অভিমান পর্ব ১১

#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১১
চারিদিকে তখন নিস্তব্ধতায় ঘেরা খোলা জায়গা। সামনে এগোতেই কিছুটা গাছগাছালির ঝোপঝাড় এর মতো। পাশেই পুকুরের স্বচ্ছ বাতাসে হালকা স্রোতের সাথে মিশে যাওয়া অথৈজল। বাতাসের তরে খুব সুন্দর করে একটার পর একটা ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে দু একটা পদ্ম ফুলে।
ঝুমকোর তখন এইচএসসি এর শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষার কেন্দ্রের পেছনেই এই জায়গাটা অবস্থিত। ওদের পরীক্ষার হলের পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যেতো। তখন থেকেই বান্ধবীরা সবাই ভেবে রেখেছিলো শেষ পরীক্ষার দিন জায়গাটা ঘুরে দেখে আসবে।

পরিকল্পনা মাফিক তারা শেষ পরীক্ষার দিন সেই জায়গায় গেলো। গাছগাছালির ঝোপঝাড়ে আবিষ্কার করলো সেখানে একটা লোককে বেদোরাম পেটাচ্ছে আরেকটা লোক। সেই লোকটা ছিলো ঝুমকোর চিরপরিচিত আপন মানুষ রাহান। রাজনীতি করতো সে তখন। বিপক্ষ দলের এক লোককে বেদোরাম মারছিলো। সাথে ছিলো তার তিন চেলা।
মারামারি রক্তারক্তি দেখে ঝুমকোর বান্ধবী দুটো ওকে একা ফেলে রেখে ভো দৌড় দিয়ে চলে গেলো। ঝুমকো তখন কিছুটা অসহায়ের মতো কাদো কাদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন সে ভীষণ বোকা ছিলো বৈ না!

মারামারির এক পর্যায়ে পুকুরের পাশে গোলগাল কাদো কাদো মুখের জ্বলজ্বল করা গালের এক বাচ্চা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহানের ভ্রু কুচকে যায়। মাথার উপর সূর্য কড়া ভাবে তাপ দিচ্ছে। গরমে রাহান ভিজে নেয়ে একাকার। তার নীল শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। মুখটাকে ভীষন রকম রাগী আর গম্ভীর বানিয়ে রাহান এগিয়ে যায় ঝুমকোর দিকে। ঝুমকো ভয়ে আরো গুটিসুটি মেরে যায়। রাহান কাছে আসতেই ঝুমকো দৌড়ে পালাতে চায়। রাহান খপ করে ঝুমকোর এক হাত ধরে ফেলে। ঝুমকো বোধ হয় কেদেই দিবে এমন ভাবে রাহানের দিকে তাকায়। রাহানের দৃষ্টি তখন জোরপূর্বক নিবদ্ধকরণ রয়েছে রোদের চিকমিক আলোয় ঝুমকোর চকচকে গালের দিকে। ঝুমকো নাক টেনে কিছু বলতে ধরলো ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়েই রাহান আকস্মিক বলে উঠলো, ‘আই লাভ ইউ।’

কি জানি কেনো এই অসংলগ্ন মুহুর্তে এমন বেফাস বাক্যটা রাহান বলে ফেলল। ঝুমকোর তখন নেহাৎ ই মনে হলো লোকটা পাগল তা না হলে বখাটে, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাকৃত কোনো মানুষ। যে কিনা একটা মেয়েকে প্রথম দেখায় এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে পারে। ঝুমকো তার বোকা বোকা চাহনি নিক্ষেপ করলো রাহানের দিকে। ভ্রু কুচকে সে রাহানকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল, ‘কি বললেন?’

রাহান নির্বিকার কন্ঠে আবার বলে, ‘আই লাভ ইউ।’

ঝুমকোর বোকা মস্তিষ্ক বোকা ভাবে জ্বলে উঠে। দাঁত কিড়িমিড়ি করে সে বলে, ‘বাট আই হেট ইউ।’

রাহানের হাতে তখন ও ছিলো হকিস্টিক। সেটা ঝুমকোর চোখের সামনে দেখিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘আজকে থেকে তুমি আমার সাথে প্রেম করবে বুঝলে? আর এতোক্ষন যা যা দেখলে তা কাউকে বলবে না বুঝেছো? বললে তোমাকে মেরে এই পুকুরে ফেলে দিবো।’

ঝুমকো তখন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। রাহান ধমকে বলে, ‘কি বললাম বুঝতে পেরেছো? আজ থেকে আমার সাথে প্রেম করবে। না হলে এই হকিস্টিক এর বাড়ি একটাও মাটিতে পরবে না।’

ঝুমকো তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে ঢোক গিলে বলল, ‘করবো করবো।’
‘হুম এবার তোমার নাম্বার দেও।’
‘নাম্বার? কিন্তু আমি তো ফোন চালাই না ভাইয়া।’
ঝুমকো ঠোঁট উলটে বলল। রাহান ভ্রু কুচকে বলে,’কিসে পড়ো?’
‘এইতো এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম।’
‘ফাইজলামি করো? বোকা পেয়েছো আমাকে? এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছো অথচ ফোন চালাও না। তাড়াতাড়ি নাম্বার দেও। ‘

রাহান ধমক দিয়ে বলল। অচেনা-অজানা ছেলে কে জানে ছেলেটা হয়তো সত্যি সত্যি ঝুমকোকে মেরে পুকুরে ভাসিয়ে দিলো কিংবা ঝুমকোর বড়োসড়ো ক্ষতি করে ফেলল। আজকাল তো এমন ঘটনা কতোই ঘটছে। ভয়ে ঝুমকো কাঁপা কাঁপা গলায় নিজের নাম্বার বলে দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের পথচলা।

এতোক্ষন থেকে ওদের লাভস্টোরি শুনে এই প্রথম প্রাপ্তি প্রশ্ন করলো, ‘হায় আল্লাহ! কি বলিস এসব? তার মানে এর জন্যই বলছিলি যে, ভাইয়া গুন্ডা?’

ঝুমকো মাথা নিচু করে ঝাকিয়ে বলল, ‘হুম। কিন্তু তাতে আমার বিশেষ কোনো সমস্যা ছিল না। ও তো তখন রাজনীতি করতো তাই বলেই!’

প্রাপ্তি আবার প্রশ্ন করে, ‘ভাইয়া তোকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলো? হুটহাট প্রথম দেখায় আই লাভ ইউ কেমনে কি দোস্ত? ‘

ঝুমকো মাথা দুলিয়ে হেসে বলে, ‘আরে না রে। আমি যাতে ওর সাথে প্রেম করি তাই জন্য। পাছে যদি কাউকে বলি দি মারামারির কথা এই ভয়ে আমার সাথে প্রেমে জড়িয়েছিলো। পরে অবশ্য কথা বলতে বলতে আমার প্রতি দূর্বল হয়ে যায়। আর আমিও তার প্রতি ফিদা হয়ে যাই। কারন মানুষটা সে ওতোটাও খারাপ ছিলো না।’

প্রাপ্তি গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তারপর?’

‘তারপর।’ ঝুমকোর স্মৃতিকুড়ানো মন আবার হারায় নিষ্কলুষ অতীতে,,,,

তারপর চলতে থাকলো প্রেম, কথা বলা, মেসেজ করা, প্রতিদিন একবার অন্তত কোনো না কোনো ভাবে দেখা করা, বাবা মাকে মিথ্যা বলা, প্রাইভেট কোচিং এর অযুহাত দিয়ে ঘুরতে যাওয়া। মানে একদম জমজমাট প্রেম। এই প্রেমের নেশায় পরে আমার এডমিশন এর কোনো পড়াই আর পড়া হলো না। শেষে ইয়ার লস দিলাম। পরের বছর পরীক্ষা দিলাম। তারপর আবার চলতে থাকলো আমাদের প্রেম। আমি তখন ভারসিটি ফার্স্ট ইয়ার আর ওর তখন ভারসিটি লাইফ শেষ। ভারসিটিতে উঠার কিছুদিন পর নিয়ন এলো আমার জীবনে বন্ধু হয়ে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগলো। আমি আর নিয়ন সবসময় একসাথে থাকতাম। নিয়নকে সময় বেশি দিতাম। রাত ভর নিয়নের সাথে ফোনে কথা বলতাম। একটা সময় আমার মনে হলো আমি রাহানকে সময় দিচ্ছি না ঠিকমতো। তখন একসময় আমি নিয়ন আর রাহানের দেখা করিয়ে দিলাম। তারপর থেকেই রাহান কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে যায়। কেমন অন্যমনস্ক। সারাদিন চিন্তায় মশগুল। আমাকে চোখে চোখে রাখা। বিভিন্ন জায়গায় যেতে বারন করা। নিয়নের সাথে কোথাও গেলে তাকে সহ নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি তার সব কথা মেনে চলতাম।

এভাবেই চলতে থাকলো সময়। কাটতে থাকলো প্রহর। পোহাতে থাকলো রাত-দিন। আমার ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হলো। তখন আমাদের রিলেশনের বয়স দু বছর সাত মাস। হঠাৎ আমার শেষ পরীক্ষার দিন পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দেখি আমার ফোনে মেসেজ এসেছে। মেসেজ টা ওপেন করতেই আমার হাত পা কাপা শুরু হয়ে গেলো। শরীর অসাড় হয়ে যেতে লাগলো। মনে হলো, হৃদয়ে কেউ খামচে ধরেছে। বুকে কেউ পাহাড় ফেলে দিয়েছে। আমি ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের অতলে। আকাশের অসীম নীলে।

ঝুমকো কান্না করে উঠে। প্রাপ্তি ঝুমকোর কাধে হাত রেখে ফিচেল গলায় বলল, ‘কি লিখা ছিলো সেই মেসেজে?’

‘বলছি।’

চোখের পানি মুছে ঝুমকো আবার বলা শুরু করে,

সেদিন আমার ফোনে দুটো মেসেজ এসেছিলো। প্রথমটায় লিখা ছিলো, ‘I think, It is high time to break the relationship. ‘

ঝুমকো কেদে উঠে হু হু করে। তার মনে হচ্ছে তার বুকের উপর কেউ কয়েক লক্ষ টন পাথর চাপা দিয়েছে। বুকের ভেতর উত্থাপিত অভিযোগরা ডুকরে কেদে উঠছে বারংবার। আঘাতে আঘাতে পুড়ছে, ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। রক্তাভ বর্ণিত সেই বুকের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।

প্রাপ্তি ঝুমকোকে জড়িয়ে ধরে। সে নিজেও কেদে ফেলে। তার মনটা একটু বেশি নরম বলেই না! প্রাপ্তি কেদে কেদে বলল, ‘দ্বিতীয় মেসেজে কি ছিলো?’

ঝুমকো নাক টেনে টেনে বলল,

‘সেখানে লেখা ছিলো। “ভালো থেকো আমার ঝুমকোলতা। তোমার ঝুম বৃষ্টির তুমুল বর্ষণ থেকে আজ আমি মুক্ত। এই মুক্তিটা খুব কষ্টের জানো? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি পাড়ি জমাচ্ছি দূর দেশের অস্ট্রেলিয়ার। একটুপর আমি বিমানে থাকবো। তারপর চলে যাবো তোমার থেকে দূরে… বহুদূরে। তোমাকে বাধনছাড়া মুক্ত করে দিয়ে গেলাম। ভালো থেকো তুমি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও। কিন্তু মনে রেখো তুমি আমার ঝুম…আমার ঝুমকোলতা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ঝুম বৃষ্টির বর্ষন শুধু আমায় ভিজাবে।”

এইটুকু বলেই ঝুমকো ডুকরে কেদে উঠে। প্রাপ্তিকে খামচে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলো। চিতকার করে কেদে সে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমার কি দোষ ছিলো সেদিন বলতে পারিস? কেনো ওমন নিষ্ঠুর ভাবে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো সে? সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো তুই যদি দেখতিস। সেদিন আমি পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। কিন্তু ওর মা আমাকে কিচ্ছু বলে নি। অবশ্য আমি আগে থেকেই বুঝতাম ওর মা আমাকে পছন্দ করে না।’

ঝুমকো থামে। কিছুক্ষন পর তার ঝুম বৃষ্টির কান্না থেমে এলে অনেকক্ষণ পর প্রাপ্তি জিজ্ঞেস করে, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কি? তারপর আমি একবছর ঘর থেকে বের হতাম না। কারোর সাথে দেখা করতাম না। মাঝে মাঝে ভারসিটি যেতাম। হঠাৎ হঠাৎ আমাদের ভালোবাসাময় স্মৃতিতে ঘেরা জায়গা গুলোতে যেতাম। কেদে উঠতাম। ওর নাম্বারে ফোন দিতাম। কিন্তু প্রতিবার বন্ধ দেখাতো। এভাবেই আমার সেকেন্ড ইয়ার শেষ হলো। থার্ড ইয়ারে উঠার পর থেকে ক্লাবে যেতে শুরু করলাম। মদ খেতাম। রাত করে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে কষ্ট ভুলতাম। নিয়ন আমাকে এ পথ থেকে সরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারে নি। ওর সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে লাগলো। তারপর তোর সাথে আমাদের দেখা হলো। ফোর্থ ইয়ারে উঠার পর মাস্টার্স এর সোহেলের সাথে দেখা হলো। তারপর থেকে ছেলেটা আমার পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো। আমিও ঘুরাতে লাগলাম। ফোর্থ ইয়ার শেষ করলাম। এরপর একদিন রাহান ফিরে এলো। তারপর থেকে এই তো চলছে।’

প্রাপ্তি ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে,’রাহান ভাইয়া চলে কেনো গিয়েছিলো?’
‘জানি না।’
‘মাস্টার্স করবি না?’
‘এই এক প্রশ্ন শুনতে শুনতে পাগল হয়ে গেলাম। পড়াশোনা আর করবো না।’
‘ভালো। প্রেমিকের বেদনায় দেবদাসী হও।’
‘হুম। এখন তুই বল আমার কি করা উচিত ওকে এক্সেপ্ট করা উচিত কি?’
‘আমার মনে হয় রাহান ভাইয়াকে তোর পেছনে কিছুদিন ঘুরিয়ে তারপর এক্সেপ্ট করিস।’

প্রাপ্তি দাত কেলিয়ে বলে। ঝুমকো চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘মামদোবাজি করো? ওকে আমি কখনো মানবো না। ও আমাকে যেই কষ্ট দিছে তার তিনগুন কষ্ট দিবো আমি।’

‘তুই নিজে ভালো থাকবি?’

‘হয়তো থাকবো না। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? আমি তো ওকে ঠকায় নি। ছেড়ে চলে যায় নি। আমি তো ওকে এখনো ভালোবাসি! হ্যা ভালোবাসি! আমার অবিশ্রান্ত মন এখনো ঝিঝি পোকার ডাকের মতো কেবল মাত্র ওকেই অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। অক্লেশ হৃদয় বেহায়া ভাবে তাকেই সোহাগ করতে চেয়েছে। ‘

ঝুমকোর কন্ঠ কেমনতর যেনো শুনা যায়। প্রাপ্তি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে ঝুমকোর মুক্তের মতো জ্বলজ্বল করা গালের দিকে ভাবুক হয়ে। কেমন যেনো পিৎপিড়তা হয়ে। মুগ্ধে অভিষিক্ত হয়ে।

চলবে❤️

গল্পের মোড় ঘুরবে শীঘ্রই। আর তিন-চার পর্ব অপেক্ষা শুধু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here