পারেনি।
তাহলে আজ কি হলো। আঁধারের বুকের বাম পাশে থাকা হৃৎপিণ্ড টা কেন জানি জোরে জোরে লাফাচ্ছে। আঁধারের মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে ‘মুনের কিছু হয়নি তো?’ আঁধার জানে মুন খুব বেশী ইমোশনাল। ছোটখাটো বিষয়েও ইমোশনাল হয়ে পরে। ওর সাথে একটু জোর গলায় কথা বললেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দেয়। সেখানে তো কাল রাতে আঁধার ওর সাথে অনেক বেশি বাজে ব্যবহার করেছে। আঁধার আর কিছু ভাবতে পারছে না। যত ভাবছে ততোই যেন ভয়ে রা ওকে জেঁকে ধরছে। এর’ই মধ্যে আরমান রেজওয়ান আর আলিয়া ও এসে পরে। আঁধার কিছু না ভেবেই দরজায় সজোরে এক লাথি মারে সাথে সাথেই দরজার লক ভেঙ্গে দরজা খুলে যায়। আর নিচে পরে থাকা মুন কে দেখে সবাই আঁতকে উঠে।
ফ্লোরে রক্ত শুকিয়ে আছে। মুন নিচে পরে আছে। হাতে রক্ত জমাট বাঁধা। আঁধার খুব প্রিয় কিছু হারানোর ভয় অনুভব করছে নিজের মধ্যে। আঁধার ছুটে গিয়ে মুনের মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে নেয়। গালে হালকা চড় মুন কে ডাকতে লাগলো,

—“মুন! মুন! মুন কি হয়েছে তোমার? কথা বলো প্লিজ। অ্যাম সরি। আমি আর কখনো তোমার সাথে মিস বিহেভ করবো না। রুড হয়ে কথা বলবো না। ধমকাবো না। আর কখনো পানিসমেন্ট ও দিবো‌। এন্ড আমি তোমার বন্ধু হতেও রাজি। শুধু বন্ধ না খুব ভালো বন্ধু। তাও প্লিজ কথা বলো তোতাপাখি।”

—“ভাই! ভাই মিষ্টির কিছু হবে না। আগে ওকে বেডে শোয়াও। ওর অনেক বেশী ব্লিডিং হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফাস্টেড করতে হবে। নাহলে ইনফেকশন হতে পারে।”

আঁধার তাড়াতাড়ি মুন কে কোলে তুলে নিলো। তারপর ওকে বেডে শুইয়ে দিলো। আলিয়া তাড়াতাড়ি গিয়ে গরম পানি আর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। আঁধার মুনের পালস রেট চেক করলো অনেক লোক। দুদিন ধরে কিছু খায় নি তার উপর আবার শরীর থেকে এতো ব্লাড বের হয়ে গেছে। এতো ধাক্কল নিতে পারছে না মুনের শরীর। আঁধার প্রথমে গরম পানি দিয়ে ভালো করে মুনের হাত টা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর ব্যান্ডেজ করে দিলো। পুড়ে যাওয়া হাতটাও ড্রেসিং করে দিলো। মুনের অনেক জ্বর উঠেছে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আলিয়া বলল,

—“ভাই আমি মিষ্টি’র শরীর মুছে দেই তাহলে যদি ওর জ্বর কিছুটা কমে।”

আঁধার বের হতেই দেখে আরিফা রেজওয়ান ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসছে। আরিফা রেজওয়ান আঁধার কে কিছু না বলেই রুমে চলে যায়। আর দরজা লাগিয়ে দেয়। আরমান রেজওয়ান অনেক আগেই চলে গেছেন নিচে। সে খুব চিন্তিত কবির খান যদি এসব শোনে তো কেলেংকারি হয়ে যাবে। মেয়েকে নিয়ে সেই খুব বেশি সিরিয়াস। মেয়ের গায়ে ফুলের টোকাও সে সহ্য করে পারে না। আঁধার নিচে গিয়ে চুমকিকে ভেজিটেবল স্যুপ, দুধ আর ডিমের মিল্ক শেক বানিয়ে উপরে নিয়ে যেতে বলল। আরিফা রেজওয়ান মুনের মাথা। জ্বল পট্টি দিচ্ছে আর আঁধার মুন কে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। আলিয়া কে আঁধার পঠিয়ে দিয়েছে রেস্ট নিতে। আরিফা রেজওয়ান কে ও বলেছিল কিন্তু তার এক কথা মুনের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সে কোথাও যাবে না। আঁধার মুনকে স্যুপ আর মিল্ক শেক খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। আরিফা রেজওয়ান জ্বল পট্টি দিতে দিতে বেডের পাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আঁধারের চোখে ঘুম আসে না আঁধার জ্বল পট্টি দিতে থাকে। আর এক দৃষ্টিতে মুনের শুকনো মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থকতেই কখন যে রাত পার হয়ে যায় আঁধার তা জানেই না।

চলবে,

[ছোট হওয়ার কারণে আমি দুঃখিত। আর কিছু পর্বের পর’ই ভিলেনের এন্ট্রি। তা আপনারা ভিলেন বেডা চান নাকি বেডি? কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন।]
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here