অভিমান পর্ব ১২

#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১২
জানালায় বসে নাম না জানা কোনো পাখি টুই টুই করে ডাকছে। অপরাহ্ণের শেষ ভাগের সোনালি-হলুদাভ আলো মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেই আলো গায়ে মাখিয়ে জমকালো গালদুটোকে আরো চকচকে করে নিয়ে ঝুমকো জানালার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘জানিস প্রাপ্তি। ওর একটা অতীত ছিলো?’
প্রাপ্তি অসহযোগ গলায় প্রশ্ন করলো, ‘অতীত?’

জানালা থেকে সরে এসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঝুমকো বলল, ‘হুম অতীত। আমার আগে একটা মেয়ের সাথে ছয় মাসের রিলেশন ছিলো ওর। ওর অতীত নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যাথা কোনো কালেই ছিলো না। কিন্তু একদিন হলো কি জানিস?’

‘কি হলো?’ প্রাপ্তির ভীতি গলা।

‘একদিন আমি নিয়নের সাথে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় দেখি রাহান তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। আমি ওকে কোনো মেয়ের সাথে কখনোই সহ্য করতে পারতাম না। ওর এক্স গার্লফ্রেন্ডটা ওর সাথে আবার সব নতুন করে শুরু করতে চায়। সেটা দূর থেকেই শুনতে পেয়েছিলাম আমি। ওর গার্লফ্রেন্ড টা আবার খুব সুন্দরী ছিলো। আমার খুব রাগ হয়েছিলো জানিস। আমি ফোন টোন বন্ধ রেখে ওর সাথে যোগাযোগের সকল পর্যায় বন্ধ করে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছিলাম। তখন চলছিলো আমার ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম। দুদিন আমাদের কোনোরকম কথা হয়নি। দেখা সাক্ষাৎ ও হয়নি। দুদিন পরেই আমি ফোন খুলি। পরীক্ষার হল থেকে বেরোনোর পরই আমার ফোনে ওর মেসেজ দুটো এলো। কি অদ্ভুত তাই না! অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার ফোন ধরতে এক মিনিট দেরি হলে মনে হতো পুরো ঢাকা শহর মাথায় তুলে ফেলবে ও। আর দুদিন আমার সাথে দেখা না করে কথা না বলে সে দিব্যি দিন কাটাচ্ছিলো। শুধু তাই না বিদেশ অবধি চলে গিয়েছিলো সম্পর্ক ছিন্ন করে।’

প্রীতি আহাজারি গলায় বলল, ‘বলিস কি?’

‘হুম। তাহলেই বল এতে আমি কি ধারণা করবো? আমার মস্তিষ্ক কি এটাই ভেবে নেবে না যে সে তার এক্স গার্লফ্রেন্ড এর জন্যই আমাকে ছেড়েছে?’ ঝুমকোর গলার স্বর অস্পষ্ট।

‘নাও হতে পারে। অন্য কারনও হতে পারে।’

‘কি হতে পারে? যেই জায়গায় আমার রাগ করার কথা ছিলো। ব্রেকাপ করলেও আমার করার কথা ছিলো। ওর কঠিন অতীত জেনেও আমি ওকে ছেড়ে যাই নি। আর সেখানে রাহান ব্রেকাপ করলো। কি আশ্চর্য!’

প্রাপ্তি কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘দেখ দোস্ত আমার মনে হচ্ছে তোর একবার বিষয়টা ঘাটিয়ে দেখা দরকার। তুই একবার ভাইবে দেখ।’

‘ভাবাভাবির কিছুই নাই। ওরে আমি ভালোবাসছিলাম। এমন ভালোবাসছিলাম যে ওর দিকে কোনো মেয়ে তাকাইলেও রাগে আমার শরীর জ্বলতো।’

‘একটা কথা তাইলে তুই ভাব তো, তোর সাথে নিয়নরে দেইখে কি তাইলে রাহান ভাইয়ার এক ফুটাও খারাপ লাগে নাই?’

ঝুমকোর কপাল কুচকে গেলো। আলগা গলায় সে বলল, ‘নিয়ন আমার বন্ধু। আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক কোনো কালেই ছিলো না।’

‘সেটা না হয় তুই বুঝলি আর নিয়ন বুঝলো। বাকিরা যে বুঝবো তার কি গ্যারান্টি? ‘

ঝুমকোকে এ পর্যায়ে খানিকটা বিব্রত দেখা যায়। সে গালে হাত দিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবলো। প্রাপ্তি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল, ‘আস্তা বাদ দে দোস্ত। এখন তোর আর নিয়নের বন্ধুত্বের কাহিনী ক শুনি। এই নিয়নটাও না হঠাৎ কইরেই কই হারায় গেলো। শালারে পাইলে রাম কেলান কেলামু। ‘

ঝুমকো ফিচেল গলায় বলল, ‘এখন না। ভালো লাগতাছে না রে দোস্ত। তুই যা। পরে মিট করিস আমার সাথে। আর নিয়নের বাড়িত খোঁজ নিছিলি?’

‘হ রে। আন্টি বলবার পায় না। উলটে আরো টেনশন করতাছিলো।’

‘ওহ।’

‘শোন আমি তাইলে যাই। এক কাজ কর। মাস্টার্স এ ভর্তি হয়ে যা। তোরে ছাড়া আমার ভাল লাগে না রে দোস্ত। দুই বান্ধবী একসাথে থাকমু ক্যাম্পাসে আড্ডা দিমু! আর এখন তো তোমার আশিক ও আইসে পরছে আর চিন্তা কি! আর কত দেবদাসী হবা? ‘

‘ভাইবে দেখবনি। তুই যা।’

‘আচ্ছা গেলাম। খোদা হাফেজ।’

‘খোদা হাফেজ’

____________________________

আকাশে ছলছল করছে মেঘ। বইছে নিদারুন বাতাস। এক ফালি হ্লুদাভ রোদ এসে আদর দিচ্ছে ঝুমকোর গালে। ঝুমকোর গাল দুটো তখন হাসছে। চিকমিক করছে। সাথে আকর্ষিত করছে আশেপাশের যুবকদের। চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে প্রাপ্তির দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে ঝুমকো বলল,

‘আমাকে কি অদ্ভুত দেখতে লাগছে? সবাই তাকিয়ে আছে কেনো?’

‘আরে ধ্যাত অনেক সুন্দর লাগতাছে তোরে।’ প্রাপ্তি হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ন্যায় বলল।

তারা শপিং এ এসেছে। সেদিন রাহানের জন্য ঝুমকো কেনাকাটা করতে পারি নি। এদিকে প্রাপ্তির ও কিছু জরুরি জিনিস পত্র কেনা দরকার। ব্যস দুই বান্ধবী এসে পড়লো শপিং মলে। রোদের কিরন গুলোকে একপাশে ফেলে রেখে ঝুমকো চলল শপিং মলের ভেতরে। শপিং মলে আজ ভিড় কম। দু তিনটে দোকান ঘোরার পর ঝুমকো নিজের পাশে কারো উপস্তিতির টের পেলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে সোহেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখে খেলে গেলো এক দারুন বিস্ময়তা। সোহেলের চোখ তখন অবধি নিবদ্ধ ঝুমকো ঠোঁটে, মুখে। ঝুমকো সোহেলকে ভালো করে একবার পরখ করে নিয়ে দাঁত কিড়িমিড়ি করে কিছু বলল।

‘হারামি।’

‘কি বললে?’ কথাটা ঠিক মতো শুনতে পায় নি সোহেল।

ঝুমকো সোহেলের কথা পাত্তা দিলো না তেমন। সে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কি চাই?’

‘কিছু না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমাকে শপিং মলে ঢুকতে দেখে চলে এলাম।’ সোহেলের নির্বিকার স্বীকারোক্তি।

ঝুমকোর রাগ উঠে প্রচন্ড। এই মুহুর্তে মন চায় সোহেলের গালে বজ্রপাতের মতো শব্দ করে একটা চর লাগাতে। কিছু কড়া কথা শুনাতে ঝুমকো উদ্ধত হয়।
কিন্তু সোহেলকে ছাড়িয়ে সামনে সেই নজরকাড়া যুবকটাকে দেখে সে থেমে গেলো। উঁচু নাক, শক্ত চোয়ালের ভাঁজে টোল, ছোট ছোট তীক্ষ্ণ অভিমানী দুটো চোখ, কপালে রাগের ভাঁজ, শ্যামলা সেই চোখা মুখের দিকে তাকাতেই ঝুমকোর মনে হলো, এই লোকটার শ্যামলা হওয়া আবশ্যক ছিলো। লোকটার গায়ের রঙ যদি এর চেয়ে আর এক ফোটাও গাঢ় হতো তবে একদমি মানান সই হতো না।

রাহান ঘুরে দাঁড়ায়। তার অভিমানী চোখ দুটোতে খেলে যাচ্ছে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা সাথে বিদীর্ণ রাগ। ঝুমকো এই অসাধারণ সুন্দর মানুষটার দিক থেকে চট করে চোখ সরাতে পারলো না সরালো তবে আস্তে আস্তে কৌশলে। সাথে বিড়বিড় করে বলল,

‘সাধারনের মধ্যে অসাধারণ। কেনো এতো অসাধারণ হলো? সাধারণ হলে হয়তো ঝুমকোর বুকের চিনচিন ব্যাথাটা এখন হতো না। ঝুমকো হয়তো এখন বেহায়ার মতো এই নিষ্ঠুর প্রতারকের দিকে তাকিয়ে থাকতো না।’

‘হ্যালো।’ সোহেল হাত নাড়ায়। ঝুমকোর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা।

ঝুমকো সোহেলের দিকে তাকিয়ে এবার সুন্দর করে একটা হাসি দিলো। রাহানের নাকের পাটাতন ফুলে উঠলো। তার কাছে মনে হলো এ বোধ হয় প্রেমের হাসি। আর এই হাসি তার কাছে লাগছে বিষের চেয়েও বেশি বিষাক্ত।

সোহেলের হাতের ভাঁজে নিজের হাত ঢুকালো ঝুমকো। সোহেলের চোখে তখন অবাকতা, খুশি, বিস্ময়। প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে সে ঝুমকোর হাতটা গাঢ় ভাবে ধরলো। ঝুমকোর সারা শরীর তখন গিনগিন করে উঠলো। একমাত্র সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অসাধারণ যুবকটির জন্যই তাকে এসব করতে হচ্ছে। দেখাতে হচ্ছে যে ঝুমকো ভালো আছে। সে ছাড়া এই দুনিয়ায় ঝুমকোর মানুষের অভাব হবে না।

সোহেল হাতটা শক্ত করে ধরতেই ঝুমকো কটমট দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। সোহেল নিজের হাত আলগা করলো। রাহানের চোখে আগ্নেয় মেখলা। তার চোখে আগুনের অশ্রু। কি জানি কি হলো সামনের এই অসাধারণ যুবকটির চোখের এই রাগের পানি দেখে ঝুমকো সোহেলের হাত ছেড়ে দিলো। মনের মাঝে চাপা একটা কান্না দলা পাকিয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। সোহেল এসবের কিছুই বুঝলো না। সে অস্থির গলায় বলল,

‘হাতটা ছাড়লে কেনো ঝুমকো?’

এই কথা দূর থেকে শোনার সাথে সাথে রাহানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত ঘষলো। যেনো দাঁতের ফাকে এই অপ্রোয়জনীয় জন্তু টাকে সে পিষে ফেলবে।

‘এখান থেকে যাও। গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার রাইট নাও।তোমার সাথে আমার পরে কথা হবে।’
ঝুমকো বলল অনেকটা চাপা গলায় দাঁত কিড়িমিড়ি করে। সোহেল ভ্রু কুচকে শুধু চেয়ে রইলো। সে আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না। তার মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। কান লাল হয়ে উঠলো। সে চলে গেলো।

সোহেল যাওয়ার পর ঝুমকো মুখ দিয়ে সুর করে গান গাইতে গাইতে রাহানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। রাহান গম্ভীর সুরে বলল, ‘দাড়াও।’

ঝুমকো দাড়ালো ঠিক ই কিন্তু বলল, ‘হু আর ইউ? তোমার কথায় আমার দাড়াতে হবে? তুমি আমাকে অর্ডার করছো?’

‘হুম করছি।’ রাহানের গলায় চাপা রাগ।

‘পারবো না অর্ডার মানতে। আমি বাধ্য নই।’

‘দাড়িয়ে তো পরলেই।’ পকেটে হাত দিয়ে আয়েশের ভঙ্গিতে বলল রাহান।

ঝুমকো অপ্রতিভ হলো একটু। দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘সে তো কথার উত্তর দিতে দাড়িয়েছি।’

‘যে কারনেই হোক দাড়িয়েছো তো?’ রাহানের ঠোঁটে বাকা হাসি।

ঝুমকো রেগে বলল, ‘লিসেন, নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ড ভেবো না।’

‘ওকে, নাও, ক্যান ইউ টেল মি? ‘

‘হোয়াট?’ ঝুমকো অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

‘ছেলেটা কে? হু ইজ দ্যা গাই?’ রাহান মোটা স্বরে প্রশ্ন করলো।

‘হি ইজ মাই বয়ফ্রেন্ড। ‘ দাঁত চিবিয়ে ঝুমকো বলে।

রাহান বিস্ময়ের সাগরে ডুবে ঝুমকোর দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মুহুর্তে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটাকে তার ঠাস করে গগনবিদারী এক চর মারতে ইচ্ছে করলো। নাকের পাটাতন লাল হয়ে ফুলে উঠলো।

পাশেই কোনো একটা দোকান থেকে অরিজিৎ সিং এর হৃদয় ভাঙা গান ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’ এর মাঝের কিছু লাইন ভেসে আসছে তখন। রাহানের রাগ হয় প্রচন্ড।

এটা গল্প হলেও পারতো,
পাতা একটা আধটা পড়তাম,
খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে।
জানি আবার আসবে কালকে,
নিয়ে পালকি পালকি ভাবনা,
ফের চলে যাবে করে একলা আমাকে।
বোঝেনা সে বোঝেনা,
বোঝেনা সে বোঝেনা(ii)

রাহানের এমন অগ্নিরথ রূপ দেখে ঝুমকো মজা পায়। হালকা গলায় গানটা গাইতে গাইতে রাহানের কাছে যায়। একদম কাছে। যতটা কাছে থাকলে একে অপরের প্রতি অপ্রতুল অনুভূতি হয়। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। রাহানের চোখে চোখ রেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে এক অসহায় রাজ্য হারা রাজকন্যার মতো করে ঝুমকো বলল,

‘সত্যি, এটা গল্প হলেও পারতো। পাতা একটা দুটো পড়তাম। খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তোমাকে। কিন্তু সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। কিছু প্রতারক ভালোবাসার যোগ্য হয় না।’

ঝুমকো চলে গেলো উড়ো হাওয়ায় মতো এক নিমিষেই। রাহান তখনও দাঁড়িয়ে মনে মনে আওড়াচ্ছে ঝুমকোর রেখে যাওয়া বেদনার অবিদ্বাণী।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here