গল্প:#অপ্রত্যাশিত_ভালোবাসা
লেখক:#কাব্য_মেহেরাব
পর্ব:০২
রক্তের লহু গড়িয়ে পড়ছে আমার নাক কান চোখ দিয়ে। আমিতো পাশেই পরে আছি। কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষটি জানালার কাচ ভেদ করে ব্রিজের ওই পাশে ছিটকে নদীতে পড়ে যায়। কাব্য নামটা আমি উচ্চারণ করতে পারিনি। তার আগে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। জ্ঞান হারায় আমি……….
পিট পিট করে চোখ মেলি। কয়েকবার চোখের ঝামটা মেরে নি। আমি কোথায় বোঝার চেষ্টা করছি। একপাশে দেওয়াল ,মাথার কাছে কোন একটা রুমের দরজা। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখছি কয়েকজন ফ্লোরে শুয়ে আছে। আর আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলছে অগণিত মানুষ। পাশেই আবার হাতে স্যালাইন চলছে আমার। বুঝতে পারলাম আমি হসপিটালে বারান্দায় ফ্লোরে শুয়ে আছি। যেখানে সাদা একটা বেড সিট আর একটা বালিশ ছাড়া আমার কাছে কিছুই নাই।
কয় ঘন্টা, কয় দিন, কয় সপ্তাহ নাকি কয় মাস পরে আমি চোখ মেলে তাকালাম জানিনা। তবে আমি বেঁচে আছি। আশেপাশে তাকিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে চোখে খুঁজছি। এত এত মানুষের কোলাহল মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে নেয়। এই বুঝি কাব্য এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। হঠাৎ কারও হাতের স্পর্শ আমার কপালে পরলো। খুব অপরিচিত এই স্পর্শ এটা। না এই স্পর্শ আমার কাব্যের হতে পারে না। হঠাৎ করে চোখটা মেলে ধরলাম। একজন নার্স আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
নার্স: কেমন লাগছে আপনার এখন..?
আমি: ভালো! আমি এখানে….
নার্স: আপনাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছিল। লোকজন খবর দেওয়া হলে হসপিটাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স যাই এবং সবাইকে উদ্ধার করে।
কাব্যর ছিটকে পড়ে যাওয়া আমার চোখে ভেসে উঠলো। মুহূর্তে আমার চোখের পানি ছল ছল করছে। সবাইকে উদ্ধার করেছে তাহলে কি কাব্যকে উদ্ধার করেছে? তাহলে সে কোথায়? অনেকগুলো প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে আমার মস্তিষ্কে…! আমাকে চিন্তা করতে দেখে নার্স টি বলল..
নার্স: মোটামুটি সবার আসেপাশেই তার বাড়ির লোক আছে। আপনার কোন আইডেন্টি আমরা পাইনি। তাই বাড়িতে খবর দিতে পারেনি। যদি কষ্ট করে এখন একটু বলতেন ,আমরা এখনি খবর দিব তারা চলে আসবেন।
আমি: কাব্য…?
নার্স: আপনি কাউকে খুঁজছেন..?
আমি: হ্যাঁ আমার সাথে ছিল! কাব্য আমার হাজব্যান্ড।(হাসবেন্ড কথাটা বলতে গিয়ে আমার শরীরে এক ঠান্ডা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমি বিবাহিত। আমি আর একা নয়। সারা জীবন আমার হাতটা ধরার জন্য একজন আছে।)
নার্স: আপনি কার কথা বলছেন ঠিক বুঝতে পারছিনা। এখানে যারা বেঁচে আছে সবার পাশে তার বাড়ির লোক আছে। আপনার হাসবেন্ড হলে তো আপনার শ্বশুর বাড়ির লোক আপনাকে দেখে চিনবে। কিন্তু কেউ তো আপনাকে চিনতে পারলো না। আবার কয়েক জন মারা গেছে তাদের পরিবারের লোক আইডেন্টিফাই করে তাদেরকে নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ আপনাকে আইডিটিফাই করতে পারেনি। তাহলে আপনি কার কথা বলছেন?
আমাকে এবং কাব্যকে কেউ আইডেন্টিফাই করতে পারবে না , কারণ এখন আমরা আমাদের জেলা থেকে কয়েকটি জেলা দূরে অবস্থান করছি। যেখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই। আর বাড়ির লোক খোঁজখবর নিবে তেমন লোকও নেই। যা দু একজন আছে যখন জানতে পারবে আমারা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি তারা তো বেঁচে যাবে। অযথা খোঁজ নিতে যাবে কেন। কিন্তু কাব্য গেল কোথায়…?( চিন্তায় কপাল বরাবর ভাঁজ পড়ল কয়েকটি) তখন মনে পরলো কাব্য জানালা ভেদ করে ছিটকে পড়ে যেতে দেখেছি 🥺। তাহলে কি……….? না আর ভাবতে পারছিনা।
আমি: আমি কাব্যকে নদীতে পড়ে যেতে দেখেছি….(কাঁদতে কাঁদতে বললাম) আপনারা সবাইকে উদ্ধার করেছে তাহলে আমার কাব্য কোথায়? বলুন আমার কাব্য কোথায়..?
নার্স: দেখুন ওই সময় নদীতে যদি পড়ে থাকে তাহলে আমরা তাকে পায়নি। মৃত্যুর আহাজারীতে কে কোথায় পড়ে গেছে। সেটা কেউ দেখেনি। আর যদি তিনি পড়েও থাকেন বেঁচে আছেন কিনা সন্দেহ। আজ 18 দিন পর তার সন্ধান কোনভাবেই নেওয়া সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
আমি: কি বলছেন আপনি..?১৮ দিন..? আমার কাব্য? এই 18 দিনে কাব্য কোথায় আছে আপনারা কেউ জানেন না। তাহলে আমাকে জাগাননি কেন? এখন আমি কাব্যকে কোথায় খুজে পাব…?(পাগলের মতো বলেই যাচ্ছি।)
নার্স দূরত্ব ডাক্তার ডেকে আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিলো। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। জ্ঞান ফিরলে আবার পাগলামি শুরু করে দেই। কিন্তু আমার পাগলামি দেখার জন্য কাব্য এই হাসপাতালে নেই। বারান্দায় ফ্লোরে আমার বিছানা হওয়ায় সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। কেউ কেউ আমার চোখের পানি দেখে নিজেদের চোখের পানি ঝরাতো। একসময় আবার শান্ত হয়ে যাই আমি।
আমাকে সুস্থ হতে হবে। কাব্যর জন্য। কাব্যকে আমি কথা দিয়ে ছিলাম হাজার কষ্টের মাঝেও এই চোখের জল আমি ফেলব না। কিন্তু কথাটা কি আমি রাখতে পারব? জানিনা রাখতে পারব কিনা। তবে আমাকে শক্ত হতে হবে ।খুঁজে বের করতে হবে কাব্য কে। আমাকে না পেয়ে হয়তো পাগলের মতন ছুটে বেড়াচ্ছে এদিকে ওদিকে। আমাকেও ব্রিজের কাছে যেতে হবে। কাব্য হয়তো ওই ব্রিজ এর আশেপাশেই আমাকে খুঁজছে।
কিছুটা সুস্থ হয়ে যায় ।মাথার ব্যান্ডেজ কেটে দেয় নার্স। এখন আমি সুস্থ হলে রেস্ট এর প্রয়োজন। ডাক্তার আমাকে রেস্ট নিতে বলেছিল। কিন্তু আমি রেস্ট নিতে নিতে যদি কাব্যকে হারিয়ে ফেলি…?
কয়েকদিন পর আমাকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়। সাথে কিছু টাকা, হয়তো চাঁদা তুলে দিয়েছে আমাকে। আর আমার জন্য পুরাতন এক সেট কাপড় এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমার শরীরে যে কাপড়টা আছে তাতে রক্তের দাগ এবং অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। এই ড্রেসটা পরেছিলাম সেদিন রাতে। কাপড় পালটে হয়তো তারা হসপিটালের কোন কাপড় আমাকে পরিয়ে ছিল।
কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ঠিকানা নিয়ে সেই জায়গায় চলে যায়।
এখন আমি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছি। রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে দেখছি এই পানির গভীরতা কতটুকু। সো সো করে পানির স্রোত বয়ে চলছে। মাঝে মাঝে পানির সাথে পানি বাড়ি খাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত শব্দ। চারিদিকে চোখ ঘোরালাম ব্রিজের পাশে। ছোট একটা গাছের থেকে ডাল ভেঙে আবার দাড়ালাম ব্রিজের মাঝখানে রিলিং ধরে। উপর থেকে সেই ডালটি ফেলে দিলাম। দ্রুত ব্রিজের এই মাথা থেকে অপজিটে গেলাম। কি আশ্চর্য এইমাত্র ফেলতে ফেলতেই ডালটি এই পাশে আসতে যেন এক সেকেন্ডেরও কম সময় নিয়েছে। দেখতে দেখতে তা চোখের আড়াল হয়ে গেল। আচ্ছা কাব্য যদি এই নদীতে পড়ে থাকে সেও কি ওই ডালটির মতন স্রোতে ভেসে গেছে…?
হাতে থাকা সেই পুরাতন কাপড়ের ব্যাগ টা ছুড়ে মারলাম পানি তে। কি আশ্চর্য! ব্যাগ টা চোখের আড়াল হতে যেন কয়েক সেকেন্ডেই যথেষ্ট।
ধুপ করে বসে পড়লাম। কাব্য কোথায় আছে। নাকি সেও স্রোতের সাথে ভেসে চলে গেছে হাজারো চিন্তা মাথায় এসে জরো হচ্ছে। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। একটা ছোট্টো হাসি আমার মুখে এলো বিদ্রুপ করার হাসি যাকে বলে। আমার ক্ষুধা লাগলে কাব্য বুঝে যেত। আর আমার সামনে রুটি আর কলা এনে দিত। যা আমার খুব পছন্দের। এখন তো আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে তাহলে নিশ্চয়ই কাব্য এখনই রুটি আর কলা এনে আমার সামনে দিয়ে বলবে, এই নাও এটা খেয়ে নাও। চোখ বন্ধ করে বসে আছি। এই বুঝি কাব্য এল।ক্লান্ত শরীরে কখন যে ব্রিজের উপর শুয়ে পড়েছি বুঝতেই পারেনি।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারমানে এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। তাহলে কি কাব্য আসেনি রুটি কলা নিয়ে মেঘাকে দিতে? ও বুঝেছি এতদিন সে আমাকে খুঁজে পায়নি বলে অভিমান করে লুকিয়ে আছে। আমার ছটফটানি দেখছে দূর থেকে। ঠিক আছে এটাই স ই।
সামনে দিয়ে বাস চলছে ক্ষণে ক্ষণে। কেউ কেউ মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে আর আমার দিকে কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজেকে একবার দেখলাম। আমার পরনে একটা নোংরা কাপড়। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। পথযাত্রীরা হয়তো ভাবছে আমি কোন পাগল। আসলেই আমি পাগল। আমার কাব্যর ভালোবাসা পাওয়ার পাগল। এই অবস্থায় যদি কাব্য আমাকে দেখে, তুলে সোজা একটা আছার মারবে। শুভশ্রীর মুখটা এমন এলোমেলো ভাবে নাকি মানায় না,কাব্য বলতো। সবসময় পরিপাটি ভাবে গুছিয়ে থাকতে বলে। একদিন আমার পোশাকের ওরনা টা অন্য জমার ছিল। আমাকে রাস্তায় এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখে চোখ দিয়ে যেন ভম্ম করে দিচ্ছিল আমাকে। রাগের কারণ জানতে চাইলে সে বলেছিল ঠিকমতন কাপড়ের মেচিং টাও কি করতে পারো না? আমি বলেছিলাম এই জামার ওড়না টা নষ্ট হয়ে গেছে তাই আরেকটা পড়েছি। পরের দিন সে আমাকে তিনটা থ্রি-পিস কিনে দিয়েছিল তার পছন্দের মতন।
আর আজ আমি এই নোংরা পোশাকে আছি।তার সামনে আমাকে এই অবস্থায় দেখলে আমাকে জাস্ট তুলবে আর একটা আছাড় মেরে ফেলে দিবে। নিজেই হেসে দিলাম।
কারোর শিষ বাজানোর শব্দে আমার ভাবনার ছেদ পরলো। ফিরে তাকিয়ে দেখি ৩-৪ জন বিদ্ধস্ত লোক কেমন কুৎসিত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। আমার অন্তর আত্তা কেঁপে উঠলো।যেন কোনো বিপদের সংকেত বলে মনে হলো। আমার সামনে এসেই, চারিদিক দিয়ে আমাকে ঘিরে ফেললো।চাতক পাখির মতো তাদের দিকে আমি চেয়ে আছি।আর তাদের মনে কি চলছে বুঝার চেষ্টা করছি।
একজন মোটা, কালো গেঞ্জি সাথে লুঙ্গি পরা, পাশের জন একটা ঢোলা প্যান্ট হাঁফ হাতা শার্ট এক পাশে ইন করে অন্য পাশ ছেরে রাখা। একজন চিকন লম্বা চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, গেঞ্জি থ্রি কটার প্যান্ট পরা। তার পাশের জন লম্বা মোটা হলদে গায়ের রং।সেও লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা।
তাদের চাহনি দেখে আমার জান টা যেন একটুস খানি হয়ে গেল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।যেন আমাকে দেখে তাদের খুব মজা লাগছিল। একজন আমার ডান হাত ধরে বলল কি গো ফুলটুসি………
(গল্পের আসল নায়ক কিন্তু এখনো আসেনি অপেক্ষা করুন)
#চলবে …….