Mr_Husband পর্ব ১৪+১৫

#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১৪

মুনের অবস্থা খুব করুন। এখনো জ্ঞান‌ ফেরেনি। জ্বর ও একটুও কমেনি বরং আরো বেড়েছে। তাই ইমিডিয়েটলি ওকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। মুনের শরীরে রক্তের শূন্যতা তার উপর হাত কাটার কারণে প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হয়েছে। তাই এখনি ইমিডিয়েটলি ওকে রক্ত দিতে হবে। না হলে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেতে। হসপিটালে শুরু এক ব্যাগ রক্ত আছে আরো দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আঁধার আর আরমান রেজওয়ান রক্ত নিতে বাইরে গেছে। আলিয়া সিটে বসে কান্নাকাটি করছে। আরিফা রেজওয়ান নামাজ পড়ে মুনের জন্য দোয়া করছেন। কবির খান এখনো কিছু জানেন না। তাকে কিছু জানানো হয় নি।

.

তিন দিন পর মুনের সেন্স ফিরে। সেদিন’ই হসপিটালের সব ফরমালেটি পূরণ শেষ করে মুন কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেদিন থেকেই সবাই আরো বেশি মুনের খেয়াল রাখতে শুরু করে। আলিয়া মুনের অজ্ঞান অবস্থায় আঁধার যা যা বলেছিল সব বলে মুন কে। মুনের নিজের কান কে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়। আঁধারের পাথরের মনে মুনের জন্য একটা অদৃশ্য অনুভূতি জন্ম নেয়। সেই অনুভুতির মানে আঁধারের জানা নেই। এভাবে দিন যেতে লাগলো। মুন এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু দিন দিন মুন আঁধার কে ইগনোর করতে শুরু করে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে আঁধারের সাথে কথা বলে না। ওর থেকে দূরে দূরে থাকে। আঁধার যেদিন বাসায় থাকে সেদিন মুন আলিয়া অথবা আরিফা রেজওয়ানের রুমে গিয়ে গল্প করে সময় কাটায়। আর রাতে আঁধারের আগে খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে চুপটি মেরে শুয়ে থাকে। ইদানিং আঁধার বুকের বাম পাশে হঠাৎ করেই চিনচিন ব্যথা শুরু হয় কেমন যেন খালি খালি অনুভব হয়। আবার মুন কে দেখলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। আঁধারের কাছে এখন মুনের সব কিছুই ভালো লাগে। কিন্তু মুনের এই ইগনোরেন্স আঁধার আর সহ্য করতে পারছে না।আঁধার মুন কে একদিন একা পায় সেদিন ওর হাত পা বেঁধে বেডের উপর বসায় আর নিজেও ওর পাশে বসে। মুন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। যা দেখে আঁধার বাকা হেসে বলল,

—“ছোটাছুটি করে কোনো লাভ নেই। আমি না চাইলে তুমি আমার বাঁধন থেকে কখনোই ছাড়া পাবে না। কারণ তুমি আমার বন্দিনী।”

মুন কটমট করে তাকায়। মুনের তাকানো দেখে আঁধার নিঃশব্দে হাসে। তারপর হঠাৎ করেই চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলল,

—“কি হয়েছে তোমার? আমাকে ইগনোর করছো কেন?”

আধার মুনের মুখে তখন টেপ লাগিয়ে দিয়েছিল। তাই মুন রেগে মনে মনে বলল,

—“মুখে টেপ মেরে দিয়ে প্রশ্ন করলে উওর কি আমি তোর মুখ দিয়ে দিবো শালা খবিশের বাচ্চা খবিশ?”

—“না না আমার মুখ দিয়ে দিবে কেন? নিজের মুখ দিয়েই দিবে। দাঁড়াও আমি টেপ টা খুলে দিচ্ছে।”

মুন আবারো মনে মনে ত্যাড়া উওর’ই দিলো,

—“বসে আছি ভালো লাগছে না যে আবার দাঁড়াতে বলছিস?”

আঁধার মুনের মুখ থেকে টেপ টা খুলে বলল,

—“নেও মুখ খুলে দিয়েছি এবার বলো কি সমস্যা?”

—“আমার কোনো সমস্যা নেই আপনার থাকলেও থাকতে পারে।”

আঁধার চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“মানে?

—“কিছু না। আমার বাঁধন খুলে দেন আমার কাজ আছে।”

—“খুলবো। তার আগে বলো আমাকে ইগনোর করার কারণ কি?”

—“আপনার কেন মনে হচ্ছে যে আমি আপনাকে ইগনোর করছি?”

—“তুমি ইগনোর করছো তাই আমার মনে হচ্ছে। তুমি আমার সাথে প্রয়োজনের বাইরে খুব বেশি কথা বলো না। আমার থেকে সবসময় দূরে দূরে থাক। এগুলো কে কি বলে?”

মুন এবার চেঁচিয়ে বলল,

—“হ্যা হ্যা আমি আপনাকে ইগনোর করছি। কারণ আমি আপনার যোগ্য না। আমার কোনো যোগ্যতা নেই আপনার পাশে দাঁড়ানোর। সেটা আপনি আমাকে সেদিনই বুঝিয়ে দিয়ে ছিলেন।”

আঁধার ও এবার রেগে গেল। আঁধার সেদিন ওকে অযোগ্য বলে নি। শুধু এটুকু বুঝাতে চেয়েছে যে ও যেটা পারে না সেটা না করাটাই ভালো। আঁধার মুনের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—“সবসময় তিন লাইন বেশী বোঝাটা কি তোমার জন্ম গত রোগ? অন্যরা তাও দু লাইন বেশী বুঝে আর তুমি………স্টুপিড একটা।”

মুন চেতে বলল,

—“আপনি স্টুপিড।”

—“দিন দিন সাহস কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে তোমার।”

—“একদম ভয় দেখাবেন না বলে দিচ্ছি। আমি আপনাকে মোটেও ভয় পাই না।”

আঁধার চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“আচ্ছা?”

—“সেদিন আমি যখন অজ্ঞান ছিলাম তখন কি বলে ছিলেন সেগুলো মনে নেই?”

—“কি বলেছিলাম?”

আঁধার ভাবার এ্যাকটিং করে বলল। মুন মনে করিয়ে দিয়ে বলল,

—“নো ধমক, নো রুড বিহেভ, নো পানিসমেন্ট।”

আঁধার ভুলে যাওয়ার ভান করে বলল,

—“সত্যি এরকম কিছু বলে ছিলাম? আমার তো কিছু মনে পরছে না।”

—“কিইইইই?”

মুন তেড়ে গেল আঁধারের দিকে। কিন্তু হাত পা বাঁধা থাকায় কিছুই করতে পারলো না। আঁধার হাসতে লাগলো। আর আঁধার কে হাসতে দেখে মুন ও হেসে দিলো। আবার দু’জনের খুনসুটি শুরু হয়ে গেল। এই ঘটনাটিই হয়তো ওদের ভালোবাসার প্রথম ধাপ ছিল। আঁধারের মনে মুনের জন্য প্রথম কোনো অজানা অনুভুতির শুরু।

.

মুন নির্জন অন্ধকার রাস্তায় প্রাণপণ চেষ্টা করে দৌড়াচ্ছে। আজ যদি ওই নরপিশাচদের হাতে পরে তাহলে হয়তো কাল সকল পত্রিকার হেডলাইন ও হবে। সবাই ওকে ধর্ষিতা বলেই জানবে। আর এই ধর্ষিতার উপাধি নিয়ে অন্তত মুন বাঁচতে পারবে না। তাই আজ ওকে দৌড়াতে হবে। মুন মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে। সে যেন কোনো দেবদূত পাঠিয়ে দেয় ওকে বাঁচাতে। মুনের মন শুধু একজন মানুষকেই এখন এই সময় সাহায্যের জন্য চাইছে আর সে হলো আঁধার। মুন দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় কিছুর সাথে বেজে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। মুন মাথা তুলে দেখে একটা মাক্স পরা লোক চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মুখুশধারী লোক। আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরো দশবারো জনের মতো। মুনের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ঘামে ভেজা মুখের সাথে লেপ্টে আছে। চোখে মুখে ভয়। ভয়টা নিজের আত্ম সম্মান হারানোর। মুন করুন দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো। মুনের সাদা রঙের কুর্তির হাতা ছেড়া। হাতে আঁচড়ের দাগ রক্ত বেয়ে বেয়ে পরছে। মুনের বুকে ওড়না নেই যার কারণে ওর শরীরের ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বসে থাকা লোকটি ইশারা করতেই সবাই নিজের চোখ নিচে নামিয়ে নিলো শুধু একজোড়া জ্বলন্ত আগুনের গোলার মতো চোখের অধিকারী ছাড়া। AR এক দৃষ্টিতে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। এর’ই মধ্যে ওই নরপিশাচ গুলো মুন কে ধাওয়া করতে করতে ওখানে পৌঁছে যায়। তাদের একজনের হাতে মুনের পরনের সাদা রঙের কুর্তির ওড়না। লোকটা বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে মুনের ওড়না টা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান শুকে মুনের দিকে তাকায়। ওই নরপিশাচ গুলো তখনো AR কে খেয়াল করে নি। নাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ও ওরা পেত না। মুনের চোখে জল টলমল করছে। ও AR এর দিকে কুরুণ চোখে তাকায়। ওর চোখ যেন বলছে ‘আমাকে প্লিজ এই নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচান। নাহলে এরা আমাকে খুবলে খুবলে খাবে।’ হঠাৎ করেই AR চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওই নরপিশাচ গুলো’র মধ্যে একজন কিছু বলতে যাবে তার আগেই AR ওদের ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। AR মারতে মারতে সব গুলো কে আধ মরা বানিয়ে ফেলেছে। সবাই শুধু পাথরের মূর্তির মত দেখছে। তার হাতে মুনের ওড়না ছিল AR ওই ছেলেটার গলা চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বলল,

—“আমার জিনিসে হাত দেয়ার তোরা সাহস পেলি কোত্থেকে? জানিস এর শাস্তি কি? এর একটাই শাস্তি আর সেটা হলো মৃত্যু।”

বলেই AR নিজের ব্যাক পকেট থেকে গান টা বের করে একেরপর এক গুলি চালাতে লাগলো ছেলেটার বুকে। গুলির শব্দ মুন ভয় পেয়ে যায়। নিজের কানে হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। AR সবগুলো নরপিশাচ কে মৃত্যু পুরিতে পঠিয়ে দেয়। AR মুনের সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে। তারপর ওর গায়ে ভালো করে ওড়নাটা পেঁচিয়ে দেয় আর নরম সুরে বলে,

—“ভয় পেয়ো না মনপাখি আমি আছি তো।”

মুন তখনো চোখ খোলে নি কিন্তু AR এর মিষ্টি কন্ঠে এমন কথা শুনে মুন সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। মুনের কন্ঠ স্বর টা খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয় আগেও শুনেছে। AR চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আঁধার গাড়ি নিয়ে আসে। আঁধার গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে আসে মুনের কাছে। মুনের এরকম অবস্থা দেখে ওকে বুকের বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আঁধার মুনের কাছে গিয়ে ওকে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুন ও আঁধার কে জরিয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এভাবেই কিছুক্ষণ কেটে যায় আঁধার মুনের গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

—“তুমি ঠিক আছো তো তোতাপাখি?”

মুন কাঁদতে থাকে কোনো জবাব দেয় না। আঁধার আবারো বলল,

—“হুঁশ! একদম কান্না করবে না। আমি এসে গেছি। এখন আর কিছু হবে না।”

আধার মুন কে ধরে গাড়িতে বসায়। মুন তখনো কাঁদছিল। বাড়িতে গিয়ে এ বিষয়ে কেউই কিছু বলে না। রাতে আঁধার সোফায় ঘুমাচ্ছে হঠাৎ করেই মুনের কান্নার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আঁধার ধরফরিয়ে উঠে মুনের কাছে যায়। মুন আজ কের ঘটনাটাই হয়তো স্বপ্নে দেখছে। ওর মনে গেঁথে গেছে ঘটনা। আঁধার মুন কে শান্ত করার জন্য ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে। মুন আস্তে আস্তে আবারো আঁধারের বুকে ঘুমিয়ে যায়। আঁধারের নিজের প্রতি’ই রাগ লাগছে। কেন ও মুন কে একা ছেড়ে ছিল। কেন সাথে যায় নি। আঁধার ঘুমন্ত মুন কে প্রমিস করে আর কখনো ওকে একা ছাড়বে না। সারাজীবন ওকে এভাবেই নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখবে।

.

সেদিনের পর থেকে আঁধার আর কখনো মুন কে একা কোথাও ছাড়ে নি। মুন ও আর দ্বিতীয় বার সাহস করেনি একা কোথাও যাওয়ার। আঁধারের মনে মুন কে হারানোর ভয় যেন আঁকড়ে ধরে ছিল। তাও একবার না দু’বার। সব’ই ঠিক চলছিল। দু’জনের মধ্যে একটা অদৃশ্য টান, একটা অদৃশ্য অনুভূতি জন্ম নিয়ে ছিল। একজনের জন্য আরেকজনের মনে মায়া জন্মে ছিল। কিন্তু ওদের দুজনের কাছে আসাটা হয়তো কারো সহ্য হলো না। শুক্রবার দিন আঁধার আর মুন ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। মুন খুব খুশি ছিল। ওরা শপিং করে লাঞ্চ করতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। আঁধার মুনের পছন্দের সব কিছু অর্ডার করছিল। মুন আর আঁধার খাওয়া শুরু করে। হঠাৎ আঁধারের ফোনেকল আসে। আঁধার হাসি খুশি ভাবেই কল অ্যাট্যান্ড করতে ওয়াশ রুমে চলে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। এসেই ভারী গলায় বলল,

—“মুন আমার একটা কাজ আছে। তোমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমাকে যেতে হবে।”

মুন অবাক হয়ে আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছু না বলেই চুপচাপ উঠে গাড়িতে গিয়ে বসে। আঁধার মুন কে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ওকে কিছু না বলেই চলে যায়। মুনের কিছুটা খারাপ লাগে। মুন মন খারাপ করে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। আরমান রেজওয়ান, আরিফা রেজওয়ান, আলিয়া, মুন সবাই ড্রইং এ বসে গল্প করছিল। আসিক, আপন, অয়ন, আর ইশী মানে আঁধারের বন্ধুরাও এসেছে। আলিয়া আপনের দিকে তাকিয়ে আছে। আপন ও কিছুক্ষণ পর পর ঘুরে ফিরে আলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। মুন বুঝতে পারে ওদের মধ্যে কোনো খিচুড়ি পাকছে। মুন আলিয়কে হালকা ধাক্কা মেরে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

—“ও হো তলে তলে টেম্পু চালানো হচ্ছে বুঝি? চালিয়ে যাও আমি তোমার সঙ্গে আছি। এমনিতেও ছেলেটা দেখতে খারাপ না। আবার পুলিশ অফিসার। খুব মানাবে।”

আলিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুন খিলখিল করে হাসছে। কিন্তু এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মেইন ডোর খোলা ছিল। আঁধার পাঁজা কোলে করে একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। আঁধারের কোলে অন্য একটা মেয়েকে দেখে মুনের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুনের চোখে মুক্তোর মতো অশ্রু গুলো চিকচিক করছে।
#Mr_Husband
#লেখিকা: আবনী ইবনাত মুন
#পর্ব_১৫

আপন, আসিক, অয়ন, ইসী সবাই মেয়েটাকে দেখে চমকের এক নতুন রেকর্ড পার করেছে। ওদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। ইসী অস্পস্ট কন্ঠে বলল,

—“রুশা!”

আঁধার রুশা কে কোলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে। মুনের বুকের মধ্যে হঠাৎ করেই চিনচিন ব্যথা শুরু হয়েছে। কেন যেন অন্য একটা মেয়েকে আঁধারের এতো কাছে মুন সহ্য করতে পারছে না। মুনের কান্না আসছে। মুন সেই কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। যার ফলে নাকের ডগা ও গালের দুপাশ লাল হয়ে গেছে। চোখে জল টলমল করছে। মুনের খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন তা মুনের অজানা। আঁধার কাউকে কিছু না বলেই সোজা গেস্ট রুমে চলে যায়। আঁধারের পিছনে পিছনে সবাই যায়। আঁধার রুশা কে বেডে শুইয়ে দেয়। তারপর আলিয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“লিয়া জলদি গিয়ে আমার রুম থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আয়।”

আলিয়া আঁধারের অর্ডার পাওয়া মাত্রই দৌড়ে গিয়ে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আঁধারের হাতে দিলো। আঁধার কোমল রুশা’র মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। রুশা’র কপাল কেটে গেছে, হাতের কুনুই ও ছুঁলে গেছে। আর তার থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত পরছে। আঁধার যত্ন সহকারে রুশা’র কপাল ও কুনুই পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। বাইরের অন্য একটা মেয়ের প্রতি আঁধারের এতো কেয়ার দেখে মুনের ভিতরে জ্বলছে। কিন্তু এখন কিছু বলতেও পারছে না। কারণ এখানে বড়রা ও আঁধার বন্ধুরাও আছে। তাদের সামনে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। আঁধার এক দৃষ্টিতে রুলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মুন শুধু জল টলমলে চোখে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। আঁধার শান্ত স্বরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—“সবাই যার যার রুমে চলে যাও আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”

—“কিন্তু আঁধার রু……….”

অয়ন কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আঁধার ওকে থামিয়ে বললো,

—“অয়ন তোরাও নিজেদের বাড়িতে চলে যা। আমি তোদের সাথে কাল মিট করে সব বলব।”

ওরা আর কিছু বলল না। আরমান রেজওয়ান কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আরিফা রেজওয়ান বলতে দিলেন না। সে বুঝতে পারেন তার ছেলে এখন কিছু বলার পরিস্থিতিতে নেই। আর তার ধারণা ভুল না হলে এ’ই সেই মেয়ে। যার জন্য তার ছেলে একসময় পাগল ছিলো। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মুন এক নজর আঁধারের দিকে তাকিয়ে সবার সাথে বেরিয়ে যেতে নেয়। কারণ আঁধার সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। মুন ও চুপচাপ বেরিয়ে যেতে নেয় কিন্তু আঁধারের কথা শুনে ওখানেই দাঁড়িয়ে পরে,

—“মুন, তোমাকে যেতে বলিনি।”

আঁধার আবারো বলল,

—“দরজা টা লক করে এদিকে এসো।”

মুন চুপচাপ আঁধার কথা মতো দরজা লক করে আঁধারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঁধার মুনের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। মুন নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের জল গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফ্লোরে। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই এই নোনা জল গুলো ধীরে ধীরে ওর চোখে সমুদ্র তৈরি করছে। যখন সেই জলে চোখ নামক সমুদ্র ভোরে যাচ্ছে তখনই কিছু ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পরছে। আঁধার কন্ঠ স্বর নরম করে জিজ্ঞেস করল,

—“কাঁদছো কেন?”

মুন নিশ্চুপ। আঁধার মলিন হাসি দিয়ে বলল,

—“তুমি ভয় পাচ্ছ মুন।”

এবার মুন মাথা তুলে আঁধারের দিকে তাকালো। চোখের কালো মনির পাশের সাদা অংশ লাল হয়ে গেছে। চোখের পাতলা পাপড়ি গুলোয় শিশিরের মতো জল জমে আছে। আঁধারের মনে হচ্ছে মুনের ওই হরিণী চোখে এক অতল সমুদ্র বিরাজ করছে। যার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তাতে ডুবেই ওর মৃত্যু হবে। আঁধার নিজেকে সংযত করলো। তারপর মুন কে নিজের জায়গায় বসিয়ে নিজে মুনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর দু হাত শক্ত করে ধরে বলল,

—“ভয়ের কিছু নেই মুন। আমি আমার অতীত কে কখনো আমার বর্তমানের উপর প্রভাব ফেলতে দিবো না। ও শুধুই আমার অতীত এর থেকে বেশী কিছু না।”

মুন আঁধারের কথা বুঝলো না। তাই অবুঝ স্বরে বলল,

—“উনি আপনার অতীত মানে?”

আঁধার বেড টেবিল থেকে পানির গ্লাল নিয়ে এক টানে খেয়ে ফেলল। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের অতীতে ডুব দিলো।

আঁধারের যখন ১০ বছর বয়স তখন আরিফা রেজওয়ান ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওকে USA পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য। আঁধার ছোট থেকেই অনেক মেধাবী। USA তে থেকেই আঁধার পড়াশোনা করতে লাগলো। আঁধার ছোট থেকেই মানুষের সাথে কম মিশত। সবসময় একা থাকতেই পছন্দ করতো। কিন্তু ওখানে গিয়ে ওর বন্ধুত্ব হয় আপন,আসিক, অয়ন, ইসী আর আরুশের সাথে। ওরা সবাই বাঙালি। আঁধার সবার থেকে বলতে গেলে নিজের থেকেও আরুশ কে বেশি ভালোবাসতো। মেধাবী হওয়ার কারণে ওখানেও আঁধার কে কেউ টক্কর দিতে পারেনি শুধু এক মাত্র আরুশ ছাড়া। আঁধার এ কারণে কখনোই আরুশ কে হিংসে করেনি। সবাই আঁধার কে বেস্ট বললেও আঁধার সবসময় আরুশ কে’ই বেস্ট বলে মানত। আরুশ দেখতে উজ্জ্বল স্যামলা। পাখির বাসার মত দেখতে মাথায় একঝাঁক কোঁকড়া চুল। লম্বায় আঁধারের মতোই। শরীর স্বাস্থ্য মিডিয়াম। রেগুলার জিমে যাতায়াত করার ফলে সিক্স প্যাক ও আছে। গায়ের রং টা আঁধারের থেকে চাপা নাহলে আরুশ কে দেখতে আঁধারের থেকে কোনো দিক দিয়েই কম না। আঁধার আর অরুনের বন্ধুত্বের স্লোগান পুরা USA গাইত। আঁধার যখন ইন্টারনেট ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম শেষ করে অবসরে সময় কাটাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ করে খবর পায় আরিফা রেজওয়ানের শরীর খুব খারাপ। তাই আঁধার সেদিনের ফ্লাইটে বিডিতে ব্যাক করে। আর আঁধার সাথে ওর পাঁচ বন্ধু ও ফেরে। আরিফা রেজওয়ান দু সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু আঁধার আর USA ফিরে যায় না। এখানেই ঢাকায় নামিদামি একটা কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এডমিশন নেয়। আঁধার বিডিতে থাকবে ঠিক করায় ওরা পাঁচজন ও আঁধারের সাথে সেম কলেজে এডমিশন নেয়। ওদের দিন ভালোই চলছিল। এখানেও আঁধার আর আরুশ নিজেদের গভীর বন্ধুত্বের রং ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। কিছুদিনের মধ্যেই ওরা হয়ে ওঠে কলেজের সব মেয়েদের ক্রাশ। একদিন ওরা সবাই কলেজ ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আঁধার আর আরুশ কে বাকিরা চেপে ধরে গান গাওয়ার জন্য। ওরা দুজনেই খুব ভালো গান করে। কিন্তু এখন কেউই গাইতে রাজি নয়। আঁধার ভারী গলায় বলল,

—“আমি এখন গানটান গাইতে পারবো না।”

আরুশ হাসার চেষ্টা করে বলল,

—“হে হে আমার যা কাকের গলা, এ গলায় গান গাইলে পাবলিক আমাকে ধরে ক্যালাবে।”

ইসী রেগে বলল,

—“একদম বাজে বকবি না। চুপচাপ যা বলছি তা কর। নাহলে তোকে পাবলিক কি ক্যালাবেরে তুই এখন গান না গাইলে তার থেকে দিগুন বেশি আমি ক্যালাব।”

আরুশ দাঁত বের করে হেসে বাহানা বানিয়ে বলল,

—“গান নাহয় গাইলাম কিন্তু গিটার কোথায়? তোরা তো জানিস আমি গিটার ছাড়া গাইতে পারি না।”

ইসী বরাবরই খুব চঞ্চল। ও দৌড়ে গিয়ে একটা জুনিয়র ছেলের কাছ থেকে গিটার ছিনিয়ে এনে আরুশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেকি হেসে বলল,

—“নে, এবার গাইতে তো কোনো সমস্যা নেই তোদের।”

আরুশ আড়চোখে আঁধারের দিকে তাকালো আর দেখলো আঁধার ও ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। আপন তাড়া দিয়ে বলল,

—“ভাই বসে বসে টাইম ওয়েস্ট করছিস কেন? তাড়াতাড়ি শুরু কর। জানিস না শুভ কাজে দেরি করতে নেই?”

আরুশ হতাশ গলায় আঁধার কে উদ্দেশ্য করে বলল,

—“কি আর করার? শুরু কর ভাই। এরা না হলে আমাদের রেহাই দিবে না।”

আঁধার আসিক কে বলল,

—“ক্লাস থেকে আমার গিটার টা নিয়ে আয় তো।”

আসিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

—“তুই গিটার নিয়ে এলি কখন? আমি তো তোকে গিটার আনতে দেখিনি!”

আরুশ মজা করে বলল,

—“সারাক্ষণ মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে দেখবি কি করে?”

আসিক ক্ষেপে বলল,

—“একদম বাজে বকবি না। আমি আবার কখন মেয়েদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম?”

—“তুই তো সবসময়’ই মেয়ে দেখলেই ছুটতে থাকিস।”

আসিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই আঁধার ধমক মেরে দু’টো কে চুপ করালো তারপর আসিক কে বলল,

—“তোকে না বলেছিলাম গিটার আনতে? আর তুই এখানে বসে বসে মেয়েদের মতো ঝগড়া করছিস। যা গিয়ে গিটার নিয়ে আয়।”

আসিক ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল গিটার আনতে। অয়ন বলল,

—“আজ একটা বাংলা গান হয়ে যাক।

আঁধার আর আরুশ গিটারে সুর তুলছে। চল না সুজন গানের সুর। তারপর দুজনে গাইতে শুরু করল,

🎶 Music 🎶
🎶মন আকাশে বৃষ্টি আসে রোদ্রো মেঘের জুটি
আজ নতুন আলোয় আঁধার কালোর খুনসুটি🎶

🎶হুম,ঝড়ের বেশে এলো কে’সে
কাজল সে চোখ দুটি
দিলো কঠিন কথার বিষন্নতার ছুটি🎶

🎶তার’ই সাথে খেলনা পাতে অযথা হাসাহাসি
হাজার বারণ আরো কারণ তবু সে দাঁড়ে আসি🎶

🎶চল না সুজন মিলে দুজন
নীল ওই আকাশে ভাসি,
দেখুক লোকে অবাক চোখে
তোর ওই দুচোখের হাসি🎶

🎶চল না সুজন হারাই দুজন
বিনা দোষে হোক ফাসি,
দেখুক লোকে অবাক চোখে
কত টা ভালোবাসি🎶

🎶 চোরাবালির পিছুটানেবুঝি না এই ভাষার মানে
অশান্ত মন কি অচেতন খোদা জানে 🎶

মেয়েলী গানের স্বর শুনে আঁধার চোখ খুলে তাকালো। হলুদ রঙের একটা শট ড্রেস আর গলায় কালো রঙ্গের স্কার্ফ পেচানো একটা ধবধবে ফর্সা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাইলাইট চুলগুলো কার্ল করা। গোলগাল চোখে টানাটানা করে আইলাইনার দেওয়া। পাতলা ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। ফর্সা লোম বিহীন হাতে কালো পাথরের ব্রেসলেট। হলুদ হাইহিল। মেয়েটার ড্রেস আপ অনেকটা মর্ডান। কিন্তু মেয়েটা অনেক রুপবতী। আঁধার একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা গানের পরের লাইন গাইলো,

🎶 ঘরের কাজে সকাল সাজে
নয়ন-নীতির ভাঁজে ভাঁজে
কিসে ছায়া এ কোন মায়া বুঝি না যে🎶

মেয়েটা ইশারায় আঁধার কে পরের লাইন গাইতে বলল। আঁধার আনমেই গাইতে শুরু করলো। আর আরুশ ওখানেই থেমে গেল।

🎶ধীরে ধীরে চেনা ভীরে অচেনা বারাবারি
অবুঝ এ মন কি জ্বালাতন এ কেমন আহাজারি🎶

🎶চল না সুজন মিলে দুজন
আরেকটু কবুল করি,
দেখুক লোকে এ দুচোখে
ছায়া যে শুধু তোরই🎶

🎶চল না সুজন মিলে দুজন
অচেনা শহর গড়ি,
সেই শহর আপন করে
বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে ঝরি🎶

মেয়েটা আবার নিজের লাইন গাইলো,

🎶বাদাম খোসায় ভালোবাসায়
নিওন আলোয় কাছে আসায়
স্মৃতির খাতা চোখের পাতায়
কিসের ফাকি 🎶

🎶আপন কথার গোপন ব্যথায়
বন্দি খাঁচার বিষন্নতায়
কিসের জ্বালায় বিশের মালায় বোঝো না কি🎶

আঁধার গাইলো,

🎶গোপন করে আপন তোরে বুকের পাঁজরে রাখি ঘুমের বড়ি দিয়ে আড়ি হৃদয় বাড়িতে থাকি🎶

🎶চল না সুজন করি কুজন
সুখ পাখি হয়ে ডাকি
দেখুক লোকে কেমন তোকে
প্রেমে জড়িয়ে রাখি🎶

🎶চল না সুজন পালাই দুজন
ওদের কে দিয়ে ফাকি
কোনো সমান্তরাল পথের বাঁকে
বাসা বানিয়ে থাকি🎶

🎶 Music 🎶

গান শেষ হতেই সবাই কড়াতালি দিলো। আঁধার চোখ বুলিয়ে দেখে ওদের চারপাশে ভীর জমা হয়ে গেছে। আপন,আরুশ,অয়ন,আসিক,ইসী ফাটা চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আঁধারের দিকে হাত বাড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

—“হাই আমি রুশা চৌধুরী!”

চলবে,

[]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here