অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৩৩

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৩৩|

রাত ৩:২৩। বেলীর চোখ গুলো ফুলে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। এমন অনবরত হেঁচকির আওয়াজে পাশে ঘুমানো বিমান লাফিয়ে উঠলো। অন্ধকারে বেলীর বারবার কেঁপে উঠা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বিমান ধীর কন্ঠে ডাকতে লাগলো,
— বেলী? এই বেলী?
বেলীর কান্নাটা তীব্র হচ্ছে। বিমান দ্রুত পায়ে রুমের লাইট সুইচ করলো। বেলী ফোন হাতে কাঁদছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। গাল, ঠোঁট ফুলে । বেলীর এমন অবস্থা দেখে কেমন চুপসে গেলো বিমান। সে বেলীকে আবারও ডাকতে লাগলো,
— বেলী? বেলী? কি হয়েছে?
বেলীর কান্নাটা আরও বাড়ছে। তার অবস চাহনি হাতের ফোনটির দিক। বিমান বেলীর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো। লক খুলে ফোনের দিক তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলো। বিমান কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজেকে সামলিয়ে দ্রুত হাতে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। সেলফোন পেয়ে তৃষ্ণাকে কল লাগালো। সুইচড-ওফ শোনাচ্ছে। এবার বিমান অভিকে কল লাগালো। অভি মনে হচ্ছে ফোনের সামনেই ছিলো। এক রিং-এই ফোন রিসিভ করে ফেলল। অভির হ্যালো বলা হয়নি। বিমানের রাগে থরথর করে কাঁপা গলা,
— তৃষ্ণা কোথায়?
অভির অবাক কন্ঠ,
— হয়েছে কি?
— আমি তোমাকে ভিডিও আর পিকচার্স সেন্ড করেছি।
— আচ্ছা।
অভি মোবাইল চেক করে থম মেরে রইলো। তৃষ্ণার এক্স শ্রাদ্ধা-র সাথে কিছু ছবি আর লিক ভিডিও। মুলত বোঝাই যাচ্ছে ছবি আর ভিডিও গুলো খুবই আগের। ভিডিও ক্লিপটি-তে স্পষ্ট তৃষ্ণার সাথে মেয়েটির চুমুর মুহুর্ত। ছবি গুলোও অনেকটা ঘনিষ্ঠ মূলক। অভি ‘ আল্লাহ বলে উঠলো। দ্রুত বলল,
— বে..বেলী? ও দেখেছে?
বিমানের রাগী কন্ঠ,
— তোদের আমি একশোবার সাবধান করেছিলাম। বরাংবার বলেছি বেলী এগুলোর জন্য ছোট। ও বুঝবে না। এই বয়সে কষ্ট নিতে পারবে না। তুই তোর কসম দিয়ে আমাকে মানিয়েছিলি। বলছস
‘ কিসের কষ্ট আমার ভাই পাগলের মতো ভালোবাসে। নিজে মরবে তাও বেলীকে কষ্ট পেতে দিবে না। ‘ অথচ তোর ভাইর এক্সিডেন্টের জন্য ও কাঁদতে কাঁদতে প্রায় মাস খানিক খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে ফেলসে। আমি জেনেও চুপ। সেদিন তোদের বাড়িতে তোদের খালা আমার বোনকে অপমান করেছে, আমি জেনেও চুপ। আশপাশের মানুষ জন নানান খারাপ কথা বলে আমার বোনকে নিয়ে। আমি তাও চুপ। আর আজ আবার এমন কিছু? আমি এখন বলছি যে
তোর ভাইকে বলবি বেলীর সামনেও আসতে না। ওর আমার বোনকে ভালোবাসার অধিকার নেই। ও যদি ওর আগের কূ-কির্তিই ঢাকতে না পেরে তাহলে কিসের জন্য প্রেম করতে এসেছে? এতো ভালোবাসার নমুনা দেখিয়ে কি হলো? এগুলো যদি বাবা জানে বা শুনে। বুঝতে পারছস কি হবে?
অভি ঢোক গিলল,
— বেব। ঠান্ডা হও। আচ্ছা শুনো আগে কুল হও।
— আমাকে ফোন দিবি না।
বিমান ফোন কেটে আবারও বেলীর দিক তাকালো। মেয়েটা কেঁদে শেষ। সাবধানে এগিয়ে গেলো। বেলীর পাশে বসলো,
— বেলী?
বেলী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— আমি কেন কাঁদছি? আমিতো জানতাম সে অনেক প্রেম করেছে। তার গার্লফ্রেন্ড ছিলো। আর তাদের সাথে সে রোমাঞ্চকর সময় স্পেন্ড করেছে। কিন্তু, আজ আমি নিতে পারছি না।
বিমান বেলীকে জড়িয়ে ধরলো,
— কাঁদে না।
— আমি জানি সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।
অনেক ভালোবাসে।
বিমানের রাগ আর ক্ষোভে মাথা ধরে আসছে। সে তাও ধীর আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
— ভালোবাসিস তৃষ্ণাকে?
বেলী ধীরে কেঁদেই যাচ্ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেই বলল,
— হ্যাঁ।
বিমানের নিজেকেই থাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সে অভিকে পাওয়ার আকাঙ্খায় সব ভুলে গেলো। ভুলেই গেলো তৃষ্ণার আগের জীবনের কথা। তাদের পারিবারিক দুরত্বর কথা। বয়সের ভেদাভেদ। সব ভুলে গেলো। বেলী কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমানের চোখে ঘুম নেই। বাকি রাতটুকু অভির কলে বিমানের ফোন বাজতেই থাকলো।

বিমানের বিয়ে আজকে। প্রচুর আয়োজন রাত থেকে। খুশির পরশু থেকে চোখে ঘুম নেই। তার হাসিমুখে আলাদা-ই কষ্টের ছাপ। আনন্দ কয়েকবার স্ত্রীকে বুঝিয়ে গেলেন। অথচ, তার নিজের মনের অবস্থা খুবই দুর্বল। বারবার তার বড় মেয়েটার বায়না গুলো মনে পড়ছে। মেয়েটা আজকের পর আর নিজের থাকবেনা। আর সে তার দায়িত্ব নিতে পারবে না। মেয়ের প্রতি তার কোনো অধিকার থাকবে না। আনন্দের মাথা ধরে আসছে।
বিমান বারবার বাড়িটা ঘুরছে। সকলের দিক সময় নিয়ে তাকাচ্ছে। বেলী এখনও গভীর ঘুমে। ঘুমাবেই তো। অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে। আর সকাল মাত্র ৫ টা বাজছে। এতো দ্রুত উঠার কথাও না। কয়েকবার খুশিকে দেখে এবার কেঁদে দিলো বিমান। বিমানের কাঁদা দেখে খুশি নিজেকে সংযত করতে পারলো না। সে-ও মেয়েকে ধরে কাঁদতে লাগলেন। অনবরত মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। আজকে অতি চালাকি বাবলু টাও কেমন মনমরা। কয়েকবার বিমানের দিক তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। এইবার রুমে ঢুকে খুশি আর বিমানের কাঁদা দেখে তার নিজের চোখেও পানি টগবগ করছে। ঠোঁট কাঁপছে। চোখ মুছতে মুছতে অন্যদিকে চলে যেতে লাগলো।

বেলী ঘুম থেকে উঠে ফোনে ছবি গুলো খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নেই। হয়তো বিমান ডিলিট করে দিয়েছে। তার এখনও স্পষ্ট মনে আছে রাত্রের ঘটনা। তৃষ্ণার সাথে কথা বলার পরপরই কিছু মেসেজেস আসে। ছবি গুলো দেখে শুধু থমকে ছিলো, ভিডিও ক্লিপটি দেখে তার কাঁপা হাত থেকে ফোনই পড়ে যায়। বেলীর এখনও স্পষ্ট ছবির ঘনিষ্ঠতা চোখে ভাসছে। সেই মেয়ের সাথে তৃষ্ণার ঘনিষ্ঠ ক্লিপ্টি। বেলীর বুক কেঁপে উঠছে ব্যাথায়। চিনচিন ব্যাথায় বুক ধরে আসছে। চোখে আবারও পানি জমা হচ্ছে। এ কোন ধরনের শাস্তি পাচ্ছে সে? এগুলো আগের। কেউ ইচ্ছে করে দিয়েছে। তার আর তৃষ্ণার মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কিন্তু বেলীর মন? অজানা ব্যাথায় কেঁদে উঠছে। মন কোনো কথায় শান্ত করা যাচ্ছে না। কেঁদেই যাচ্ছে। চোখের পানি থামানো যাচ্ছে না। এই অদ্ভুত অনুভূতি, এই ব্যাথা এগুলো থেকে বেলী মুক্তি চায়। তৃষ্ণার ছবি দেখতে গিয়ে এইবার বেলী আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো। ধীর আওয়াজে বিরবির করতে লাগলো,
— শুধু আমাকে ভালোবাসেন। আমি জানি। কষ্ট পাব না একদম। এগুলো আগের। এমন কিচ্ছু কখনও আর হবেনা।
মুখে বললেও বেলীর চোখের পানি গুলো থেমে নেই। বয়েই যাচ্ছে। ব্যাথা তীব্র হচ্ছে। অনুভূতি ভয় দিচ্ছে।
খুশির ডাকে বেলী দ্রুত চোখ মুছে ফেলল। খুশি হঠাৎ মেয়ের এমন চেহারা দেখে ভরকে গেল,
— কি হয়েছে?
বেলী হালকা হেসে বলল,
— আজকে পেত্নী বিদায় হবে। তাই একটু আরকি,
খুশির চেহরার পরিবর্তনে বোঝা যাচ্ছে সে আবারও কাঁদতে বসবেন। বেলী দ্রুত বিছানা ছেড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলো,
— আর কাঁদতে হবেনা। আপু বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে না। আশপাশই থাকবে। যখন ইচ্ছে দেখতে পাবে।
খুশি নিজের মনকে শান্ত করলো,
— আয়, কিছু কাজ করবি।
বেলী বলল,
— ব্রাশ করে আসছি।
— দ্রুত আয়৷
খুশি যেতেই বেলী ফোন ওফ করে ফেলল। আবারও চোখে পানি ভিরতে চাইলে দ্রুত মুছে ফেলল।
উঠানে যেতেই বিমান বেলীর বাহু ধরে নিজের দিক ফিরালো,
— ঠিক আছিস?
বেলী হালকা হাসলো,
— হ্যাঁ। একদম। আর তুমি এভাবে মন খারাপ করে কেন?
বিমান বেলীর মুখে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো,
— তখন মাথায় আসেনি ব্যাপারটা। মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে তোর কাছে পাঠিয়েছে।
বেলী মাথা দুলালো। বিমান আবারও বলল,
— কাঁদবি না। মানুষের পাস্ট তো থাকেই তাই না?
— হ্যাঁ।
— ভুলে যা। আর যদি মনে হয় ভুলতে পারবি না এগুলো তাহলে তৃষ্ণাকে ভুলে যা। আর আমি জানি তুই পারবিনা তাকে ভুলতে। তাই দুটোর যেকোনো একটা ভুলতে হবে। হু?
— হ্যাঁ।

মদের প্রভাব কাটেনি আবিদের। কিন্তু অভি মোবাইল তার সামনে ধরতেই তারও ঘুম উড়ে গেলো মনে হচ্ছে। লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লো,
— ও মা’ই গড।
— বিমান পাঠিয়েছে।
আবিদ মুখে হাত রেখে চোখ বড়সড় করলো,
— বেলী? ও দেখছে?
— ওর কাছেই পাঠিয়েছে কেউ কাল রাত্রে। বিমান তো রেগে আগুন। ফোন ধরছে না একটাও আমার।
— কোন মাদা*** ? এগুলো তুলার সাহস কিভাবে পাইলো? শ্রাদ্ধার নাম্বার আছে? এটার হাত থাকলে একদম পুঁতে দিব।
কিছু ভেবে আবার অসহায় কন্ঠে বলল,
— ভাই জানে?
— না। ঘুমিয়ে। আয়ুশ ডাকতে গেছে।
— বেলীর অবস্থা কেমন?
— বিমান যেভাবে ক্ষেপেছে। মনে হচ্ছে বেলীর অবস্থা নাজেহাল।
— ভাই তো একদম হুসসস করে দিবে।

চলবে

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here