#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৪
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল ইকরাম আজাদের। পাশ ফিরতে চমকে ওঠেন। ক্যামেলিয়া চেয়ারে বসে তাঁর হাতের কাছে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। হাতটা নড়লে ওর ঘুম ভেঙে যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা। ইকরাম আজাদ স্থির রইলেন। ক্যামেলিয়ার মুখের ওপর কিছু চুল পড়েছে। কিন্তু মুখের কিয়দংশ দেখা যাচ্ছে। চোখের চারপাশের কালিমা বড়ো বেশি নজরে লাগল। ফর্সা ত্বকের ওইটুকু কেবল কালো। অনেকদিন বোধহয় ঘুমায় না। মনে মনে অপরাধবোধ জন্ম নিলো ইকরাম আজাদের। বিয়ে করেই যেন দায়িত্ব শেষ করেছিলেন। একটা বার ওর দিকে ভালো করে ফিরেও দেখেননি। জিজ্ঞেস করেননি ভালোমন্দ। উচিত কি ছিলো না? খুব ছিল কিন্তু সংকোচে পড়ে উচিত কাজটি করা হয়নি৷ স্ত্রী হিসেবে হয়তো পরিপূর্ণ অধিকার তিনি ওকে দিতে পারবেন না, তবে সম্মান ও নিরাপত্তা ঠিক দেবেন। সমাজ ওর কপালে যে কালিমা লেপেছিল তা মুছে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। কিন্তু ওর স্বামী হয়ে ওঠা তাঁর হবে না। ওই কথা ভাবতেই পারেন না। মুখ ঘুরাতেই চোখে পড়ে দেওয়ালের ওপর মরহুমা প্রিয়তমা স্ত্রী ও দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গিনী কাজলের কৈশোরের ছবি।
ইকরাম আজাদ তখন টগবগে তরুণ। মাতৃপ্রেম ভিন্ন নারীর প্রতি আরও যে বিশেষ প্রেম থাকতে পারে তাঁর অপরিপক্ক হৃদয়ানুভূতি জানত না। একে তো ধনীর দুলাল তার ওপর সুপুরুষ। বেগম সিদ্দিকী অর্থাৎ তাঁর মা সকাল-সন্ধ্যা দোয়া-দরুদ পড়ে ছেলেকে ফু দিতেন। এ নিয়ে বন্ধু ও আত্মীয় মহলে বেশ ঠাট্টার শিকার হতে হতো৷ কিন্তু মা নিষেধ শুনলে তো! বড়ো ছেলেটি তখন বিবাহিত। সুতরাং বাবা-মায়ের সকল চিন্তার কারণ ছোটো ছেলেটি। মায়েদের চিন্তা কিঞ্চিৎ বেশিই হয়। পাছে তার ছেলেটিকে কেউ জাদু-টোনা করে, বংশের মর্যাদা হানি হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ছেলেটিও কেমন সংসার বিবাগী। সুতরাং ছেলে ও কূল উভয়কেই রক্ষা করা আবশ্যক হয়ে ওঠে। সেই নিমিত্তে গোপনে গোপনে পছন্দসই মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। পেয়েও গেলেন। দূর সম্পর্কের এক বোনের মেয়েকে দেখামাত্রই তাঁর মনে ধরে গেল। এখন ছেলের মনেও তো ধরানো দরকার। কিশোরীর একটা ছবি এনে রেখে দিলেন ছেলের টেবিলের ওপর। ইকরাম আজাদ দুপুরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে টেবিলের ওপর ছবিটা দেখতে পান। কিছুক্ষণ চোখের পলক ফেলতে পারেননি। সেই কিছুক্ষণে তাঁর পৃথিবী বদলে যায়। হৃদয়ে প্রথম প্রেমের কোকিল ডেকে ওঠে। অথচ, ছবিটির কিশোরী বড্ড সাদামাটা গেঁয়ো মেয়ে। পরনে টাঙ্গাইল শাড়ি, কাঁধ বেয়ে ঝুলে থাকা দুটো বেনী আর কপালে কালো টিপ। কী সাধারণ সাজ তবুও চোখের পলক পড়ল না। ঠোঁটের কোণে স্মিত লাজুক হাসি। যা গিয়ে ব্যাপ্ত হয়েছে ওর দুটো কাজল কালো ডাগর আঁখিতে। ইকরাম আজাদ সর্বস্ব দিয়ে বসেছিলেন সেই ডাগর নয়নে চেয়ে। বড়ো ভালোবেসে কিশোরী নববধূকে তিনি কাজল বলে ডাকতেন। দীর্ঘ সতেরো বছরের সংসারে কাজলের প্রতি ভালোবাসা তাঁর বেড়েইছে। ঈপ্সা সেই ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা এনেছিল। স্ত্রী কন্যা নিয়ে সুখেই কাটছিল জীবন। হঠাৎ তাঁকে ফাঁকি দিয়ে একলা করে কাজল পরপারে পাড়ি জমায়। কাজল নেই এইটুকু বিশ্বাস করতে, মানতে বছর কেটে যায়। এখনও কি পুরোপুরি মানতে পেরেছেন? ইকরাম আজাদের বুকের বা’পাশে কেমন চিনচিনে ব্যথা ওঠে। কাজলের শূন্যতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তাঁর জীবনে। মনটা বড়ো কাজল! কাজল করে। কিন্তু কাজল যে সাড়া দেয় না। ইকরাম আজাদের মুখে বিষাদের ছায়া নামে। দৃষ্টি উদাস। বেখেয়ালে নড়েচড়ে উঠতে ক্যামেলিয়াকে জাগিয়ে দিলেন। অপ্রস্তুত হয়ে শাড়ির ঠিক করে অগোছালো চুলের ওপর ঘোমটা টানল মেয়েটা। ইকরাম আজাদ উঠে বসতে গেলে ক্যামেলিয়া সাহায্যে জন্য হাত বাড়ায়।
“আমিই পারব।”
স্পর্শ করার আগেই থামিয়ে দিলেন। নিজে নিজে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন। মেয়েটি কি তাঁকে বয়োঃবৃদ্ধ ভাবে? ভাবলেই বা কী! বয়স তো আর কম নয়। ক্যামেলিয়া উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে বলে,
“আপনার শরীর এখন কেমন?”
“ভালো।” ছোট্ট জবাব। আবার দুজনে চুপ। এরপর ইকরাম আজাদই বললেন,
“রাতে বোধহয় ঘুম হয়নি। তুমি বরং আরেকটু ঘুমাও। আমার একটু কাজ আছে। বাইরে যেতে হবে।” সাথে সাথেই বিছানা ছেড়ে নামলেন। ক্যামেলিয়ার জবাবের অপেক্ষা না করে বাথরুমে ঢুকে পড়েন। দরজা দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলেন, যেন এতক্ষণ আঁটকে ছিল। হঠাৎ তাঁর মনে হলো গোসল করবেন কিন্তু কাপড় যে ভুলে আনেননি। আধঘন্টা সেখানে বসে-দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখলেন রুমে ক্যামেলিয়া নেই। দ্রুত কাপড় নিয়ে ফের ঢুকলেন। গোসল করে তৈরি হয়ে একেবারে নিচে নামলেন। সেখানে তাঁর জন্য আরেক বিপদ অপেক্ষা করছিল।
“ওই যে আব্বাজানে আইয়া পড়ছে।” প্রৌঢ়া বসার ঘরের কাউচ ছেড়ে সহাস্যে উঠে এগোলেন তাঁর দিকে। ইকরাম আজাদ চিন্তায় পড়লেন। জোরপূর্বক বিফল চেষ্টা করলেন সহবতের হাসির।
“আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কাইল রাইতে মেলা খারাপ একখান স্বপন দেখলাম। মনডা কেমন কেমন করল। মাইয়ারে কইলাম এইবার আমি আমার বাপজানরে যাই দেইহা আহি। ভালা আছো তো বাপজান?” ইকরাম আজাদের বাহুতে মমতাসুলভ হাত বুলিয়ে দিলেন।
“জি, খালাম্মা, ভালো। দাঁড়িয়ে কেন আপনি? চলুন বসবেন।”
প্রৌঢ়ার হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে এলেন তিনি। তাঁকে বসিয়ে মনসুরকে বললেন,
“মনসুর, বুয়াকে বল খালাম্মার রুমটা পরিষ্কার করে দিতে। এত পথ জার্নি করে এসেছেন নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। মনসুর বুয়াকে টেবিলে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বল।”
প্রৌঢ়া প্রায় জোর করে তাঁকে পাশে বসিয়ে মাথায় ও পিঠে মমতামাখা হাতখানা আবার বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
“এত তাড়াহুড়ার কাম নাই বাপ। তুমি একটু আমার পাশে বসো। নয়া বউ কই? ও বউ?” ইকরাম আজাদ বিব্রতবোধ করলেন। যথাসাধ্য সেটা গোপন করে বললেন,
“উম..খালাম্মা ও এখন থাক। ওর শরীরটা একটু খারাপ। ঘুমাতে বলেছি আমি।”
প্রৌঢ়া খানিক কপাল কুঁচকে ঠোঁট টিপে হাসলেন।
“আচ্ছা থাক, থাক।”
প্রৌঢ়ার হাসির কারণ বুঝতে পেরে ভারি লজ্জায় পড়লেন ইকরাম আজাদ। চট করে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এত পথ জার্নি করে এসেছেন আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমার একটু বিশেষ তাড়া আছে। রাতে এসে কথা বলব খালাম্মা।”
প্রৌঢ়া উজ্জ্বল মুখ মলিন হলো।
“যাইবা? আচ্ছা যাও। রাইতে তাইলে কথা হইব।”
ইকরাম আজাদ যত দ্রুত পারলেন সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। থামলেন বাড়ির সামনে দাঁড়ানো গাড়ির পাশে এসে। মনসুর পেছন পেছন এলো। গম্ভীর মুখে ওকে বললেন,
“খালাম্মাকে কেউ যেন আগেভাগে কিছু না জানায়। সময়-সুযোগে আমিই সব বলব।”
মনসুর মাথা নাড়ায়,
“ঠিক আছে।”
“ওদিকের খবর-টবর কী?”
“খোঁজ চলছে। ওরা বলেছে কালকের মধ্যেই ফাইনাল জানাবে।”
“এহসাস ঠিক আছে তো?”
“আশা তো করছি। তাছাড়া বাবার ক্ষতি করা অত সহজ না। আপনি চিন্তা করবেন না সৈয়দ সাহেব। বাবাকে সহিসালামত ফিরিয়ে আনব।”
“চিন্তা কী আর ইচ্ছে করে করি রে! ও কেন এমন করেছে জানতে পেরেছিস কিছু?”
“ক্লিয়ারভাবে না। শুনেছি বাবার কোনো এক বন্ধুর লাপাত্তা হওয়ার পেছনে ওই ছেলের হাত ছিল। পুরো ঘটনা জেনে আপনাকে সবিস্তারে জানাব আজ-কালের ভেতরে।”
“তুই বারবার দিন দেখাচ্ছিস কেন মনসুর? কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমি এহসাসকে বিপদে ফেলে রাখতে পারব না। যা করার দ্রুত কর। যত তাড়াতাড়ি পারিস ওর খোঁজ বের কর। কে জানে কোন ষড়যন্ত্রের শিকার আবার হলো। হাতের কাছে পেয়ে নিই একবার ব্যাটাকে। কান টেনে ছিঁড়ে দেবো ওর। এত বড়ো একটা কান্ড ঘটনোর আগে একবার আমাদের কথা ওর স্মরণে এলো না? এখন ওর নানিকে কী জবাব দেবো!”
গাড়ির দরজা খুলতে মনসুর বলে,
“কোথায় যাচ্ছেন এই অবেলায়?”
“আমার এখন আর বেলা আর অবেলা। তোর একার ওপর এত কিছু চাপিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে তো পারি না আমি। ইকরাম আজাদ তাঁর ভাতিজার বিপদ জেনে হাত গুটিয়ে ঘরে শুয়ে থাকবে না। ও শুধু আমার ভাতিজা না আমার ছেলে। আমি আমার ছেলেকে ভালো করেই জানি৷ ও আর যা করুক কোনো নিরপরাধের মৃত্যুর কারণ হবে না। কারো মৃত্যুর কারণ হবে এও তো বিশ্বাস হয় না।”
গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঈপ্সা কোথায়?”
“আম্মাজান আজ গাড়ি ছাড়াই কলেজে গেছেন।”
দুটো ক্লাসে উপস্থিতি দিয়েই কলেজ থেকে বেরিয়ে এলো ঈপ্সা। উদ্দেশ্য মিরপুর দশ। ব্যক্তিগত গাড়িটি আজ এজন্যই আনেনি। বাসে যাত্রা এখনও বেশ দুরূহ ওর জন্য। তবুও বাসে করে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। যথেষ্ট ভোগান্তির পর বাসে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু সিট খালি নেই। অতিরিক্ত যাত্রীতে ঠাসা বাসটা। পাশ থেকে একজন মাঝ বয়সী লোক ইচ্ছে করেই গায়ে ধাক্কা দিলো। ঈপ্সা রেগে তাকাতে লোকটা এমন একটা ভাব করল যেন তার মতো সাধু পুরুষ পৃথিবীতে দুটো নেই। মনে মনে ওর গালি ভান্ডারের কুখ্যাত গালিটি দিলো লোকটাকে। মুখে সেসব কোনোদিন বলতে পারবে না৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাসে যাওয়া আসা করতে হলে মুখে বলাটা শিখতে হবে।
বাস থেকে যখন মিরপুর দশ এর ওভারব্রিজের নিচে নামল সমস্ত শরীরে যেন অশুচিতা। পারলে এখনই শাওয়ার নেয়। মানুষ এমন নোংরা মানসিকতার কী করে হতে পারে! মন খারাপ করে সামনে হাঁটতে লাগল। প্রায় পনেরো মিনিট পরে গন্তব্যে এসে থামে। পিঠের ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মিরর ক্যামেরায় নিজেকে শেষবার দেখে নিলো। এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে আঁচরে ঠিক করে, কুঁচকে যাওয়া কাপড়ের ওপর ইস্ত্রির মতো হাতের তালু ঘষল, মুখটা টিস্যু পেপারে মুছে নেয়। মেকাপ করেনি৷ কলেজে কে মেকাপ করে বের হয়! তার ওপর দাদাভাই নিখোঁজ। মনটা এমনিতেই প্রচন্ড খারাপ। তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস দাদাভাই ফিরে আসবে। আয়নায় আবার তাকালো। একটুখানি কাজল দিয়েছিল তাও লেপ্টে গেছে। ঠোঁটে দেওয়া লিপবামের অবস্থা আরও খারাপ। পঁচা ব্রান্ড! দোকানদার ঠকিয়েছে ওকে। ঠোঁট ফুলিয়ে মোবাইল সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। পা বাড়াল আগে।
“ডাক্তার সাহেব আছেন?” ক্লিনিকের রিসিপশনের মেয়েটিকে প্রশ্ন করল ঈপ্সা। ওর বুক দুরুদুরু করছে। মেয়েটির দৃষ্টির সামনে অপ্রতিভ হয়ে যাচ্ছে বারংবার।
“ডাক্তার তো একজন নয়। কাকে খুঁজছ তুমি?”
“উমম.. দু..দুর্জয় আহমেদ। আছেন উনি?”
“ডাক্তার দুর্জয়? না, এই তো মিনিট পাঁচেক আগে তিনি বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার মারিয়ার সাথে।”
“ডাক্তার মারিয়ার সাথে!কো.. কোথায়?”
“কী জানি?” দায়সারা জবাব দিলেন রিসেপশনিস্ট মেয়েটি। ঈপ্সা হতাশ মুখে ঘুরে দু’কদম এগোতেই পেছনে চাপা গলায় বলতে শুনল,
“আমি নিশ্চিত ওরা ডেটে গিয়েছে। কদিন ধরে দুজনের কম মাখা-মাখি তো দেখছি না। ডাক্তার মারিয়া তো দুর্জয় স্যার বলতে লাইলি। বিয়ে না করে ছাড়বে না মনে হয়। মানাবেও কিন্তু বেশ দুজনকে।”
“হুশ! এসব জোরে বলো না। কেউ শুনতে পাবে।” রিসেপশনিস্ট মেয়েটি আগের মেয়েটিকে সাবধান করল। তারপর ফিক করে হেসে উঠল দুজনই।
ঈপ্সার মনে হলো কেউ যেন খুব জোরে ওর বুকের ভেতর আঘাত করল। মায়ের মৃত্যু পর দ্বিতীয়বার ওর এত কষ্ট হচ্ছে। চোখ সজল হয়ে ওঠে। পায়ে শক্তি পায় না তবুও এক দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে,,,,