#অবেলায়_তুমি (পর্ব-১১)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ
অফিসের ম্যানেজার খালেক সাহেব তনুকে বাঁচাতে আসলো, কিন্তু তনু তাকেই উল্টো ঝাড়ি দিতে শুরু করেছে। খালেক সাহেবের মতন আকাশ ও থতমত খেয়ে যায় তনুর কথাবার্তা শুনে। কারণ সে তনুকে জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। তনুর তাকে এখন বাটাম দেওয়ার কথা। কিন্তু তনু তা না করে উল্টো অফিসের ম্যানেজার খালেক সাহেবকেই বকছে। খালেক সাহেব আর আকাশ দু’জনেই হতভম্ব হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। তনুর কথাবার্তা সব কিছুই কেমন যেনো তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে খালেক সাহেবের। তনুকে বাঁচানোর কারণে তিনি যে উল্টো প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবেন সেটা খালেক সাহেব কখনো ভাবতেও পারেনি। তনুর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কি জওয়াব দিবেন খালেক সাহেব সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গিয়েছে খালেক সাহেব। সেই সঙ্গে মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেনো কেউ খালেক সাহেবের মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। বোবার মতন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে খালেক সাহেব। অপরদিকে খালেক সাহেবের কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে তনু খালেক সাহেবকে আরো রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,
–‘কি হলো কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেন খালেক সাহেব? আপনি কোন সাহসে ওর কলারে হাত দিয়েছেন উত্তর দিন।’
খালেক সাহেব এবার মুখ খুলে উত্তর দেয়।
–‘ম্যাডাম আমি কেবিনের দরজা খুলা মাত্রই দেখতে পেলাম এই বেয়াদবটা জোরপূর্বক আপনাকে জড়িয়ে ধরে অশ্লীলতা করার চেষ্টা করছিল। তাই আমি ওর শার্টের কলার চেপে ধরেছি।’
–‘সে আমার সাথে অশ্লীলতা করলে তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?’
–‘ম্যাডাম আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে আপনি আমার অফিসের ম্যাডাম। আপনার বিপদ হলে এগিয়ে আসা আমার দায়িত্ব।’
–‘আচ্ছা মানলমা আপনি আমাকে বাঁচাতে এসেছেন। কিন্তু আপনাকে কে বলেছে সে আমার সাথে জোরপূর্বক অশ্লীলতা করছিল? বা জোরপূর্বক আমার সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছিল?’
–‘ম্যাডাম কেউ বলেনি। তবে আমি নিজেই তো দেখতে পেলাম সে আপনার সাথে অশ্লীলতা করতে চেষ্টা করছিল। তাই তো তার সাথে এমনটা করেছি।’
–‘আপনার দেখার গুষ্টি মা’রি। সে আমার সাথে যাই করবে করুক, কিন্তু আপনার কোনো রাইট নেই ওর গায়ে হাত দেওয়ার।’
–‘ম্যাডাম আপনার কথার মানে টা আমি বুঝে উঠতে পারছিনা! দোষ করলো সে। আর আমি আপনাকে বাঁচালাম। আপনি কথা শুনালে তো তাকে শুনানো উচিত। কিন্তু আপনি তা না করে উল্টো আমায় কেন কথা শুনাচ্ছেন? আমি তো কোনো দোষ করিনি ম্যাডাম। দোষ তো সে করেছে। আর আমি তো আপনার উপকার করেছি।’
–‘খালেক সাহেব নিজের লিমিটে থাকেন। আপনাকে কেউ বলেনি আমার উপকার করার জন্য। আর না আমি চেঁচিয়ে কারোর কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছি। সে আমার সাথে যা ইচ্ছে হয়েছে করেছে। আর ভবিষ্যতে যা ইচ্ছে হবে তাই করবে। তার ইচ্ছে হলে সে হাজার বার আমায় জড়িয়ে ধরবে। তার ইচ্ছে হলে সে হাজার বার আমার গায়ে হাত দিবে। তার ইচ্ছে হলে সে হাজার বার আমার সাথে জোড়াজুড়ি করবে। তার ইচ্ছে হলে সে হাজার বার আমার সাথে অসভ্যতা করবে। মোট কথা তার যা ইচ্ছে হবে সে আমার সাথে করবে। কিন্তু আপনার তো কোনো অধিকার নাই তার ইচ্ছার মাঝে এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর। কারণ হি ইজ মাই হাজবেন্ড। তার পুরোপুরি অধিকার আছে আমার শরীরে স্পর্শ করার। কিন্তু আপনি কোন অধিকারে আকাশের শার্টের কলার চেপে ধরেছেন তাও আবার আমার চোখের সামনে?’
খালেক সাহেব তনুর কথা শুনে পুরো আবুল হয়ে যায়। তনুর কথা শুনে প্রথমে কি অবাক হয়েছে, তার চাইতে তিনগুণ বেশি অবাক হয়েছে বর্তমানে তনুর মুখে আকাশের সম্পর্কে জানতে পেরে। অফিসের একজন সাধারণ এ্যাসিস্ট্যান্ট বা নিম্নমানের কর্মচারী যে অফিসের ম্যাডামের স্বামী হতে পারে সেই বিষয়ে খালেক সাহেবের আগে কোনো ধারণাই ছিল না। খালেক সাহেব পুরোদমে অবাক। শ্বাসপ্রশ্বাস উল্টো-পাল্টা ভাবে চলতে শুরু করেছে খালেক সাহেবের। বীর বাহাদুর সাজতে গিয়ে যে নিজের পায়েই কুড়াল মে’রেছে সেটা খালেক সাহেবের এখন বুঝে এসেছে। চাকুরী বাঁচাতে করুন সুরে তনুকে বলে,
–‘ম্যাডাম আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না আকাশ সাহেব আপনার হাজবেন্ড! ম্যাডাম আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ ম্যাডাম এবারের মতন আমায় ক্ষমা করে দিন।’
–‘ক্ষমা আমার কাছে নয়। ক্ষমা চাওয়ার হলে আকাশের কাছে চান।’
–‘আকাশ সাহেব আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সত্যিই জানতাম না আপনি ম্যাডামের হাজবেন্ড। আমি ভেবেছি আপনি ম্যাডামের সাছে দুনম্বরী কিছু করার চেষ্টা করছেন। তাই না বুঝে আপনার শার্টের কলার ধরে ফেলেছি৷ আকাশ সাহেব আমায় এবারের মতন ক্ষমা করে দিন।’
আকাশের মুখে কোনো কথাবার্তা নেই। খালেক সাহেবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে সে। খালেক সাহেব আকাশকে কলার চেপে ধরে অপমান করায় তনু যা রিয়াকশন করেছে তা দেখে আকাশ হুঁশ- জ্ঞান হারিয়ে বসেছে। তনু আকাশের বিষয়টা বুঝতে পেরে খালেক সাহেবকে চলে যেতে বলে। খালেক সাহেব আর এক সেকেন্ড ও দেরি না করে তনুর কথা মতন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। খালেক সাহেব কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তনু আকাশকে বলে,
–‘আপনার আবার কি হলো? আপনি আমার দিকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন?’
তনুর কথায় আকাশের হুঁশ ফিরে আসে। এতো সময় আকাশ স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। তনুর প্রশ্নে আকাশ স্বাভাবিক হয়। নরম গলায় উল্টো তনুকে প্রশ্ন করে,
–‘আচ্ছা তুমি তো আমার উপরে প্রচন্ড রেগে ছিলা। একটু আগেই বললা আমাকে তোমার চাই না। আমাকে তোমার আর দরকার নাই। কিন্তু তুমি হুট করেই স্বামী ভক্ত হয়ে গেলা কি করে? যেই না খালেক সাহেব আমার কলার চেপে ধরেছে, তখনি তুমি রেগেমেগে ফায়ার হয়ে গেলা। কাহিনী কি তনু?’
–‘কাহিনী কিছুই না। আর না আমি স্বামী ভক্ত।’
–‘তাহলে একটু আগে আমার কারণে খালেক সাহেবের সাথে রেগে যাওয়া এবং খালেক সাহেবকে আমাদের বিষয়ে যেসব বললা সেসব কি ছিল?’
–‘আকাশ সাহেব আপনাকে একটা কথা বলি। আমার বলা কথা গুলো সত্যি। আর আমি সেজন্যই কথা গুলো বলেছি। তবে রেগে যাওয়ার পিছনে অন্য একটা কারণ আছে।’
–‘কি কারণ তনু?’
–‘কারণ হচ্ছে আমাদের মাঝে যেই সমস্যাটা হয়েছে সেটা আমাদের দু’জনের ব্যক্তিগত। কিন্তু তাই বলে যে আমি আপনার মতন মানুষকে সবার সামনে অপমান করবো বা সকলের সামনে অপমানিত হতে দিব এটা তো হতে পারে না। ব্যক্তিগত সমস্যা সেটা ব্যক্তিগতোই। এটাকে কেন্দ্র করে আপনার সম্মানে আঘাত করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে আপনি দেখে হয়তো আমায় অপমান করতে পেরেছিলেন সকলের সামনে, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব না সেটা করা। তবে হ্যাঁ আমিও আগের বার অফিসের সকলের আপনাকে অপমান করেছি। যেটা আমার মস্ত বড় ভুল ছিল। তবে তাই বলে যে প্রতিবার একই ভুল করবো সেটা তো হতে পারে না। আমার ভিতরেও মনুষ্যত্ব বলতে কিছু আছে। আমি আগের বার নিজের মনুষ্যত্বকে কাজে না লাগালেও এবার কাজে লাগিয়েছি। আর আপনি আমার সাথে যেটা করেছেন সেটা আমার নিজের কর্মফলের কারণেই হয়েছে। কিন্তু জানেন আপনাকে আমি অফিসের সকলের সামনে অপমান করলেও আপনার সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্যাপাসিটি হয়তো আমার আছে। আমি অফিসের সকল কর্মচারীকে এক জায়গায় করে যদি বলি আপনি আমার হাজবেন্ড, তাহলে আপনার দিকে হয়তো আর কেউ বাঁকা চোখে তাকানোর সাহস করবে না। আমি কোনো না কোনো ভাবে আপনার উপর থেকে দাগটা উঠাতে পারবো। কিন্তু আপনি আমায় যেই সকল মানুষের সামনে অপমান করেছেন, সেই অপমানের দাগ আমার গা থেকে কখনোই সরবে না। সব সময় আমার গায়ে সেটা লেগে থাকবে। সব সময় আমাকে তাদের সামনে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতে হবে। আমি আর কখনো তাদের সাথে আগের মতন করে সসম্মানে কথাবার্তা বলতে পারবো না। সেই সঙ্গে আমি তাদের সাথে কথা বলতে গেলেই আমার ভিতরে একটা লজ্জা বোধ কাজ করবে।’
তনুর কথা শুনে আকাশ আবারো রিয়েলাইজ করে সে যেটা করেছে সেটা অনেক বড় ভুল ছিল। তার ঐরকমটা করা কখনোই উচিত হয়নি। হ্যাঁ তনুও তার গায়ে দাগ লাগিয়েছে৷ তবে তনু চাইলে সেটা তার গা থেকে সত্যিই তুলেও ফেলতে পারে। কারণ এই অফিসের বস তনু। আর সবাই তনুর কর্মচারী। এছাড়া তনুর কথায় এই অফিসের অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু আকাশ যেটা করেছে, সেটাতে করে তনুর গা থেকে কখনোই দাগ যাবে না। কারণ পার্টিতে যারা ছিল তারা তনুর কর্মচারী নয়। তারা ছিল তনুর বিজনেস পার্টনার। আকাশ বুঝতে পারছে না কি করবে৷ সেই সঙ্গে তনুর মন-খারাপ দেখে আকাশের আরো খারাপ লাগছে তনুর জন্য। তনুর মন-খারাপ আকাশ বিষয়টা কোনো ভাবেই মানতে পারছে না। আকাশ কি করবে ভেবে না পেয়ে আবারো তনুকে জড়িয়ে ধরার পরিকল্পনা করে। কারণ এতে করে হয়তো তনুর মন-খারাপটা ভালো হতে পারে। আসলে প্রিয়-মানুষটা যতোই অভিমান করুক না কেন, ভালোবেসে তাকে একবার বুকে টেনে নিলে অভিমানের মাত্রা অনেকটা কমে যায়। আকাশ নিজের পরিকল্পনা মতন তনুকে আবারো জড়িয়ে ধরার জন্য সামনে এগোয়, তখনি তনু আকাশকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। কারণ তনু আকাশের পরিকল্পনা আগেই বুঝে ফেলেছে। তনু আকাশকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার পর আকাশকে বলে,
–‘আকাশ সাহেব আমাকে আপনার খেলনার পুতুল বলে মনে হয় তাই না? যখন ইচ্ছে হবে আমার শরীরে কাঁদা ছুঁড়বেন। আবার যখন ইচ্ছে হবে আমার এই কাঁদা মাখা শরীর টাকে নিজের কাছে টেনে নিবেন? দেখুন এসব বন্ধ করুন। আমার এসব আর ভালো লাগছে না। আপনি প্লিজ নিজের কাজে গিয়ে মন দিন। তাতেই আমার কিছুটা স্বস্তি ফিল হবে। অতিরিক্ত কিছু করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্লিজ এবার আপনি যান।’
আকাশ তনুর কথা শুনে সমস্ত পরিকল্পনা বাদ দিয়ে চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে চলে যায়। মনটা তারো ভিষণ খারাপ। চেহারা মলিন করে চেয়ারের উপরে বসে শান্ত মাথায় ভাবতে থাকে কি ভাবে সব কিছু আবার আগের মতো করা যায়। ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষন পর আকাশের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। আকাশ ঠিক করে বুদ্ধিটা সে কাজে খাটাবে। তবে সেটা এখন নয় সঠিক সময়ে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে যায়। অফিসে লাঞ্চ ব্রেক দেয়। আকাশ নিজের ডেস্কেই বসে আসে। আর তনুকে নিয়ে ভাবছে। কখন তনু তাকে ডাকবে। না হয় তনু খাওয়ার জন্য কেবিন থেকে বের হবে। আর সে তনুকে এক নজর দেখবে। কিন্তু লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তনু আকাশকে ডাকে না। এবং সে নিজেও কেবিন থেকে বের হয় না। আকাশ বুঝতে পারে তনুর হয়তো মন ভিষণ খারাপ। আকাশ ডেস্ক থেকে উঠে সোজা কেন্টিনে চলে যায়। এরপর কেন্টিন থেকে নিজের টাকায় তনুর জন্য এক প্যাকেট খাবার কিনে তনুর কেবিনে যায়। কেবিনে গিয়ে দেখে তনু ডেস্কের উপরে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আকাশ কেবিনে ঢুকে তনুকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে খাবারের প্যাকেট টা ডেস্কের এক পাশে রেখে তনুর মাথায় আলতো করে হাত দিয়ে তনুকে ডেকে বলে,
–‘তনু লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার জন্য খাবার এনেছি। তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে খাবার গুলো খেয়ে নাও।’
তনু ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আকাশকে বলে,
–‘আমি কি আপনাকে বলেছি আমার জন্য খাবার আনতে?’
–‘নাহ বলোনি।’
–‘তাহলে কেন এনেছেন?’
–‘এমনিতেই।’
–‘দেখুন আমি বাচ্চা নই। আমাকে এক্সট্রা কেয়ার দেখাতে আসবেন না। অনুগ্রহ করে খাবার গুলো নিয়ে গিয়ে নিজেই গিলে খান।’
তনুর কথায় আকাশের চরম মন খারাপ হয়। তবে আকাশ সেটা প্রকাশ করে না। তনুর কথায় চুপ করে খাবারের প্যাকেট টা ডেস্ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসতে ধরে। এমন সময় পিছন থেকে তনু আকাশকে ডেকে বলে,
–‘আচ্ছা শুনেন খাবার গুলা যেহেতু কষ্ট করে এনেছেন তাহলে আর দ্বিতীয়বার কষ্ট করে নিয়ে যেতে হবে না। ডেস্কের উপরেই আবার রেখে যান। আমি খেয়ে নিব নে। আর এই যে নিন খাবারের টাকা।’
তনু ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে ডেস্কের উপরে রাখে। আকাশ তনুর কথা অনুযায়ী ডেস্কের উপরে খাবারটা রাখে। তবে যখন টাকা নেওয়ার পালা আসে তখন সে তনুকে বলে,
–‘তনু টাকা টা না নিলে হয় না?’
–‘আকাশ সাহেব ফ্রি-তে খাওয়ার স্বভাব আমার খুব কম। তার উপরে আপনার পকেটের টাকা অপচয় করে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। টাকাটা নিন। আর আপনি দুপুরের খাবার খেয়েছেন?’
আকাশ তনুকে খেয়েছে বলে মিথ্যা জওয়াব দেয়। সত্যিকারত্বে আকাশ কিছুই খায়নি। আসলে আকাশের কেন জানি কিছু ইচ্ছে করছে না। তাই সে কোনো কিছুই খায়নি। কেন্টিন থেকে তনুর জন্য খাবার নিয়ে সোজা ফিরে এসেছে। তবে কোনো একটা অজানা কারণে আকাশ তনুকে মিথ্যা বলে ডেস্কের উপরে খাবারটা রেখে তনুর দেওয়া টাকাটা নিয়ে সে চলে আসে। দেখতে দেখতে বিকাল হয়৷ অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। সবাই অফিস শেষ করে যে যার মতন বাড়ি চলে যাচ্ছে। আকাশ ও অফিস ছুটি হওয়ায় চলে যায়। পরেরদিন যথারীতি আকাশ অফিসে চলে আসে। অফিস শুরু হয়ে গেছে। তনুও অফিসে চলে এসেছে। অফিস শুরু হওয়ার ঘন্টা খানিক পর তনুর কাছে একটা ফোন আসে। তনু ফোনটা রিসিভ করে। অপরপাশের মানুষটা তনু ফোন রিসিভ করার পর যা বলে তা শুনে তনু পুরোদমে চমকে উঠে…
#অবেলায়_তুমি (পর্ব-১২)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ
তনুর কাছে একটা ফোন আসে। তনু ফোনটা রিসিভ করে। অপরপাশের মানুষটা তনু ফোন রিসিভ করার পর যা বলে তা শুনে তনু পুরোদমে চমকে উঠে। তনু বুঝে উঠতে পারছে না ফোনের অপরপাশের মানুষ টাকে তার বিয়ের কথা কে বলেছে। এই বিয়ের বিষয়ে তো তেমন কেউ জানে না। সে এবং আকাশ আর ছাড়া বাহিরের একমাত্র খালি খালেক সাহেব জানেন। তনু আশ্চর্য হয়ে ফোনের অপরপাশের মানুষটাকে জিজ্ঞাস করে,
–‘আসাদ সাহেব আপনাকে আমার বিয়ের কথা বলেছে?’
–‘কে বলবে আর আপনার হাজবেন্ড আকাশ সাহেব বলেছেন। উনি গতকাল আমার কাছে এসেছিলেন। তিনিই আপনার আর তিনার কথা বলেছেন। এছাড়া পার্টির বিষয় নিয়ে নাকি আপনার মন ভিষণ খারাপ। দেখুন এটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ সেদিনের বিষয়টা নিয়ে আমরা অনেকেই কৌতূহলী হয়ে ছিলাম। তবে গতকাল আকাশ সাহেব আমার কৌতূহল দূর করে দিয়েছেন। আপনি ঐ বিষয়টা নিয়ে একদম টেনশন করবেন না। আমরা সত্যিটা জেনে গেছি। আকাশ সাহেব আমাকে সত্যিটা জানিয়ে দিয়েছে।’
–‘কি সত্যি জেনেছেন আসাদ সাহেব? আর আকাশ আপনাকে কি বলেছে?’
–‘আরেহ ঐ আরকি। আপনাদের দু’জনের মধ্যে নাকি সেদিন একটু রাগারাগি হয়েছিল। তাই আকাশ সাহেব সেদিন নাকি রেগে গিয়ে উল্টো-পাল্টা বলেছিল।’
–‘হুম।’
–‘আচ্ছা শুনুন এবার আর মন খারাপ করে থাকবেন না। সেদিনের বিষয়টা নিয়ে আপনার অসম্মান হয়েছে ভেবে আকাশ সাহেবের ও ভিষণ মন খারাপ। উনি গতকাল যখন আমার সাথে কথা বলছিল, তখন উনার চেহারা একদম মলিন হয়ে ছিল। তাই অনুরোধ করবো মন খারাপ করে থাকবেন না।’
–‘আরেহ নাহ মন খারাপ করে নেই।’
–‘যাক তাহলে তো ভালো। তবে আপনার উপর কিন্তু একটা অভিযোগ আছে তনু ম্যাডাম, সরি মিসেস হবেন। কারণ এখন তো আকাশ সাহেবের বউ আপনি। তাই মিসেস বলেই ডাকবো এখন থেকে।’
–‘আমি আবার কি করেছি আসাদ সাহেব!’
–‘কি করেন নি সেটা বলেন। আপনি আর আকাশ সাহেব বিয়ে করে নিয়েছেন, অথচ আমরা সেই বিষয়ে কিছুই জানি না!’
–‘আসলে আসাদ সাহেব আমরা বিয়ের বিষয়টা গোপন রাখবো বলে ঠিক করেছিলাম। তাই কাউকেই জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম সঠিক সময় আসলে সবাইকে জানিয়ে আবারো জাঁকজমক ভাবে বিয়ে করবো। তাই আরকি।’
–‘থাক হয়েছে। আপনারা যদিও বা চাননি কাউকে বিয়ের বিষয়ে জানাতে, কিন্তু তারপরেও আমরা এখন সকলেই জেনে গিয়েছি। এবার ভালো একটা দিনক্ষণ ঠিক করে বিয়ের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলুন। বহুদিন হলো ভালো কোনো বিয়ে খাচ্ছি না। এবার আপনাদের উছিলায় ভালো একটা খাওয়া হবে।’
–‘অবশ্যই আসাদ সাহেব। খুব জলদিই বিয়ের অনুষ্ঠানটা করবো।’
–‘হুম দোয়া রইলো আপনাদের জন্য। আর এবার তাহলে ফোনটা রাখছি। অফিসের বাহিরে যেতে হবে আমাকে একটু।’
–‘আচ্ছা।’
আসাদ সাহেব ফোন কেটে দেয়। আসাদ সাহেবের সাথে কথা শেষ করে তনু ফোন রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে জলদি পা চালিয়ে সোজা আকাশের কাছে চলে যায়। আকাশ তনুকে কেবিন থেকে বেরিয়ে চালু পায়ে হেঁটে তার কাছে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। চুপ করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। অপরদিকে তনু আকাশের কাছে এসে আকাশকে প্রশ্ন করে,
–‘আপনি গতকাল কোন সময় আসাদ সাহেবের কাছে গিয়ে আসাদ সাহেবের সাথে দেখা করেছেন?’
–‘অফিস ছুটির পর।’
–‘ওহ ভালো। তবে আপনি এই কথা কেন বলেছেন যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে?’
–‘আসলে আমার জন্য তোমার সম্মান নষ্ট হয়েছে। তাই আসাদ সাহেবকে ঐ কথাটা বলেছি। যাতে করে উনারা তোমাকে ভুল না বুঝে।’
–‘ওহ আচ্ছা। কিন্তু আপনি ঐ দিনের কথাটা নিয়ে মিথ্যা কেন বলেছেন, যে আপনার সাথে আমার রাগারাগি হওয়ায় আপনি ওসব বলেছিলেন?’
–‘মিথ্যা বলি নাই। সেদিন তোমার সাথে আগে না হোক পরে ঠিকই রাগারাগি হয়েছে।’
–‘হুম আচ্ছা মানলাম এটা সত্যি। কিন্তু আমি তো আপনাকে বলিনি আমার সম্মান যেটা নষ্ট করেছেন সেটা ফিরিয়ে দিন। তাহলে আপনি কেন এতসব কিছু করতে গেলেন?’
–‘কারণ তোমার মুখে আমি সব সময় হাসি দেখতে চাই। তোমার মলিন চেহারা আমার একদম ভালো লাগে না। আমি গত পরশু দিনের ঘটনার পর থেকে দেখছি তোমার মনের অবস্থা ভালো নেই। আর সেটা একমাত্র হয়েছে খালি আমার কারণে। তাই আমি এতসব কিছু করেছি।’
–‘আকাশ সাহেব আপনি আমার মন খারাপ হয় মতন কাজ ও করবেন। আপনার সেই কাজের কারণে আমার মন খারাপ হলে আবার আপনার নিজের ও খারাপ লাগে। বাহ বেশ ইন্টারেস্টিং তো ব্যাপার টা।’
আকাশ চুপ করে থাকে। তনুর কথা শুনে কেমন যেনো লজ্জা কাজ করছে আকাশের ভিতরে। আকাশ লজ্জায় নজর সরিয়ে নেয় তনুর দিক থেকে৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তনু আকাশের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
–‘হয়েছে জনাব আর লজ্জা পেতে হবে না। আমি আপনাকে লজ্জা দিতে কথাটা বলিনি। যাস্ট এমনিতেই বলেছি। তাই আর লজ্জা পেতে হবে না। এবার চলেন আমার সাথে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে।’
তনুর কথায় শুনে আকাশ তনুকে জিজ্ঞাস করে,
–‘কোথায় যাবো? আর কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তনু?’
–‘সেটা গেলেই দেখতে পাবেন। এবার চলেন।’
আকাশ এতো সময় চেয়ারে বসা ছিল। তনুর কথা মতন উঠে দাঁড়ায়। আকাশ উঠে দাঁড়াতেই তনু আকাশের হাত ধরে টানতে টানতে তাকে অফিসের সকল কর্মচারীদের সামনে নিয়ে যায়। কর্মচারী সবাই তনু আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে তনুর সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ও নাই। তনু আকাশকে সকলের সামনে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখানোর দিন যেভাবে আকাশের হাত পেঁচিয়ে ধরেছিল সেভাবে আজকেও আকাশের হাত পেঁচিয়ে ধরে। সবাই তনুর কাজে রীতিমতো অবাক। তনু সবাইকে আরো অবাক করে দিয়ে বলে,
–‘কয়েক মিনিটের জন্য কাজ বন্ধ রেখে সবাই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি সেদিন আকাশকে অহেতুক অপমান করেছিলাম। বেচারা এক দিনে সাতটা ফাইল কমপ্লিট করেছে। সেই সাতটা ফাইলের মধ্যে একটা ফাইল ছাড়া কোথাও কোনো ভুল হয়নি তার। আর যেই ফাইলে ভুল হয়েছে সেটাও একদম অতি সামান্য ছিল। কিন্তু সেদিন আমার মাথা কোনো একটা কারণে খারাপ ছিল। যার কারণে আমার সমস্ত রাগ আমি আকাশের উপরে ঝেড়েছি। তাই আপনারা আগামীতে আর কখনো কেউ আকাশের দিকে বাঁকা চোখে তাকাবেন না। তাহলে কিন্তু আমার চাইতে ভয়ানক কেউ হবে না বলে দিলাম। আর আরেকটা কথা। আপনারা আকাশের দিকে বাঁকা চোখে তো তাকাবেন এই না, সেই সঙ্গে আজ থেকে আকাশকে সবাই সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। কারণ সে আমার অনেক,অনেক,অনেক কাছের একজন মানুষ। বলতে পারেন সে আমায় হৃদয়ে বসবাসকারী একজন লোক। তার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। তাই সকলকে যেটা বলেছি সেটা মাথায় রাখবেন। এবার সবাই কাজে মন দিন।’
তনু কর্মচারীদেরকে আকাশের বিষয়ে কিছু কথা বলে আকাশের হাত ধরে আকাশকে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। আকাশ অনেকটা আশ্চর্য হয়। তবে সে কিছুই বলে না। এদিকে কর্মচারীরা তনু চলে যাওয়ার পর একে অপরের সাথে কানাঘুষা শুরু করে দেয় আকাশ তনুর কি হয়। কেন তনু আকাশকে এতো প্রায়োরিটি দিলো। কেন তনু জোর গলায় সবাইকে বললো আকাশকে সম্মান দিতে। আর কেনোই বা তনু আকাশের হাত ঐ ভাবে ধরে ছিল। একেক জন অন্য জনের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে শুরু করে৷ কর্মচারীদের কানাঘুষা গুলো ম্যানেজার খালেক সাহেব শুনতে পায়। তাই খালেক সাহেব সবাইকে সতর্ক করে বলে,
–‘প্রতিটা নারীর জীবনে একজন খুব মূল্যবান মানুষ থাকে৷ ম্যাডামের জীবনের মূল্যবান মানুষটা হচ্ছে আকাশ মাহমুদ সাহেব। তাই ম্যাডাম উনাকে নিয়ে এতোকিছু বলেছে। আপনারা এবার কানাঘুষা বন্ধ করে যে যার কাজে মন দিন। না হয় আপনাদের নামে গিয়ে ম্যাডামের কাছে নালিশ করে আসবো।’
খালেক সাহেবের কথা শুনে সবাই কানাঘুষা বন্ধ করে কাজে মন দেয়। অপরদিকে তনু আকাশকে সঙ্গে করে নিয়ে নিজের কেবিনের ভিতর এসে থেকে দরজা আঁটকে দেয়। তারপর আকাশকে তনুর চেয়ারের সামনে নিয়ে গিয়ে বলে,
–‘আমার চেয়ার টাতে বসো।’
আকাশ পুরো থতমত খেয়ে যায় তনুর কথা শুনে। কারণ প্রথমত তনু তাকে ভিতরে নিয়ে এসে দজরা বন্ধ করে দিয়েছে। তার উপরে এখন আবার তুমি করে বলছে। আকাশ তনুর মতিগতি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কি করতে চাইতে তনু। বেকুবের মতন চেহারা করে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। পাশ থেকে তনু আকাশকে তার দিকে বেকুবের মতন তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেই আকাশকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর আকাশকে প্রশ্ন করে,
–‘কি হলো অবাক হচ্ছো যে?’
–‘অবাক করছো তাই অবাক হচ্ছি। শুরুতে কর্মচারীদের সামনে নিয়ে গিয়ে আমার নামে গুণগান করলে। সাথে আরো সকলকে বললে আমাকে সম্মান দিতে। এরপর এখন সঙ্গে করে কেবিনে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করার পাশাপাশি তুমি করে বলছো। এতোকিছু দেখে অবাক তো হবোই।’
–‘হুম অবাক তো হবাই। আচ্ছা আরেকটু অবাক করি তোমাকে?’
–‘মানে!’
–‘তুমি চোখ বন্ধ করো। তারপর মানেটা বুঝতে পারবে।’
–‘আজব তোমার মানে বুঝার জন্য চোখ কেন বন্ধ করবো?’
–‘আরেহ তোমাকে চোখ বন্ধ করতে বলেছি তুমি করো। আমি বললে তারপর চোখ খুলবে।’
আকাশ আর কথা না বাড়িয়ে তনুর কথা মেনে চোখ বন্ধ করে। আকাশ চোখ বন্ধ করতেই তনু ডেস্কের উপরে থাকা কলমদানির মধ্যে একটা ফল কাঁটার ছুরি ছিল যেটা হাতে তুলে নেয়। এরপর ছুরিটা আকাশের গলায় চেপে ধরে আকাশকে চোখ খুলতে বলে। আকাশ তনুর কথায় চোখ খুলে দেখে তনু তার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে ধরে আছে। আকাশ চোখ বড় বড় করে আশ্চর্য হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। আর তনু আকাশের আশ্চর্য হয়ে তাকানো দেখে জোরে জোরে পৈচাশিক ভাবে হাসতে আরম্ভ করে। তনুর হাসি দেখে মনে হচ্ছে তনু এই দিনটার জন্য বহু সময় ধরে অপেক্ষা করে বসে ছিল….
চলবে….
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)
চলবে….
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)