#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৮ (দীর্ঘশ্বাস)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“মা, আমি বাবার বিজনেসে আসতে চাই।”
“তুই সিরিয়াস, শুদ্ধ?”
সুভা বেগমের কথায় শুদ্ধ ফোনের এপাশে হালকা হেসে বলল, “খুব সিরিয়াস। মেয়ে পটানোর আগে অবশ্যই নিজের খুঁটি শক্ত করে গেড়ে নিতে হবে। নয়তো সে এক্সকিউজ পেয়ে যাবে, ‘শুদ্ধ, তুমি তো নিজেই বাপের টাকায় খাও। আমায় কী খাওয়াবে?’ আমি তখন কিছু বলতেই পারব না!”
“ভালো কথা! গুড ডিসিশন। বাট এটা তো তোর বাবাকে বলা দরকার, তাই-না?”
“তুমি বলে দিয়ো।”
“এহ! নিজেরটা নিজে করে নে, আমি পারব না।”
“এটা অবিচার!”
“একদম না। দরকারের সময় এত ম্যা ম্যা করবি না। নিজের কাজ নিজে করতে শেখ। আর শোন, তোর বাবাকে বলিস—মাকে শপিংয়ে নিয়ে যেতে। এ-মাসে আমাকে নিয়ে যায়নি তোর বাপ।”
“নিজের কাজটাও আমাকে দিয়ে করাবে?”
“অবশ্যই। মায়ের কথা শোনা তো তোর সন্তানধর্ম রে, পাগলা।”
“বুঝলাম। কিন্তু, বাবার সাথে এই বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলব?”
“সে আমি কী জানি?”
“কেন? তুমি জানো না—আমি বাবার সাথে খানিকটাও ফ্রী নই। কথা বলতে গেলে হাঁটু কাঁপে; সে-ভয়ে সামনেই যাই না।”
“সামনে আসার প্রয়োজন কী? কল দিয়ে কথা বলে নে।”
“ও-মা, একটু ম্যানেজ করো না! জানো তো বাবার ভয়েস শুনলেই কলিজা শুকিয়ে যায় আমার।”
“আচ্ছা, তোর বাবা তো রাগী না। এত ভয় পাবার কী আছে?”
“ও-তুমি বুঝবে না। কিছু কিছু মানুষ কিছু না করেও অনেক কিছু করে ফেলে। তোমার বর সেরকম একজন। উফ! চাহনিতেই স্পষ্ট, ‘শুদ্ধ, একদম বেহুদা কথা বলবে না; চিবিয়ে খেয়ে ফেলব’। তার ভয়ে কথা তো দূর, আওয়াজই আসে না।”
“তুই বেহুদা কথা না বললেই হয়।”
“পারব না, পারব না।”
“কেন?”
“কী কেন? এতক্ষণ কি আমি আমার বাচ্চাদের নাম-ধাম ডিসকাস করছিলাম তোমার সাথে?”
সুভা বেগম মিনমিনে স্বরে বললেন, “লাজ-লজ্জা সব খেয়ে নিয়েছে, সুভার বাচ্চাটা!”
“কিছু বললে?”
“না, বলিনি কিচ্ছুটি। তোকে একটা পেইজ লিংক দিচ্ছি। ওই পেইজ থেকে দুইটা ভালো দেখে সেম ডিজাইনের বেনারসি কাতান কিনে আমার এড্রেসে পাঠিয়ে দিস। আমি এদিকটা সামলে নেব।”
“ঘুস খাচ্ছ, বাবা জানে?”
“তুই যে তলে তলে এতদূর গেছিস, বাবা জানে?”
“উঁহু উঁহু, না। জানে না।”
“আমারটাও যেন না জানে।”
“আচ্ছা, কিন্তু দুইটা সেম শাড়ি?”
“একটা আমার, একটা তোর বউয়ের। মা-মেয়ে একদম সেম সেম সাজব। তোকে আর তোর বাপকে পাত্তা দেবো না। তোর বউয়ের সাথে আমি লং ড্রাইভে যাব, মুভি দেখব, চিল করব। মাস খানেকের নামে ল-ম্বা একখান ট্রিপ দেবো। তুই আর তোর বাপ ফক্কা।”
এই বলা সুভা বেগম হাসতে লাগলেন। মায়ের এমন সোজাসাপটা মনোভাব দেখে শুদ্ধরও অন্তরটা জুড়িয়ে গেল। হেসে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিলো। ঝটপট একটা শাওয়ার নিয়ে বেরোতেই কলিং বেলের আওয়াজে জলদি গিয়ে দরজা খুলল। ওপাশে দিশা ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বলল, “জানো, শুদ্ধ ভাইয়া? আজকে তোমার পছন্দের সব রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো—কেমন হয়েছে!”
শুদ্ধ দিশার পিছে পিছে ডাইনিংয়ে গিয়ে বসল। দিশা খাবার বাড়তে লাগল। শুদ্ধ বলল, “এসবের কি কোনো দরকার ছিল? এটুকু সময় পড়ালেখা করলেই কিন্তু ভালো হতো! সামনে তোমার টার্ম ফাইনাল আছে।”
দিশা খাবার বাড়া থামিয়ে সরু দৃষ্টিতে শুদ্ধের দিকে তাকাল। ওভাবে তাকাতে দেখে শুদ্ধ থতমত খেয়ে বলল, “কী? কী হয়েছে?”
দিশা বলল, “এত পড়াশোনা নিয়ে এডভাইস দেবে না। তুমি নিজেও আমার মতোই; পড়া দরকার তাই পড়ছি টাইপের পাবলিক। আমাদের এই পড়াশোনা দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কিছু করার জন্যও পড়ছি না। আমি হব পাক্কা গৃহিণী; বাচ্চার শিক্ষিত মা হবার জন্য যতটুকু দরকার পড়ছি। আর তুমি আর্নিং মেথোড হিসেবে সিঙ্গিংটাকে নিতে পারো।”
“বুঝলাম! বাট শখ আর প্রফেশন—দুটোকে এক করলে যদি ব্যর্থতায় নাম ফেলতে হয়! ভয় তো এটারই!”
“ভয় পেয়ো না। ইট উইল বি স্ট্রংগার।”
শুদ্ধ জবাবে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে দিশার প্রশ্ন শুনতে পেল, “আচ্ছা, সেদিন তনু আপুর সাথে তোমার কাহিনিটা বললে না?”
“হুঁ।”
“আমার না খুব ইন্ট্রেস্টিং লেগেছে। কী সুন্দর! কিন্তু..”
শুদ্ধ খাওয়া থামিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি রেখেই বলল, “নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি সেই আদিমতার শুরু থেকেই। আমিও মানুষ, আকর্ষণ আমারও হয়েছে।”
“তোমাদের পরিণতি নিয়ে আমি সত্যিই চিন্তিত।”
“চিন্তা কোরো না। তাকে নিয়ে সব চিন্তা আমার একান্ত থাকুক; যেমনটা তাকে ঘিরে আমার প্রেম রয়েছে!”
“তাকে পাবে তো তুমি?”
“সে-আশা রাখছি না আর। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব নিজের সবটুকু দিয়ে। বাকিটা ভাগ্য। সে আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে ইচ্ছে ছাড়াই। এদিকে আমি তাকে নিজের ভাগ্যে জায়গা করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেছি। সে আমার হলে আমি ব্যর্থতাকেও আপন করে নিতে রাজি।”
_______
রাত জাগার বাজে একটা অভ্যেস আছে তনুজার। এক যুগ আগে, এই মেয়েটা ঘুমপ্রিয়া ছিল। তারপর একজন এসে তাকে রাত জাগতে শিখিয়ে দিলো। সে তো চলে গেল, কিন্তু অভ্যেসগুলো পিছু ছাড়ল না; মনের কোনে সুপ্ত প্রেম ভেতরে ভেতরে একটা মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়ে গেল।
রাতের আড়াইটা বাজে। পুরো বাসার লাইট অন করে রাখা, তনুজা অন্ধকারে ভয় পায় তো—তাই। সারারাত এই আলো জ্বলবে, নিভবে ভোরে। এর মাঝে ঘুম এলে ভালো, নয়তো ওভাবেই তনুজা পড়ে থাকবে৷ একাকিত্বের এই দমবন্ধকর অনুভূতি চার দেয়ালের বাইরে যায় না। তনুজা একাই অনুভব করে। সে কাঁদে না, হাসেও না। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে। অথচ, এক সময় কতটা চঞ্চল ছিল!
বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিল তনুজা। এমন সময় হোয়াটসঅ্যাপের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ম্যাসেজে সে চকিতে চাইল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে পেল, একটা আননৌন নম্বর। সে চোখ বুজে ধরে নিল, এটা শুদ্ধ। কৌতুহল নিয়ে নয়, সামান্য বিরক্তি নিয়েই ম্যাসেজটা দেখল।
স্ক্রিনে লেখা আছে, “প্রিয়তমার কথা স্মরণ হতেই এক প্রেমিক পুরুষের ঘুম রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ভেঙে গেল। ঘুম-ভাঙা চোখে সে প্রেমিক দেখতে পেল—তার প্রিয়া হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে; তখন তার বুকটা প্রশান্তির শীতল হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল—এর চেয়ে শান্তির কিছু দ্বিতীয়টা নেই। প্রেমিকের চোখে দেখা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সর্বসুন্দর দৃশ্যের একটি হচ্ছে প্রিয়নারীর স্নিগ্ধ হাসি। অথচ অলকানন্দা, আমি আপনাকে মন থেকে হাসতেই দেখিনি।”
তনুজা দেখল, পড়ল বেশ কয়েকবার। এর মাঝে আবার দেখতে পেল—টাইপিং হচ্ছে। তনুজা ওদিকে তাকিয়ে রইল। সময় নিয়ে শুদ্ধ পরের ম্যাসেজটি সেন্ড করল।
“আমার কল্পনায় আপনি ভীষণ চঞ্চল একজন মানুষ, আপনার মাঝে গাম্ভীর্যের ছিটেফোঁটাও নেই, আপনি সবসময় হাসতে জানেন, কারণে-অকারণে হাসেন। আবার আমার একটু অযত্নেই ঠোঁট উলটে কাঁদেন, অভিমানে গাল ফোলান, অভিযোগের ঝুলি খুলে বসেন। তখন আপনাকে দেখতে অসহনীয় সুন্দর লাগে.. অসহনীয়। আর কেবল-মাত্র এই লোভেই তো আপনার যত্নে আমি খুঁত রাখি। নয়তো কি রাখতাম? কল্পনায় আমি আমার অলকানন্দাকে নিয়ে খুব বেশিই অধিকারসূচক। এই-যে, ম্যাডাম! আপনাকে না আমার কল্পনায় ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে। কারণ, আমার কল্পনায় আপনি একজন সপ্তদশী কিশোরী, বয়সে আমার ছোটো, সম্পর্কে আমার প্রেমিকা; মাঝে কোনো ধরণের বাঁধা নেই। আর এইখানটায় গিয়েই রইল আকাশসম দীর্ঘশ্বাস।”
এটুকু পড়তে পড়তে আবারও ম্যাসেজ এলো, “জীবনে সবাই সব পায় না, না?”
তনুজা উত্তর দিলো না। শুদ্ধ নিজের মতো ম্যাসেজ করতে লাগল, “আপনাকে পাবার আশা আমার জীবদ্দশায় আমি ছাড়ব না। নিরাশ হব, হতাশ হব, তবুও আশা ছাড়ব না। আপনি চাইলে আপনি আমার, না চাইলেও আমি আপনার।”
“আমার ভালোবাসা কৃষ্ণগহ্বরের মতন গভীর, আলোর ন্যায় তেজী আপনিও সেখানটায় পথ হারাবেন; ঘুরে ফিরে কেবল আমাকেই পাবেন।”
তনুজা এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। চোখ জ্বলছে খুব তার। টাইপিং হচ্ছে, কিছুক্ষণ বাদে সেন্ডও হলো। সেখানে লেখা, “কল্পকন্যা, আপনি কি কখনও বুঝবেনই না—গোটা বিশ্ব বিপরীতে রেখে আমি কেবল আপনাকেই চেয়ে গেছি।”
এই ম্যাসেজটা তনুজা দেখতে পেল না। টাইপিং শো করতেই সে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে দিয়েছে। মাথা গিয়ে ঠেকেছে দেয়ালে। চোখ দুটো বন্ধ। গুমোট পরিবেশটিতে হুট করেই তনুজা শুনতে পেল একটি আওয়াজ। কেউ যেন কানের কাছে এসে বড্ড ফিসফিসিয়ে বলছে,
“তনুশ্রী, সোনাবউ আমার! তোমার মুখের এই হাসিটা আমাকে জানান দেয়—আমি কতটা সার্থক পুরুষ। ঘুম-ভাঙা চোখে আমি আমৃত্যু তোমার মুখের হাসিটা দেখে যেতে চাই। জানো কি—এই হাসির শব্দ আমাকে হাজার বছর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়! যেদিন তোমার এই হাসিটা গায়েব হয়ে যাবে, সাথে সাথে আমার জানটাও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। বুকে আসো। তোমাকে ছাড়া বুকটা খালি খালি লাগে।”
অথচ, আজ আট বছর হলো তনুজা সিদ্দিকের বুকে যায়নি। তাই বলে কি সে বুক খালি রয়েছে? উঁহু! সে-বুকে আজ অন্য নারীর বসত। সিদ্দিক বেঁচেই আছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিব্যি সুখে আছে…
আর সহ্য হচ্ছে না তনুজার। ত্বরিতে চোখ দুটো খুলে ফেলল। লালচে চোখ দিয়ে জল গড়ায় না। অস্বাভাবিকভাবে তনুজা গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। সারারাত আর দুচোখের পাতা এক করল না। মনের কোনায় বড্ড গভীর ভাবে গেঁথে গেল, “কেউ কাউকে ছাড়া মরে না।”
চলবে?
শব্দসংখ্যা-১৩৬৭