#The_Terrible_Lover
#অদ্রিতা_জান্নাত
#পর্ব__৩১
★★★
নিজের অফিসে বসে অফিসের কিছু ফাইল চেক করছে আরিহান ৷ সেই মূহুর্তেই ওর ফোনটা বেজে উঠলো ৷ তাকিয়ে দেখে আননোউন নাম্বার ৷ চোখ ফিরিয়ে কাজে মন দিলো ৷ তৎক্ষনাৎ আবার বেজে উঠলো ফোনটা ৷ আগের নাম্বারটাই ৷ কিছুক্ষন বাজতে বাজতে কেটে গেলো ৷ আবার বেজে উঠলো ৷ বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশের মেয়েলী কন্ঠ শুনে স্থির হয়ে গেল, শান্ত হয়ে গেল আরিহান ৷ ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এ কার গলা শুনলো ও? এতোটা ভুল কখনোই হতে পারে না ওর ৷
***
কেয়া আর আরিয়ার কারণে শেষমেষ বাধ্য হয়ে কাশফিয়া ফোন করে আরিহানকে ৷ তিন বারের বেলায় কলটা রিসিভ করে ৷ তারপর হ্যালোও বলে কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো প্রকার উত্তর আসে নি ৷ আসবে কি করে? আরিহান তো শকের মধ্যে আছে ৷ কাশফিয়া আবার বললো,,,,,,”হ্যালো?”
আরিহান এখনো চুপ ৷ ওর মাথা কাজ করছে না ৷ কি করবে ও? এতো গুলো বছর পর সেই একই আওয়াজ অবিশ্বাস্যকর একটা ব্যাপার ৷ সেই পুরোনো আওয়াজ চিনতে ওর এক ফোঁটাও ভুল হতে পারে না ৷ ঠিক শুনেছে ৷ ওর কাশফুল ওকে ফোন দিয়েছে ৷ মুখের কোনায় একটা হাসি ফুটে উঠলো ৷ সেই হাসিটা বজায় রেখেই বললো,,,,,,,”কাশফুল!”
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা এরকম চেনা আওয়াজে কাশফিয়া অবাক হয়ে গেল ৷ আরিহানের বলা কথাটা বারবার ওর মাথায় বাজছে ৷ আরিহানের গলাটাও ওর কাছে পরিচিত লাগছে ৷ ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না ৷ দুজনেই চুপ ৷ যেন একে অপরকে অনুভব করছে ৷
হুট করেই কেয়া কাশফিয়ার হাত থেকে ফোনটা টান মেরে নিয়ে গেল ৷ কাশফিয়া সেই আগের মতোই চুপ করে বসে আছে ৷ আরিহানের বলা “কাশফুল” কথাটা ওর কানে বারবার ভেসে আসছে ৷ ও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে ৷
কেয়া ফোনটা স্পিকারে দিয়ে আরিহানকে বলতে লাগলো,,,,,,
কেয়া : হ্যালো আঙ্কেল? কেমন আছো?
এক প্রকার আশা নিয়ে কানে ফোন নিয়ে চুপচাপ বসেছিল আরিহান ৷ কিন্তু ওপাশের থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের গলা শুনে ওর সেই আশাটাও চলে গেল ৷ এতোটা ভুল কি করে হতে পারে সেটাই ভাবছে ও ৷ ওপাশের থেকে কেয়ার গলা শুনে ও বুঝতে পারে সকালের বাচ্চা দুটোই ফোন করেছে ওকে ৷ নিজেকে সামলিয়ে কোনো রকমে বলে,,,,,,
আরিহান : এই তো ভালো ৷ তোমরা কেমন আছো? কি করছো এখন?
কেয়া : আমরাও ভালো আছি আর তোমার সাথে কথা বলছি ৷
আরিহান : দুপুরে খেয়েছো তো?
আরিয়া : হ্যাঁ আঙ্কেল তুমি আবার কবে আসবে?
আরিহান : আসবো পরে এক সময় ৷
এভাবে কথা বলতে লাগলো ওরা ৷ এদিকে ফোনটা স্পিকারে দেয়ায় কাশফিয়া আরিহানের সব কথা শুনেছে ৷ ওর এখন মাথায় চাপ পরছে ৷ এই কন্ঠটা ও চিনে কিন্তু মনে করতে পারছে না ৷ মনে করতে গেলেই মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায় ৷ বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি দিলো তারপর চোখে মুখেও পানি দিলো ৷ ওকে স্বাভাবিক থাকতে হবে ৷ অন্তত ওর মেয়েদের জন্য ৷
কোনো কিছু মনে করতে গেলে মাথায় চাপ পরবে আর এই চাপের ফলে মাথায় রক্ত উঠে যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে ওর এটা ডাক্তার বলেছিল ৷ তাই ও কোনো সময়ই জোর করে কিছু মনে করতে চায় না ৷ এমনিতেই ওর মেয়েরা পিতৃ পরিচয় ছাড়া বড় হচ্ছে যদি কাশফিয়াও না থাকে তাহলে ওদের কি হবে? সে সব ভাবলেই কষ্ট হয় ওর ৷
রুমে গিয়ে কেয়া আর আরিয়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে কল কেটে দিয়ে বললো,,,,,
কাশফিয়া : অনেক হয়েছে সোনা ৷ আর না ৷ আঙ্কেলকে কাজ করতে দাও ৷ বিরক্ত করো না আর ৷
বলেই কাশফিয়া ফোনটা অফ করে চার্জে দিলো ৷
এদিকে হঠাৎ কল কেটে যাওয়ায় কিছুটা অবাক হলো আরিহান ৷ আবার কল করলে ফোন বন্ধ বলে ৷ ও চেয়েছিল আরিয়া আর কেয়ার সাথে কথা বলে ওদের মায়ের সঙ্গেও কথা বলবে ৷ কিন্তু সেটা আর হলো না ৷ ফোনটা টেবিলে রেখে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল ৷ ওর কানে বারবার কাশফিয়ার বলা ‘হ্যালো’ শব্দটা বাজছে ৷
________________________
★★★
আজ ঢাকায় এসেছে কাশফিয়া ওর মেয়েদেরকে নিয়ে ৷ সঙ্গে এসেছে লিজা আর রাতুল ৷ একটা ভাড়া করা ফ্লাটে উঠেছে ওরা ৷ ফ্লাটের মালিক রাতুলের বন্ধু তাই প্রবলেম হয় নি কোনো ৷ ওদেরকে ফ্লাট দেখিয়ে দিয়ে রাতুল অফিসে গিয়েছে ইন্টারভিউ দিতে ৷
প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পর রাতুলের ফোন এলো কাশফিয়ার কাছে ৷ এই ফোনেরই অপেক্ষা করছিল ও ৷ ফোন রিসিভ করে বলতে লাগলো,,,,,,
কাশফিয়া : হ্যালো? কি খবর ওখানে ভাইয়া?
রাতুল : আলহামদুলিল্লাহ চাকরিটা কনফার্ম হয়েছে ৷
কাশফিয়া : সত্যি জবটা পেয়েছো তুমি?
রাতুল : হ্যাঁ আর শোন আরেকটা কথা ৷ কেয়া আর আরিয়াকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে ওদের এডমিশান টেস্টটা দিয়ে আনিস ৷ ফর্ম ফিলাপ করে রেখেছিলাম আমি শুধু এক্সামটা দিলেই হবে ৷
কাশফিয়া : কবে সেটা?
রাতুল : কাল ৷
কাশফিয়া : কালই?
রাতুল : হ্যাঁ চিন্তা করিস না সব ঠিকঠাকই হবে ৷ আর আমার আসতে ঘন্টা খানিকের মতো লাগবে ৷ সাবধানে থাকিস ৷
কাশফিয়া : আচ্ছা তাহলে রাখি ৷
বলেই কল কেটে দিল কাশফিয়া ৷ কেয়া আর আরিয়ার দিকে ঘুরে বসে দেখে ওরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ৷ এমন ভাবে কথা বলছে যে কাছ থেকেই কিছু শোনা যাচ্ছে না ৷ মনে মনে হাসলো কাশফিয়া ৷ সব অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড ও ওর মেয়েদের মধ্যে দেখলো ৷ কেয়া আর আরিয়াকে ওর দিকে ঘুরিয়ে বললো,,,,,,
কাশফিয়া : শুধু গল্প করলে হবে? পড়তে হবে তো নাকি?
আরিয়া : কি পড়বো মাম্মা?
কাশফিয়া : স্কুলে যাবে না?
আরিয়া : যাবো ৷
কাশফিয়া : কাল যেতে হবে তোমাদের ৷ একটা ছোট্ট টেস্ট নিবে তোমাদের টিচার ৷
কেয়া : কি রকম?
কাশফিয়া : তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে যে তোমার নাম কি?, কোথায় থাকো তুমি?, তোমার মায়ের নাম কি?, বাবার নাম কি?, কোন কোন কবিতা পারো? এরকম আরো কিছু প্রশ্ন ৷ আমার মেয়েরা উত্তর দিতে পারবে না?
কেয়া : হ্যাঁ পারবো ৷ সব জানি তো কিন্তু পাপার নাম তো জানিনা মাম্মা ৷
আরিয়া : হ্যাঁ মাম্মা কি বলবো আমরা?
কাশফিয়া চুপ করে রইল ৷ ও নিজেই তো জানে না ৷ সেখানে কি বলবে ও? আরিয়া কাশফিয়ার হাত ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,,,,,
আরিয়া : ও মাম্মা বলো না বলো না ৷ কি বলবো আমরা?
কেয়া : মাম্মা আমরা পাপার সঙ্গে দেখা করতে যাবো না? শহরে এসেছি তো এখন নিয়ে চলো না প্লিজ ৷ ও মাম্মা পাপার কাছে নিয়ে চলো না ৷
আরিয়া : মাম্মা কিছু বলো না? আমাদের নিয়ে চলো ৷ আমরা যাবো পাপার কাছে ৷ চলো না মাম্মা ৷
কাশফিয়া কেয়া আর আরিয়াকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে দিলো ৷ কি করবে ও? কি করে নিয়ে যাবে ও? ওর বুকটাও যে খালি ৷ মেয়েদের জন্ম পরিচয় জানে না ৷ নিজের পরিচয়ও জানে না ৷ সেখানে ও কি করবে? ওরও তো বুকটা ফেটে যায় নিজের মেয়েদের কষ্ট দেখে ৷ ওরও তো কষ্ট হয় ৷
কেয়া আর আরিয়া ওদের ছোট ছোট হাত কাশফিয়ার গালে ছুঁইয়ে চোখের পানিটা মুছে দিলো ৷
আরিয়া : কাঁদছো কেন? কষ্ট দিয়েছি আমরা? সরি আর কষ্ট দিবো না মাম্মা ৷ প্লিজ কেঁদো না ৷
কেয়া : মাম্মা আমরা আর বলবো না ৷ তুমি যখন ইচ্ছা আমাদের পাপার কাছে নিয়ে যেও তবুও কেঁদো না প্লিজ ৷
কাশফিয়া নিজের চোখ দুটো মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো ৷ তারপর কেয়া আর আরিয়াকে বললো,,,,,
কাশফিয়া : আচ্ছা সে সব বাদ দাও ৷ এখন তোমাদের কালকের জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে তো নাকি? তো আর কোনো কথা না আমি যেসব বলবো মন দিয়ে শুনবে ওকে?
দুজনেই : ওকে!!
★★★★★
পরেরদিন,,,,,,,,
কেয়া আর আরিয়াকে নিয়ে একটা স্কুল থেকে বের হলো কাশফিয়া ৷ স্কুল থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তা ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলো ৷ রাতুল ওকে এখানে নিয়ে এসেছে আর রাস্তা চিনিয়ে দিয়ে অফিস চলে গিয়েছে ৷ কেন জানি কাশফিয়ার মনে হচ্ছিল ও এই রাস্তাগুলো চিনে ৷ এর আগে কি কখনো এসেছিল এখানে?
হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো ৷ রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে কথা বলতে লাগল ৷ এদিকে কেয়া আর আরিয়া দুজন দুজনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজনদের দেখছে ৷
________________
আরিহান গাড়ি নিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছিলো ৷ তখনি রাস্তার সাইডে চোখ যায় ওর ৷ কেয়া আর আরিয়াকে চিনতে অসুবিধা হলো না তার ৷ গাড়ি থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে গেল ৷ ওদের সামনে ওদের কাছে গিয়ে ওদের সামনে হাটু গেড়ে বসে পরলো ৷ কেয়া আর আরিয়া দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে চেয়ে রইল আরিহানের দিকে ৷
দুজনে একসাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,,,,,,”আঙ্কেল তুমি?”
আরিহান দেখছে ওদের ৷ গতকালই তো শুধু দেখে নি ৷ কিন্তু ওর মনে হয়েছে প্রায় কয়েকবছর পর দেখছে ওদের ৷ আরিহান ওদের দুজনের গালে হাত রেখে বললো,,,,
আরিহান : তোমরা এখানে, এভাবে রাস্তায় কেন?
কেয়া : গতকাল এসেছি আমরা এখানে আর আজ মাম্মা আমাদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল ৷
আরিহান : ওহ তাই? তো কোথায় তোমাদের মাম্মা? তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে অাছো কেন?
আরিয়া : মাম্মা ফোনে কথা বলছে ৷ ওই যে দেখো ৷
হাতে উঁচিয়ে কাশফিয়ার দিকে ইশারা করে কথাটা বললো আরিয়া ৷ ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাশফিয়া পিছনে ঘুরে কথা বলছে ফোনে ৷ আরিহান ওর ইশারা অনুযায়ী তাকালো ৷ পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে তবুও ওর কাছে অন্যরকম লাগছে ৷ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ৷ আর একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ৷
মনে মনে বলছে ”কে ও? ওই দিন ওদের মায়ের গলা কাশফিয়ার মতো লাগল ৷ আজ দেখতেও কাশফিয়ার মতো লাগছে ৷ এতোটা ভুল কখনোই হতে পারে না আমার ৷ কখনোই না ৷”
একটু একটু করে আরিহান কাশফিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর একটু একটু করে ওর মনের ভেতর নিভে থাকা আশার আলোটা জ্বলে উঠছে ৷
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,