অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -১৯

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৯ (রাগ না কি অভিমান!)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“তনুশ্রী! লাঞ্চের পর মেডিসিনগুলো নিয়ো ঠিকঠাক, আজ খুব ব্যস্ত থাকব। কল দেওয়ার সময় হবে না হয়তো। তাই বলে এসে যেন না শুনি—মেডিসিন মিস গেছে, তবে মাইর খাবে। বুঝেছ? সিদ্দিক লাভস ইউ, সোনাবউ!”

নিজের ফোনে আসা ম্যাসেজটা তনুজার মনের বিষাদ দূর করতে পারল না। পালটা ম্যাসেজে লিখল, “হুম।”

দুপুরের রান্না সেরে এসে ঘুমিয়ে পড়েল। ইদানিং শরীরে ক্লান্তিটা খুব বেশিই এসেছে। মনের সাথে সাথে শরীরটাও ঝিমিয়ে পড়েছে। বিছানায় শুতেই কখন যে চোখ লেগে গেল—টেরই পেল না। অর্ধ-অচেতন অবস্থায় সে শুনতে পেল ফোনের কলিং টিউনের তীব্র আওয়াজ। সিদ্দিক এই সময়ে কল করবে না। সিদ্দিক ছাড়া আর কল করার মতো কেউ নেই-ও। এই ভেবে সে ওভাবেই পড়ে রইল। কল কেটে গেল, আবার কিছু সময় পর রিং হলো। এবার আর না উঠে তনুজা পারল না। চোখ বন্ধ করেই ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলল। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে একটা ভারি আওয়াজ শুনতে পেল, “তনুজা বলছ?”

তনুজা চোখ খুলল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল—আননৌন নম্বর। ওপাশের নারীটিকে তনুজা চিনতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, “জি, আপনি কে?”

“আমাকে চিনতে পারবে কি? নাম বললে বোধহয় চিনতে পারবে!”

“নাম বলুন।”

“আমি আশামণি বলছি।”

আশামণি! তনুজার নিকট পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত নাম বোধহয় এটাই। চাপা রাগ ভেতরে চেপে রেখে বাইরে থেকে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, “চিনতে পারছি না। কোনো প্রয়োজন?”

আশা বুঝতে পারল—তনুজা তাকে চিনেছে। কেন অস্বীকার করল—তা-ও আন্দাজ করতে পেরেছে। সে মিহি হেসে বলল, “কেমন আছ?”

“ভালো আছি।”

“আমিও ভালো আছি। বাড়ির সবাই ভালো?”

“ভালো।”

“তোমার শরীর কেমন আছে এখন?”

“ভালো।”

“মেডিসিন নিচ্ছ তো ঠিকঠাক?”

“নিচ্ছি।”

“কাল আবরার বলল—তুমি নাকি ইদানিং খুব রাগচটা হয়ে গেছ?”

“আবরার? এসব কেন বলেছে?”

“আরে? রেগে যাচ্ছ আবার? রাগবে না, কেমন? শোনো। কাল আমাকে ইনসিস্ট করল—রাতের ডিনারটা একসাথে করার জন্য। আমি রাজি হলাম। তারপর ডিনার করতে করতে তোমার বিষয়ে বলছিল। তুমি নাকি ওর সাথে উইয়ার্ড বিহেভ করছ, ঠিকমতো কথাই বলছ না।”

“এসব আপনাকে বলার কারণ?”

“শোনো, তনু।”

“তনুজা!”

“আচ্ছা, তনুজা। শোনো, তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তোমার কোনো হাত নেই। তবে তুমি ভুক্তভোগী। আবরার তা বুঝতে পারছে। এজন্য তোমাকে দেখলেই ওর ভেতরটা কেঁদে ওঠে। ও চায়নি তোমাকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখতে। ওর কষ্ট হয়। সেজন্য এখন ও তোমার সামনেই যেতে চাইছে না। বুঝতে পারছ? তোমার স্বামী তোমার সামনে যেতে চাইছে না জাস্ট বিকজ অব্ ইওর বিহেভিয়ার। নিজেকে একটু সামলাও! আল্লাহ চাইলে সব হবে। এত কষ্ট নিয়ো না।”

তনুজা রাগে-দুঃখে কল কেটে দিলো। তার ব্যর্থতার গুনগান সিদ্দিক বাইরেও করছে! বিষয়টা কতটা অপমানের—তা তনুজা সিদ্দিককে বোঝাতে পারল না। এদিকে কাল সে সিদ্দিকের অপেক্ষা করতে করতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওদিকে সিদ্দিকের অশান্ত মস্তিষ্ক আশার কাছে মানসিক ভোগান্তির কথা বলতে বলতে ভুলেই বসেছিল তনুজার অপেক্ষা।

এভাবেই কাটছিল দিন। তনুজা ডিভোর্সের কথা বললেও, তা মন থেকে চাইছে না। সে সুযোগ খুঁজছে থেকে যাওয়ার। একটা মানুষ কতটা অসহায় হলে—নিজ থেকে মুক্তির পথ বের করে, আবার পিছে তাকিয়ে থেকে যাওয়ার কারণও খোঁজে, তা বোঝার সাধ্য খুব কমেরই আছে!

এভাবে ছোটো ছোটো কিছু ঘটনা, মন থেকে মনের আস্তে-ধীরে স্থির দূরত্ব, মানসিক বিপর্যয়, সময়ের খেলা, অনুভূতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে তনুজা আর টিকতে পারল না। এক সন্ধ্যায় সিদ্দিকের সাথে তুমুল ঝগড়া শেষে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল। এরপর আর সে-বাড়িতে ফিরল না। তনুজার মনে পড়ল, সেই দেখাটাই সিদ্দিকের সাথে তার শেষ দেখা।

____
ভাবনা থেকে বের হলো তনুজা। সেই শেষেরদিনগুলো আজও তার ভারি মনে পড়ে। সে তো ফিরে যেতে চেয়েছিলই! কিন্তু..

জীবন হচ্ছে চোরাবালির ন্যায়। জীবনের কোনো নির্দিষ্ট দিকে এগোতে গেলে, সে রাস্তাটা আস্তে আস্তে তোমাকে নিজের মাঝে গিলে নেবে। তুমি আর বেরোতে পারবে না। তনুজাও পারেনি। তলিয়ে গিয়েছে ভেতরটায়। বার বার হাতড়ে ওঠার চেষ্ঠা চালিয়েছে, আজও পারেনি; ওঠার সুযোগও অবশ্য আর নেই তার।

দীর্ঘস্বাস ফেলে কিচেনে গিয়ে রান্না সেরে নিল তনুজা। আজ ভার্সিটি অফ। তাই বাসাতেই থাকবে। রান্না করতে করতেই কলিং বেলের আওয়াজ এলো। তনুজা হালকা পায়ে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ডেলিভারি ম্যানকে দেখে সে খানিকটা চমকে গেল। সে তো কিছু অর্ডার দেয়নি! তনুজা সাইন করে তার হাত থেকে একটা বক্স নিল। সেটা দেখার লোভ একটুও নেই তনুজার। তবে জানার একটা কৌতুহল আছে।

রান্না সেরে নিয়ে বক্সটা খুলল এবং সবিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল এবার। বেশ বড়ো একটা বক্স। আর পুরোটা ভরা চিরকুট। অসংখ্য চিরকুটের মাঝ থেকে একটি তনুজা বের করল। তাতে লেখা, “মিস তনুজা, জেনে রাখুন—কোনো এক শুদ্ধপুরুষ তার অলকানন্দাকে বেশ ভালোবাসে।”

আরেকটা চিরকুট বের করল। তাতেও একই লেখা। তনুজা একাধারে একটা-দুইটা-তিনটা এরপর অসংখ্য চিরকুট বের করল, সবেতে একই লেখা। বুক ফেটে কান্না এলো তার।

কেন যেন সে শুদ্ধর অনুভূতি অনুভব করে, শুদ্ধকে অনুভব করে। ভালো তো সে-ও বেসেছিল অন্য একজনকে। একই রকম ভালোবাসাই সে পাচ্ছে, অন্য পুরুষের থেকে। এই প্রেম, এই পাগলামি! এগুলো সবই তার মাঝে ছিল। সে-ও একটা পাগলাটে প্রেয়সী ছিল তার স্বামীর। এরকম কাজ কত্ত করল!
একবার সিদ্দিক রেগে গিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। সে রাতে তনুজাকে বুকে না নিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠে নিজের মাথার ধারে সিদ্দিক একটা ডায়েরি পায়। সে-ডায়েরির প্রতিটা পেইজের আগা-গোড়া একটা শব্দ দিয়েই পরিণত ছিল—‘ভালোবাসি’।

তনুজা এমন ভালোবাসা ভয় পায় এখন। ভয়টা প্রকাণ্ডরূপে বেড়ে চলেছে। তাই আর দেরি করল না। অনেকদিন ধরে যা ভেবে চলেছিল, তা এবার বাস্তবিক অর্থেই করতে নিল। ফোন বের করে শফিক সাহেবকে কল লাগাল।

রিসিভ করতেই তনুজা কোনোরূপ কুশলাদি ছাড়া বলে উঠল, “মামা, সাহায্য লাগবে।”

_______
অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে সিদ্দিকের আজ রাত হলো। সে আগের মতো কোনো কিছুতে বাধ্য নয়, রাত হয়-ই! সব জায়গা থেকে সে মুক্ত হলেও, এক জায়গায় গিয়ে আটকে আছে, একজনের কাছে থমকে রয়েছে। তার জন্য এই রাতের বারোটায় কিছু লাল ফুল আর চকোলেট নিল।
তার ফিরতে যতদেরিই হোক না কেন, একজন অপেক্ষা করে। দেরি হলে গাল ফোলায়। মাঝে মাঝে ছল ছল চোখে তাকিয়ে বলে, “পাষাণ!”

সিদ্দিক সেই দৃষ্টিকে ভয় পায় কেবল। আনমনে হেসে বাসায় চলে এলো। কলিং বেল বাজাল না। এক্সট্রা কী দিয়ে দরজা খুলে নিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ গেল লিভিং স্পেসে। লাইট জ্বালানো। এত রাতে এই একজন তার অপেক্ষায় এখানে বসে আছে। সোফায় বসে টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে টিভি দেখছে। টিভিতে কার্টুন চলছে।

সিদ্দিকের আসাটা সে খেয়াল করেনি। সিদ্দিক তাকিয়ে রইল, কেমন গুটিশুটি মেরে বড়োদের মতো বসে আছে। এভাবেও যেন কত রাগ ঝাড়ছে!
আর অপেক্ষা না করে ডাকল সে, “প্রিন্সেস!”

অর্ষা আড়চোখে বাঁয়ে তাকিয়ে বাবাকে দেখল। আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। সিদ্দিক এগিয়ে গিয়ে ছোট্টো অর্ষাকে কোলে তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে বলল, “বাবাই লাভস ইউ, প্রিন্সেস!”

অর্ষা কিচ্ছু বলল না। ফুলো গালগুলো কেবল বেলুনের মতো আরও খানিকটা ফুলতে লাগল। সিদ্দিক রাগ ভাঙানোর উদ্দেশ্যে তাকে কোলে করে সোফাতে বসল। এরপর চকোলেটস আর ফ্লাওয়ার্সগুলো দিলো। তাকিয়ে দেখল—অর্ষার রাগ গলল বলে!

অর্ষা কথা বলল এবার, “কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, জানো? তুমি সবসময় এমন লেইট করো, বাবাই!”

সিদ্দিক অর্ষার গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল, “আর হবে না, মা।”

“প্রমিস?”

“পাক্কা!”

অর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল। সিদ্দিককে দুহাতে জড়িয়ে বুকে মুখ ঘষে বলল, “লাভ ইউ মোওওওওওওর, বাবাই।”

সিদ্দিক ভেবে পায় না! পাঁচ বছরের বাচ্চাটা এত পাকনামি কীভাবে করে! বাচ্চাটা এত কথা জানে! বায়নাগুলোতে সবসময় সে তনুজার ছোপ পায়, বায়না না মেটানোর কান্নাগুলোতেও যেন তনুজার বাচ্চাকালের রূপ প্রকাশ পায়। হয়তো এই জন্যই এখনও বেঁচে আছে। তনুজার জুনিয়র ভার্সন বলে কথা!

অর্ষা আবার বলল, “বাবাই, তোমাকে একটা জিনিস দেখাব! দাঁড়াও।”

এই বলে সিদ্দিকের কোল থেকে নেমে সোজা রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে একটা ফোটোফ্রেম নিয়ে এসে বলল, “আজ মাম্মা আমাকে সব্বার আগেকার ছবি দেখাচ্ছিল। সবাইকে চিনলেও, এনাকে চিনতে পারিনি। মাম্মাকে জিজ্ঞেস করায় বলল—এটা নাকি আমার আরেক মাম্মা। আচ্ছা, সবার তো একটা করে মাম্মা হয়। আমার দুইটা কীভাবে? মাম্মাকে কুয়েশ্চনটা করায়, আমাকে আর কিচ্ছু বলেনি। তাই আমি ছবিটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তোমার কাছে জিজ্ঞেস করব বলে। ভালো করেছি না—বলো, বাবাই?”

রাগে সিদ্দিকের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছে সে। তার সামনে যে একটা বাচ্চা রয়েছে—সে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছি। অর্ষার হাত থেকে এক ঝটকা মেরে ফ্রেমটা নিয়ে বাইরে চলে গেল। অর্ষা ওখানটাতেই কেঁপে উঠল, এগোনোর সাহস পেল না। সিদ্দিক ফ্রেম নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ছবিটি বের করল। এরপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। কিছু মানুষকে ছবিতেও দেখতে ইচ্ছে করে না। সিদ্দিকের নিকট তনুজা তেমনই একজন মানুষ।

চলবে..
শব্দসংখ্যা- ১৩৫১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here