অনপেখিত পর্ব ১

” ভাইয়া, লাইট নেভাবেন না দয়া করে। আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”
” লাইট নেভানো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। তাছাড়া আমার ঘরে আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। তোমার কি?
রূঢ় কণ্ঠে জবাব দিয়ে ফারদিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বধূবেশীর দিকে। মেয়েটির চোখে ভয় আর আতঙ্কের এক গভীর ছাপ স্পষ্ট। এই রূপবতীর সাথে আজ ফারদিনের বাসর রাত। তারই বিছানায় বসে তারই সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী তাকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করছে। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত! প্রথম পরিচয়েই নববধূর মুখে এমন ভাইয়া ডাক শুনলে যে কেউ হতাশ হবে। তবে ফারদিন এই মুহুর্তে হতাশ নয়। সে বিরক্ত। কঠিনভাবে বিরক্ত। চোখ-মুখ শক্ত বানিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ফারদিন বলল,
” লাইট বন্ধ থাকবে। অবশ্যই বন্ধ থাকবে।”
মেয়েটার চেহারায় ভয়ের সাথে সাথে এখন রাজ্যের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেল। ফারদিন লাইট বন্ধ করতে গেলেই মেয়েটি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো,” ভাইয়া প্লিজ…”
ফারদিন আঁড়চোখে তাকালো। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” কি সমস্যা?”
মেয়েটি চুপ রইল। কণ্ঠনালী কাঁপছিল তার। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
” লাইট জ্বালানো থাক।” পিচ্চি মেয়েদের এই এক সমস্যা। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই কেঁদে ভাসায়। এই মেয়েটির বয়স কত হবে? দাদু বলেছিলেন আঠারো হয়ে গেছে। আসলেই কি হয়েছে? নাকি দাদু বাড়িয়ে বলেছেন? সত্যতা যাচাই করতে ফারদিন সোফায় বসে কিছুটা ভদ্রতা সহিত প্রশ্ন করল,
” তোমার বয়স কত?”
মেয়েটা মাথা নামিয়ে উত্তর দেয়,” ষোল।”
ফারদিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আক্রোশে। তার মানে দাদু মিথ্যেই বলেছিলেন। মেয়েটাকে এখন তার আরও বিরক্ত লাগছে। শেষমেষ কি না বাল্যবিবাহই করতে হলো! নিজেকে নিকৃষ্টতম মানুষ মনে হচ্ছে। ফারদিন গলা ঝেড়ে প্রায় হুকুমের স্বরে বলল,” তুমি এই ঘরে থাকতে পারবে না। পাশের ঘরে চলে যাও।”
মেয়েটা আঁতকে উঠা দৃষ্টিতে ফারদিনের দিকে তাকালো। দেখে মনে হলো তাকে ভয়ংকর কোনো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফারদিন বলল, ” কি ব্যাপার? যেতে বললাম না?”
ষোড়শী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” কিন্তু বাহিরে তো অনেক মানুষ। আমি পাশের ঘরে গেলে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কি বলবো?”
” কি আবার বলবে? আমি তোমাকে বের করে দিয়েছি এটাই বলবে! নাকি এটা বলতে লজ্জা লাগবে?”
ফারদিনের বিদ্রুপমাখা কণ্ঠের কাছে পরাজিত মেয়েটি কোনো উত্তর দিতে পারল না। ফারদিন তাগাদা দিল,” সময় নষ্ট না করে যা বলছি তাই করো। নাহলে আমার বিছানা ছাড়ো। আমাকে ঘুমাতে দাও। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। সারারাত তোমার ঢং নিয়ে বসে থাকার মতো সময় নেই আমার।”
মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফারদিন জহুরি চোখে মেয়েটার উচ্চতা পরিমাপ করল। মোটামুটি লম্বা বলা যায়। শাড়ি পড়ার কারণে তাকে কিছুটা মোটা দেখাচ্ছে। এমনিতে মেয়েটা শুকনো। ফারদিন ছবিতে দেখেছিল। সামনা-সামনি কখনও দেখা হয়নি তাদের। মেয়েটাও হয়তো ফারদিনকে এই প্রথমবার দেখছে। তবে ছবির চেয়ে মেয়েটিকে বাস্তবে দেখতে বেশি সুন্দর। মেয়েটি বিছানার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। ফারদিন কাছে এসে বলল,” এই বিয়েতে আমার সম্মতি ছিল না। এটা নিশ্চয়ই তুমি জানো।”
” জ্বী।”
” তবুও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলে কিভাবে?”
ষোড়শী নিশ্চুপ। ফারদিন কাঠখোট্টা গলায় বলল,” কি ব্যাপার?”
” আমার আব্বার কথায় রাজি হয়েছি।”
” স্ট্রেঞ্জ! তোমার আব্বা বলল আর তুমিও একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে?”
” বিয়ে তো অপরিচিত’র মধ্যেই হয়।”
” তুমি জানো আমি যে তোমার থেকে দশ বছরের বড়?”
” জানি।”
” তবুও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে?”
ফারদিনের কণ্ঠে বিস্ময়। মেয়েটা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
” আমার আব্বা আম্মার চেয়ে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। তাদের তো বিয়ে হয়েছে৷ তাছাড়া শুধুমাত্র বয়সের ব্যবধান বিয়েতে নাকচ করার কোনো কারণ হতে পারে না।”
ফারদিন থতমত খেল। এই কথার দ্বারা মেয়েটা কি বুঝাতে চাইছে? সে বিয়ে করে খুব খুশি? গ্রামের মেয়ে বলে তাকে সহজ, সরল আর বোকা ভেবেছিল ফারদিন। কিন্তু এই মুহুর্তে মেয়েটিকে একটুও বোকা মনে হচ্ছে না। ফারদিন বলল,” নাম কি তোমার?”
” মেহেক ইমরোজ।”
” নাম তো সুন্দর। ”
” ধন্যবাদ।”
সামান্য লাজুক কণ্ঠে বলল মেহেক।
” প্রশংসা করেছি বলে ভেবে নিও না এই ঘরেই তোমাকে থাকতে দিবো। তোমার এই বাক্স-পেটরা সাথে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারো বিদায় হও।”
মেহেক বিছানা থেকে তার শাড়ির ব্যাগ আর হ্যান্ড পার্স তুলে নিল। শাড়িটা তাকে রাতে পরার জন্য দেওয়া হয়েছিল। মেহেক বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফারদিন বলল,
” শোনো, বাহিরে কাউকে দেখলে বোলো আমার ঘরে যেনো জগভর্তি পানি রেখে যায়।”
” ঠিকাছে ভাইয়া।”
ফারদিন তেতে উঠলো,” ভাইয়া মানে? কে তোমার ভাইয়া?”
” আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। ভাইয়া না ডাকলে আর কি ডাকবো?”
কথা ঠিক। ভাইয়া ছাড়া মেয়েটি তাকে আর কি ডাকবে? তাছাড়া ভাইয়া ডাকে দোষ নেই। কিন্তু যতবার মেয়েটি তাকে ভাইয়া ডাকে ততবার ফারদিনের মনে পড়ে যায়, এই পিচ্চি তার বিয়ে করা বউ! ফারদিন কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
” কিছু না। যাও তুমি।”
মেহেক বেরিয়ে যেতেই ফারদিন লাইট নিভিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। দুই চোখ জুড়ে তার রাজ্যের ক্লান্তি। কতদিন শান্তিতে ঘুমায় না সে। আমেরিকা থেকে আসার পর যখন দাদু বলল তাকে বিয়ে করতে হবে তখন থেকেই ঘুম, শান্তি সব লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আজকে সে আরাম করে ঘুমাবে। অনেকদিনের ঘুম একসাথে ঘুমিয়ে নিবে। আহ! ঘুমে এতো শান্তি! চোখ প্রায় লেগে এসেছিল ফারদিনের। মোমবাতির আবছা আলোয় মেহেক তার রূপবান স্বামীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। ঘুমালে কাউকে এতো মোহনীয় লাগে বুঝি? হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো ফারদিন। মেহেককে মোমবাতি হাতে তার মুখের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেহেক খিলখিল করে হেসে বলল,
” আরে আমি মেহেক। আপনার জন্য জগভর্তি পানি এনেছি!”

চলবে

#অনপেখিত
#পর্ব_১
Sidratul Muntaz

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here