#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৮
‘ইউ গেট লস্ট ফ্রম মাই টুক্কুস করে কামড় দেওয়া গাল।’
রাহানের বিরক্তিকর কথা শুনে আর্ধেক পথ গিয়ে রাগে এলোপাথাড়ি পা ফেলে আবার ঘুরে আসে ঝুমকো। ছাদে আড্ডার আসর জমানোর জন্য যে লালরঙা চাদরটা বিছানো হয়েছিলো সেখানে গিয়ে নির্বিকল্প ভাবে হাটু ভেঙে বসে পরে। এরপর খানিক গাল ফুলিয়ে বলল,
‘যাব না আজ ছাদ থেকে। দেখি কে কি করে? আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বলে গেট লস্ট। কত্তবড় সাহস! নানুমনি তুমি কিছু বলবে না? ‘
কামিনী বেগম মুখ টিপে হেসে বলে, ‘থাক না নানুমনি। ছেলেটা কতদিন বাদে এলো।’
দাঁত কিড়িমিড়ি করে ঝুমকো বলে, ‘এখন জামাই আদর করো।’
রাহান পাশ থেকে কেশে উঠে। কামিনী বেগম মুখ টিপে হাসে। তার কুচকাওয়াজ গালের ভাঁজ আরো কুচকে যায়। রিয়া, রুম, সবুজ গিয়ে আস্তে করে ঝুমকোর পাশে বসলো। ঝুমকোর হাত ধরে রিয়া আহ্লাদ করে বলল,
‘একটা গান গাও না ঝুম আপু।’
ঝুমকো তার অগ্নিধ্বজা যোগী কটমট চাহনী ফেলে রিয়ার উপর। রিয়া আমতা আমতা করে বলে,
‘থাক তোমার গাইতে হবে না। রাহান ভাইয়া তুমি তো খুব সুন্দর গান পারো। একটা গান গাও না।’
রাহান নাটকীয় কাশি কেশে বলল, ‘আমি গান গাইলে তোমাদের আপু নিতে পারবে তো?’
কামিনী বেগম রাহানের কাধ চাপড়ে বলেন, ‘আরে তুই শুরু কর আমার নাতনী নিতে পারবে না মানে দেখা যাবে রীতিমতো তোর সাথে গান গাওয়া শুরু করে দিবে।’
রাহান মাথা নাড়িয়ে নাকচ করে বলল, ‘ইম্পসিবল। পারবে না।’
বিষদষ্ট সাপের মতো ফনা তুলে ঝুমকো বলে উঠলো,’নানুমনি বলে দেও, আমি পারি না এমন কোনো কাজ নেই।’
‘লেট’স সি ।’
“কেনো বলো না?
তুমি আমায় বুঝো না?
রাহান গাইছে। ঝুমকোর কাধের সাথে ধাক্কা দিয়ে রাহান গায় লাইনটুকু।
আমি তোমাকে ছাড়া কিছু ভালোবাসি না।(ii)
তোমায় ঘর বাড়ি আমার, লিখে দিবো বুঝিয়ে।
তোমায় নিয়ে যাবো হায়, পৃথিবীকে জানিয়ে।
রাহান গায় একবার চোখ টিপে আবার ঠোঁট দুটো চোখা করে তো আবার চোখ দিয়ে সারা পৃথিবী ইশারা দিয়ে ঝুমকোকে ধাক্কা দিয়ে নানান ভঙ্গি ইঙ্গিত দিয়ে গান গায়।
আমার গরুর গাড়িতে…..
বউ সাজিয়ে।
তুত্তুর তুত্তুর তুত্তুর তু,
সানাই বাজিয়ে।
আরে যাবো তোমায় শ্বশুড় বাড়ি নিয়ে….”(ii)
হাত দিয়ে দূর দূরান্তের পথ দেখিয়ে দেয় রাহান। ঠোঁটে সদ্য বিবাহের আলাপনকালের মতো মিস্টি হাসি তার। ঝুমকো মুখ টানা মেরে তাচ্ছিল্য হাসি হেসে গেয়ে উঠলো,,
‘তোমার ভাঙা গাড়িতে আমি যাবো না…
কারো ঘরের ঘরণী আমি হবো না।
করবো না তো কোনোদিনও বিয়ে…’
রাহান ঝুমকোর মাথায় টুকা দিয়ে আবারো ইশারায় বুঝিয়ে সুর দিয়ে গলা ছেড়ে গাইলো,
‘আরে যাবো তোমায় শ্বশুড় বাড়ি নিয়ে….’
ঝুমকো আর গান গায় না। আচমকা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
‘কোনো শ্বশুড় বাড়ি টশুড় বাড়ি আমি যাবো না। এখন তুমি আমার বাড়ি থেকে বিদেয় হও।’
আর কারোর দিকে কর্ণপাত না করে ঝুমকো গটগট করে শব্দ তুলে চলে যায় নিজের ঘরে। ঘটনা কি ঘটলো বুঝতে খানিক বেগ পেতে হয় সবার। সকলের উৎসবমুখর উৎসাহপূর্ণ দুষ্টুমি মন গুলোতে একরাশ মন খারাপ ভর করে। ঝুমকোর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় রাহান বলল,
‘সত্যি কি কখনো যাবে না শ্বশুড় বাড়ি? আমাদের কি বিয়ে হবে না? আমার সাথে কি কখনো ওর মিল হবে না নানুমনি? ওর জেদ কবে নামবে? রাগটা কবে কমবে?’
‘রাগ না নানুভাই। অভিমান..। অভিমান হয়েছে ওর। অভিমান রাগের চেয়েও বিষধর।’
রাহান দীর্ঘশ্বাস শূন্যে ছেড়ে দিয়ে বাতাস গিলল।বলল,
‘আমি এবার যাই নানুমনি। একটু রিফ্রেশমেন্ট এর প্রয়োজন আমার। ভালো থেকো। আসসালামু আলাইকুম। ‘
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। সাবধানে যাস ভাই।’
‘আসছি নানুমনি। সবুজ, রিয়া তোমরা যাবে না কি থাকবে? গেলে চলো তোমাদের ড্রপ করে দিয়ে যাই।’
রিয়া কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে, ‘না ভাইয়া আমি ঝুম আপুর সাথে থাকবো আর সবুজ রুম এর সাথে আজ থাকবে। আমরা দুদিন পর যাবো। ‘
‘ওহ আচ্ছা থাকো তাহলে। আমি আসি।’
‘সাবধানে যাবেন ভাইয়া। আর মাঝেমাঝে আমাদের সাথে দেখা করবেন।’
‘ঠিকাছে। আল্লাহ হাফেজ ।’
‘আল্লাহ হাফেজ।’
_______________________________
ঘরের হালকা হলদেটে টেবিল ল্যাম্প এর আলো বারবার নিভছে জ্বলছে। ডান হাত মাথায় ঠেকিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে সুইজ টিপে আলো জ্বালাচ্ছে বন্ধ করছে ঝুমকো। মাথায় ঝড়পল্ট ভাবে প্রশ্নরা ভিড় জমিয়ে বসে আছে। তাল-গোল পাকাচ্ছে চারিপাশের সকল অবস্থা। বিষন্ন মনে এখন প্রশ্নের পাহাড়। কষ্টে ভারী হওয়া বুকটাতে এই রোদ্দুরে বৃষ্টি তো এই আবার ঘন কালো ছেয়ে যাওয়া বৃষ্টিআলাপন।
ঠিক যখন নিয়নের খোঁজ পাওয়া গেলো না তখনি রাহান এসে হাজির হলো। সকাল থেকে নিয়নকে খুঁজে পাওয়া গেলো না আর সেইদিন রাতেই হাজির হলো রাহান। এটা কি কোনোরকম ভাবে কাকতালীয় ঘটে গেছে? না কি ঘটিয়েছে? তিনবছর পর রাহান কেনো সেইদিনই এলো? এলো তো এলোই ঝুমকোর সাথে প্যাচআপ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে কেনো? সম্পর্ক তো ঝুমকো ভাঙে নি। ভেঙেছে সে। তবে আবার কেনো জোড়া লাগাতে চায়? আর তাছাড়া কি হয়েছিলো সেদিন? যার কারনে রাহান সম্পর্কটাই ভেঙে দিয়েছিলো? ঝুমকোর মতামতেরও প্রয়োজন অনুভব করে নি।
ঝুমকো ল্যাম্প অফ করে ঘরকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে। নিয়নের এই হঠাৎ উদাও হয়ে যাওয়ার পেছনে কারন কি? ঘটনাক্রমে কোনোভাবে কি এর পেছনে রাহানের হাত আছে?
ঝুমকো পাশফিরে শয়। সে জানে রাহান আগে থেকে নিয়নকে হালকা হালকা পছন্দ করতো না। কিন্তু ঝুমকো নিয়নের মাঝে খারাপ কোনো কিছু দেখতে পায় নি। আর ততোদিনে নিয়ন ঝুমকোর সম্পর্কও বেশ গাঢ় রকমের সখ্যতা হয়ে উঠেছিলো। রাহানের অহেতুক কথায় তখন ঝুমকো তার এই অতি গাঢ় বন্ধুসুলভ সম্পর্কটা ভাঙতে পারে নি। রাহান ও আর বেশি কিছু বলে নি। কিন্তু তার সামনে নিয়নের নাম তুললেই রাহান কেমন যেনো একটা করতো।
কি হয়েছিলো যার কারনে ঝুমকোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো রাহান? রাহানের কঠিনতর থেকে কঠিনতম সত্য নিজের চোখের সামনে দেখেও তো ঝুমকো তাকে ছাড়তে পারে নি। ভেঙে দিতে পারে নি সম্পর্কটা। কখনো মুখ ফুটে বলতেও পারে নি যে, ‘রাহান তুমি এই কাজটা কেনো করলে?’ সবসময় রাহানকে ভালোবেসেছে। তবে কেনো রাহান তাকে ছেড়ে চলে গেলো? রাহান কি সত্যি কখনো ভালোবাসতো ঝুমকোকে?
তবে এখন কেনো ফিরে এসেছে? ওওও….. সুন্দরী ললনাগুলোর দিন শেষ এবার বুঝি ঝুমকোর পালা?
তবে যাই হোক, ঝুমকো আর কখনো রাহানকে মেনে নিবে না। আগে ঠিক যতটা নরম ছিলো রাহানের প্রতি এখন ঠিক ততটাই শক্ত সে।
_______________________________
টিএসসি তে ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরেছে রিয়া। অগ্যতা ঝুমকোর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আসতে হলো। ফুচকা খেয়ে রিকসা দিয়ে ফেরার পথেই ঝুমকো রাস্তার ধারে দেখতে পায় রাহানকে এক মেয়ের সাথে। রিক্সাওয়ালাকে দাড় করায় ঝুমকো। মেয়েটাকে চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ঝুমকো মেয়েটাকে চেনে না। তবে এটুকু বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা বিদেশি। পোশাকে তার বিদেশি কূটনীতিকদের রূপ ভেসে উঠেছে। ঝুমকো চিবিয়ে চিবিয়ে রিয়াকে বলল,
‘দেখ তোদের আদরের ভাইয়া। মেয়ে নিয়ে ঘুরছে।’
ঝুমকো চোখ ছোট ছোট করে সেদিকে তাকায়। সেই বিদেশি মেয়েটা কিছুর জন্য বায়না ধরেছে। রাহানের মুখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে রাজ্যের বিরক্তি। রিয়া গালে হাত দিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,
‘মেয়েটা কি ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড? ‘
ঝুমকো চকিতেই তাকায় রিয়ার দিকে। রিয়া ঠিক হয়ে বসে আমতা আমতা গলায় বলল,
‘না মানে, তোমার সাথে তো ভাইয়ার ব্রেকাপ তাহলে সাথের মেয়েটা তো গার্লফ্রেন্ড হতেই পারে।’
‘কেনো? গার্লফ্রেন্ড ছাড়া কি দুনিয়াতে ছেলেরা মেয়ে নিয়ে ঘুরতে পারে না? আমি যে রুমকে নিয়ে ঘুরি এর মানে কি আমরা প্রেমিক প্রেমিকা? ‘
রিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলে, ‘ইউ মিন মেয়েটা ভাইয়ার বোন হয়?’
‘ওরকম দামড়া মার্কা মেয়েকে মনে হয় ওর বোন। আর তাছাড়া ওর কোনো বিদেশি মেয়ে কাজিন আছে এটা তো আমার জানা নেই।’
‘এতো হাইপার হয়ে যাচ্ছো কেনো? কুল না।’
ঝুমকো দেখে রাহান ওদের দিকে তাকিয়েছে। ঝুমকো একটু চমকে উঠে। এরপর তেজি গলায় উচুঁস্বরে বলে,
‘কোনো হাইপার হয়ে যাচ্ছি না। এই মামা চলেন তো। যত্তসব নাটংবাজ।’
‘তেথি তুমি বুঝতে পারছো না। ফুসকায় অনেক ঝাল। ঝালের কথা নাহয় বাদ দিলাম সেটা কমিয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু কথা হলো এই রাস্তার ধারের খাবার তোমার পেট সহ্য করতে পারবে না।’
তেথি জেদ ধরে রাস্তায় পিড়াপিড়ি করার মতো করে রাহানের হাত টেনে নিয়ে যেতে চায়। বলে,
‘প্লিজ রাহান মাই বেবি….চলো না একটু খাই। আমি কখনো এটা টেস্ট করি নি। বাংলাদেশে জন্মে যদি এই ফুসকাই না খাই তাহলে কীভাবে কি বলো তো?’
রাহান বিরক্তে চোখ মুখ কুচকে সামনের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
‘শালার এই বেবি ডাক শুনলেই রাগ উঠে। আমার মা জীবনে আমাকে বাবু পর্যন্ত বলে ডাকে না। আর এই মেয়ে কন্টিনিউয়াসলি বেবি বেবি করে যায়। অসহ্য!’
চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই রাহানের দৃষ্টি পরে সামনে রিক্সার দিকে। সচেতন চোখে সেদিকে তাকাতেই রাহান বুঝতে পারে রিক্সাতে ঝুমকো আর পাশের মেয়েটা রিয়া। রাহান স্পষ্ট দেখতে পায় ঝুমকো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে সাথে স্পষ্ট শুনতে পায় ঝুমকো বলল ‘নটাংবাজ’। রাহান মাথায় হাত দেয়। স্বগতোক্তির মতো বিরবির করে বলল,
‘মাই গড। এই মেয়ে আবার আমাকে ভুল বুঝলো না তো।’
তেথি রাহানের হাত ধরে টান দেয়। রাহান হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দৌড়ে এগিয়ে যায় রিক্সার দিকে। রাহান দেখে ঝুমকো রিক্সাওয়ালা মামাকে তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য। রাহান রিক্সার কাছে দৌড়ে পৌছুতে পৌছুতে ঝুমকোর রিক্সা চলে যায়। রাহান সেখানে দাঁড়িয়ে হাটুতে হাত দিয়ে ভর করে হাপাতে হাপাতে চোখ মুখ কুচকে বলল,
‘শিট…’
রাহান নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ঝড়ের বেগে গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে তেথির উদ্দেশ্যে বলল,
‘তেথি ফুসকা খাও আর বিষ খাও… স্যরি যাই খাও না কেনো খেয়ে তোমার বাড়ি চলে যাও। আমার আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে। আমি গেলাম।’
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না তেথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শো করে রাহান চলে যায়। তেথি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। রাগে অপমানে মুখটা লাল হয়ে যায়। সে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে নিজের সাথে নিজে বলল,
‘আমি যখনই একটু তোমাকে কাছে পাই তখনি তুমি দূরে চলে যাও। কেনো? হোয়াই ইউ ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হাও মাচ আই লাভ ইউ?’
#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৯
ফুরফুরে সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস। সন্ধ্যাতারা গুলো আকাশের এক কোণায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। বাতাসে বৃষ্টির আভাসিত অনুভূতিরা গায়ে সুরসুরি দিয়ে যাচ্ছে। হিমেল টাটকা ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর শীতলে কেঁপে উঠছে। তিরতির করে কাঁপছে গোলাপি ঠোঁট জোড়া। কালো জর্জেটের জামার ইয়া বড় হাতার লেজ বাতাসে উড়ছে ভু ভু করে। কি জানি কি হলো ঝুমকোর চোখের কোণায় মুক্তোর মতো এক ফোটা পানি টুস করে পরে গেলো। ঝুমকো নাক টানলো। তখনি পেছন থেকে হঠাৎ কেউ গভীর অপরাধী গলায় বলে উঠলো,
‘ঝুমকোলতা।’
ঝুমকো আবেশে যত্ন করে চোখ বন্ধ করে। এই ডাক শুনলে তার মনে হয় মৃত্যু তাকে কাছে ডাকছে। এখনি বুঝি শয্যাশায়ী হয়ে বন্ধ কুটিরে আটকা পরে আল্লাহর কাছে চলে যাবে। কেনো মনে হয়? এই উদ্ভট চিন্তার কারন কি? ঝুমকোর ভাবনাগুলোর মাঝেই রাহান আবার বলল,
‘ঝুম..
রাহানকে কথা বলতে না দিয়ে ঝুমকো ঘুরে তাকায়। নিজের মাঝে নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলে, ‘নিয়নের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে তোমার হাত আছে তাই না রাহান?’
আকস্মিক এমন কথায় রাহান ভ্রু কুটি করে ঝুমকোর দিকে তাকায়। ঝুমকো শান্ত নির্লিপ্ত কন্ঠে আবার বলল, ‘ঠিক সকাল বেলা থেকে নিয়ন উদাও আর রাতের বেলা তুমি এসে হাজির।’
রাহানের এতোক্ষন বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালেও এবার কেমন জানি গলায় বলল, ‘ও যদি হারিয়েও যায় তাতে তোমার কি? ডু ইউ লাভ হিম?’
আক্রোশে ফেটে পরে ঝুমকো। আক্রোশপ্রসূত সে রাহানের গালে হঠাৎ সজোরে চর বসায়। রেগে চিৎকারে করে বলে, ‘হাও ডেয়ার ইউ টু টক লাইক দিস? হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। মাই বেস্ট ফ্রেন্ড….। ভালোবাসার সংজ্ঞা টাই তুমি বুঝো না রাহান। আর এর জন্যই আমি হেইট করি তোমাকে। আই হেইট ইউ রাহান আই হেইট ইউ।’
রাহানের বুকে মোচড় দেয়। তিনবছর আগের ঘটনা গুলো পালাক্রমে মনে পরে। তখনো সে একই ভাবনা ভেবে ভুল করেছিলো। আজ সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি কি আবার করতে যাচ্ছিলো?
ঝুমকোর রাগ কমেনি। তারউপর আজ বিকালে রাহানকে এক মেয়ের সাথে দেখেছে। আবার এখন রাহান ঝুমকোর কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ভাবনায় মশগুল। সব মিলিয়ে ঝুমকো রাহানের কলার চেপে ধরলো। চিতকার করে আকাশ, বাতাস, মাটি নাড়িয়ে বলে উঠলো,
‘যেদিন আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার মতামত পর্যন্ত না নিয়ে দু বছরেরও বেশি সময়ের সম্পর্কটা ভেঙে চলে গিয়েছিলে, বিমানে বসে দূর.. বহুদূর..আমার থেকে দূরে চলে যাওয়ার সকল কার্যক্রম সেরে নিয়ে যখন আমার ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে ছিলে, “I think, It is high time to break the relationship.” একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগটা পর্যন্ত দেও নি আমার অপরাধ কি? ফোন করলে ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলে। দীর্ঘ এক বছর ফোন করেও যখন তোমাকে পাওয়া যায় নি। আমি যখন দিশেহারা বিধ্বস্ত ভঙ্গ হৃদয়ের প্রতারিত প্রেমিকার মতো ঘুরে বেড়াই তখন এই নিয়ন… এই নিয়ন আমার পাশে ছিলো। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কোথায় ছিলে সেদিন তুমি? কম তো চেষ্টা করি নি আমি। দীর্ঘ একটা বছর শুধু তোমার আশায় ছিলাম। অগণিতবার তোমার বাড়িতে পা রেখেছিলাম৷ কিন্তু তোমার নিষ্ঠুর বাবা মা আমাকে কিছুই জানান নি। ফোন করলে যখন দেখতাম এক যান্ত্রিক গলা একই সুরে পালাক্রমে বলছে, ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ‘ তখন বুকটা আমার ফেটে যেতো। ফোন ভেঙে ফেলতাম। এই মহিলার গলা শুনলে আমার গলা শুকিয়ে আসতো। চোখ ভিজে আসতো। তারপর ধীরে ধীরে এক বছর ক্রমাগত ধৈর্য্য ধরেও যখন তোমাকে পেলাম না তখন বেছে নিলাম মাদক। মাদকাসক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়লাম আমি। কোথায় গিয়েছিলে সেইদিন এই তুমিটা? তখন আমার পাশে নিয়ন ছিলো। নিয়ন…’
এক নিঃশ্বাসে কথা বলে ঝুমকো কান্নায় ভেঙে পরে। হাপাতে থাকে ক্রমাগত। বুকের কষ্টের পাটাতনে এতো শক্ত ভাবে গাথানি দেওয়া হয়েছে যে চাইলেও আর ভাঙা যাচ্ছে না। রাহান স্বগতোক্তির মতো শুধু একটা বাক্যই বলল এই মুহুর্তে, ‘আই লাভ ইউ জান….’
ঝুমকোর কান্না থেমে যায়। বাতাস শো শো শব্দ করে বয়। এই অস্বাভাবিক মুহুর্তে এমন অপ্রাসঙ্গিক এবং বোকা কথায় ঝুমকোর হঠাৎ কেনো জানি হাসি পায় সেই সাথে খুব কষ্টও লাগে। আগে রাহানকে দিয়ে মাসে একবারের জন্যও আই লাভ ইউ বলানো যেতো না। এই নিয়ে ঝুমকো গাল ফুলিয়ে বলতো,
‘আমার বান্ধুবীদের এক একটা বয়ফ্রেন্ড দিনে ছত্রিশ বার করে আই লাভ ইউ বলে। তারা কথা বলা শেষে ফোন কেটে দেওয়ার সময় সবসময় আই লাভ ইউ জান বলে চুমু খেয়ে কেটে দেয়। আর তুমি? মাসে একবার আমাকে আই লাভ ইউ বলো না। আমার জোর করে করে বলাতে হয়।’
রাহান তখন হালকা হেসে হাত নাড়িয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলতো,
‘এখনকার আই লাভ ইউ কত সস্তা দেখেছো? আগে ভালোবাসি বলতে কত লজ্জা অস্বস্থি জড়তা কাজ করতো আর এখন? দিনে ছত্রিশ বার করে মানুষ আই লাভ ইউ বলে। আরে বাবা আই লাভ ইউ বললেই কি ভালোবাসা হয়ে গেলো? আমি মুখে বলি না তারমানে কি আমি তোমাকে ভালোবাসি না? বরং আরো বেশি ভালোবাসি। ওদের ভালোবাসা নেকামো মেশানো। আমার ভালোবাসা পিউর।’
রাহান থেমে আবার বলল, “‘ভালোবাসায় ভালোবাসি বলতে জড়তা বেশি।”
রাহানের কথায় মুগ্ধ হয় ঝুমকো।
‘এখন একটু বলো।’
ঝুমকোর নিসংকচন আবেদন। রাহান গাঢ় করে ঝুমকোর কপালে চুমু দিলো। বলল,
‘আই লাভ ইউ জান। ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি।’
ঝুমকো আনমনায় একটু হাসে। সাথে তার গাল দুটো ফুলে উঠে। চিকচিক করে চাঁদের আলোয়। রাহানের মুখের দিকে তাকাতেই ঝুমকোর আবার মনে পরে যায় কষ্টের দিন গুলো। না সে ভাবতে চায় না সেই বিষাক্ত অতীতগুলো। মুছে ফেলতে চায় জীবন থেকে। রাহান ঝুমকোর হাতটা ধরলো। অনেকটা অপরাধীর মতো নত মাথা তার। চোখে মুখে গাঢ় রকমের দুঃখী ভাব। ঝুমকো একটা শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলে,
‘জীবন আমাকে আরেকটা সুযোগ দিলে আমি তুমি নামক চ্যাপ্টারটা ডিলিট করে দিতাম রাহান। এ জীবনে আমার তোমার মতো প্রতারককে চাই না। যে কি না প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে ব্রেকাপ টাও বলতে পারে না। মুঠোফোনের বার্তার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় যে সে ব্রেকাপ চায়। কত কাপুরষ তুমি রাহান!’
ঝুমকো হাসে। তাচ্ছিল্য হাসি। রাহান করুন চোখে তাকায় ঝুমকোর দিকে। শুধু একটা কথাই বলে, ‘একদিন তোমার ভুল ভাঙবে।’
ঝুমকো হেসে উঠে। হাহা করে বিদ্রুপ হাসি।
‘আমি কোনো ভুল করেনি বা বুঝিনি যে আমার ভুল ভাঙবে। আমার চোখের সামনে, আমার নিজের সাথে যা ঘটেছে তা ভুল কি করে হবে?’
রাহান তাকায় ব্যথিনী নয়ন দিয়ে। তার চোখে কিছু পানি চিকচিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে ঝুমকোর কষ্ট হলো। হালকা চিনচিনাত্মিক ব্যথা সেও অনুভব করলো। যতই হোক ভালোবাসা তো। ঝুমকো আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃত হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘জানো রাহান।’
‘হুম বলো।’
ঝুমকোর কান্না পায়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে অনেক কষ্টে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘আমার যখন তিন-চার বছর বয়স তখন বাবার কাছে গিয়ে কাঁদতাম আমার একটা ভাই বা বোন নেই কেনো। বাবা তখন আমাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলতো, তোমার যে মা নেই তাই। তখন আমি কেদে কেদে বলতাম, কেনো নেই? তুমি একটা মা কিনে নিয়ে আসোনা বাবা। বাবা শুধু উপরদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। সেই এতোটুকুনি আমি বুঝতে পারতাম বাবার খুব কষ্ট। দেখেছো তিন-চার বছর বয়সের কথা আমার মনে আছে কত আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? অথচ কালকের কথা আজই ভুলে যাই। হয়তো স্মৃতির পাতায় সারাজীবন লিখে রাখার জন্যই ছিলো সেইদিন গুলো। তাই তো এখনো আমার স্পষ্ট মনে রয়েছে। কিছু মুহুর্ত সারাজীবন মনে রাখার জন্যই তৈরি হয়।’
ঝুমকো একটু থামলো। বাতাস গিলল। এরপর আবার বলল,
‘আবার যখন আমার ৫ বছর বয়স তখন খুব কাঁদতাম আকাশের দিকে তাকিয়ে, আমার বাবা-মা কেনো আমাকে একা ফেলে চলে গেলো? আমি কি অনেক বেশি দুষ্টুমি করি? বাবার কথা শুনি না? বাবাকে কি কষ্ট দিয়েছি এর জন্য কি বাবা আমাকে ছেড়ে তাঁরা হয়ে গেছে? উত্তর পেতাম না সেসব প্রশ্নের একা একা কেঁদে আল্লাহকে প্রশ্ন করতাম। আকাশের দিকে তাকালেই মনে হতো সেই ছোট্ট ঝুমকুনি আল্লাহকে দেখছে।’
ঝুমকোর কথা জড়িয়ে আসলো। কান্নার দম আটকে রাখতে না পেরে সে হা করে নিঃশ্বাস নিলো। তার চোখ দিয়ে তখনো পরছে অজস্র অশ্রু কণা।তবুও অনেক কষ্টে পরের কথাটুকু বলল,
‘আবার যখন ২০ বিছর বয়স তখন ও খুব কাদতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কাদতাম। কিন্তু তাঁরা দেখে নয়। বিমান দেখে। আকাশ দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখলে ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠতাম। মনে হতো, সেই বিমানে তুমি চলে যাচ্ছো আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে। আমার শিকড় সহ উপড়ে ফেলে দিয়ে তুমি চলে যাচ্ছো। আর দিয়ে যাচ্ছো এক বিষাদ বাণী। যেই বানীটির কথা মনে পরলেই আমার বুক কাপে। আজও কাপে। শুধু মনে পরে, ‘I think, It is high time to break the relationship.’ কানে বাজতে থাকে কথাটা। রাহান আমার খুব কষ্ট। খুব….। তোমাকে দেখলে আমার কষ্টগুলো বেড়ে যায় রাহান। জানান দেয়, আমি প্রতারিত হয়েছি। আমার বিশুদ্ধ ভালোবাসাও আর পাঁচটা দূষন ভালোবাসার সাথে মিশে গেছে। এক হয়ে গেছে। আমি মানতে পারি না রাহান। শত শত নির্ঘুম কালো রাতের কথা মনে পরলে আমার ঘুম হারাম হয়। তুমি বুঝতে পারছো রাহান…? আমার কষ্ট হয়।’
ঝুমকো কেঁদে উঠে নিজ আর্তচিৎকারে। রাহান সব কিছু ভুলে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ঝুমকোকে। বুকের সাথে আগলে নেয় তার ঝুমকে। ভালোবাসার বেড়াজালে আটকানোর চেষ্টায় থাকে সে। ফিরে পেতে চায় তার ঝুমকোলতাকে। ঝুমকো রাহানের শার্ট খামচে ধরে কাঁদে। রাহানের দামী শার্ট দুমড়ে মুচড়ে যায়। প্রেয়সীর কান্নায় শার্টের নিচে হার্টের খুব কষ্ট হয়। সেও বুঝি পাম্প করা বন্ধ করে দেয়। রাহানের চোখ দিয়ে পানি পরে দু ফোঁটা।
হঠাৎ কি মনে করে ঝুমকো সরে যায় রাহানের থেকে। চোখ মুছে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। রাহান শুধু স্তব্ধ হয়ে তাড়াতাড়ি বলল,
‘বিকালে যেই মেয়েটাকে দেখেছিলে সে তেথি। আমার সাথে অস্ট্রেলিয়ার পড়াশোনা করেছে। ওর বাড়িও ঢাকায়। আমার সাথে ভালো সম্পর্ক। তাই ঢাকা শহর ঘুরছিলো, অনেকদিন বাদে এলো তো। ফুসকা খাওয়ার বায়না ধরেছিলো।’
তারাহুরোয় রাহান এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলল। ঝুমকো নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে শ্লেষের হাসি হেসে বলল,
‘কৈফিয়ত দিতে হবে না। কৈফিয়ত দিচ্ছো কেনো? বাড়ি ফিরে যাও রাহান। আমার ভালো লাগছে না।’
চলবে❤️
আমি হতাশ। কেনো জানি না হঠাৎ করে গল্পের রেসপন্স বিভিন্ন গ্রুপে কমে গেলো। এটা কি আমার আইডির সমস্যা না কি অন্যকিছু আমি বুঝতে পারছি না।
কাল গল্প দেই নি কারন কারেন্ট ছিলো না।
চলবে❤️