My First Crush পর্ব -১৮

#My_First_Crush
#পর্ব-১৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

(হৃদি)
চমৎকার একটি দিনের সূচনা। ওয়েদারটাও দারুণ। রৌদ্রজ্বল দিন। কিন্তু রোদের দাহ নেই। ফ্লোরিডাকে এমনিতেও বলা হয় সানশাইন স্টেট। বছরের বারো মাসই এখানে বিরাজ করে সামার ভাইবস। আর ‘কি ওয়েস্ট’ তো সেক্ষেত্রে চমৎকার একটি আইল্যান্ড। এখানে পর্যটকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
দেখার মতো এখানে আছে অনেক কিছু। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি আজকের দিনের একটিভিটির ছোটখাটো একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলেছি। হোটেল থেকেই ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা সেই উদ্দেশ্যেই বের হলাম। বীচে আসতেই মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো। সমুদ্রের বিশাল জলরাশির সাথে নীল আকাশের দিগন্তের দৃশ্য কেড়ে নিলো নজর। আমরা আজকে ‘কি ওয়েস্ট’ এর সানসেট ওয়াটার স্পোর্টস এ যাবো। সারাদিনের জন্য একটা প্যাকেজ। সেখানে অনেক অনেক ওয়াটার স্পোর্টস এক্টিভিটির ব্যবস্থা করা আছে। আমি তো শোনার পর থেকেই অনেক এক্সাইটেড। বোটে উঠার আগে আমাদের একটা কাগজে সাইনও করতে হলো। যার ভাবার্থ ছিল ওখানে গিয়ে কোন দূর্ঘটনার জন্য আমার মৃত্যু হলেও কেউ দায়ী না। কাগজ পড়ে তো রাইয়ান হকচকিয়ে যাবার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি কোনমতে তার দৃষ্টি থেকে বেঁচে একপ্রকার জোর করিয়েই তাকে কাগজে সাইন করালাম। তারপর আমিও সময় নষ্ট না করে খুশি মনে সাইন করে দিলাম। প্রথমে আমাদের একটি বড় বোটে করে সমুদ্রের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের সাথে আমরা ছাড়াও আরো চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মতো পর্যটক ছিল। সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে বোটে যেতে যে এতো ভালো লাগছিল! তবে একটু ভয় ভয়ও হচ্ছিল। ভাবতেই কেমন লাগছিল সমুদ্রের মাঝখানে! যথাসময়ে সমুদ্রের মাঝখানে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বোটটি সারাদিনের জন্য থামানো হলো। সেখান থেকেই একেকটি এক্টিভিটি করানো হবে। আমি খুবই আনন্দিত! রাইয়ানের সাথে প্রথম কোথাও ঘুরতে এসেছি। তাও আবার এতো সুন্দর জায়গা। মন না ভালো থেকে পারে? সমুদ্রের মাঝখানে বোটে দাঁড়িয়ে একদম চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতো ব্যাপার হলো। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। একদম স্বচ্ছ। যাকে বলে ‘ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়াটার।’ পানির রং টাকে নীল নাকি সবুজ বলে ব্যাখা করবো তা নিয়েই আমি হয়ে পড়লাম বিভ্রান্ত। আকাশটাও আজ দারুণ সুন্দর। একদম ঝকঝকে সানশাইন। সাদা পেজোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু উড়ু মেঘের দল। আমি প্রশান্তি মুখে রাইয়ানের দিকে তাকালাম। রাইয়ানের চোখও সমুদ্রের দিকেই। তার পরনে আজ সাদা টি শার্টের উপর বোতাম খোলা হালকা আকাশি রঙের শার্ট। বাতাসে তা মৃদু মৃদু উড়ছে। নীল আকাশ, নীল সমুদ্রের সাথে তার সুন্দর একটি সমন্বয়। রাইয়ানেরও চোখ পড়লো তখন আমার উপর। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো কি হয়েছে? আমি চোখ নামিয়ে হেসে মাথা ঝাকিয়ে বোঝালাম কিছু না। রাইয়ান বলল,
‘সারাদিনের জন্য আমরা এখানে কি করবো হৃদি? এর থেকে তো অন্য কোথাও যেতে পারতাম।’
আমি জোর দিয়ে বললাম,
‘আমি শুনেছি এই প্যাকেজটায় অনেক মজা। আর আজকে একদিনের জন্যই তো! অন্য সময় অন্য কোথাও যাবো?’
‘আমাদের তখন ঐ কাগজে সাইন কেন নিলো? ইনজয় করতে এসে মরে যাবার স্টেটমেন্ট দিয়ে এলাম।’
‘ওটা তো এমনিই জাস্ট ফর্মালিটি। ওমন কিছুই হবে না। আমি খবর নিয়েছি এটা সেইফ ই। আর আমরা তো লাইফ জ্যাকেট ই পরা থাকবো।’
তারপর একটু মজার সুরে আমি রাইয়ানকে বললাম,
‘ভয় পেয়ো না রাইয়ান, সমুদ্রের পানিতে কোন তেলাপোকাও থাকে না।’
রাইয়ান সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় আস্তে করে একটা বারি দিয়ে সরে গেলো। আমি হাসতে লাগলাম।

এক্টিভিটির শুরু আমরা ‘ব্যানানা বোট’ দিয়ে করলাম। লম্বা একটা বায়ুপূর্ণ পাতলা বোটের দু পাশে কিছু সংখ্যাক মানুষের সাথে আমরাও বসলাম। আমি আর রাইয়ান পাশাপাশি দু দিকে সবার সামনেই বসেছি। আমাদের পেছনে বাকি মানুষ। সবার পরনেই লাইফ জ্যাকেট। আমাদের বোটের সামনে দড়ির মতো কিছু একটা বেঁধে মূলত আরেকটি স্পিড বোড সামনে থেকে চলে আমাদের ব্যানানা বোটটি বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে টানতে লাগলো। আমরা শক্ত করে বোট ধরে রাখলাম।
স্পিডের সাথে বোটটি টেনে নেওয়ায় সমুদ্রের পানি আছড়ে আমাদের মুখে শরীরে পড়তে লাগলো। এ এক অন্যরকমই উত্তেজনা। মনে হয় এই পড়ে পড়ে গেলাম। আবার আনন্দও লাগতে লাগলো। এরপর আমরা আরেকটি ওয়েভ রানার যানে উঠবো বলে ঠিক করলাম। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘Jet Ski.’ এটাতে দুজন করেই উঠে। একজন চালায় আরেকজন পেছনে বসে থাকে। এটাতে উঠার আগে আমাদের সবাইকে আগে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিলো। সেখানে সব নিয়মাবলী লেখা আছে। সেগুলো ভালো মতো পড়ে নাকি আবার পরীক্ষা দিতে হবে। আমার মুখটা ভোঁতা হয়ে গেলো। এই পরীক্ষা আমার আজীবনের শত্রু। আর এখন ঘুরতে এসে সমুদ্রের মাঝখানে বসে বসে পড়াশোনা করে নাকি পরীক্ষা দিতে হবে, এর কোন মানে হয়! পরীক্ষা শুরু হলো। পঁচিশ এর মধ্যে ঊনিশ পেলে পাশ। ভালো করে পড়েও পরীক্ষার সময় দেখি অনেককিছুই ভুলে গেছি। অবশেষে অনেক সাবধানতা থাকা সত্ত্বেও আমি কৌশলে রাইয়ানের থেকে লুকিয়ে দুটো প্রশ্নের উত্তর দেখে কোনমতে টেনে টুনে পাশ মার্ক ঊনিশ পেয়েই পাশ করলাম। রাইয়ান পেলো চব্বিশ। অনেকে ফেলও করলো। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা ‘Jet Ski’ রাইড নেবার সুযোগ পেলাম। আর এটাতে যে এতো মজা হলো! এমনিতেই তো রাইয়ানের পেছনে বসেছি। রাইয়ান চালাচ্ছে আর আমি তাকে ধরে রেখেছি। এত স্পিডে চলছিল যে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। এতদিন সিনেমায় দেখা দৃশ্যটা বাস্তবে যেন উপভোগ করলাম। এরপর ফিরে গেলাম মেইন বোটে। এরমধ্যে অনেকটাই ভিজে গেছি আমরা। তাই ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। বোটে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রাইয়ান আমার কিছু ছবি তুলে দিলো। আমিও রাইয়ানের কিছু ছবি তুলে দিলাম। কিছু একসাথে ছবিও তোলা হলো আমাদের৷ দেখতে দেখতে লাঞ্চের সময় হয়ে এলো। লাঞ্চের আয়োজন বোটেই করা হয়েছে। এটাও এই প্যাকেজেরই একটা অংশ। আমরা জানালার ধারে একটা টেবিল দেখে বসলাম। বেশিরভাগই সামুদ্রিক মাছের আইটেম। খাবারগুলো অতি সুস্বাদু। এতক্ষণ এত দৌড়ঝাঁপ হওয়ায় খিদেও লেগেছিল প্রচুর। খাবার মুখে পুরতেই স্বাদে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। রাইয়ান আমার অবস্থা দেখে ঈষৎ হেসে বলল, ‘আস্তে আস্তে খাও হৃদি। খাবার গলায় আটকিয়ে ফেলো না আবার!’
আমি বললাম, ‘খাবারগুলো খুবই মজা লাগছে রাইয়ান।’
‘এতো খিদে লাগলে যেকোন খাবারই মজা লাগবে। তুমি আজকে লাফিয়েছোও তো কম না।’
আমি খাবার মুখে নিয়েই আহ্লাদী হাসি হাসলাম। তারপর বললাম, ‘এখান থেকে ফিরে আমি দাদীমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাতে চাই রাইয়ান। দাদীমা যদি এতো সুন্দর ব্যবস্থা করে না পাঠাতো তাহলে কি আর এতো আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম! আসার আগে দাদীমা যে দেখা করতে এলো তখন তো তাড়াহুড়ো করে ঠিকমতো কথাই বলতে পারলাম না।’
রাইয়ান হঠাৎ ভাবুক হয়ে কিছু ভেবে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হৃদি, আমি যখন গাড়ি বের করছিলাম তখন দাদীমা তোমাকে কি বলছিলো?’
আমার খাবার চিবানো বন্ধ হয়ে গেলো৷ মুহুর্তেই স্থির হয়ে গেলাম আমি। দাদীমা আমাকে কি বলেছিল সেটা এখন বলি কিভাবে? রাইয়ান আবারো ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো। আমি কষ্ট করে খাবারটা গিলে কথা ঘোরাতে বললাম, ‘এমনিই তেমন কিছু না। তুমি এটা খেয়ে দেখো অনেক মজা।’
রাইয়ান আমার কথায় ভুললো না। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘না, তোমাদের দুজনকে তো দেখলাম অনেকক্ষণ কি নিয়ে যেন কথা বললে। দাদীমা তোমাকে কি বলছিল?’
আমি কাঁচুমাচু করতে লাগলাম৷ কথা ঘোরানোর জন্য আবারো কিছু বলতে গিয়ে রাইয়ানের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সে ভ্রু উঁচিয়ে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অগত্যা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে একনাগাড়ে বললাম,
‘এবার ফিরে গিয়েই শীঘ্রই দাদীমা আমাকে তাকে একটা গ্রান্ড চাইল্ড গিফট করতে বলেছে।’
কথাটা বলতে বলতেই আমার গালদুটো লাল হয়ে উঠলো। আমি আস্তে করে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে সফট ড্রিংকের গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়েই একদম থেমে গেছে। আমার চোখ পড়তেই হঠাৎ কাশতে শুরু করে দিলো সে। মুখ থেকে পানি বের হয়ে এলো। প্রায় বিষম উঠে যাবার মতোই অবস্থা হলো তার। আমি তাড়াতাড়ি উঠে একটা টিস্যু তার মুখের কাছে নিয়ে মুছতে দিতে গেলাম। রাইয়ান আমার হাতে ধরা রাখা টিস্যুটা চেপে ধরলো মুখে। এমন সময় কোথা থেকে একটা বাচ্চা এসে দুরুম দুরুম করে ছবি তুলতে লাগলো আমাদের। ফোনের সাটার সাউন্ডের শব্দ শুনে আমরা দুজন পাশে তাকালাম। বাচ্চাটা হঠাৎ জোরে জোরে চেঁচিনো শুরু করে বলল,
‘মম, ডেড, দেখো ওরা দুজন রোমান্স করছে! রোমান্স করছে!’
আমরা দুজন অপ্রস্তুতের সাথে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। বাচ্চাটার মা এসে বাচ্চাটাকে ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে সরি বলে চলে গেলো। আমি সোজা হয়ে বসলাম। তারপর চুপচাপ একেবারে খাবারে মনোযোগ দিলাম দুজনে।

লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা প্রস্তুত হলাম প্যারাসেইলিং এর জন্য। রাইয়ান একটু গড়িমসি করছিলো। আরো বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। আমিই রিকুয়েষ্ট করে তাকে রাজী করালাম। বরাবরই সবসময়ের মতো এবারও বেশি এক্সাইটেড ছিলাম আমিই। বোটের ক্রিউরা (Crew) প্রথমে আমাদের সবকিছু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো। এরপর একটা স্পিড বোট থেকে প্যারাসুট দিয়ে আমাদের দুজনকে একসাথে সমুদ্রের অনেকটা উপরে উঠিয়ে নেওয়া হলো। প্রথমে এটা নিয়ে এতো নির্ভয়ে লাফালাফি করলেও সমুদ্রের এতো উপরে উঠতে দেখে গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো আমার। আর গড়িমসি করা রাইয়ানই একদম চিল মুডে। একসময় প্যারাসুট আরো উপরে উঠতে লাগলে ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে চেঁচানো শুরু করে দিলাম। আমার অবস্থা দেখে হাসতো লাগলো রাইয়ান। একসময় মনে হলো প্যারাসুটটার উপরে উঠা থেমে গেলো। রাইয়ান আমার কানের কাছে বলতে লাগলো, ‘হৃদি চোখ তো খুলে দেখো। নয়তো কিন্তু পরে আফসোস করবে।’
রাইয়ানের কথা শুনে আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। বিস্ময়ে আমার চোখের পলক ফেলা বন্ধ হয়ে গেলো। প্রকৃতির সৌন্দর্য বলতে যে আসলে কি সেটা যেন সেই মুহুর্তেই উপলব্ধি করলাম আমি। সমুদ্রের তিনশো ফিট উপরে আমরা। নিচে আটলান্টিক মহাসাগরের নীল জলরাশি। আমি রাইয়ানের দিকে তাকালাম। মুগ্ধতায় অভিভূত আমার মুখ। রাইয়ান স্মিত হেসে ভ্রু নাচালো। ঠিক তখনই নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই বোটের ক্রিউরা বোট টেনে আমাদের বিভিন্নভাবে ঘোরানো শুরু করে দিলো। উত্তেজনায় আমি চেঁচানো শুরু করে দিলাম। এ এক অন্যরকমই রোমাঞ্চকর মুহুর্ত। যা আসলে জীবনে একবার হলেও অন্তত উপভোগ করাই উচিত। কয়েক মিনিট পর দড়ি টেনে আমাদের বোটে নিয়ে আসা হলো। আমাদের অবস্থা তখন পুরো অস্থির। কোমরে হাত রেখে জোরে জোরে দম নিয়ে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম আমি।
___________________________________________________

(রাইয়ান)
সব এক্টিভিটি শেষ করে আইল্যান্ডে ফিরতে ফিরতে আমাদের বিকেল চারটা বেজে গেলো। সন্ধ্যা হতে তখনও প্রায় দুই ঘন্টার মতো বাকি। সারাদিন সমুদ্রের মাঝখানে থেকে এখন হিসেবে আমাদের হোটেলে ফিরে যাবার কথা। কিন্তু হৃদিকে থামাবে কে? দু দিনের মধ্যে এক সেকেন্ডও নষ্ট করতে চায় না সে। আজকের মতো হৃদিই যেন আমাদের ট্যুর গাইড হয়ে রইলো। এতো এতো তথ্য সে কিভাবে জোগাড় করলো কে জানে! বোঝার কোন সাধ্য নেই কি ওয়েস্টে এটাই তার প্রথম ভ্রমণ। চলাচলের সুবিধার জন্য একটা স্কুটি রেন্টে নিয়ে নিলাম আমরা। আমি প্রথমে ট্যাক্সির কথা বলেছিলাম কিন্তু হৃদিই বায়না করলো স্কুটির জন্য। ইউনিভার্সিটি লাইফে শেষ বাইক চালিয়েছিলাম। অনেকদিন পর স্কুটি চালিয়ে ভালোই বোধ হতে লাগলো আমার। আমি সঠিক স্পিডেই স্কুটি চালাচ্ছিলাম। হৃদি হঠাৎ পেছন থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘রাইয়ান আমরা কি এই দুই ঘন্টা রাস্তাতেই কাটাবো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন? রাস্তাতে কেন কাটাবো? তুমি না কোথায় যাবার কথা বললে?’
‘তাহলে আরেকটু তাড়াতাড়ি চালাও। হাতে মাত্র আর দুই ঘন্টার মতো আছে। এতো স্লো গেলে কিভাবো হবে!’
‘এটাই সঠিক স্পিড। স্লো না।’
হৃদি মুখ ভোঁতা করে বিড়বিড় করে বলল, ‘তুমি ফাস্ট চালাতেই পারো না সেটা বলো।’
আমি চোখ ছোট ছোট করে একবার পাশে দৃষ্টি নিয়েই স্কুটির স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। হৃদি চমকে উঠে আমার কাঁধ আরো শক্ত করে ধরে বলল,
‘এর জন্য এতো জোরে।’
আমি শুনলাম না। বাকা হেসে একই স্পিডে টেনে নিতে লাগলাম স্কুটি। রাস্তার দু ধারের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলতে লাগলাম।

আমরা গেলাম প্রথমে ‘সাউদার্ন মোস্ট পয়েন্টে।’ এটাকে মূলত ফ্লোরিডার জিরো পয়েন্ট বলা হয়। এখানে লাল, হলুদ, কালো রং করা লম্বাকৃতির মধ্যে গোলাকার যে বিশাল পাথরটা বসানো সেটাকে বলা হয় জিরো পয়েন্টের প্রতীক। এই পাথরের সাথে ছবি তোলার জন্য বিশাল লাইন দিতে হয়। কারণ এখানে পর্যটকদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। সাউদার্ন মোস্ট পয়েন্টের আরো একটি চমৎকার বিষয় হলো এখান থেকে মাত্র নয়শো মাইল সমুদ্র পাড়ি দিলেই কিউবা নামের দেশটি। পর্যটকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমরা আর জিরো পয়েন্টের সাথে ছবি তুলতে পারলাম। অন্যদিকে হাতে সময়ও কম। তাই দূর থেকেই কয়েকটা ছবি তুলে আমরা সেখান থেকে চলে এলাম। এরপর সেখান থেকে কাছেই গেলাম ‘কি ওয়েস্ট বাটারফ্লাই এন্ড ন্যাচার কনসারভেটরি’ তে। ভেতরে ঢোকার আগে বাইরে লেখা একটা উক্তি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। উক্তিটি হলো,
‘Excite Your Sense
Expand Your Mind.’
এটি মূলত একটি সংরক্ষণাগার। ভেতরে অনেক অনেক ভিন্ন ধরনের গাছ সাথে প্রচুর প্রজাপতি এবং ব্যতিক্রমী পাখি। চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। উপরের অংশটুকু কাঁচের ছাদ দিয়ে আটকানো। শৌখিন গাছপালার মাঝে আবার পাথরের গা দিয়ে ছোট ঝর্ণার মতোও দেখা গেলো। যার একদম সরু জলধারা একে বেঁকে চলছে। সবকিছু অনেক সুন্দর করে সাজানো। অনেকটা রাজপ্রাসাদের বাইরের রাজকীয় বাগানের মতো। চারপাশে প্রচুর রং বেরঙের প্রজাপতি উড়াউড়ি করতে লাগলো। কিছু বসে রইলো গাছের ডালেও। প্রজাপতি নিয়ে আমার তেমন কোন ফ্যান্টাসি বোধ ছিল না। কিন্তু এখানে এভাবে দেখে আসলেই মুগ্ধ হলাম। প্রজাপতি চোখের সামনে দিয়ে উড়ছে, বসছে। পাখিরা মাটিতে হাঁটছে। ছোট ছোট তৈরি করা বাসায় বসে আছে। একটা নীল রঙের প্রজাপতি এসে হৃদির হাতে বসলো। হৃদি তো দারুণ খুশি। তবুও নিজের এক্সাইটমেন্ট আটকে রেখে একদম স্ট্যাচুর মতো স্থির হয়ে থেকে হৃদি আমাকে ছবি তুলতে বললো। প্রজাপতির সাথে আমি তার ছবি তুলে দিলাম। অনেক নতুন ধরনের পাখিও দেখতে পেলাম। একটা গিফট শপও ছিল সেখানে। যেখানে প্রজাপতি সম্পর্কিত সব ধরনের আইটেম ছিল। যদিও সংরক্ষণাগারটা খুব বেশি বড় না। পুরো ঘুরে দেখতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগার মতো। আমরা সেখানে আধাঘন্টা সময় কাটিয়ে চলে এলাম। সেখান থেকে গেলাম ‘ম্যালোরি স্কয়ারে।’ কি ওয়েস্ট এর ম্যালোরি স্কয়ার সানসেট এর জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসে এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সমুদ্রের ধারের এই জায়গাটা তাই এই সময় স্বভাবতই জনবহুল। আমরা গিয়ে একটু কম মানুষ দাঁড়ানো এমন জয়গা দেখে দাঁড়ালাম। আমার বা পাশেই দাঁড়ানো হৃদি। তার মুখে নম্র হাসি বিরাজমান। সূর্যাস্ত হতে এখনও কিছু সময় বাকি। আমরা আশেপাশে তাকিয়ে চারপাশের পরিবেশ দেখতে লাগলাম। সারি সারি করে মানুষ দাঁড়ানো। সামনেই বিশাল সমুদ্র। সেখানে ঢেউ তুলে চলে গেলো একটি জাহাজ। হঠাৎ হৃদি আমাকে ডেকে বলে উঠলো,
‘রাইয়ান, ওদিকের দুটো মেয়ে দেখো সেই কখন থেকে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় তোমাকে পছন্দ হয়েছে।’
হৃদি মুখ টিপে হাসতে লাগলো। আমি সেদিকটায় তাকিয়ে বললাম, ‘হেই তুমি তো ভালোই! আমি আসলেই জানতাম না এমনও কোন মেয়ে আছে যার হাজবেন্ডকে অন্য মেয়েরা দেখলে সেটা আবার সে তাকেই ডেকে দেখায়!’
হৃদি আনমনে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,
‘তাতে কি হয়েছে? হাজারটা মেয়ে তোমার দিকে তাকালেও থাকবে তো তুমি আমারই।’
ঠিক তখনই সূর্যাস্তের সময় হয়ে উঠলে সবার মধ্যে একধরনের শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। সবাই যাবতীয় ভাবনা সরিয়ে এক মনোযোগে তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের উপরে পশ্চিম আকাশের দিকে। আমিও তাকালাম। দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে লাল আভা। তার মাঝে সমুদ্রে ডুব দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে এক রক্ত লাল বৃত্ত। যার রং আছড়ে পড়েছে সমুদ্রের নীল জলেও। সে এক অন্যরকমই দৃশ্য! আমি আস্তে করে পাশে হৃদির দিকে তাকালাম। সূর্যের শেষ সময়ের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে হৃদির হাসি মুখেও। তার চোখ সমুদ্রের উপর রক্ত রাঙা আকাশে দিনের শেষ আলোক খন্ডের দিকে। আর আমার চোখ তার দিকে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here