অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -২১

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২১ (তনুজার অতীত-উন্মোচন)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“তনুজা কোথায়?”

সিদ্দিক হেসে ফেলল। টেনে টেনে বলে উঠল, “ত-নু-জা?”

সিদ্দিকের এমন তাচ্ছিল্যভাব দেখে শুদ্ধর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, মনটা বিষিয়ে উঠল। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে বলল, “ও কোথায়?”

“ওওও?”

শ্লেষ বাক্যকে শুদ্ধ কানে তুলল না, “বলুন!”

সিদ্দিক বলল, “আমি জানি না।”

“শেষ কবে দেখা হয়েছে?”

“আপনাকে বলাটা কি আমার জন্য বাধ্যতামূলক?”

শুদ্ধ ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে হুমকি ছুড়ল, “তার ব্যাপারে আমি ৭০% জানি, বাকি ৩০% ধোয়াশা। যতক্ষণ না জানতে পারছি, শান্তি পাব না, কাউকে শান্তিতে থাকতেও দেবো না।”

“বাচ্চা ছেলে আপনি! না বললে কেঁদেও দিতে পারেন; বলা তো যায় না আর! আচ্ছা, আপনার ‘তনুজা’-র সাথে সম্পর্কটা? প্রেমিক নাকি? মানে ওনাকে যতটুকু চিনি, থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়!”

এই পর্যায়ে শুদ্ধর হাতের থাবা গিয়ে সামনের টেবিলটায় পড়ল, বেশ শব্দ হয়ে উঠল। সিদ্দিক বাঁকা হাসল। শুদ্ধ হুংকার দিয়ে উঠল, “আপনি ওনার চরিত্রে আঙ্গুল তুলছেন কিন্তু!”

“চরিত্রহীনাদের চরিত্রে কলঙ্ক লাগে না, কালি ছোঁড়া যায় না; তাদের মনটা এমনিতেও কালো হয়! কুচকুচে কালো!”

“কী বলতে চাইছেন?”

সিদ্দিকের মনটা বলে উঠল, “এ-ই, যে—আপনি যার কথা বলছেন, সে এক সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী আর খারাপ ধরনের মহিলা।”
কিন্তু মুখে তা বলল না। কেবল বলল, “প্রশ্ন করুন—যা জানার আছে!”

শুদ্ধ ক্ষণকাল ব্যয় না করে শুধাল, “শেষ দেখা কবে?”

“সাতাশ জুন, ২০১৩।”

“নয় বছর আগে?”

“সময়ের হিসেব তো তাই বলে।”

“আচ্ছা, এরপর কোনো যোগাযোগ?”

“সে চিঠি পাঠায়।”

“শেষ চিঠি কবে পাঠিয়েছে?”

“মাসখানেক আগে।”

“কী লেখা ছিল ওতে?”

“জানি না।”

“আশ্চর্য! জানেন না?”

“পড়িনি কোনোবারই।”

“কী করেন সেগুলো দিয়ে?”

“বিশ্বাসঘাতকতার একটাই শাস্তি হয়.. নিঃশেষ করে দেওয়া। ওকে তো পারি না, তাই চিঠিগুলোকেই তা করি; পুড়িয়ে দিই।”

“কেউ এত কষ্ট করে, এত অনুভূতি নিয়ে লেখে, আপনি পুড়িয়ে ফেলেন? না পড়েই? ওদিকে সে যে কত আশা নিয়ে বসে থাকে!”

জবাবে সিদ্দিক হাসল! মনে অনেক অ-নে-ক কথা! কিন্তু সে বলতে চাইছে না। সবার কিছু একান্ত কথা থাকে, যেই কথাগুলো কাউকে বলা যায় না। কেবল নিজের মাঝে লালন করা যায়, চুপিচুপি সেখান থেকে প্রশ্ন তুলে নিজেকে শোধানো যায়। সেগুলো ব্যক্তিগত কথা, অন্য কারো জন্য নিষিদ্ধ! সিদ্দিকের গোপন কথাগুলো শুদ্ধপুরুষের জন্যও নিষিদ্ধ।

শুদ্ধ আবার বলল, “তনুজার সাথে যোগাযোগ করেননি?”

“অনেক চেষ্টা করেছিলাম প্রথম দুই-তিন বছর। কোনোভাবেই খুঁজে পাইনি। এরপর সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঠিক তখনই তাকে পেলাম, যখন পরিস্থিতি আমার বিপরীতে চলে গিয়েছিল।”

“কীভাবে?”

“ওখানটায় যাকে নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তিনি নেই। তাই ওদিকটায় যাবেন না। অন্য কুয়েশ্চন করুন।”

“জানেন—তনুজা এতকাল ময়মনসিংহ ছিল?”

“জানি।”

“দেখা হয়েছে?”

“হয়েছে আবার হয়নি।”

“মুখোমুখি?”

“না। ও আমাকে দেখতে পেয়েছে—এটা আমি জানি। অথচ, আমি ওকে দেখেও দেখিনি।”

“রহস্য ক্রিয়েট করছেন?”

“না। এর চেয়ে সোজা করে বলা পসিবল না।”

“তার প্রতি এত রাগের কারণ?”

“তা আপনায় বলতে বারণ।”

“শুনতে ইচ্ছুক।”

“বলতে নই।”

শুদ্ধ গভীর শ্বাস ফেলল। পুনরায় শুধাল, “তনুজা কেন চলে গিয়েছিল?”

“না জেনে এসেছেন?”

“জানি।”

“তবে?”

“অর্ধাংশ। কেবল ওনার দিকটাই জানি। আপনারটা না জেনে এর দায় পুরোটা আপনাকে দিতে চাইছি না।”

“দায়ী করলেও কিছু মনে করব না। ছিলাম আমি এক ব্যর্থ পুরুষ, নয়তো কি বউ ছেড়ে যায়?”

“আপনার চোখ অন্য কিছু বলছে, আজওয়াদ সাহেব!”

সিদ্দিক হাসল। কেন যেন এই ছেলেকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। হাতঘড়িতে দেখল—৭টা বাজতে কিছু সময় বাকি। শুদ্ধর সময় প্রায় শেষ! সিদ্দিক আনমনেই শুদ্ধর সময় বাড়িয়ে দিলো। বলা শুরু করল, “সামান্য কারণে ঝগড়া, এরপর আমি অফিসে চলে যাই। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। বাড়ি গিয়ে আর তাকে খুঁজে পাই না। মা বলে, সে না কি অন্য কারো হাত ধরে পালিয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস করি না। অনেক খুঁজে যাই, অ-নে-ক! বছর পেরোল! আর তাকে পেলাম না। আমাদের অ্যানিভার্সেরির দিন, একটা পার্সেল আসে। ডিভোর্স পেপার! সেখানে জ্বলজ্বল করছিল তার সাইন। আমি শেষবারের মতো সেদিন কেঁদেছিলাম। এরপর.. মায়ের কথা বিশ্বাস করে নিলাম।”

“মিসেস আশা?”

“ওর এক্স হাজব্যান্ড তখন ওকে ডিস্টার্ব করছিল। হুমকি দিচ্ছিল বিভিন্নভাবে। এক সময়ের প্রেম ছিল তো আমার, তাই আমি না চাইতেও ওর সমস্যাগুলোতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, এড়িয়ে যেতে পারিনি। ধীরে ধীরে আশা আর আমার মাঝে খুবই বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অথচ মেয়েটা ভেবে বসে, আমি আশাতে মত্ত হয়েছি। আমাদের মাঝে আশাকে নিয়ে তৈরি সব কম্পলিকেশন আমি আশাকে খুলে বলি, যাতে আশা আমার থেকে একটু দূরত্ব মেইনটেইন করে। কিন্তু আশা চাইছিল, আমাদের মধ্যকার ঝামেলা মেটাতে। তাই সে এতে ওকে কল দিয়ে বোঝায়, আমাদের মধ্যে কিছু নেই। কিন্তু আগুনে পানির বদলে যেন ঘি পড়ল। সম্পর্কের চরম অবনতি হয়ে যায়। এইভাবেই এক সামান্য ঝগড়াকে মধ্যমণি করে ও বাড়ি ছাড়ে।
বছর দেড়েক পর আমার একাকিত্বের সুযোগ নেয় আশা আর আমার মা। আশা গিয়ে মাকে বোঝায়, আমাকে ও চায়। মা তো আমার সিঙ্গেল লাইফ মেনে নিতে পারছিল না আর। তাই ইমোশনাল ড্রামায় আমাকে জড়িয়ে ফেলে। আমি তখন অনুভূতিশূন্য। কোনো না-বাক্য ব্যবহার করিনি। মাসখানেকের মাঝেই ঘরোয়া ভাবে আশা আর আমার বিয়ে হয়।
এর ১১মাস পর তার প্রথম চিঠি পাই। অল্প কিছু কথা লিখেছিল—আমার বিয়েতে শুভ কামনা জানিয়ে। আর জানিয়েছিল, ও ভালো আছে। ওকে যেন না খুঁজি। রাগে-ক্ষোভে আমি সত্যিই আর খুঁজিনি।”

সিদ্দিকের কথা শুনে শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়, “তনুজা বাড়ি ছেড়ে তার মামার বাড়িতে গিয়েছিলেন কেবল রাগের বশেই। রাগ নামতেই ফিরতে চেয়েছিলেন। ফিরে আসার পথ বন্ধ করেছে আপনার মা, জানেন?”

সিদ্দিক নির্বিকার। শুদ্ধ নিজের মতো বলতে লাগল, “উনি ডিভোর্সের চিন্তাটা কখনই নিজ থেকে করেননি। প্রেশারটা আপনার মা-ই তাকে দিচ্ছিল, জানেন?”

এবারও সিদ্দিক কিচ্ছু বলল না। শুদ্ধ আবার বলতে লাগল, “উনি বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন খুব করে। কিন্তু পারেননি। বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মিনতি করে গিয়েছিলেন ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার জন্য, আপনার মা দেননি। তারপর আপনাকে কল দিয়ে সব জানাতে চাইছিলেন, আপনার মা আটকায়। আপনার মা তার ব্রেইনওয়াশ করে। তাকে বোঝায়, আপনার থেকে দূরে থাকতে। আপনাকে সে শিগগিরই বিয়ে করাবে; আপনারও বাবা হতে ইচ্ছে করে, আপনি বিয়েতে রাজি। কেবল মাত্র তনুজা ছিল বলে আপনি বিয়ে করতে পারছিলেন না। আরও হাজারটা ইউজলেস কথাবার্তা বলে তনুজাকে পুরোপুরি বশে আনে আপনার মা।
তনুজা ফিরে যান। তাঁর মামার কাছে। আপনি জানতেন, তনুজার কোনো ফ্যামিলি মেম্বার্স নেই যাবার মতো। এদিকটা তনুজার জন্য মাইনাস পয়েন্ট ছিল। তনুজা খুব করে চাইতেন, আপনি যেন তাঁকে খুঁজে পান। উনি তো যেতে পারবেন না। আপনি যেন যান তাঁর কাছে!
অথচ আপনি তাঁকে খুঁজে পেলেন না। সে কল দিতে গিয়েও দিতে পারেনি। ছিল কিছু বাধ্যবাধকতা! এরপর সে আপনাকে রাগে-কষ্টে আর আপনার মায়ের প্ররোচনায় পড়ে ডিভোর্স পেপারটা পাঠিয়েই দেন। দেখার ছিল তাঁর—আপনি আসলে কী করেন। অতঃপর দেখতে পেলেন, আপনি মাসের মাঝেই বিয়ে করে নেন।

তনুজা ভেঙে পড়েন। হসপিটালাইজড ছিলেন অনেকদিন। এরপর সুস্থ হয়ে কেমন যেন গুমড়ে যান। ওই সময়ে তার পাশে মিসেস শিখা ছিলেন, ওনার ফ্রেন্ড। তাঁর সাহায্যে তনুজা মুভ অন করেন। পড়াশোনায় ফোকাস করেন। তনুজার এগোনোতে সবচেয়ে বেশি হাত ছিল তাঁর মামার। পড়াশোনা শেষে তনুজা একা থাকা শুরু করেন। বিসিএস দেওয়ার পর ওনার জবও হয়ে যায়। উনি এখন অনেকটা এগিয়ে, তাই ভাবছেন? নাহ! আসলে উনি এখনও এই ‘আপনি’-তেই থমকে আছে। এই যে, এত সব কাহিনি! এগুলো আপনার অজানা!”

ওই মুহূর্তে সিদ্দিক গুমোট পরিবেশে মুখ খুলে বলে উঠল, “জানি সবটাই।”

চলবে..
শব্দসংখ্যা-১২০৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here