অন্তরালের কথা পর্ব ১৮

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৮
.
.
” অনেক কথা বলে ফেলেছি এবার যাও গোসলটা সেরে ফেলো। অবশ্য এমনিতেও শরীরের ঘাম দিয়ে একবার গোসল করেছ এখন না’হয় ঠান্ডা পানি দিয়ে আরেকটি বার গোসল করবে। হা হা… ”
অতলের হাসির সাথে তাল মিলাতে তানহাও মুচকি হাসলো। তারপর বিছানা থেকে উঠে আলমারি থেকে সুতি গোলাপী রঙের শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে নিলে অতল বলে উঠল,
” ও তোমাকে তো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি। তোমার আব্বু কল করেছিল। ”
” কেন? ”
” কেন! এটা কিরকম প্রশ্ন? তুমি তাদের একমাত্র সন্তান তোমার কাছে কল দিবে না তারা! ”
” আমি ঠিক সেভাবে বলিনি। আমার কথার অর্থ ছিল কি কারণে কল দিয়েছে?”
” ও তাই বলো। ”
” হুম। ”
” বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তখন মোড়ের দিকে গিয়েছিলাম তাই তোমাকে দিতে পারিনি। আর বাড়িতে এসে তো ভুলেই গিয়েছি। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে এর থেকে বেশি দেরি হওয়াটা খুব বাজে দেখায়। তাই বলছিলাম তুমি গোসল করার আগে যদি বাবার সাথে কথা বলতে ভালো হতো। ”
“সমস্যা নেই, পড়ে কথা বলে নেব।”
“না না, এখনি বলে নাও। বাবা হয়তো বসে আছে তোমার একটা ফোনের অপেক্ষায়।”
” সমস্যা নেই, বাবা টা’তো আমার আমিই না’হয় বুঝিয়ে বলব। আপনি এই নিয়ে টেনশন করবেন না। ”
আর অপেক্ষা করলো না তানহা সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। অতলের ব্যাপারটা ভীষণ রকম অস্বাভাবিক লাগল। যেকোনো মেয়েই বাবা-মায়ের কথা শুনলে লাফিয়ে উঠে আর সে জায়গায় তানহা কত শান্ত গলায় কথা বলে চলে গেল। তাও আবার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও।
অতল বিষয়টি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত থাকলেও চিন্তাটি দীর্ঘস্থায়ী করতে হলো না। এর মাঝেই তার ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। অতল বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে যেতেই দেখে বাবা দাঁড়িয়ে। তাই বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” বাবা, তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো। ”
” হুম, ভেতরে আসবো বলেই তো এসেছি। চল, ভেতরে চল। ”
অতল ও বাবা দুজনেই বিছানায় বসল। অতল কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা আনিস খন্দকার বলে উঠলেন,
” তো কি ভাবলি? কী কী আয়োজন করবি কাল? ”
” কাল আয়োজন! কিসের আয়োজন বাবা? ”
” এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন অতল? এটা কিন্তু আমি তোর কাছ থেকে মোটেও আশা করিনি। কাল তোদের বৌ ভাতের অনুষ্ঠান আর আজকে তুই বলছিস কিসের আয়োজন! ”
” ওহ্ হো! আমি তো একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম বাবা। আসলে বিয়ের রাত থেকে এতো ঝামেলার মাঝে ছিলাম এসব নিয়ম কানুনের কথা একেবারেই মনে নেই। ”
” তাও ঠিক।যা ঝড় বয়ে গেল আমাদের উপর দিয়ে মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। তো বল কি কি আয়োজন করবি? আর কাদের কাদের আসতে বলবি? ”
” কাল বৌভাত আর আজ ইনভাইট করলে কেমন দেখায় না বাবা! ”
” কেমন দেখানোর কি আছে? সবাই তো জানে বিয়েটা হুট করে হয়েছে। তাই বৌ ভাতের অনুষ্ঠানও যে হুট করে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ”
” হুম, তো বলো কিভাবে কি করবে? ”
” আমি কি বলবো, তোর কথাই তো আমার কথা। তুই ঠিক কর কি করবি। ”
” বাবা বলছিলাম যে, তিহান বাসায় আসার পর প্ল্যানিং করলে কি ভালো হয় না? ”
” ও আসতে আসতে রাত হবে। আর সেসময় অবশ্যই কাউকে ইনভাইট করার উপযুক্ত সময় না। তাই না৷? ”
” হুম, আচ্ছা তবে আমরা দুজন মিলেই সবকিছুর লিস্ট করে ফেলি। পড়ে নাহয় ওকে দিয়ে একবার চেক করিয়ে নেব যদি কেউ বাদ পড়ে থাকে সেজন্য। ”
” সে করতেই পারিস। ওর ও তো কিছু বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে। তাই ওকে একবার দেখিয়ে নিলেই ভালো হবে। ”
” হুম সেজন্যই। ”
” তো বল কিভাবে কি হবে? ”
অতল একে একে সবকিছু তার বাবাকে বলছে কিন্তু সিলেক্ট করছে না। বাবার সায় পেলেই খাতায় লিপিবদ্ধ করছে। প্রায় মিনিট বিশেকের মাঝে তাদের সব লিস্ট পূরণ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় ফোনের মাধ্যমে তাদের অত্যন্ত কাছের ও সমাজের বেশ কয়েকজন মানুষকে ইনভাইট করা। এরই মাঝে গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হয় তানহা। ঘরের মাঝে হুট করে শ্বশুরকে দেখে ধীর গলায় সালাম দিয়ে আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বারান্দার দিকে চলে যায় কাপড় ছড়াতে। বারান্দা থেকে ফিরে শ্বশুরের সাথে দাঁড়িয়ে অতলের হাতে থাকা লিস্টের দিকে তাকাতেই অতল বলে উঠল,

” এদিকে না দাঁড়িয়ে যাও তোমাদের বাড়িতে কল দাও। মাত্র তোমার বাবা’র সাথে আমার বাবা’র কথা হয়েছে। উনি বসে আছেন তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তাই সময় নষ্ট না করে যাও দ্রুত ফোন দাও। ”
তানহা আর একটি কথাও বলল না অতলের ফোনটি নিয়ে ঘরের বাহিরে চলে গেল।
কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে তানহা বুঝতে পারছে না। তাই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে ছাদে চলে গেল। মোবাইলে নাম্বার তুলতে তুলতে একেবারে ছাদের কর্নারে গিয়ে দাঁড়ায়। তানহা ফোন ডায়াল করে কানের কাছে তুলতেই মুহূর্তের মাঝে ফোন রিসিভ করে উত্তেজিত কন্ঠে তানহার বাবা জামাল সাহেব বললেন,
” হ্যালো তানহা! ”
” হুম বাবা, বলো? ”
” কেমন আছিস মা? বাড়ির সবাই কেমন আছে? ”
” ভালো। তোমরা কেমন আছো? ”
” তোকে ছাড়া কি আমরা ভালো থাকতে পারি? ”
” বুঝলাম। ”
” এই বাবা’টার কথা বুঝি মনে পড়ে না? সেই যে পরশু গেলি তারপর একটি বারের জন্যও তো ফোন দিয়ে খবর নিলি না। তোর মা তো কেঁদে কেটে অস্থির শুধুমাত্র তোর কন্ঠটি শোনার জন্য। ”
” এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? তোমরা তো একপ্রকার জোর করে আমাকে বিদায় করেছ তাহলে এখন কেন এতো অস্থিরতা? ”
” তানহা! এসব কি বলছিস মা? তুই….”
” মা’কে ফোনটা দাও বাবা। আমার জরুরী কিছু কথা আছে মায়ের সাথে। ”
” আচ্ছা বেশ, আমি দিচ্ছি তুই লাইনেই থাকিস। ”
তানহা ফোনটি কানে ধরে তাকিয়ে আছে ছাদের কোণে স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে বেড়ে ওঠা ছত্রাকের দিকে। আর ভাবছে তার জীবনের ঘটে যাওয়া সকল চক্রাকারের কথা। এমনসময় তানহার মা তাহমিনা বেগম ক্ষানিকটা জোরে বলে উঠলেন,
” হ্যালো, হ্যালো! তানহা! তুই কি শুনছিস আমার কথা? ”
মায়ের জোড়ালো কন্ঠ কানে এসে লাগতেই তানহার ধ্যান ভেঙে গেল। আর শান্ত গলায় বলল,
” হুম, শুনছি। ”
” কোথায় গিয়েছিলি ফোন রেখে? সেই কখন থেকে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি তোর কোনো সাড়াশব্দই নেই। ”
” কোথাও যাইনি এখানেই ছিলাম। ”
” তাহলে উত্তর দিচ্ছিলিস না যে? ”
” খুব সুখে রেখেছ তো তোমরা আমাকে তাই আর কি। ”
তানহার কথা শুনে তার মা বেশ ভয় পেয়ে যায়। এমনিতেই মেয়ের অমতে বিয়ে তারউপর এসব কথা যেন তাকে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আবাশ দিচ্ছে। চোখ মুখ কুচকে তাহমিনা বেগম বললেন,
“কী বলছিস তানহা? এভাবে কথা বলছিস কেন, কি হয়েছে তোর? সবকিছু ঠিক আছে তো? ”
নিজেকে শক্ত রাখার শত চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হলো না তানহার। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কিচ্ছু ঠিক নেই মা, কিচ্ছু ঠিক নেই। তোমরা ভালো করতে চেয়েছিলে না আমার? সুখে দেখতে চেয়েছিলে না আমায়? কিন্তু পারো নি তোমরা। কারণ আমার কপালে যে সুখ নেই। সুখ নামক বস্তুটাকেই যে জন্মের সময় সাথে করে নিয়ে আসিনি আমি। নাহলে কি আজ এই নরকে আমায় পরতে হতো? হতো না, কখনোই হতো না। তোমরা ভালো করতে গিয়ে যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলেছ। যে ক্ষতির দায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমায় বহন করে যেতে হবে। যে ক্ষতির মাশুল আজীবন আমায় দিয়ে যেতে হবে। আর বেঁচে থাকতে হবে এই তীব্র দাবদাহ জীবনে।”
” তুই এসব কি বলছিস তানহা? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। ”
” তোমরা বিয়ের কথাবার্তার সময় খোঁজ নিয়ে দেখেছিলে ছেলেরা কয় ভাই-বোন?”
” হুম, তোর বাবা জিজ্ঞেস করেছিল তো। জামাই’রা তো দু’ভাই। কোনো বোন নেই জামাইদের। ”
” হুম, সেই একমাত্র ভাইটি যে কে তা কি একবারের জন্য হলেও দেখেছিলে কিংবা তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলে? ”
তানহার করা প্রশ্নটি শুনেই তানহার মায়ের বুকটি মোচড় দিয়ে উঠল। এক অজানা ভয়ের কারণে মুখ দিয়ে টুশব্দটি বের হচ্ছে না।
এদিকে মায়ের নীরবতা দেখে তানহা কাঁপা গলায় বলল,
” থাক তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলে দিচ্ছি। সেই সাথে তোমার উত্তেজনাও কমিয়ে দিচ্ছি। ”
তানহা কিছুক্ষণ থেমে রইলো। বুকটা যে ভীষণ ব্যাথা করছে। নিঃশ্বাস নিতেও তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল পড়ছে। চোখ দুটো বন্ধ করে স্থির গলায় তানহা আবারও বলল,
” হ্যাঁ মা, তুমি যেটা এই মুহূর্তে ভেবেছ সেটাই আমার জীবনে ঘটেছে। তিহানই একমাত্র ছোট ভাই অতলের। ”
কথাটি শোনামাত্র তাহমিনা বেগমের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। আর টপটপ করে চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে আরম্ভ করলো। মেয়েকে কি বলে বুঝ দিবে ভেবে কুলাতে পারছে না সে। তাদের একটি সিদ্ধান্তে মেয়েটির জীবনে এরকম অভিশাপ নেমে আসবে জানলে হয়তো কখনোই তারা এরকম যন্ত্রণাময় কূপে মেয়েকে ঠেলে দিত না।
কোনো কথা না বলে লাউড স্পিকার বন্ধ করে আস্তে করে ফোন কেটে দিল তাহমিনা বেগম। আর পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে জামাল সাহেব চোখ দুটো বড় বড় করে বুকের বাম পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো এখুনি ঢলে পড়বে মেঝের বুকে। তাহমিনা বেগম মোবাইলটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে ঝাপটে গিয়ে ধরতে যায় জামাল সাহেবকে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি সে। সে আসার আগেই যে জামাল সাহেব মেঝেতে ধাপ করে পড়ে যায়। সে ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে জামাল সাহেবকে আর বুঝতে চেষ্টা করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারা কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস যে উঠানামা করছে না। বলতে গেলে একেবারে থেমে আছে। তাহমিনা বেগমের যে দিশেহারা লাগছে সবকিছু। গলা কাঁপছে, চোখ ভরে আসছে সে পারছে না নিজেকে সামলাতে। তাইতো এক চিৎকার দিয়ে এ ভুবনকে জানান দিল তার জীবনসঙ্গী তাকে একা করে দিয়ে এ ভুবন থেকে চিরবিদায় নিয়ে, না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।
এদিকে তানহা কান থেকে মোবাইল নামিয়ে বেশ খানিকটা সময় ধরে তাকিয়ে থাকে কদমফুলে সমৃদ্ধ গাছটির দিকে। আর ডুবে যায় সেই পুরনো সুখময় স্মৃতিতে। তবে সেই স্মৃতিতে বেশিক্ষণ আনাগোনা করতে পারে না তানহা। পেছন থেকে যে কেউ একজন তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে।

তবে সেই আলতো করে ছুঁয়ে দেয়াটাই তানহার বেশ ভারী লাগল।কেবল….কেবলই তার মা’কে বলা কথাগুলোর জন্য। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখে অতল গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তানহা বেশ ঘাবড়ে যায়! তাই ডুব গিলে চোখ দুটো বড় করে মনে মনে ভাবল,
” অতল এখানে কি করে এলো? সে তো অতলকে বলে আসেনি তাহলে বুঝল কি করে সে ছাদে? আচ্ছা, অতল তার মা’কে বলা সব কথা শুনে ফেলেনি তো! ”
চোকমুখ কুচকে একবার জিহবা কামড়িয়ে তো একবার ঠোঁট কামড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিল তানহা। ঠিক তখনি অতল তানহার দু’কাঁধে ধরে কিছুটা ঝাঁকি দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
” কী ব্যাপার কি ভাবছ এতো? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
অতলের স্বাভাবিক কথা বলার ধরন দেখে তানহার যেন প্রাণ ফিরে এলো। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুটা তোতলিয়ে বলল,
” আ..আপনি কখন এসেছেন ছাদে? ”
” এইতো মাত্রই এসেছে। ২ মিনিটও হয়তো হয়নি কিন্তু কেন?
তানহা চোখ দুটো বন্ধ করে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” না মানে এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। তো হুট করে ছাদে আসলেন যে আর আপনি জানলেনই বা কি করে আমি ছাদে? ”
” আমি আবার জানবো কোথা থেকে তুমি কি কিছু বলে এসেছ? কিছুই তো বলে যাওনি। অবশ্য সেই পরিস্থিতিটাও ছিল না। তাই আমি বাড়ির প্রতিটি ঘরে চেক দিতে দিতে অবশেষে ছাদে এসেই তোমায় পেয়েছি। ”
” ও আচ্ছা। ”
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here