#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৬.
গত কয়েক দিন এনজিওতে আসতে না পারায় অর্কের অনেক কাজ জমে গেছে।হাতে থাকা ঘড়িটায় বারবার তাকাচ্ছে আর ফাইলে কিছু লিখছে।অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই অয়নকে দিয়ে তনিমা আর কলিকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।দিহাদ অর্ককে ছাড়া বাসায় ফিরবে না।তাই দিহাদও অর্ককে সাহায্য করছে যাতে করে হাতের কাজ গুলো একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে বাসায় ফিরতে পারে।অর্ক কয়েকবারই দিহাদকে চলে যেতে বলেছে কিন্তু ও যায় নি।হাতের কাজ প্রায় শেষই হয়ে এসেছে।আর একটা ফাইল বাকি।অর্ক ফাইলের উপর দৃষ্টি রেখেই বললো,
– তোকে যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটা করেছিলি?
দিহাদ আমতা-আমতা করে বলে,
– আসলে আমি কিরণ চৌধুরীর ঠিকানা জোগাড় করতে পারি নি।
দিহাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে অর্ক ধীর কন্ঠে বলল,
– আমাকে আগে বললি না কেন?
– তোকে বললে তো তুই অসুস্থ শরীর নিয়েই ওকে খুঁজতে চলে যেতি।
– তো?
ভাবলেশহীন ভাবে বললো অর্ক।দিহাদ কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে বললো,
– আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল তো অর্ক।
– বল!
– তুই ওই কিরণ চৌধুরীর পরিচয় নিয়ে কেন পড়ে আসিস?ওই মেয়ে তো এই দেশে থাকে না অব্দি।কয়েকদিন হলো এসেছে আবার কয়েকদিন পরে হয়তো চলেও যাবে।
– একজন সেলিব্রিটির সম্পর্কে হালকা পাতলা খুঁজ খবর নেওয়া খারাপ না তো।
– এই মেয়ে আদৌ কোনো মানুষ তো রে ভাই?নাকি কোনো জ্বিন পরী?না জানি চেহেরা দেখতে কেমন।আমার তো মনে হয় ওই মেয়ের চেহারাই ভালো না!হয়তো কুৎসিত বলেই নিজেকে ওমন সবার থেকে আড়াল করে রাখে সব সময়।কিন্তু মেয়ের কন্ঠ মাশাল্লাহ।শখের বসেই হয়তো গানটা করে।হবে হয়তো কোনো ধনীর দুলালি!শুনেছি শো-কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থের দুই ভাগই নাকি ডোনেশন দিয়ে দেয়!আমি নিশ্চিত এই মেয়ে কোনো মানুষ না!নির্ঘাত কোনো জ্বিন পরী বা অশরীরী আত্মা!মানুষ বেশে ঘুরে বেড়ায়।নয়তো কোনো ভ্যাম্পায়ার?তা না হলে এই মেয়ে রাত বেরাতে শো-কনসার্ট করে বেড়ায় কেন?আরে ভাই তুই মেয়ে মানুষ,তোর কেন এত সাহস থাকবে?তুই দিনে কনসার্ট কর।দিনে স্টেজ শো কর।সন্ধ্যার আগে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যা!তা না তুই রাতের বেলা টইটই করে ঘুরে বেড়াস আর হাজারো ছেলের মাথা চিবিয়ে খাস!
দিহাদ শেষের কথাটা অর্কের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে।অর্ক এতক্ষণ চুপচাপ দিহাদের কথা শুনছিল আর ওর কাজ করছিল।হাতে থাকা ফাইল সহ টেবিলের উপর রাখা সব গুলো ফাইল সুন্দর মতো করে ঘুচিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
– শুনেছি চাঁদেরো নাকি কলঙ্ক আছে!কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সূর্যের কিরণের কোনো কলঙ্ক নেই!
অর্কের কথা বোধগম্য হলো না দিহাদের।কিন্তু অর্ককে বুঝতে না দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে বললো,
– ওইহই সূর্য মশাই কি প্রেমে পড়লো নাকি শেষ পর্যন্ত?
– কিরণ সূর্যেরই হয়!সূর্য ছাড়া কিরণের কোনো অস্তিত্ব নেই!কিরণকে কিরণ নিতে হলে এই সূর্যের কাছেই আসতে হবে।
দিহাদ হা করে অর্কের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
– কিন্তু এই সূর্যটা আবার কে?
– আমি?
অর্কের ঝটপট উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় দিহাদ।বুঝতে না পেরে বললো,
– মানে?
অর্ক শক্ত হাতে দিহাদের গাল টিপে আহ্লাদী গলায় টেনে টেনে বললো,
– আরে গাধা,অর্ক নামের অর্থই হলো সূর্য!
দিহাদ অর্কের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
– তাহলে এর মানে কি দাঁড়ালো?
অর্ক দিহাদের কথায় মুচকি হেসে বলে,
– তোর এত মানে বুঝে কাজ নেই।চল বাসায় চল।
_________________
প্রতিদিনের মতো অর্ক আজো বাড়ি ফিরে সোজা ওর রুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ঘড়ির কাঁটা একটার উপরে।সেই যে সকালে মেহেনূরদের বাড়ি থেকে খেয়ে বেড়িয়েছিল এর পর থেকে আর কিচ্ছু খাওয়া হয় নি।এখন ঠিকই প্রচন্ডরকম খিদে পেয়েছে কিন্তু খেতে মন চাইছে না।যে ছেলেকে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে না দিলে আয়েশা বেগমের মন শান্ত হতো না এখন সেই ছেলেকে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেওয়া তো দূর ভালো করে কথা বলেন না।ছেলে কি আদৌ খেলো নাকি খেলো না এটা নিয়েও উনার বিন্দুমাত্র কোনো মাথা ব্যাথা নেই।পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে অর্ক না খেয়েই শুয়ে পড়ে।পরক্ষণেই হুড়মুড় করে উঠে বসে।ওর রুমে আসার সময় ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে কাউকে বসে থাকতে দেখেছিল।রুমের লাইট অফ ছিল বলে বেশি খেয়াল করে নি।চোখ ছলছল করে উঠে অর্কের।মনে পড়ে যায় রাত জেগে অপেক্ষারত মায়ের কথা!ছেলের জন্য রোজ না খেয়ে বসে থাকতেন আয়েশা বেগম।ছেলেকে খাইয়ে তারপর উনি খেতেন।এ কদিনে এই অভ্যাসটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মা ছেলে দুজনেই।বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অর্ক।দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে চলে যায়।মায়ের অবয়ব দেখে হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয় অর্কের।অভিমানের পাহাড় গলে পানি হয়ে যায় নিমিষেই। অর্ক সুইচ টিপে লাইট অন করতেই চমকে উঠেন আয়েশা বেগম।হুট করেই মাথা তুলে পাশে তাকিয়ে আধখোলা চোখে বলেন,
– খোকা এসেছিস?
অর্কের বুকের ভেতর ধুক করে উঠে।মায়ের মুখের কত সুন্দর কত মুধর এই শব্দ।লাস্ট কবে মা ওকে এই শব্দে সম্মোধন করেছে ওর মনেই নেই।হয়তো দুজনের মধ্যে এই দূরত্বের কারণটা ঔ।ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মায়ের মাথা আলতো হাত রেখে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে,
– তুমি এখনো জেগে আছো কেন?
– ছেলে বাইরে থাকলে মায়ের চোখে বুঝি ঘুম আসে?
অভিমানী সুরে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।অর্ক মায়ের মাথাটা ওর বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।ছেলের এই ব্যবহারে আয়েশা বেগম মোটেও অবাক হন নি।আকাশে মেঘ করলে এক সময় না এক সময় বর্ষণ হবেই।তাই প্রস্তুত ছিলেন।মনে মনে ছেলের কান্নাকাটি করাটা সহ্য করতে না পারলেও মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
– হয়েছে থাম এবার।কান্নাকাটি করার অনেক সময় পাবি!এখন খেয়ে নে তো।
মায়ের কথায় চোখ মুখ মুছে আয়েশা বেগমের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে অর্ক।কান্না করার ফলে হেচকি উঠে গেছে।আয়েশা বেগম ভাত মেখে একেক লোকমা ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন আর অর্ক পরম তৃপ্তিতে খাচ্ছে।ক্ষনে ক্ষনে ফুলিয়ে উঠছে অর্ক।ছেলের এই অবস্থা দেখে আয়েশা বেগম মুখ টিপে হেসে বলেন,
– ছোটবেলার ছাপটাই তো এখনো যায় নি আর এই ছেলে কিনা করবে সংসার!
মায়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে বিস্মিত হয়ে তাকায় অর্ক।অর্কের প্রশ্নসূচক দৃষ্টি দেখে আয়েশা বেগম বললেন,
– তোমার জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে।তোমার বাবা চান এই বছরই বিয়েটা করে তুমি সেটেল্ড হও।
– কিন্তু মা…..
– তোমার বাবা এও বলেছেন,তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে তাহলে বলতে পারো।
অর্ককে বলতে না দিয়ে ওর মুখে খাবারের অবশিষ্ট লোকমাটা তুলে দিয়ে কথাটা বললেন আয়েশা বেগম।অর্ক কি বলবে বুঝতে পারছে না।মুখের খাবারটা শেষ করে পানি খেয়ে চুপচাপ বসে আছে।অনেক্ষন ছেলের কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আয়েশা বেগম বলেন,
– কাউকে ভালোবাসি তুই?
অর্ক ওর মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে উঠে সোজা ওর রুমে চলে যায়।আয়েশা বেগম হতভম্ব হয়ে অর্কের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন।ছেলের কাছ থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যান আয়েশা বেগম।অর্ক রুমে পাইচারি করছে।মস্তিষ্কের নিউরনগুলোয় ঝংকার পড়েছিল এতদিন।ওর বাবা মা যে ওর বিয়ের কথা ভাবছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না ও!কিন্তু তাঁদেরও তো দোষ নেই।ছেলে বড় হয়েছে।ফরজ কাজটা সেড়ে ফেলা তাঁদের দায়িত্ব।উনারা তো ওর মতামতই জানতে চাইছে।
কিন্তু মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ও কি বলবে?যাকে ও ভালোবাসে সেই তো জানে না!তাহলে ও ওর মা বাবাকে কি বলবে?এটা বলবে,আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু সে জানে না যে,আমি তাকে ভালোবাসি!এটা বললে তো আমাকেই হাসির পাত্র হতে হবে।তাহলে কি আমি ওকে হারিয়ে ফেলবো?কথাটা ভাবতেই শিউরে উঠে অর্ক।না না এটা তো আর হতে দেওয়া যাবে না।ওর হৃদয় গহীনে যার বসবাস তার জায়গা ও কাউকে দিতে পারবে না,কাউকেই না!কিন্তু যাকে ও এতটা কাছে চায় সে তো ওর ধরা ছোঁয়ার বাইরে।কত চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই ওর লাগাল পাচ্ছে না।অর্ক হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!নিজের মাথার সব চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।চলে যায় ব্যালকনিতে।আজ যে নেশাক্ত জিনিসটা বড্ড টানছে ওকে।পুরো ব্যালকনিটা সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলি বানিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে।গলায় খুশখুশ করতেই ক্ষণে ক্ষনে কেশে উঠছে।চোখ লাল হয়ে গেছে।ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে তাও বেখেয়ালি মনে ধোঁয়া উড়িয়েই যাচ্ছে।রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে চোখে।চোখ টেনেও খুলে রাখতে পারছে না।আধখোলা চোখেই হতাশ কন্ঠে বললো,
নারী তুমি বড়ই রহস্যময়ী!
ধরা যদি নাই বা দেবে তুমি,
তবে কেন করলে আমার মন চুরি!
আমি হলাম আরেক বোকা,
চোর ধরা কি চাট্টিখানি কথা!
ভালো ছিলাম!ভালোই ছিলাম বুঝি?
তবে কেন তোমায় খুঁজি?
প্রশ্ন করি আমি!
আর কতকাল থাকবে শুনি,
এই অদমের অগোচরে তুমি!
চলবে……….#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
৭.
নেশায় ভোর হয়ে ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ক।সূর্যের তীর্যক রশ্মি চোখে মুখে পড়তেই বিরক্তিতে কপাল কুচকে আসে অর্কের।চোখ খুলে নিজেকে মেজেতে বসে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয় অর্ক।পরমুহূর্তেই গত রাতের কথা মনে পড়তেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ঘাড়ে ব্যাথা করছে।কি জানি রাতে কিভাবে না কিভাবে বসে ঘুমিয়েছে।দরজার ও পাশে মায়ের ডাকের আওয়াজ পেতেই চমকে উঠে।মায়ের ডাকে সাড়া না দিলে এখন হয়তো দরজা ভেঙেই চলে আসবে।অর্কের মাথা কাজ করছে না।একে তো নিজের এমন এলোমেলো চেহারা তারউপর যদি ব্যালকনিতে সিগারেটের পরিত্যক্ত অংশ দেখে তাহলে নির্ঘাত এই ব্যালকনিতে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে!অর্ক হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে। কিন্তু ব্যালকনি পরিষ্কার করার মতো কিছুই পেল না।শেষে উপায় না পেয়ে কাপড় দিয়ে ঝেড়ে সব সিগারেট আর ছাই নিচে ফেলে দেয়।ওইদিকে আয়েশা বেগম ডেকেই যাচ্ছেন।কাঁপা কাঁপা হাতে চোখ মুখ মুছে চুলটা ঠিক করে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় অর্ক।আয়েশা বেগম সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বলেন,
– কোনো দিন তো রুমের দরজা লক করে ঘুমাস নি তাহলে আজকে হঠাৎ লক করলি যে?আর দরজা খুলতেই বা এত দেরি হলো কেন?
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অর্ক।মাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।পরক্ষনেই গলা খাঁকারি দিয়ে নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে,
– বারে এতদিন তো ছেলের বউ দেখার কথাও ভাবো নি!তাই আমিও দরজা লক করার প্রতি আগ্রহ দেখাই নি!
আয়েশা বেগম ছেলের কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকান।কিন্তু পর পরেই বুঝতে সক্ষম হতেই মুখ টিপে হেসে ছেলের কান ধরে বললেন,
– বড্ড পেঁকে গেছিস না!
মায়ের কথার প্রত্যুত্তরে লাজুক হাসে অর্ক।আয়েশা বেগম ছেলের কান ছেড়ে তাড়া দিয়ে বলেন,
– যা গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়।কানাডা থেকে রাওনাফ ওর বাগদত্তাকে নিয়ে দেশে আসছে ওদের রিসিভ করতে তোকে যেতে হবে।
অর্ক রাওনাফের নাম শুনতেই মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বললো,
– তো আমাকে কেন যেতে হবে?ওদের কি মানুষের অভাব?
আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই অর্ক মেকি হেসে বললো,
– আরে না না!আমি কি বলেছি যে যাবো না?মজা করছিলাম আরকি।
– হুম!
ভারী কন্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করেই অর্কের মা চলে যায়। মা চলে যেতেই ফোঁস করে দম ছাড়ে অর্ক।রাওনাফকে রিসিভ করার কথাটা শুনতেই রাগ উঠে গেছে ওর।ও চায় না রাওনাফের মুখোমুখি হতে।কিন্তু মাকে অখুশি করতে চায় না বলে নিজের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওর যেতে হবে।একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।শরীর থেকে কেমন বিশ্রী বিদঘুটে গন্ধ বের হচ্ছে।নিজেরই গা ঘুলিয়ে আসছে।বমি বমি পাচ্ছে।গায়ের টিশার্ট টা ভালো করে ধুঁয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসে অর্ক।মায়ের হাতে ব্রেকফাস্ট করে বাইকের চাবি নিয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলেই আয়েশা বেগম শীতল কন্ঠে বলনে,
– ওরা দুজন!
অর্ক ভ্রু কুচকে মায়ের দিকে তাকায়। আয়েশা বেগম স্মিত হেসে বলেন,
– তুই ভুলে গেছিস?তুই বিদেশ ফেরত কাউকে রিসিভ করতে যাচ্ছিস!ওরা কি হেটে হেটে আসবে নাকি?
অর্ক নিজের বোকামি দেখে ফিচেল হেসে বললো,
– আসলে সব সময়ই তো বাইক নিয়েই বেরুই তাই মনে ছিল না।
অর্ক এগিয়ে এসে বাইকের চাবি রেখে গাড়ির চাবিটা নিয়ে আবার যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই আয়েশা বেগম বলেন,
– মেহেনূরও যাবে।
ওইদিনের পর থেকে মেহেনূরের নাম শুনলে এখন আর তেলে বেগুন জ্বলে উঠে না অর্ক।মেয়েটাকে বেশ নম্র ভদ্রই মনে হয়েছে ওর কাছে।যাক এই সুযোগে ওইদিনের ব্যবহারের জন্য না হয় একটা সরি বলে দিবে!একটা সরি বলাতে খুব বেশি ছোট হয়ে যাবে না ও!অর্ক কথাগুলো মনে মনে আওড়িয়ে নরম গলায় বলে,
– ঠিক আছে।
____________________
গাড়ির মধ্যে পিনপিনে নীরবতা।অর্ক স্বাভাবিক ভাবেই ড্রাইভ করছে।মেহেনূর ওর ফোনে কিছু একটা করছে।ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে ক্ষনে ক্ষনে আড় চোখে অর্ক মেহেনূরের দিকে তাকাচ্ছে।মেহেনূরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা খাঁকারিও দিয়েছে বার কয়েক কিন্তু লাভ হয় নি।মেহেনূর নির্লিপ্ত চোখে ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে।অর্ক মনে মনে একটু বিরক্ত হলো ঠিকই কিন্তু প্রকাশ করলো না।নিজের ইতস্ততবোধ সাইডে রেখে ধীর কন্ঠে বললো,
– আ’ম সরি!
– ফর হোয়াট?
মুখ তুললো না মেহেনূর।ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রশ্নটা করে ও।অর্ক মেহেনূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,
– ওইদিন হয়তো কথাটা ওইভাবে বলা উচিৎ হয় নি আমার।আসলে সকালে ঘুমাতে পারি না বলে বিরক্ত হয়ে ওইদিন ওই কথা গুলো বলে ফেলেছি।আমি কিন্তু মন থেকে বলি নি।আর….
– ইটস ওকে!
অর্ক থামে।মেহেনূরের দিকে একটু তাকিয়ে আবার বললো,
– এখন আর রেওয়াজ করো না?
– না।
– বাবাকে ম্যানেজ করলে কি করে?
– উনি নির্বোধ নয়!
কথাটা তীরের মতো বিঁধলো অর্কের বুকে।ওর কাছ থেকে এইরূপ উত্তর আশা করাটা অযাচিত নয়।যুক্তি আছে।অর্ক ফের বললো,
– তুমি কি রেগে আছো আমার উপরে?
– না!আপনি তো সত্যিই বলেছেন।
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে মেহেনূরের ভালো লাগছে না অর্ক এটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
– পায়েসটা খুব ভালো ছিল!
– থ্যাংকস!
ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাইভিং এ মন দেয় অর্ক।কিন্তু কয়েকটা কথা ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বার বার।মেহেনূর কি সত্যিই কিছু মনে করে নি ওর ব্যবহারে?নাকি ওকে ইগনোর করার চেষ্টা করছে?সব গুলো উত্তর ফোনের দিকে তাকিয়েই দিয়েছে ও। মাঝে মাঝে ফোনের উপর থেকে দৃষ্টি অবশ্য বাহিরেও দিয়েছে কিন্তু ভুলেও সেই দৃষ্টি অর্কের দিকে একবারও ফিরে নি।
– সিগারেট খাওয়া কি আপনার নিত্যদিনের অভ্যাস?
মেহনূরের দিকে বিস্মিত চোখে তাকায় অর্ক।মেহেনূর হঠাৎ এমন প্রশ্ন করতে পারে অর্কের কল্পনাতেও ছিল না।কিন্তু ওর মাথায় এই প্রশ্ন এলো কোথা থেকে?এই জন্যই কি ও আমার মুখে দিকে তাকিয়ে কথা বলতে চাইছিল না?অর্ক গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
– না!
– সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক!চলে এসেছি আমরা!
অর্ক মেহেনূরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মেহেনূর বলে,
– এয়ারপোর্ট এসে গেছে।
অর্ক সামনে তাকিয়ে দেখে সত্যিই চলে এসেছে।ভাবনার মাঝে এতটাই বিভোর ছিল যে টেরই পায় নি কখনো চলে এসেছে।পর মুহূর্তেই অর্ক বললো,
– কিন্তু তুমি….
– রাতের খোলা আকাশের নিচে বসে সময় কাটানো আমার একটা নেশা।বদঅভ্যাসও বলতে পারেন!কি করবো আমার ভালো লাগে।কাল রাতেও আমি ছাদেই ছিলাম!
অর্ককে বলতে না দিয়ে মেহেনূর প্রত্যুত্তর করে। বিনিময়ে অর্ক কিছু বলে নি।গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় মেহেনূর।মিনিট দুয়েক পরেও অর্ককে গাড়িতেই বসে থাকতে দেখে মেহেনূর কপাল কুচকে জিজ্ঞাস করলো,
– আপনি ভেতরে যাবে না?
– না!
রুদ্ধ কন্ঠে জবাব দেয় অর্ক।মেহেনূর মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে বললো,
– ঠিক আছে আপনি বসুন তাহলে।
মেহেনূর চলে যেতেই অর্ক গাড়ি থেকে নেমে আসে।অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার বেশ বিরক্ত লাগছে ওর।গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বার বার হাতে থাকা ঘড়িটায় তাকাচ্ছে।এবার বেশ বিরক্ত নিয়ে সামনে তাকাতেই রাওনাফের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখে সামনে বেশে উঠে।বয়স যেন দিন দিন কমতির দিকে!দেখে মনে হচ্ছে সবে আঠারোয় পা দিলো!গায়ের রং টা বরাবরই উজ্জীবিত ছিল।কিন্তু এখন একটু বেশিই মনে হচ্ছে!হবে নাই বা কেন?মনে বিয়ের রং লেগেছে কিনা!কথাগুলো ভেবে রাওনাফের উপর থেকে ঠোঁট বাকিয়ে দৃষ্টি সড়িয়ে পাশে তাকাতেই চোখ পড়ে অপরিচিত রমনীর উপর।তার ঠিক পাশেই হাটছে মেহেনূর।একপাশে ভাই অন্য পাশে অর্কের অপরিচিতাকে রেখে মাঝখানে চলে এসেছে মেহেনূর!এখন দুজনের হাত ধরে হাটছে মেহেনূর।অর্ক বুঝতে পারে ওর এই অপরিচিতাই রাওনাফের বাগদত্তা।পোশাকাশাকে বাঙালীআনা থাকলেও দেখে মনে হচ্ছে বিদেশিনী।মায়ের মুখে রাওনাফের বাগদত্তার কথা শুনে ওর মনে এটা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগে নি যে,রাওনাফ কাকে বিয়ে করছে?সে কি আদৌ কোনো বাঙালি ঘরের মেয়ে কিনা?নাকি কোনো বিদেশিনীর প্রেমে মজেছে ও?অর্কে মনে মনে তাচ্ছিল্যে হেসে ভাবে,যার সাথে সম্পর্কটাই নেই তার সম্পর্কে এত খুঁজ নিয়ে ও কি করবে?হঠাৎ করেই চোখাচোখি হয়ে যায় রাওনাফের সাথে।এতক্ষণ তো ও রাওনাফের দিকেই তাকিয়ে ছিল কিনা!হকচকিয়ে গিয়ে দৃষ্টি সড়িয়ে নিয়ে সোজা গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে।রাওনাফ মুচকি হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে।লাগেজ গুলো রাওনাফই গাড়িতে উঠায়।অর্ক থমথমে মুখ করে বসে আছে।মেহেনূর আর অর্কের বিদেশিনী গাড়িতে উঠে বসে। আর রাওনাফ গিয়ে অর্কের সাথে ফ্রন্ট সিটে বসে।রাওনাফ গিয়ে বসতেই অর্ক কোনো শব্দ না করেই গাড়ি স্টার্ট দেয়।স্বাভাবিকের চেয়ে তুলনামূলক দ্রুতই ড্রাইভ করেছে অর্ক।ওর লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারা।
– তোমাদের ড্রাইভারটা কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম!
কথাটা কানে আসতেই জোড়ে ব্রেক কষে অর্ক।পিছনে থাকা বিদেশিনী আর মেহেনূর তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা সামনে ঝুকে পড়ে।চকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে তাকায় অর্ক।চোখ যেনো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার আসার উপক্রম।ওকে ড্রাইভার ভাবায় যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে ওর মুখের ভাষা শুনে।এই মেয়ে বিদেশিনী নয়?অর্কের ভাবনার মাঝেই ফিক করে হেসে উঠে রাওনাফ।অর্ক দাঁত কড়মড় করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাওনাফের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই রাওনাফ মুখে হাত দিয়ে হাসি সংবরণ করার চেষ্টা করে।কিন্তু ব্যর্থ হয়।অর্ক তড়িঘড়ি করে সিট বেল্ট খুলে হুট করেই গাড়ি থেকে নেমে যায়।রাওনাফের মুখের হাসিও গায়েব হয়ে যায় সাথে সাথেই।ভাবতে থাকে,অর্ক আবার বেশি রাগ টাগই করে ফেলে নি তো?কিন্তু না!রাওনাফকে ভুল প্রমান করে দিয়ে মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে আসে অর্ক।কিন্তু নিজের সিটে এসে বসে নি।ঘুরে গিয়ে সোজা মেহেনূরের সামনে এসে দরজা খুলে বললো,
– তুমি একটু সামনে গিয়ে বসো তো!
মেহেনূর একবার রাওনাফের দিকে তাকিয়ে ভাইয়ের সায় পেয়ে নেমে যায়।মেহেনূর নেমে যেতেই মেহেনূরের সিটটায় ধপ করে বসে পড়ে অর্ক।রাওনাফ বুঝতে পারে অর্ক ড্রাইভ করবে না।বোনকে নিজের সিটে বসতে দিয়ে ও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে।রাওনাফ গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়ি আপন গতিতে ছুটে চলেছে।অর্ক রাওনাফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিদেশিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– তা আপনি যেন কি বলছিলেন?আমি খুব হ্যান্ডসাম ড্রাইভার?
রোশনি চোখ গোল গোল করে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ক একটু থেমে চোখের ইশারায় রাওনাফকে দেখিয়ে বললো,
– সামনের ড্রাইভারটার থেকেও বুঝি বেশি হ্যান্ডসাম?
ঠোঁট টিপে হাসছে রাওনাফ আর মেহেনূর।রোশনি শীতল কন্ঠে বলল,
– তার গুণে সে তো আমায় কবেই ঘায়েল করেছে।
স্মিত হাসে অর্ক।কথা সত্যি!আসলেই রাওনাফ একজন সুদর্শন যুবক।রোশনি আবার বলল,
– শুনেছিলাম অর্ক নামের কেউ একজন আমাদের রিসিভ করতে আসবে কিন্তু ও না এসে ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে কেন?যাক গে তুমিও তো খারাপ না!মাশাল্লাহ ভালোই!ড্রাইভার হিসেবে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।এই রাওনাফ বাসায় গিয়ে আমার হয়ে ওকে কিছু টাকা বেশি ভাড়া দিয়ে তো বকশিস হিসেবে!
বিষম খেয়ে বসে অর্ক।রোশনি ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলেই কানে হেডফোন গুঁজে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে।আর ওইদিকে রাওনাফের হাসি কে দেখে।মেহেনূর ভয়ার্ত চোখ অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।এই ছেলের যা রাগ ওর হবু ভাবীর গলাটাই না টিপে দেয়!মেহেনূর রোশনিকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু অর্ক ওকে ইশারায় বলতে বারণ করে।রাওনাফের হাসিতে অর্কের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।অর্ক শুধু দাঁতের গোড়ায়ই নিজের রাগটা পিষছে।
চলবে………