#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯
কিন্তু রান্নাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেমনকিছুই হাতের কাছে পেলো না রোজা। একবার ভাবলো মিতালি বা নিশিতাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে কোথায় কি আছে। কিন্তু তাঁরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে বিধায় ওদের ডিস্টার্ব করতে মন সায় দিলো না। অগত্যা পানির গ্লাসটা নিয়েই ছাদের দিকে রওনা হলো রোজা। একধাপ সিঁড়ি পেরুয় আর একধাপ নামে, ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে জমে গেলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। ছাদে গিয়ে দেখল, আদ্রিশ চেয়ারে হেলান দিয়ে গোল টেবিলের ওপর পা-জোড়া তুলে চোখ মুদিত করে বসে আছে। সাদা শার্টটার বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা। আর কোলের ওপর অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে ওর কালো কোর্টটা। পারফিউমের কড়া সুবাসে ভাসছে চারপাশ, তার সাথে বাগানের ফুলের সুগন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। আদ্রিশের চেহারায় ক্লান্ত ভাব, চুলগুলো হালকা বাতাসে কপালের ওপর ওড়াওড়ি করছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে মাত্র ছুটি পেয়ে নিজেকে যেন প্রকৃতির কাছে সঁপে দিয়েছে! ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছিল তখন আদ্রিশকে। রোজা ওর এই অবস্থা দেখে কী করবে বুঝে ওঠতে পারলো না। ওকে ডাকবে না-কি ডাকবে না এ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল গ্লাস হাতে। লোকটা কি বেশিই ক্লান্ত? তার ওপর অফিস থেকে ফিরেই গরম চা খেয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল! দ্বিধা ভুলে একসময় মানবিক বিবেচনায় রোজা নিজেই এগিয়ে গেল। ইতস্তত করে ডাকলো, ‘শুনছেন? এই যে?’
আদ্রিশ শুনলো না, চোখ খুলে তাকালোও না। রোজা গলায় জোর এনে বিরস মুখে আবার ডাকলো, ‘এইযে? শুনতে পাচ্ছেন? আহা, উঠুন না!’
মিষ্টি কন্ঠস্বরের ডাকটি যেন তীরের মতো বক্ষপিঞ্জরে আঘাত হানলো। রোবটের মতো চোখ খুলে তাকালো আদ্রিশ। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া নারী মূর্তিটি ওকে দেখে চমকে দু’পা পিছিয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গ্লাস হাতে। আদ্রিশ পা নামিয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এভাবে কে ডাকছিল?’
রোজা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি।’
‘কেন?’
‘আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
‘চোখটা লেগে গিয়েছিল। কিন্তু তুমি এভাবে ডাকছিলে কেন?’
রোজা পানির গ্লাসটা দেখিয়ে জবাবে বলল, ‘আপনি না পানি খেতে চেয়েছিলেন? মিষ্টি কিছু পাই নি নিয়ে আসার জন্য। তাই শুধুই পানি এনেছি।’
আদ্রিশ গ্লাসটি হাতে নিয়ে বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ। হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, ‘মিষ্টি কিছুর দরকার নেই তা তো আগেই বলেছি। বাই দ্যা ওয়ে, বিশ মিনিট লাগে একগ্লাস পানি আনতে?’
রোজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘নাহ!’
আদ্রিশ চড়া গলায় বলে ওঠে, ‘তাহলে এত দেরি কেন? নাকি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছিলে?’
রোজা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘তা কেন হবে?’
আদ্রিশ পানির গ্লাসে চুমুক বসাতে বসাতে বলল, ‘তুমি তো ডেঞ্জারাস মেয়ে। পারতপক্ষে আমার সামনে পড়তে চাও না। ভীষণ ইন্টিলিজেন্ট গার্ল।’
রোজা থতমত খেয়ে বলল, ‘এরকম বলছেন কেন?’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘একমাস! আমার সামনে এসেছ তুমি? পালিয়ে বেড়িয়েছো সারাক্ষণ। কি ভেবেছো, আমি কিছু বুঝতে পারি না? আমাকে তোমার বোকা মনে হয় মিস.রোজা?’
ধরা পড়ে যাওয়ায় রোজা দৃষ্টি অবনত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর উত্তর কি দেবে জানা নেই। পরক্ষনেই আদ্রিশের ওপর রাগ হলো, হলো নিজের ওপরও। কেন যেচে পড়ে ওর জন্য পানি আনতে গিয়েছিল? এই আদিক্ষেতাটা না দেখালে লোকটার সামনে এত এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না। বিব্রতকর পরিস্থিতি যেন সবসময় ওর জন্যই তৈরি হয়ে বসে থাকে। রোজা ক্ষীণ স্বরে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি কোথা থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি? সারাক্ষণ তো বাসা নয়তো ভার্সিটিতেই থাকি!’
আদ্রিশ ভরাট কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছো। না জানার ভান করছো কেন? এই জিনিসটা কিন্তু আমি ভীষণ অপছন্দ করি।’
‘ইয়ে মানে..’
আদ্রিশ অপ্রতিভ কন্ঠে আদেশসূচক শব্দব্যয় করল, ‘নিজেকে বেশি চালাক ভেবো না! এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসার জায়গা কি সব আমার দখলে? কি প্রমাণ করতে চাও আমি নির্দয়? তোমাকে দাঁড় করিয়ে আমি আরামে বসে আছি? বদনাম করতে চাও আমাদের নামে? বসো এখানে, কথা আছে!’
রোজা বাক্যহারা হয়ে গেল। লোকটার উল্টাপাল্টা কথাবার্তার দরুন ওর হার্টবিট রকেটের গতিতে ছুটছে। আবার কি বলতে চায়? আচ্ছা, আদ্রিশ কী ওর হার্টবিট করার জোরালো শব্দ শুনতে পাচ্ছে? ওফ..ভয়ে হার্ট-টা বুঝি বেরিয়েই এলো। আদ্রিশের রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে না-সূচক কিছু বলার সাহস করলো না রোজা। বাড়িতে ঘুমন্ত দু’জন মানবী ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই যে এই লোকটার হাত থেকে ওকে বাঁচাবে। আজ আদ্রিশের হাত থেকে আর রক্ষা নেই সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে রোজা। এতদিন পালিয়ে বেড়ানোর কড়ায় গন্ডায় হিসাব আদায় করে নেবে যেন। ওকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিশ তীব্র কন্ঠে ধমকে ওঠতেই রোজা অন্য আরেকটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কোনো বদনাম করতে চাই না।’
আদ্রিশ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখো। নেহা-ফিহা-উৎস এবং ওর ফ্রেন্ডসার্কেলের সব ফ্রেন্ড, ওদের সঙ্গে তো ঠিকই হেসেখেলে কাটিয়ে দিচ্ছো। শুধু আমার বেলাতেই অন্যরকম বিহেভিয়ার! কিন্তু কেন? আমি কী বাঘ? নাকি ভাল্লুক?’
রোজা বলার চেষ্টা করল, ‘আমি সবার সঙ্গেই মেশার চেষ্টা করি।’
আদ্রিশ তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘সিরিয়াসলি? এতবড় একটা বাড়িতে কী আমি থাকি না? সকালের চা, বিকেলের স্ন্যাকস’টা, রাতের ব্ল্যাক কফিটা তুমি নিজের হাতে তৈরি করো। কারণ তোমার ভালো লাগে। মা-বাবা, ছোটা চাচা-চাচী, উৎস, নেহা-ফিহা সবার ঘরে ঘরেই সেসব পৌঁছে যায়। কিন্তু এই একমাসের কোনো একদিন তো মনে পড়ে না, সেসবের ভাগ আমি পেয়েছি! এই অধমকে কি তোমার চোখে পড়ে না?’
আদ্রিশের রাগী স্বরে বলা কথাগুলো শুনে রোজার কাশি ওঠে গেল। সবকিছু যেন ডায়েরিতে নোট করে রেখেছে ও। কখন কি করছে না করছে এসব আদ্রিশ কীভাবে জানলো? ও তো বাড়িতেই থাকে না। রাতের বেলা আদ্রিশ যখন বাড়ি ফিরে তখন বাড়ির অর্ধেক লোক-ই ঘুমে বিভোর থাকে। তাহলে? রোজাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় কাশতে দেখে আদ্রিশ হাতের কাছে থাকা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ফিনিশ ইট।’
রোজা অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে পানির বোতলে চুমুক বসায়। নিজেকে সামলিয়ে বোতলটা টেবিলের ওপর রেখে দেয়। তখন সূর্য ডুবে চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। ছাদের চারিধারে ফিট করা চারটা বাতি একসঙ্গে জ্বলে ওঠলো। হলদেটে আলোয় ছেয়ে গেল পুরো ছাদ। গাছের পাতার রঙ পালটে গেল, ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠলো। মসজিদ থেকে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠের মাগরিবের আযান। আদ্রিশ রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘রিলাক্স?’
প্রতুত্তরে রোজা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে সায় জানালো, ‘ঠিক আছি।’
আদ্রিশ কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘নিচে যাও। আর লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, যদি লুকোচুরি করার চেষ্টা করো তাহলে এই একমাস যেভাবে শান্তশিষ্ট রুপে দেখেছো, তারচেয়ে দশগুণ উগ্রতা দেখতে পাবে আমার মধ্যে। আমার ভাগের সবকিছুর অধিকার যেন আমারই থাকে, অন্য কেউ যেন সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে মাই গার্ল!’
রোজা চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হাত-পা ঘেমে ওঠলো। শক্ত কাঠ হয়ে বসে রইল। কর্ণকুহরে কোনো শব্দ-বাক্য ভুল করে ঢুকে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে ওর। আচমকা আদ্রিশ নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠে পড়লো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে রোজার মুখোমুখি অন্য আরেকটি চেয়ারে বসে পড়লো। কোর্টটা টেবিলের ওপর রেখে রোজার গায়ের পাতলা শালটা টেনে মাথায় ওঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘হরিণীদের এভাবেই মানায়। প্রসাধনবিহীন স্নিগ্ধ চোখমুখ, এলোমেলো চুলে। ললাটের ভাঁজে আর কপোলের রক্তিম আভায়!’
রোজা বিস্ময়ে বিমূঢ়। কি করছে আদ্রিশ? কি হচ্ছে এসব ওর সাথে? অনেক কষ্টে ঢোক গিলে রোজা শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলছেন আপনি?’
আদ্রিশ চেহারায় কাঠিন্য ভাবটা বজায় রেখে বিগলিত কন্ঠে বলে ওঠলো, ‘এতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম নিজেকে বুঝার জন্য। আজকের এই বিকেলটার জন্য।’
রোজা হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘ম মানে?’
আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘হরিণীদের বেশিকিছু বোঝাতে নেই। তাঁরা সবসময়ই নিষ্ঠুর, নির্দয়। তাঁরা অনুভূতি বোঝে না, ওদের বোঝার ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ। কেউ তাঁদের চোখের সামনে পাণিপ্রার্থী হয়ে পড়ে থাকলেও সেটা তাঁদের চোখে ধরা পড়ে না।’
ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না রোজা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিয়ৎক্ষণ। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না। আদ্রিশ সেটা বুঝতে পেরেই ধমকের সুরে বলে ওঠল, ‘তুমি নিজেকে যতই গর্তে লুকিয়ে ফেলতে চাও না কেন, আমি ঠিকই গর্ত থেকে বের করবো, দরকার পড়লে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনবো। তুমি চেনো না আমাকে। কি কি করতে পারি সেটাও তোমার মতো ষ্টুপিড আন্দাজ করতে পারবে না। আজকের এই কথাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করবে, ওকে? এখন যাও।’
রোজা দ্রুতগতিতে সেখান থেকে চলে এলো। হাত-পা ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। বেশিকিছু বোধগম্য না হলেও আদ্রিশ কীসের ইঙ্গিত করেছে বিষয়টা ওর কাছে স্বচ্ছ জলরাশির ন্যায় পরিষ্কার। খালার বাড়ি পড়াশোনা করতে এসে যদি এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, আর বাবা-মা যদি জানতে পারে তাহলে ওরা ঠিক কতটা কষ্ট পাবে, অপমানিত বোধ করবে সেটা কি রোজা কাউকে বোঝাতে পারবে? নাকি আদ্রিশ বোঝার চেষ্টা করবে? কিন্তু লোকটা তো নিষ্ঠুর, নিজের মতো করেই এসব ভেবে বসে আছে, রোজার কথা তো একবারও ভাবলো না!
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
সূর্যরশ্মির তির্যক আলোকপাতে উজ্জ্বল ধরণী। গাছের পাতার ওপর ঝিরিঝিরি রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠেছে। ঘাসের ওপর টুকরো রোদ সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েকগুণ। বারান্দায় বসে একটা উপন্যাসের বই পড়ছিল রোজা। বই পড়তে পছন্দ করে না ও, কিন্তু আজ কেন জানে না এই কাজটায় স্বস্তি লাগছে ওর। তখনি হন্তদন্ত পায়ে একপ্রকার ছুটে এলো ফিহা। রোজার মনোযোগে বিঘ্নতা ঘটলো। ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো ফিহার মুখপানে। উৎফুল্ল ফিহা রোজার মুখোমুখি টুলটাতে পা তুলে বসলো। খুশি খুশি কন্ঠে বলল, ‘কী করছিস রোজা?’
রোজা নিঃশব্দে বইটা বন্ধ করলো। কোলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, ‘কিছু করি না। কোনো প্রয়োজন?’
‘হ্যাঁ।’
রোজা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। ওর কাছে ফিহার আবার কী প্রয়োজন থাকতে পারে বোধগম্য হলো না। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই ফিহা বলে ওঠল, ‘আজ তো ছুটির দিন। সবাই মিলে চল বাইরে ঘুরতে যাই।’
ফিহা ভেবেছিল রোজা কথাটা শুনে খুশি হবে। কিন্তু ওর চিন্তাধারা ভুল প্রমাণিত হলো। কাল রাত থেকেই রোজা কেমন মনমরা হয়ে আছে। কথাও বলছে না কারো সাথে ঠিকমতো। সকালে খাবারও খায় নি। রোজার মধ্যে বাইরে যাওয়ার কোনো প্রবণতা দেখতে না পেয়ে ফিহা আশাহত হলো। তারপর বিষন্ন গলায় বলল, ‘চল না রোজা। তুই গেলে আমাদের ভালো লাগবে।’
রোজা নত কন্ঠে বলল, ‘আমি যাব না আপু।’
ফিহা প্রশ্ন করলো, ‘কেন যাবি না?’
‘ভালো লাগছে না।’
ফিহা ওর গালে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ তোর? কিছু হয়েছে? কাল থেকেই তোকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে। কি হয়েছে বল না।’
‘আমার কিছু হয় নি আপু। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে বাড়িতে যাওয়া হয় নি। আমি বাড়ি থেকে কিছুদিন ঘুরে আসতে চাই।’
‘কিন্তু এখন তোর ভার্সিটি খোলা। যাওয়াটা ইম্পসিবল। ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাসগুলোতে এ্যাটেন্ড করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো কিছুই বুঝতে পারবি না। এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। তুই না-হয় রমজানের ছুটিতে গিয়ে ঘুরে আসিস।’
রোজা প্রতুত্তরে কিছু বললো না। কিছুই ভালো লাগছে না। কারো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। আদ্রিশের কথাগুলোর মর্মোদঘাটন করতে করতে নিজের ওপরও বেশ বিরক্ত হলো রোজা। লোকটার জন্য ওর মনে কোনো অনুভূতি নেই। ওর চেহারাটুকু পর্যন্ত দেখতে চায়-না। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত কাটানো যেন শত সহস্র বছর কারাগারে বন্দীনি হয়ে থাকার সমতুল্য। ভাবনার প্রহরে ঘুরে বেড়ানো মস্তিষ্কটা নির্মল চিন্তাভাবনা করার কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। এর মধ্যেই ফিহা ওঠে দাঁড়ালো। রোজার হাত টেনে ধরে চেহারায় কাঠিন্য ভাব ফুটিয়ে তুলে আদেশসূচক কন্ঠে বলল, ‘এখন ওঠ। বাইরে যেহেতু যাবো বলেছি, তোকে নিয়েই যাব।’
রোজা নিভলো। ফিহার এই কন্ঠটা ওর পরিচিত। তারপর ভাবলো, বাড়িতে বসে থেকে মনের ভেতর আদ্রিশের কথাগুলোই ভেবে চলেছে একনাগাড়ে। বাইরে গেলে হয়তো সাময়িকের জন্য এসব ভুলে থাকতে পারবে। মনটাও হালকা ফ্রেশ হবে। নিজের মন ভালো করার জন্য হলেও একবার বাইরে ঘুরাঘুরি করা দরকার। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রোজা তপ্ত শ্বাস ফেলে তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আর কে যাবে? আমি আর তুমিই?’
‘ইশা-নেহা আপু ওরা যাবে।’
রোজা জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কোথায় যেতে চাও?’
ফিহা ওর হাতটা ছেড়ে দিলো। টুলটাতে বসে কিছু একটা চিন্তা করে বলল, ‘আসলেই তো! এটা তো ভেবে দেখে নি। আচ্ছা তোর কোনো চয়েজ আছে? কেমন টাইপ জায়গা পছন্দ তোর?’
রোজা দু-সেকেন্ড ভাবলো। তারপর বলল, ‘গাছগাছালি বেশি এমন টাইপ জায়গা? অথবা, নদীর পাড়?’
ফিহা সাথে সাথেই বলল, ‘তাহলে রমনা যাই? রমনার বটমূল?’
রোজা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আমি তো আগে যাই নি। তোমরা যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব।’
‘তাহলে জলদি তৈরি হয়ে নে।’
‘আচ্ছা!’
ফিহা ওঠে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে আবার উলটোপথে ফিরে এলো। সচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর অফ-হোয়াইট রঙের জামা আছে না একটা? ওটা পরিস!’
‘কেন?’
ফিহা চোখ টিপে হেসে বলল, ‘তোকে ওই রঙের জামা’তে বেশি সুন্দর দেখায়। একদম পুতুলের মতো।’
————————–
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবীলোক। ঝিরিঝিরি আরামদায়ক উষ্ণ হাওয়া বইছে। নয়নাভিরাম সবুজ বৃক্ষরাজির বুকজুড়ে হাঁটছে চারজন। নেহা-ফিহা-ইশা এবং রোজা। তাঁদের পরণে একই ডিজাইনের ভিন্ন ভিন্ন রঙের সালোয়ার-কামিজ। অবশ্য রোজা হিজাব পরিহিত। মুখে তেমন কোনো প্রসাধনের ব্যবহার নেই। সাদামাটা সাজগোজে ওকে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছিল। ইশা আর ফিহা দু’জন সামনে। একসাথে কথাবার্তা বলতে বলতে হাঁটছে। ওদের থেকে কয়েক কদম পিছনে নেহা-রোজা। সামনের দু’জন মানবীর ওদের দিকে কোনো খেয়ালই নেই দেখতে পেয়ে নেহা বিরক্তির সুরে বলে ওঠল, ‘দেখেছিস রোজা? আমাকে কী জোরজবরদস্তি করেই না আনলো, এখন আর চেনেই না? নিজেরা নিজেরা কী সুন্দর গল্প জুড়ে দিয়েছে। এই ফিহা-টা আমার বোন? এত বজ্জাত কেমনে হলো?’
রোজা আলতো হেসে বলল, ‘আমাকে একপ্রকার হুমকি দিয়েই এনেছে। এখন দেখি চেনে-ই না।’
নেহা কটমট করে বলল, ‘দুইটা শাকচুন্নি। ফিহা তো আস্ত বজ্জাত। বাড়ি ফিরে যদি আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে বিচার না দিই তো আমি নেহা না।’
আদ্রিশের নাম শুনে ঢোক গিললো রোজা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। পা দুটো থমকে গেল। মাথার ভেতর নড়াচড়া দিয়ে চিন্তাভাবনার জটগুলো আবারও খুলে বসতে চলেছে। রোজা চোখদুটো বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। ওকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নেহাও থমকালো। ভ্রু-কুটি করে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো সমস্যা?’
রোজা ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আপু আর হাঁটতে পারছি না শ্রীঘ্রই একটা বসার ব্যবস্থা করে দাও।’
‘বসবি?’
রোজা মাথা নাড়ালো। নেহার নিজেরও পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে। বিকেলটাও মরে এসেছে। আর কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে বাড়ি রওয়ানা দিতে হবে। নেহা হতাশ হয়ে উচ্চস্বরে ডাকলো ইশা-ফিহা’কে। ওরা দু’জন গল্পে এতটাই মগ্ন ছিল যে আচমকা নেহার ডাক শুনে চমকে ওঠলো। তড়িঘড়ি করে দুজনেই ছুটে এলো। অতঃপর নেহার কাছে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
নেহা বোনদের ওপর বিরক্ত হলো খুব। রেগে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল, ‘কখন থেকে হেঁটেই যাচ্ছি, এবার তো একটু বসি। আর তোরা দু’জন কী নিজেরা নিজেদের মতো গল্প করতেই এসেছিস? তাহলে আমাদের দু’জনকে কাবাব-মে-হাড্ডি বানানোর প্রয়োজন কী ছিল?’
রাগে নেহার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। ফিহা উত্তেজিত স্বরে বোনকে কিছু একটা বলতে নিলেই পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য ইশা ওর হাত ধরে থামালো। আলতো হেসে বলল, ‘রিলাক্স নেহা আপু। আ-ই এক্সট্রিমলি সরি। আসলে গল্পে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, মাথাতেই ছিল না তোমাদের কথা। আচ্ছা, চলো বসি। এখানেই বসব?’
নেহা রাগ সংযত করে বলল, ‘হুম।’
বিশালাকৃতির একটি রেইনট্রি গাছের নিচে ঘাসের ওপর পাতা বিছিয়ে ওরা বসলো। খানিক দূরেই বন্যঝোপ, ঘন ঘাস, লতাগুল্ম। মৌসুমি ফুলে ছেয়ে আছে কিছু সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষ। সারিবদ্ধভাবে লাগানো রয়েছে মেহগনিসহ নানা জাতের গাছ। উত্তর পাশ লাগোয়া হেয়ার রোডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাদাউক গাছ। এসবের ভিড়ে কিছু ঔষধি গাছও দেখা যাচ্ছে। পার্কের মধ্যিখানে বহুকালের পুরোনো একটি মহুয়াগাছ। দিনের শেষভাগে অনেকেই পরিবার নিয়ে হাঁটতে এসেছে, কেউ এসেছে শরীরচর্চা করতে। চারদিক নিরবে-নিভৃতে জানান দিচ্ছে রমনার বৈচিত্র্যতা। রোজা মুগ্ধ চোখে অবলোকন করছিলো চারপাশের স্নিগ্ধতা। হঠাৎই ওর চোখে পড়ে কয়েক হাত দূরের একটি ঝোপে। জংলিফুলে ঘেরা ঝোপটির আড়ালে বসে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। ততক্ষণে সূর্য লুকিয়েছে ধরণীর বুক থেকে। আশপাশটা টিমটিমে আঁধারে ঢেকে আছে। রোজা উদাসীন মনোযোগে বোনদের আলাপচারিতা শুনে যাচ্ছিলো। কিন্তু না চাইতেও রোজার দৃষ্টিজোড়ায় ধরা পড়লো ঝোপের আড়ালে বসে থাকা যুগলবন্দী ওই প্রেমিক-প্রেমিকার কর্মকাণ্ডে। ওদেরকে নিষিদ্ধ কার্যে লিপ্ত হতে দেখেই রোজা মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। বিস্মিত, লজ্জিত, কুন্ঠিত রোজার গা কাঁপতে লাগলো। এত সুন্দর, মনোমুগ্ধকর একটা পাবলিক প্লেসে এরকম বিশ্রি, ঘৃণিত কাজটি করতে ওদের লজ্জা করলো না? এখানে কি এসবই হয় নাকি? রোজা এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাইলো না৷ সটান ওঠে দাঁড়ালো। বাকি তিনজন হতবিহ্বল হয়ে ওর মুখপানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওঠে দাঁড়ালি যে?’
রোজা ইশারায় ঝোপের আড়ালটা দেখিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘এরকম বিশ্রি পরিবেশে আমাকে নিয়ে আসলে কেন আপু? আমি এক্ষুনি এখান থেকে যেতে চাই।’
সবাই ঘটনাটি বুঝতে পারলো। ফিহা রাগের চোটে গালাগালি আরম্ভ করল, ‘এই কু* জন্যই কোথাও গিয়ে বসা যায় না। আরে তোদের যখন এতই প্রেম তো বাড়ি গিয়ে করিস না! রাস্তাঘাটে এসব ছ্যাছড়ামির মানে কী? বাড়িঘর নেই? ফক্কিনি, বেহায়ার দল কোথাকার..’
নেহা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘চুপ। চল এখান থেকে।’
এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছে মুহূর্তেই। রাস্তায় কোনো রিকশা বা ক্যাব পাওয়া গেল না। ফিহার মেজাজ চটে গেল, রোজাও বেশ বিরক্ত। এত বিরক্ত এর আগে কোনোদিন অনুভব করে নি। মস্তিষ্ক এসব আর নিতে পারছে না। ওদিকে গাড়িটাড়ি না পেয়ে নেহার কথায় ফিহা তৎক্ষনাৎ ফোন বের করে কাকে যেন কল করে ওদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো, রোজা সেটা বুঝতে পারলো না। এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে লম্বা ঘুম প্রয়োজন ওর।
কিছুক্ষণ ফুটপাতেই কেটে গেল ওদের। আচমকা সাঁই করে একটি গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে। রোজা ভড়কে গেল। যেভাবে গাড়িটা ব্র্যাক কষেছে তাতে এক্সিডেন্ট হওয়াটাও দোষের কিছু না। রোজা রাগ রাগ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখনি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আদ্রিশ। রোজা থমকালো। পূর্ণ দৃষ্টিতে গাড়িটা দেখে নিয়ে হতাশ হলো ও। অন্ধকারে ঠিকঠাক বুঝতে পারে নি, এটা আদ্রিশের-ই গাড়ি। ও এখানে কেন? ফিহা ওকেই ফোন করেছিল নাকি? তার মানে এখন এই লোকটার গাড়ি করেই বাড়ি ফিরতে হবে? রোজা আপনমনে বিড়বিড় করলো, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়। ওফফ…রোজা! কী হচ্ছে এসব তোমার সাথে? যার কাছ থেকে পালাতে চাও, তাঁর-ই খাঁচায় বারবার বন্দী হও?’
‘এক্সকিউজ মি। তোমাকে কী কোলে তুলে গাড়িতে বসাতে হবে মাই গার্ল?’
আদ্রিশের তীব্র কন্ঠে রোজার ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। সচকিত দৃষ্টি মেলতেই রোজা ব্যক্কল বনে গেল। নেহা-ফিহা-ইশা তিনজনই গাড়িতে ওঠে বসে আছে এবং তিনজনই সবগুলো সিট ফিলাপ করে বসেছে। রোজার জন্য একফুট জায়গা অবধি ফাঁকা রাখে নি। নেহা জানালা দিয়ে বাইরে মাথাটা এনে হাত নেড়ে ব্যস্ত কন্ঠে রোজাকে বলল, ‘এই রোজা৷ এখানে তো আর জায়গা ফাঁকা নেই। তুই ভাইয়ার সাথে সামনে বসে যা।’
রোজা তড়িঘড়ি কন্ঠে জবাবে বলল, ‘আমি সামনে বসতে পারবো না আপু৷ তুমি এসে প্লিজ বসো।’
নেহা বলল, ‘সামনে বসলে আমার মাথা ঘুরায়। প্লিজ বসে যা।’
ফিহা আর ইশাও একযোগে বলে ওঠল, ‘আরে ভাইয়া, গাড়ি স্টার্ট করো। রাত হয়ে এসেছে, তাড়াতাড়ি না ফিরলে বকা শুনতে হবে।’
ওদের কথা শুনে আদ্রিশ রোজার দিকে তাকালো। পিচঢালা ফুটপাতে সোডিয়ামের নিভু নিভু আলোর নিচে অফ-হোয়াইট রঙের জামায় আবৃত মেয়েটিকে দেখে ধাক্কা খেল যেন। ওর প্রিয় রঙ। হৃদপিন্ডের কাঁপুনিটাকে থামিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে এসে স্বর নামিয়ে বলল, ‘আমার সাথে না বসার বাহানা করে লাভ নেই। বাকি জীবনটা আমার পাশে বসেই কাটাতে হবে। সো রাইট নাও…’
রোজা তেজদীপ্ত কন্ঠে বলল, ‘বসবো না আপনার সাথে।’
আদ্রিশ চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘বোবা’র মুখে কথা ফুটেছে। কোলে তুলেই নিয়ে যেতে হবে দেখছি।’
রোজা এক ঝটকায় ওর হাতটা ছেড়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আমার হাত-পা ঠিক আছে। আমি নিজেই বসতে পারি।’
বলেই আদ্রিশের ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসে পড়লো যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। আদ্রিশ যখন এটা দেখলো রাগে ওর চোয়াল শক্ত করে ফেলল। মেয়েটা দরজার সাথে এমনভাবে এঁটে বসেছে যেন বসার জায়গা নেই। কি প্রুফ করতে চায় এমন করে? পেছনে ছোটবোন গুলো থাকায় সে কিছু বলতেও পারছে না। রোজা ওর দিকে তাকাচ্ছেও না। এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। আদ্রিশ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘বাড়াবাড়িটা পছন্দ হচ্ছে না।’
রোজা নিচু স্বরে বলল, ‘আমারও না।’
আদ্রিশ রক্তিম চোখে তাকালো, ‘ভুগতে হবে এরজন্য।’
‘আপনাকে।’
————————————