#অব্যক্ত_ভালোবাসা
#লেখনীঃআরভি_আহিয়াদ_তিহু
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্বঃ৩১
প্রায় মিনিট বিশেক সময় যাবৎ রুশা এক নাগাদে কেঁদে যাচ্ছে। ওর হাত দুটো এখনো বাঁধা রয়েছে। শান রুশার হাতের বাঁধন খুলে দেয়নি, আর রুশাও জোর করে নিজের হাতের বাঁধন খোলার কোনো ব্যর্থ চেষ্টা করেনি। শানের স্থির দৃষ্টি এখনো রুশার দিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু রুশা তখন থেকে একবারের জন্যেও শানের দিকে তাকায়নি। চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে হেঁচকি দিয়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। রুশার কান্না থামছে না দেখে শান রুশার হাতের বাহু ধরে টেনে নিয়ে এসে ওকে নিজের বুঁকের উপরে শুইয়ে দিল। রুশার কপাল গিয়ে ঠেকল শানের উন্মুক্ত বুঁকে। রুশা শানের থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্যে মোচড়া-মুচড়ি শুরু করল। শান এক হাত রুশার কোমড়ে রেখে ওকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
–“শুধুমাত্র মুখের বাঁধন খুলেছি, হাতের বাঁধন কিন্তু এখনো হাতেই আছে। অতিরিক্ত ছটফট করলে অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করতে আমার বেশি সময় লাগবে না রুশা।”
শানের কথায় রুশা দমে গেল। ওর কিঞ্চিৎ কমে যাওয়া কান্নার গতি আবারও বেড়ে গেল। ক্লান্ত শরীরের ভার হয়ে আসা মাথাটা গিয়ে ঠেকল শানের বুঁকের মাঝ বরাবর। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ গরম পানির ফোটা গুলো টুপটাপ করে শানের উন্মুক্ত বুঁকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। শান বেডের সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায়ই চোখ জোড়া বন্ধ করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। ‘ও’ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে ‘ও’ রুশাকে আজকে অনেকটা আঘাত দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা ছাড়া ওর কাছে আর অন্য কোনো উপায় ছিল না। ভালো ভাবে কথা বলতে চাইলে রুশা ওর কথা কখনোই শুনত না। রুশার মনে ওর প্রতি রাগের পরিমান এতটাই বেশি ছিল যে রুশা স্ব-ইচ্ছায় ওর কথা কখনোই মেনে নিত না। তাই শান বাধ্য হয়ে এই পথটা বেছে নিল। দরকার হলে এরজন্যে রুশার কাছে পরে মাফ চেয়ে নিবে। কিন্তু যাই হয়ে যাক ‘ও’ কোনো ভাবেই রুশাকে হারাতে পারবে না। প্রয়োজন পড়লে এরকম আরো হাজার’টা অন্যায় করবে, হাজার বার রুশার কাছে অপরাধী হবে, কিন্তু রুশাকে ছাড়া ‘ও’ আর অন্য কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবে না।
শান চোখ খুলে তাকাতেই ওর চোখ গেল রুশার চুলের খোপায়। ধস্তাধস্তিতে খোপায় আটকানো কাকড়া’টা ভেঙে দু-ভাগ হয়ে এখনো চুলের সাথেই আটকে আছে। শান এক হাত রুশার কোমড়ে রেখেই অন্য হাত দিয়ে রুশার চুল থেকে আলত হাতে কাকড়া’টা ছাড়িয়ে নিল। চুল থেকে কাকড়া’টা ছাড়াতেই রুশার সিল্কি চুলগুলো খুলে ঝরঝর করে রুশার পিঠসহ শানের বুঁকের উপরে লুটিয়ে পড়ল। শান হাতে থাকা কাকড়া’টা বেডের এক সাইডে রেখে রুশার চুল গুলোকে নাড়তে নাড়তে বেশ শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
–“রুশা, একটা গল্প শুনবে? যেখানে এক দাম্ভিক রাজা সবকিছু হারিয়ে নিজের মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার সেই শেষ সময়ে রূপকথার গল্পের মতো একজন রাজকন্যার আবির্ভাব ঘটল। সেই রাজকন্যা ওই দাম্ভিক রাজাকে এমন ভাবে নিজের মায়ায় জড়াল যে ওই দাম্ভিক রাজার মন, মস্তিষ্ক, ভাবনা, আবেগ সবকিছু জুড়ে শুধু ওই মায়াময়ী রাজকন্যার বিচরণ রয়ে গেল।”
শানের কথায় হুট করেই রুশার কান্নার গতি কমে এলো। ওর অবচেতন মন জানান দিল ‘ও’ যার জন্যে সেদিন শানদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল। আর শানের থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখন সেটাই হতে যাচ্ছে। শানের কথা শুনে ‘ও’ বেশ ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছে যে শান সবটা জেনে গেছে। আর সবটা জানার কারনেই এসব কথা বলছে। রুশার এসব ভাবনার মধ্যেই ওর শরীরে অসম্ভব কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। ওর হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুত উঠানামা শুরু করল। রুশার অবস্থা দেখে শান মৃদু হাঁসল। রুশাকে আগের থেকেও আরো শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে খানিকটা আরষ্ঠ কণ্ঠে বলা শুধু করল,
–“রুশা তোমার সেদিনের কথা মনে আছে, যেদিন আয়াশ আমাকে মে”রে রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়েছিল? প্রায় আড়াই বছর আগের কথা। সেদিন আমার নিস্তেজ, র’ক্তা’ক্ত শরীর’টা রাস্তায় পড়েছিল। আমি আবছা চোখে তাকিয়ে শেষ বারের মতো অন্ধকার পৃথিবীটাকে দেখে যাচ্ছিলাম। বাঁচার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার মধ্যে। আমার দু-পাশ দিয়ে একটার পর একটা গাড়ি ‘শা’ ‘শা’ করে নিজ গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছিল। হেডলাইটের আলোতে সবাই আমাকে দেখছিল ঠিকই। কিন্তু তাও তারা আমাকে সাইড কাটিয়ে নিজেদের গন্তব্যস্থলে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়টায় আমি ওখানে পড়ে থেকে নিজের মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম কখন একটা দ্রুতগামী গাড়ি আসবে আর আমার শরীরটাকে একবারে ছিন্নবিন্ন করে থেতলে দিয়ে চলে যাবে। ভালোবাসার মানুষটার বিশ্বাসঘাতকতা পাওয়ার পর এই পৃথিবীর সামান্য বাতাসটাও যেন আমার জন্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার মৃত্যু আসবে আর আমি এই ভয়ংকর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব।”
কথাটা বলতে বলতে শানের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসলো। রুশাও নিজের কান্না থামিয়ে চুপ করে শানের কথা শোনায় মনোযোগী হলো। শান গলা খ্যাকারি দিয়ে গলাটা একটু স্বাভাবিক করে আবারও বলা শুরু করল,
–“আমি যখন আমার নিশ্চিত মৃত্যু ধরে নিয়েছিলাম। তখন কেউ একজন এসে আমার হাত’টা শক্ত করে আকড়ে ধরল। আমার মাথাটা তার কোলে উঠিয়ে আমাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আমি অবাক হলাম। কিছুক্ষনের জন্যে ভেবে নিলাম ওটা আমার ইতি। কিন্তু আমার ভুল তখন ভাঙল যখন মেয়েটা আমার গালে হাত রেখে বলল, “আমি বেঁচে থাকতে আমি আপনার কিচ্ছু হতে দেব না।” কথাটা আমার কানে বারবার বাজতে শুরু করেছিল। কণ্ঠ’টাও বেশ পরিচিত মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন আমার এতটাই খারাপ অবস্থা ছিল যে ঠিকভাবে বুঝেই উঠতে পারিনি কণ্ঠস্বর’টা কার। শুধু অন্ধকারে নিভু, নিভু চোখে একটা আবছা কান্নাভেজা মুখশ্রি দেখেছিলাম। যাকে দেখে মনে হয়েছিল আমার কিছু হলে সে নিজেও ম”রে যাবে। বুঝে উঠতে পারছিলাম কে সে? যে আমার জন্যে এতটা উতলা হয়ে উঠেছে। আমার এসব ভাবতে ভাবতে মেয়েটা কিছু লোকের সাহায্যে নিয়ে আমাকে ধরে একটা অটোতে উঠাল। তারপর আমাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বসে রইল। কিন্তু ততক্ষণে অতিরিক্ত ব্লাড লস হওয়ার কারনে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর আমার সাথে কি হয়েছিল আমার আর কিচ্ছু মনে ছিল না। জ্ঞান ফিরেছিল প্রায় ঊনিশ দিন পরে। জ্ঞান ফেরার পর আমি জানতে পেরেছিলাম আমি সুইডেনের একটা হসপিটালে আছি।”
শানের কথা শেষ হতেই রুশার ভিতর থেকে আপনা আপনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো। ‘ও’ শানের বুঁক থেকে মাথা উঠিয়ে শানের দিকে একবার চোরা চোখে তাকিয়ে তারপর কম্পিত স্বরে বলল,
–“আ-আপনি এ-এসব আমাকে ক-কেন ব-বলছেন? আ-আমি এসব শ-শুনে ক-কি করব?”
শান রুশার দিকে সুক্ষ দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাঁসি ফুটিয়ে বলল,
–“আসলে আমি সেন্সলেস হওয়ার পর ওখানে কি হয়েছিল সেটা তো আমি জানিনা। তাই তোমার থেকে সবটা শোনার জন্যে তোমাকে এসব বললাম। আমি সেন্সলেস হওয়ার পর ওখানে কী কী হয়েছিল বলো তো?”
শানের প্রশ্নে রুশা থতমত খেয়ে গেল। চোখে-মুখে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–“আশ্চর্য! আমি কীভাবে জানব? আমি ওখানে ছিলাম না-কি?”
–“সেটাই তো। তুমি কীভাবে জানবে? তোমার তো জানার কথাই না। আচ্ছা যখন জানোই না, তখন আমার থেকেই নাহয় সবটা শোনো।”
নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলে আবারও নিজের চেহারার ভাব-ভঙ্গি সিরিয়াস করে ফেলল শান। রুশাও শানের কথা শোনার জন্যে ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। সিরিয়াস কণ্ঠে শান বলল,
–“সেন্স আসার পর সবার আগে আমার মাথায় ওই মেয়েটার কথাই প্রথমে এসেছিল। হসপিটালে আমার মা-বাবা, বোন সবাই আমার কাছে ছিল। কিন্তু আমি তাদের চিন্তা না করে শুধুমাত্র ওই মেয়েটার কথা চিন্তা করে যাচ্ছিলাম। বারবার এটা জানার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে-কে ওই মেয়েটা। একটু সুস্থ হওয়ার পর আম্মুকে মেয়েটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় আম্মু আমাকে জানায়, ওনারা হসপিটালে এসে কোনো মেয়েকে ওখানে দেখতে পাননি। তবে হসপিটালে এসে শুনেছিলেন একটা মেয়ে হসপিটালের রিসিভশনে আমাদের বাড়ির ল্যান্ড-লাইনের নম্বর দিয়ে বলেছিল ওই নম্বরে ফোন করে আমার অসুস্থতার ব্যাপারে আমার পরিবারকে জানাতে। এটা শোনার পর মেয়েটার ব্যাপারে আমার কিউরোসিটি আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম মেয়েটা আমার পরিচিত কেউ। কিন্তু কে হতে পারে সেটা কিছুতেই আন্দাজ করে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে প্রায় চার মাস একটানা ট্রিটমেন্টের পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু আম্মু হাজার চেষ্টা করেও আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারল না। আমি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ছুট লাগালাম সেই হসপিটালের উদ্দ্যেশ্য। হসপিটালে এসে হসপিটাল কর্তিপক্ষের সাথে কথা বলে আমি ওইদিনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলাম। সিসিটিভি ফুটেজ চেক করার পর যখন মেয়েটার চেহারা দেখলাম তখন আমি চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেয়েছিলাম। আমার পাঁয়ের নিচের মাটি সরে গিয়েছিল। যেই মেয়েটার জন্যে আমার মান-সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশে গেল, যার জন্যে আমি মা”র খেয়ে ম”র”তে বসেছিলাম। সেই মেয়েটাই কিনা আমাকে ওইদিন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল? আমি কিছুটা সময় স্তব্দ হয়ে ওখানেই দাড়িয়ে ছিলাম। মেয়েটা আমার উপরে দয়া দেখিয়েছে ভেবে আমার সেই সময়ে নিজেকেই নিজের শেষ করে দিতে ইচ্ছে করেছিল। কিছু সময়ের জন্যে আমার রাগের মাত্রাটা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে মেয়েটাকে মে”রে তার শরীরটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল।”
কথাটা বলে শান রুশার দিকে তাকাল। দেখল রুশার মুখটা একদম মলিন হয়ে গেছে। রুশা মলিন চেহারায় ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাঁসি ফুটিয়ে শানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
–“ওহ, তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেই বুঝি এতদিন এই কাজগুলো করে গেছেন? তাহলে আজকে থেমে গেলেন কেন? নিজের অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ন করে ফেললেই পারতেন। তাহলে আর কষ্ট করে আপনার আমাকে মারতেও হত না। আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিতাম।”
রুশার কথায় স্পষ্ট অভিমান প্রকাশ পেল। শান চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে খানিকটা ধমকের স্বরে বলল,
–“শাটআপ! আমার কথার মধ্যে একদম বাম হাত ঢোকাবে না।”
শানের ধমকে রুশা শানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়ে ওর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। শান লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“তোমাকে দেখে ক্ষনিক-ক্ষনের জন্যে আমি রেগে গেলেও পরক্ষণে তোমার কর্মকাণ্ড দেখে আমার সব রাগ উবে গিয়েছিল। আমি অবাক হয়েছিলাম। কারন তুমি আমার জন্যে ডাক্তারদের কাছে রীতিমতো হাত জোড় করে কিছু একটা অনুরোধ করে যাচ্ছিলে। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, ওনারা আমাকে এরকম ইনজুরড অবস্থায় দেখে পুলিশ কেস ছাড়া আমার ট্রিটমেন্ট করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তুমি ওনাদের কাছে হাত জোড় করে কান্নাকাটি করে রিকোয়েস্ট করেছিলে যাতে ওনারা দ্রুত আমার ট্রিটমেন্ট’টা শুধু করে। যেটা দেখে ওনারা আর তোমার অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। পুলিশ কেস ছাড়াই আমার ট্রিটমেন্ট শুরু করেছিলেন। এসব দেখেই অতিরিক্ত শকডে আমার মাথা ঘুরছিল। এরপর একজন ওয়ার্ড বয় এসে আমাকে এর থেকেও বড় শকিং নিউজ দিল। তুমি না-কি সেদিন ইমাজেন্সি টাকা যোগার করতে নিজের গলার একটা স্বর্ণের চেইন ত্রিশ হাজার টাকায় বন্ধক রেখে আমার অপারেশনের বিল দিয়েছিলে। তারপর আমার বাড়ির লোকের নম্বর রিসিভশনে দিয়ে ওখান থেকে কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বের হয়ে গিয়েছিলে। সবকিছু শুনে আমি ভিষণ রকম শকড হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছিলাম না। অনেক গুলো প্রশ্ন একসাথে আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যার একটার উত্তরও আমার কাছে ছিল না। তাই আমি হসপিটাল থেকে বের হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন তোমার সাথে দেখা করে তোমার থেকেই সব প্রশ্নের অ্যান্সার চাইব। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। বাড়িতে আসতেই জানতে পারলাম আমার বিজনেস একদম শাট ডাউন হওয়ার পথে। আমার নামে তুমি যেই নিউজ রিপোর্টারদের দিয়েছিলে তার জন্যে আমার সমস্ত রেপুটেশন একবারে শেষ হয়ে গেছে। সমস্ত ইভেস্টারেরা নিজেদের পার্টনারশিপ ক্যান্সেল করে দিয়েছে। কম্পানির স্টাফ’রা আমার অ-বর্তমানে কম্পানির সব টাকা এদিক থেকে ওদিক করে ফেলেছে। মোট কথা আমার রেপুটেশনের সাথে আমার কম্পানিও একদম ধ্বংসের পথে। ওই সময়টায় আমার তোমার উপরে আবারও রাগ হয়েছিল। তুমি চাইলেই ইতির বিরুদ্ধে থাকা সব প্রমাণ গুলো আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে দিতে পারতে। কিন্তু তুমি সেটা না করে আমি আয়াশকে মারায় তুমি আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে আমার কষ্ট করে গড়ে তোলা বিজনেস’টাকেই একেবারে শেষ করে দিয়েছিলে। সাথে আমার মান-সম্মানও।”
কথাটা বলে শান ফোশ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,
–“আমার বিজনেস থেকে শুরু করে বাকি সবকিছু ঠিক করতে আমার প্রায় এক বছরের মতো সময় লেগে গিয়েছিল। ততদিনে ইতি, আয়াশ, তুমি, তোমরা তিনজনেই আমাকে একেবারে ভুলে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমাদের একদিনের জন্যেও ভুলিনি। আমার অপমান আর আঘাতগুলো বারবার তোমাদের কথা আমায় মনে করিয়ে দিত। তবে আয়াশ আর ইতির প্রতি আমার ঘৃনা জমে থাকলেও আমি তোমাকে কখনো ঘৃনা করতে পারিনি। তোমার উপরে আমার রাগ ছিল ঠিকই। কিন্তু কোথাও গিয়ে তোমার উপরে আমার একটা দূর্বলতাও ছিল। কারন শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্যে-ই আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। তুমি কে সেটা জানার জন্যে-ই আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। আমার মস্তিষ্কের কোথাও একটা তোমার সেই কান্নারত চেহারাটা গেঁথে গিয়েছিল। যেটা প্রায়শই আমাকে রাতে ঘুমাতে দিত না। কখনো কখনো সারা রাত এটা ভাবতে ভাবতেই কেঁটে যেত যে তুমি কেন আমায় সেদিন বাঁচিয়েছিলে? আর কেনোই বা আমার জন্যে ওভাবে কেঁদেছিলে?”
কথাগুলো বলে শান কিছুটা সময় চুপ হয়ে রইল। তারপর আবারও শান্ত কণ্ঠে বলা শুরু করল,
–“তোমার ধারনা আমি তোমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে তোমাকে বারবার আঘাত করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কখনোই তোমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইনি। আমি যতবার তোমাকে আঘাত করেছি যাস্ট রাগের বশে করে ফেলেছি। ইন্টেনশনালি কখনো তোমাকে আঘাত করা আর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা আমার মাথাতেই আসেনি। আর যদি বিয়ের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করো। তাহলে বলব, তখন তোমাকে বিয়ে করার শুধু একটাই কারন ছিল। আয়াশের থেকে তোমাকে দূরে রাখা। কেন যেন আমি তখন তোমাকে আয়াশের পাশে একদম সহ্য করতে পারতাম না। আমার মনে হত আয়াশ ইতিকে যেমন আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তেমনি তোমাকেও আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। তাই তোমাকে না জানিয়ে তোমাকে দিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার পেপারে সাইন করিয়ে রেখেছিলাম। যাতে ওই বিয়ের দোহাই দিয়ে আয়াশকে তোমার জীবন থেকে একেবারের জন্যে দূরে সরাতে পারি। তবে আয়াশের ব্যাপারে সবকিছু জানার পর সেই ইচ্ছেটাও আমার আর এখন নেই। ওর উপরে আমার এখন আর কোনো রাগও নেই। ‘ও’ বেচারা তো শুধুমাত্র আমার জীবন থেকে একটা বিশ্বাসঘাতক’কে কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমার পরিবার তো ওর থেকে ওর সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ওর পুরো জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে। জানো রুশা, সেদিন সিকদার ভিলার ছাদে তুমি আর আয়াশ যখন কথা বলছিলে তখন তোমাদের সবকথা আমি শুনেছিলাম। সব শোনার পর আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপসোসে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আই উইশ, আমি আম্মুর কথা শুনে সেদিন তোমাকে বিয়ে করতে যদি রাজি হয়ে যেতাম। তাহলে আমাদের লাইফে আর এতকিছু ঘটতোই না।”
কথাগুলো বলতে বলতে শান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রুশা এতক্ষণ চুপ করে শানের কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার ‘ও’ শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
–“এখন এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এবার আপনি আপনার মতো নিজের লাইফ নিয়ে হ্যাপি থাকেন। আর আমাদেরকেও আমাদের মতো হ্যাপি থাকতে দিন। সেদিন ফোনে আমি যে আপনার সাথে মিসবিহেব করেছি। তারজন্যে আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি। তবে আপনি আজকে যেটা করলেন তার জন্যে আমি আপনাকে কোনোদিনও মাফ করব না।”
রুশার কথায় শান ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–“তোমার কাছে মাফ চেয়েছে কে? আমি আজকে যেটা করেছি তারজন্যে আমি মোটেও রিগ্রেট ফিল করছি না। বরং আমি তোমাকে এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার ক্যারেক্টারে যদি প্রবলেম থাকত, অথবা তোমার সাথে আমার যদি উল্টাপাল্টা কিছু করারই ইচ্ছে থাকত তাহলে সেদিনই করতে পারতাম যেদিন তোমাকে আমি ফাস্ট টাইম তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। এন্ড তারপরেও আমার কাছে হাজারটা অপশন ছিল তোমাকে মলেস্ট করার। কিন্তু আমি এরকম কিছুই করিনি। আমার এরকম কিছু করার ইন্টেনশন কখনো ছিলোই না। আমি বরাবরই তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। এবং আজ অবদি তোমাকে যতবার প্রপোজাল দিয়েছি সেটা শুধুমাত্র বিয়ের জন্যেই দিয়েছি। অন্য কোনো বাজে প্রপোজাল আমি তোমাকে কখনো দেইনি। অথচ তুমি আমাকে কথায় কথায় ক্যারেক্টারলেস বানিয়ে দেও। লজ্জা করেনা তোমার? নিজের হাজবেন্টকে ক্যারেক্টারলেস বলতে?”
শেষের কথাটা শান কিছুটা দুষ্টুমির ছলে বলল। শানের কথায় রুশার মুখটা থমথমে হয়ে গেল। রুশা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–“আমি আপনাকে হাজবেন্ট হিসেবেও মানি না। আর এসব কোর্ট ম্যারেজেরও আমার কাছে কোনো মূল্য নেই। আই যাস্ট ওয়ান্না ডিবোর্স।”
শান মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য হাঁসল। তারপর বিদ্রুপের স্বরে বলল,
–“রুশানি, যখন আমি আমার অনুভূতি সম্পর্কে জানতাম না, তখনই তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে তোমাকে আমি কিডন্যাপ করে তোমাকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিলাম। আর এখন তো আমি জানি যে আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারব না। তাহলে তুমি ভাবলে কিভাবে তুমি চাইলেই আমি তোমাকে ডিবোর্স দিয়ে দিব? এরকম চিন্তা-ভাবনা তোমার মাথায় আসলোও বা কীভাবে? তাও যদি তুমি আমাকে ভালো না বাসতে তাহলেও নাহয় একটা কথা ছিল। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তাহলে এখানে এখন তো ডিবোর্সের কোনো প্রশ্নই আসে না।”
শানের কথা শুনে রুশা অবাক হয়ে শানের দিকে তাকিয়ে রইল। শানের বলা কথাগুলো বারবার ওর কানের কাছে রিপিড হতে লাগল। শান এত অনায়াসেই ওকে নিজের মনের কথা বলে দিবে সেটা ‘ও’ কখনো ভাবতেও পারেনি। আর তাছাড়া শানও যে রুশার অনুভূতির ব্যাপারে বুঝতে পেরে গেছে এটা রুশার কাছে আরও শকিং একটা ব্যাপার। রুশা কখনো চায়নি ওর মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতির ব্যাপারে কেউ জানুক। কেউ জানুক যে রুশাও নিজের প্রথম ভালোবাসার কাছ থেকে প্রত্যেখান পেয়ে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বহুবার নিজেকে আঘাতও করেছিল। কিন্তু কাউকে কখনো সেটা বুঝতে দেয়নি। নিজেকে সব সময় কঠিন রেখে নিজের ভালোবাসাটাকে সারাজীবন অব্যক্ত-ই নিজের মনের মধ্যে পুষে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আপসোস, শান সবটা বুঝে ফেলেছে। এইজন্যেই রুশা শানের সাথে সব সময় রুড বিহেব করত, শানের থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করত। যাতে শানের প্রতি ওর দূর্বলতা’টা কখনো শান বা অন্যকারো সামনে প্রকাশ না পায়। কিন্তু এতকিছু করেও লাভের লাভ কিছুই হলো না। সেই শান শেষ পযর্ন্ত সবটা বুঝেই গেল। এসব ভেবে রুশা একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর করুন দৃষ্টিতে শানের মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল,
–“আমার হাতে ভিষণ লাগছে মিঃ রায়জাদা। আমার হাত’টা খুলুন আর আমাকে যেতে দিন প্লিজ। আমার এখানে থাকতে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আমার বাসায় যেতে চাই।”
রুশার কথা শুনে শান স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বেশ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
–“পালাতে চাইছো? কার থেকে? আমার থেকে না-কি নিজের এত বছরের লুকিয়ে রাখা অনুভূতি গুলোর থেকে?”
শানের প্রশ্নে রুশা চোরা চোখে একবার শানের দিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলল। কিন্তু প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না। শান লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুশার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ছাড়া পেতেই রুশা তড়িঘড়ি করে উঠে ছিটকে শানের থেকে বেশ অনেকটা দূরে সরে গেল। শান বেড থেকে নেমে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লকটা খুলে প্যান্টের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে সটান হয়ে দাড়িয়ে পড়ল। রুশা তড়িৎ গতিতে ওড়নাটা হাতে নিয়ে দ্রুত মাথায় পেচিয়ে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দ্যেশে পাঁ বাড়াল। শানকে ক্রস করে যেতে নিতেই শান এক হাত বাড়িয়ে রুশার কোমড়ে রেখে ওকে হেচকা টান দিয়ে নিজের মুখোমুখি এনে দাড় করাল। আচমকা শানের এমন কান্ডে রুশা ভরকে গেল। শান রুশাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর মুখের উপরে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলোকে ওর কানের পিছনে গুজে দিতে দিতে অতি শান্ত গলায় খানিকটা হুমকির স্বরে বলল,
–“আমার থেকে নিজের অনুভূতি গুলো লুকিয়ে রাখতে চাও, বেশ ভালো কথা। তবে তোমার উপরে আমার সাংঘাতিক দূর্বলতা আছে। আমি তোমাকে ছাড়া এখন নিজের অস্তিত্ব এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনা। তাই যদি ডিবোর্স কিংবা এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মাথাতেও এনে থাকো। তাহলে সেটা মাথা থেকে একেবারের জন্যে ঝেড়ে ফেল। কারন তুমি যেখানেই যাবে, আমি ঠিক তোমার পিছু পিছু সেখানে চলে যাব। সেইজন্যে অযথা আমাকে ব্যতিব্যাস্ত করার চেষ্টা একদম করবে না। কারন তোমাকে পাঁয়ে শেকল পড়িয়ে জোর করে আটকে রাখার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। আমি তোমাকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে দিতে চাই। শুধু দিনশেষে তুমি আমার কাছে ফিরে আসলেই হলো। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, আশাকরি নিজের ভালোটা তুমি নিজেই বুঝবে।”
কথাটা বলে শান রুশার কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু খেয়ে ওর কোমড় ছেড়ে দিল। রুশা কপালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ হতবম্ভ হয়ে দাড়িয়ে থেকে এক দৌড়ে ওখান থেকে বের হয়ে চলে গেল। শান রুশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রুশাকে সবটা বলতে পেরে ওর মনটা আজকে অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে। এতদিন মনে হচ্ছিল বুঁকের উপরে একটা পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশের মানুষজন থেকে শুরু করে নিজেকেও নিজের কাছে কেমন অসহ্য লাগছিল। তবে আজকে অনেকটা রিলিফ লাগছে। বুঁকের মধ্যে অদ্ভুত রকমের একটা সুখ অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক সাধনার কাঙ্খিত জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি ওর কাছে আসতে চলেছে।
#চলবে
Baki part gulo tratri den plzzzz
Golpo ta akhno pelam na 😒🥺
Next part gulo kothay?kove diben?