#অনপেখিত
পর্ব_২
লিখা: Sidratul Muntaz
মেহেকের এহেন রসিকতায় ফারদিনের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। রুষ্ট বাচ্যে ধমক দিল,
” তুমি এখানে কি করছো? আর মোমবাতি কেনো জ্বালিয়েছো?”
মেহেক ভয়ে জুবুথুবু কণ্ঠে বলল,” অন্ধকারে লাইট জ্বালালে আপনি জেগে যেতেন। যাতে আপনার ঘুমে ডিস্টার্ব না হয় তাই মোমবাতি নিয়ে এসেছি।”
” তাহলে মোমবাতি আমার মুখের সামনে ধরে হা করে তাকিয়ে ছিলে কেনো?”
মেহেক এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। ওর ওই গাঁ জ্বালানো হাসিতে ফারদিন আরও রাগে ফেটে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
” লাইট জ্বালাও দ্রুত!”
মেহেক লাইট জ্বালিয়ে দিল। দুইশো বিশ ভোল্টের লাইটের আলোয় ফারদিন ভালো করে দেখতে পেল মেহেককে। বেনারসি বদলে বেগুনী সুতির শাড়ি পড়েছে সে। মুখে এখন কোনো প্রসাধন নেই। মেকাপ তুলে ফেলেছে। চুল খোলা। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো একপিঠ রেশমি চুলের অর্ধেকটাই সামনে আনা। এই মেয়েকে এখন পুরো বাচ্চা লাগছে। ফারদিন যদি বিয়ের আগে একবার দেখে নিতো মেয়েটিকে তাহলে জীবনেও বিয়েতে রাজি হতো না। এই বিয়ে তার জীবন-মরণের প্রশ্ন৷ সারাজীবন অসম বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সে কাটাবে কি করে? তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাই বা হবে কিভাবে? আমেরিকায় বেড়ে উঠা ফারদিনের রুচি কখনোই মেহেকের রুচির সাথে মিলবে না। বয়সের পাশাপাশি তাদের মধ্যে আরও অনেক ফারাক আছে। আকাশ-পাতাল ফারাক! এমন নয় যে মেহেককে দেখতে অসুন্দর। ভালো করে তাকালে মেহেক চমৎকার রূপবতী। কিন্তু ফারদিন তার দিকে ভালো করে তাকাতেও অনিচ্ছুক। মেয়েটা যে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট! এখানেই তার সবচেয়ে বড় অরুচি। মেহেক বলল,” ভাইয়া, আপনার জন্য পানি এনেছি।”
” নাও, পানি আমার মাথায় ঢালো। ঢালো!”
ফারদিন মাথা এগিয়ে দিল। মেহেক প্রায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল। মানুষটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? ফারদিন খিটখিটে মেজাজে বলল,” আরেকবার ভাইয়া ডাকলে কাঁচের জগ তোমার মাথায় ভাঙবো আমি।”
মেহেক নেতানো গলায় বলল,” স্যরি ভাইয়া।”
ফারদিন এবার রেগে-মেগে ভরাট কণ্ঠে এমন জোরে ধমক দিল যে মেহেক ভয়ে কাঁচের জগ নিয়েই কোনোমতে দৌড়ে ছুটে পালালো। বাপরে বাপ! এমন ভয়ংকর ধমক সে জীবনেও খায়নি৷ তার আব্বাও তাকে এমন ধমক কখনও দেয়নি। ফারদিনের রাগ অনেক বেশি এই কথা বিয়ের আগেই জানতে পেরেছিল মেহেক। যখন ফারদিন তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে এসেছিল। মেহেক দরজার আড়ালে লুকিয়ে ফারদিনকে দেখে এতো ভয় পেয়েছিল যে সেদিন ইচ্ছে করেই পাত্রপক্ষের সামনে যায়নি সে। তার মনে হচ্ছিল সামনে গেলেই ওই রাগী পাত্র তাকে চিবিয়ে খেয়ে নিবে। ফারদিনের চৌখা নাকের ডগা, সারাক্ষণ কপাল কুচকে রাখা, সরু চোখে তাকানো, এইসব দেখলে যেকোনো সুস্থ মানুষের হৃৎপিন্ডে দামামা বাজতে শুরু করবে। এই কাঠখোট্টা স্বভাবের অতিরিক্ত মেজাজের মানুষটিকে ছোট্ট মেহেক সামলাবে কি করে? সত্যি বলতে, প্রথম দর্শনেই মেহেক তার হবু স্বামীর প্রেমে পড়েছিল। মেহেককে দরজার বাহিরে কাঁচের জগ হাতে দাঁড়ানো দেখে ফারদিনের ভাবী তিশা এগিয়ে আসল। তিশা ফারদিনের আপন ভাবী না। ফারদিনের চাচাতো ভাইয়ের বউ হয় সে। মেহেকের পেছনে দাঁড়িয়ে তিশা বলল,
” মেহেক, তুমি দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কি করছো?”
মেহেক এতো ভয় পেয়ে ছিল যে হঠাৎ তিশার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো। বুকে থুতু দিতে দিতে বলল,” আপু আপনি?”
” ভয় পেয়েছো নাকি?” হেসে ফেললো তিশা।
” আমি তোমার আপু না, ভাবী হই বুঝেছো?”
মেহেক অপ্রস্তুতভাবে মাথা নাড়ল। এই বাড়িতে কেবল এই মেয়েটির সঙ্গেই তার একটু খাতির আছে। বিয়ের আগে মেয়েটি একবার তাদের বাড়ি এসেছিল৷ তাকে আংটি পরিয়েছে।তিশা হাসি মুখে বলল,” তুমি ঘরের বাহিরে কি করছো?”
মেহেক আমতা-আমতা শুরু করল। সে উত্তর দিতে পারছে না দেখে তিশা নিজেই বলল,” ফারদিনের জন্য পানি আনতে গেছিলে?”
” জ্বী ভাবী।”
মেহেক আশেপাশে তাকাল। বাড়িটা নীরব লাগছে। অতিরথিরা কি সবাই চলে গেছে? মেহেক রান্নাঘর থেকে পানি আনার সময় কাউকে দেখেনি। কাজের মেয়ে লিয়া তাকে পানি ঢেলে দিয়েছে। মেহেক জিজ্ঞেস করল,” মেহমানরা কি সব চলে গেছে ভাবী?”
” হ্যাঁ। গেস্টরা তো সেই কখন চলে গেছে। দাদুও ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার ভাইয়াও ঘুম।”
মেহেক উৎফুল্ল হয়ে বলল,
” তাহলে ভাবী, আপনি আমার সাথে চলুন। আমি আর আপনি একসাথে থাকবো।”
” মানে কি? আজকে না তোমার বাসররাত? তুমি আমার সাথে থাকবে কেন?”
ভারী অবাক শোনালো তিশার কণ্ঠ। মেহেক গোমরা মুখে বলল,” উনি তো আমাকে বের করে দিয়েছে ভাবী?”
” মানে?”
বিস্ময়ে ফেটে পড়ল তিশা। মেহেকের হাত ধরে বলল,” এসো আমার সাথে। ছেলেটা নাটক শুরু করেছে নাকি? নতুন বউকে কেউ বাসরঘর থেকে বের করে দেয়? এটা তো খুব অন্যায়।”
ফারদিন একটা বালিশ মাথায় চেপে ঘুমিয়ে ছিল। তিশা শব্দ করে ডাকলো,” ফারদিন, এইযে দেবরসাহেব। কি শুনলাম এইসব?”
ফারদিন চোখমুখ কুচকে দারুণ বিরক্তিসূচক কণ্ঠে উত্তর দিল,” কি?”
” তোমার বউ বাহিরে কি করে?”
” আমি কি জানি কি করে?”
” এইসব বললে তো হবে না। এই বিছানা কি তোমার একার? এই রুমটা কি তোমার একার? আজকে থেকে মেহেকও সবকিছুর সমান ভাগীদার। তুমি ওকে এইভাবে বের করে দিতে পারো না।”
ফারদিন বক্র দৃষ্টিতে একবার মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক ভয়ে তিশার পেছনে মুখ লুকালো। তিশা অভয় দিয়ে বলল,” কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!”
তারপর ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আজকে তোমার এইসব হম্বিতম্বি একদম চলবে না দেবরসাহেব। মেহেককে তোমার বিছানায় থাকতে দাও। নাহলে কিন্তু দাদুকে ডাকবো আমি?”
” ভাবী, তুমিও শুরু করেছো? মানে আমার ঘরে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই?”
” বিয়ের পর সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। এটাই নিয়ম।”
” এই মেয়ে কি তোমাকে উকিল হিসেবে ভাড়া করে এনেছে?”
” ভাড়া করে আনবে কেনো? বড়বোন হিসেবে আমি ওর পাশে দাঁড়িয়েছি। বাচ্চা মেয়েটাকে একলা পেয়ে তুমি নির্যাতন করছিলে।”
” নির্যাতন কখন করলাম?”
ফারদিনের চেহারায় বিস্ময়। তিশা ধমক দেওয়ার মতো বলল,” মাঝরাতে তুমি ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছো৷ এইটা কি নির্যাতন করা নয়? দাদুকে যদি এইসব একবার বলি..”
” বার-বার দাদুকে কেনো টানছো? তুমি নিজেও কি দাদুর থেকে কম? ওকে বলো আমার ঘরে আমি লাইট অফ করে ঘুমাবো। এই নিয়ে কোনো রেস্ট্রিকশন চলবে না। ওর থাকতে ইচ্ছে হলে থাকবে নাহলে চলে যাবে।”
তিশা মেহেকের দিকে তাকালো,” লাইট বন্ধ থাকলে তোমার কোনো প্রবলেম আছে?”
মেহেক মাথা নিচু করে না বলল। তিশা বলল,” এইতো, দেখেছো? ওর কোনো প্রবলেম নেই। লক্ষী একটা মেয়ে। শুয়ে পড়ো তোমরা। গুড নাইট। আমি তাহলে গেলাম। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে ডেকো মেহেক৷ ভয় পেয়ো না।”
” ঠিকাছে।”
ফারদিন বিরক্তিসূচক শব্দ করে বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে রইল। মেহেক দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে সন্তর্পণে ফারদিনের পাশে এসে শুলো। কিন্তু তার খুব শীত লাগছিল। এসি’র পাওয়ার হাইস্পিডে। কাঁথা ফারদিনের কাছে। মেহেক বলতে চাইল,” আমি কি একটু কাঁথাটা নিতে পারি?”
এই কথা বলার জন্য সে যেই না মুখ খুলতে যাবে অমনি ফারদিন বলে উঠলো,” আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ভাবীকে ডেকে এনেছো তাই না? তুমি তো খুব চালু মাল!”
মেহেক অসহায়ের মতো বলল,” আমি কি করবো? আপনিই তো বলেছেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যেনো বলি আপনি আমাকে বের করে দিয়েছেন। আমি তো ভাবীকে সেটাই বলেছি।”
ফারদিন এ পর্যায়ে কোনো উত্তর দিল না। মেহেক কাঁথার ব্যাপারে বলতে গেলেই ফারদিন
ধমক দিয়ে উঠলো,” কোনো কথা না। জাস্ট সাইলেন্ট।”
মেহেক মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে গেল। শাড়ি দিয়েই কোনোমতে নিজেকে ঢেকে রাখল। রাক্ষসের কাছে কাঁথা চেয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে শাড়িই ভালো। ভোরবেলা ফারদিনের ঘুম ভাঙলো মেহেকের চুলের পানির ঝাপটায়। রেগে-মেগে সে বিছানা থেকে উঠে বসলো। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে৷ এতো দ্রুত ফারদিন জীবনে ঘুম থেকে উঠেনি৷ তার ঘুম ভাঙার সময় এগারোটা কি বারোটা। আজকে এই মেয়েটার জন্য তার ঘুমটাও পরিপূর্ণ হলো না।তুমুল বিরক্তি নিয়ে ফারদিন বলল,
” এই মেয়ে, তোমার সমস্যা কি? এতো সকালে গোসল করেছো কেন?”
মেহেক নিচু গলায় বলল,” গোসল করলেও আপনার সমস্যা?”
” তাই বলে এতো সকালে? শীত লাগে না তোমার?”
” শীত লাগলেও লাভ কি? বিয়ের পর তো সবার সকালেই গোসল করতে হয়। আপনি জানেন না?”
এই কথা বলে মেয়েটা নির্বিকার ভঙ্গিতে চুল ঝারতে লাগল। পানির ঝাপটা ফারদিনের নাকমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ফারদিনের হুশ নেই। সে আপাতত বিস্মিত, স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ। বিয়ের পর সকালে গোসল করতে হয় এইসব ফালতু কথা এই পিচ্চি মেয়েকে কে শেখালো? এখন তো দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল ফারদিনের। এই অবস্থায় মেয়েটা ঘর থেকে বের হলে বাড়ির মানুষ উল্টা-পাল্টা চিন্তা করবে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কাছে এনে দুইটা থাপ্পড় লাগাতে। ফারদিন মেহেককে ধমক দিতে নিচ্ছিল। তখনি দরজায় কারো করাঘাত। ফারদিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। যে-ই আসুক, সে তাকাবে না। তিশা ঘরে ঢুকেই মেহেককে উদ্দেশ্য করে বলল,” ওয়াও, তোমাকে সুন্দর লাগছে মেহেক। গোসল করেছো?”
তিশা এমন ভঙ্গিতে কথাটা জিজ্ঞেস করল যে ভেতরে ভেতরে ফারদিন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। গোসল করেছে ওই মেয়েটা। তার এতো লজ্জা লাগছে কেন?
চলবে