#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২৩
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
একটা জলজ্যান্ত মানুষ কী করে হাওয়ায় মিশে যেতে পারে! কোথায় না খুঁজেছ তাকে! ঢাকা থেকে শুরু করে রাঙামাটি। মাঝখানে বহুপথ, বহুদূর! সব তন্ন তন্ন খুঁজেছে! কোথাও নেই। ওর চিহ্নও না। যেন মৃত আত্মার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
পাশা হক সিগারেট টানে আর ভাবে। যতক্ষণ চেতনা থাকে এই ভাবনা তাকে শান্তি দেয় না। রক্তের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে সে। টগবগ করে ফোটে গরম রক্ত। শব্দ হয় না। কেউ বোঝে না। একা সে বোঝেন৷ একা তার এই যন্ত্রণা। একটা মুখ সেই যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। বহু বছর গত হয়েছে মানুষের রক্ত হাতে লেগেছিল। ইদানীং তীব্র আকাঙ্খা জেগেছে আবার দুহাত রক্তে লাল করবে। সমস্ত গায়ে মাখিয়ে পৈশাচিক উল্লাস করবে। সেই রক্ত নির্দিষ্ট একজন মানুষের হবে৷ সে আর কেউ না সৈয়দের আদরের দুলাল এহসাস আরমান।
স্থাণুবৎ একমাত্র পুত্রকে দেখে তার চোখে অশ্রু আসে না। প্রতিশোধের তীব্র আগুন জ্বলে। পুড়িয়ে ছারখার করতে চায় সৈয়দদের, সৈয়দ বংশের প্রদীপকে। কী ভেবেছে ওরা? পাশা হক সহজে হার মানবে? হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া এহসাস আরমানকে খুঁজে বের করে আনতে পারবে না? ভুল ভাবে ওরা। প্রতিশোধ নেবে। যেভাবে তার আদরের সন্তান ভুগেছে সেভাবেই ভুগতে হবে ওকেও। নিজের সাথে করা এ তার পণ।
ডাক্তার রোজ আসে। রোজ জীবন্ত লাশ হয়ে বেডে পড়ে থাকা পিয়াসকে নাড়ি-চাড়িয়ে দেখে চলে যায়। রোজ হতাশ করে যায় পাশা হককে তারা।
“ডাক্তার, কোনো পরিবর্তন বুঝা যায়?”
সভয়ে মাথা নাড়ায় দুদিকে ডাক্তার। ভয় পায় পাশা হককে সে। কে না পায় ভয় তাকে? পিয়াসও পেত। মানুষ হিসেবে যতটা না খারাপ ছিল বাবা হিসেবে ততটা ছিল না সে। আবার আদর্শও বলা চলে না। কোনো সম্পর্কেই নীতি মানেনি। তার স্খলিত চরিত্র, তিরিক্ষি মেজাজ কোনোটাই পিয়াস পায়নি। বাপের একেবারে বিপরীত ও। শান্ত, সভ্য আর ভীতু। নিজের প্রতিচ্ছবি নয় বলে গোপনে গর্ব লুকিয়ে রাখত। খুব সাময়িক সেই গর্বের খুশি। ছেলে ভীতু এই ব্যাপারটা শুধু মানিয়ে নিতে পারত না। তার বংশে কেবল ডাকাত জন্মেছে। পিয়াসের স্বভাবে সেই হিংস্রতা আসবে না কেন? এত ন্যাতানো ভীতু হবে কেন তার সন্তান? এই কেনর জবাব আজও হন্যে হয়ে খোঁজেন।
ঘৃণ্য ও পাষণ্ড এক পশু ছিল পাশা হক যৌবনে। এখনও ভেতরে সেই পশুটি রয়ে গেছে, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানুষ হবে। পিয়াস মানুষ হবে। পাপ করা পাশা হকের রক্তে ছিল। একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়৷ আস্তে আস্তে সেটাতেই সুখ পান। কিছু সুখ মানুষ পেতে তো চায় কিন্তু ভালোবাসে না। পাপ তার কাছে তেমনই। এই যে সেই পাপেই বুঝি পিয়াসের আজ এই দশা। পাপই এর কারণ। যত দোষ তার ও তার পাপের। শুধু ঘৃণাই না ভয়ও পায় পাপকে। পাপটা সাপ হয়ে এক ছোবলে না নির্বংশ করে দেয়!
“স্যার, স্যার!”
“হুঁ!” চমকে তাকায় ডাক্তারের দিকে।
“অনেকক্ষণ ধরে ডাকছিলাম আপনাকে। ঠিক আছেন আপনি?” বলল ডাক্তার।
পাশা হক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু মাথা নাড়িয়ে নিশ্চল শয্যাগত ছেলের দিকে তাকালেন।
“ছেলেটা কি আর জাগবে না ডাকতর?” গলাটা পাথরের মতো কঠিন শোনাল। ডাক্তার বুঝে -শুনে জবাব দেয়,
“আশা রাখেন আঙ..ক.. আইমিন স্যার, আসলে ও যে স্টেজে আছে সেখানে নিশ্চিত হয়ে বলা মুশকিল। এক মিনিট পরেও জেগে উঠতে পারে আবার এক বছর পরেও। আল্লাহকে ডাকেন। তিনি চাইলে মিরাকল ঘটতে পারে।”
মিরাকল! অলৌকিক কিছু ঘটবে? তার মতো পাপীর প্রতি সদয় হবে সৃষ্টিকর্তা! পাশা হক মিরাকল কথাটায় ভরসা পায় না। ছেলের হাত পা ছুঁয়ে দেখল। কী উষ্ণ! যেন এক্ষুণি জেগে উঠবে। বাবাকে দেখতে চোখদুটোর পল্লব নেমে যাবে। ওই একই চোখ পাশা হকের। কিন্তু চাহনি দু রকম। এক চোখজোড়া হিংস্র পশুর ন্যায় নির্মম আর অন্য জোড়া শান্ত, ভীতু। এই মুহূর্তে জেগে বাবাকে দেখলে চাপা এক উচ্ছ্বাসে ও ভয়ে বরাবরের মতোই ডেকে উঠবে, “আব্বা,আব্বা!”
পাশা হকের বুক মথিত হয়। ছেলেকে এতটা ভালোবাসত এই প্রথম উপলব্ধি হলো। কেন যে হলো! পাষণ্ড, পাপীদের এসব অনুভূতি থাকতে নেই। তাতে যে দুর্বলতা আসে।
ডাক্তার প্রস্থান করে। পাশা হক নড়ে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। তার চোখে রক্ত ক্ষুধা ঝলসায়। ঘায়েল জন্তুর মতো বুকের মধ্যে গর্জন ওঠে। ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি বাজে কোথাও। কেউ চিৎকার করে বলে,”প্রতিশোধ চাই!”
ক্লাসরুমের সামনের করিডোরের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ঈপ্সা। রোদ এখনও ছড়িয়ে পড়েনি। থম ধরে আছে সামনের প্রাচীন লালে ছাওয়া কৃষ্ণচূড়ার ডালপালা। নিম্নচাপের তাপে হাসফাস করছে মানুষ। কোথাও বাতাসের নামগন্ধ নেই। কৃষ্ণচূড়ার পাতা ও ফুলগুলো জড় পদার্থের ন্যায় স্থির।
প্রচণ্ড ঘামছে ঈপ্সা। আজ ইউনিফর্মের ওপর হিজাব পরেনি। পিঠে বইয়ের ব্যাগ। ফর্সা গ্রীবাদেশে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম মুক্ত দানার মতো জমে আছে। ছোট্ট একটা পাখায় বাতাস নিচ্ছে। হাত লেগে গেল! শরীরটা ইদানীং ভারি ভারি লাগছে। আগের তুলনায় মোটা হয়ে যাচ্ছে কি? বড্ড অনিয়ম হচ্ছে সবকিছুতে আজকাল। নিজের প্রতি অবহেলা করছে। আয়নায় দেখা নিজের প্রতিবিম্বের প্রতি ধীরে ধীরে বিরাগ জন্মাচ্ছে। ভালো লাগে না ওর। কিছুই ভালো লাগে না।
হাতঘড়িটা একবার দেখে নেয়। ক্লাস শুরু হতে এখনও দশমিনিট বাকি। একা একা কোথায় বসবে? নাফিসা আজ আসবে না। ওর ভীষণ জ্বর। সৌমির প্রথম ক্লাসটা নেই। আসতে একটু দেরি হবে। কলেজে ঈপ্সার তেমন বন্ধু নেই। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ভারি লজ্জা করে। সকলে ভাবে অহংকার! ঈপ্সা মোটেও অহংকারী নয়।
পেটটা ডেকে ওঠে। কাল দুপুর থেকে জাঙ্ক ফুডই খেয়েছে। ভাত তরকারি ছুঁয়ে দেখেনি। বাবার ওমন রাগী মূর্তি ও ধমক ঘরের খাবারের খিদে মেরে দিয়েছে। ওর ঘর থেকে ওরা বের না হওয়া পর্যন্ত বাথরুম থেকে বের হয়নি সেদিন। ভেবেছিল বাবা বকবে। তারপর ঈপ্সা রাগের মাথায় আবোল তাবোল বললে হয়তো মারবে… ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনোটাই ঘটেনি। সাহসও পায়নি আর দরজা খোলার। সকালে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কলেজে চলে এসেছে। খিদেতে পেট গুড়গুড় করছে। ঈপ্সা ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা হয়। সিঁড়িতে নামতে থেমে যায়। শান্তও থামে ওকে দেখামাত্র। সেদিনের পর আজ প্রথম দেখছে শান্তকে৷ ভেবেছিল কলেজে দুর্নাম রটিয়ে দেবে।আজ কলেজে এসে বুঝেছে সেসবের কিছুই ঘটেনি। মার খাওয়ার শোধ তুলবে কি এখন অপমান করে? মনে মনে একটু ভয়ই পেল ঈপ্সা। শান্ত ওরই দিকে তাকিয়ে আছে।
“ভালো আছো ঈপ্সা?” ওকে অবাক করে দিয়ে সংকোচের সাথে জানতে চাইল। ঈপ্সা ভালো করে লক্ষ্য করল। একেবারে গোবেচারা টাইপ ছেলেটা। খামোখা আদরূপ ওকে মেরেছে।
“ভালো। তুমি?”
“আমিও ভালো। এই কদিন কলেজে আসোনি কেন?”
চিন্তিত গলায় বলল! ঈপ্সার জন্য ও কী চিন্তা করেছে? ঈপ্সা দৃষ্টি যায় ওর ঠোঁটের পাশে। ছেলেটার ঠোঁটের ঘা এখনও শুকায়নি। অপরাধবোধে ঈপ্সা এগিয়ে এলো।
“আ’ম সরি শান্ত। আমার জন্য শুধু শুধু মার খেলে সেদিন।”
“আমি কিছু মনে করিনি। উনি ভুল বুঝেছে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ইট’স ওকে।” ঘাড়ের কলারের পেছনে হাত ডলতে ডলতে বলল। লজ্জায় চোখদুটো পায়ের দিকে থামে। ঈপ্সার ভীষণ খারাপ লাগল।
“কেন মনে করোনি? একটা লোক বিনা কারণে তোমার ঠোঁট ফাটিয়ে দিলো আর তুমি কিছু মনে করোনি? লজ্জা পেয়ো না। আমাকে বকো। যা ইচ্ছে বলো। আমারই দোষে ওভাবে মার খেলে। ঈশ! ঠোঁটে বুঝি এখনও ব্যথা হয়?”
শান্ত জবাব দিলো না বিস্ময়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার হেসে দিলো।
“আরে ধুর! এইটুকু ব্যথাতে কী এমন হয়? শোনোনি মার্দ কো দার্দ নেহি হোতা। আমি সত্যি কিছু মনে করিনি। কেন করিনি জানো?”
“কেন?” ঈপ্সা কৌতূহলি হয়। সিঁড়িতে উঠতে নামতে অনেক সহপাঠী ওদের দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। শান্ত বলে,
“আমার সাথে এসো বলছি।”
শান্ত ওকে করিডোরের নিরিবিলি স্থানে নিয়ে এলো। ঈপ্সা অধৈর্য হয়ে বলল,
“এখন বলো।”
শান্ত ওর কৌতূহলি চোখে চোখ রেখে বলে,
“এই যে তোমার সুনজরে পড়ব তাই। মারটা না খেলে এত দয়া দেখাতে? সেধে কথা বলতে আসতে আমার মতো সাধারণ ছেলের সাথে? কদিন আগে তুমি আমার ছায়াও চিনতে না। কদিন আগে আমার স্বপ্ন মনে হতো এই এখনকার মুহূর্ত। ওই মারের কল্যাণে স্বপ্নটা পূরণ হলো। কিছু মনে করি কী করে তাহলে? বরং খুশিই হয়েছি। তবুও তোমার যদি খুব খারাপ লাগে তাহলে একটা অনুরোধ রাখো আমার।”
“অনুরোধ?”
“তেমনই। তোমার বন্ধু হতে চাই আমি ঈপ্সা। বানাবে বন্ধু?”
“পাগল! আদরূপ ভাই তোমাকে আমার পাশে দেখলে মেরেই ফেলবে। আমার ভাইদের সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। তাছাড়া আমি ছেলেবন্ধু বানাই না। অন্য অনুরোধ করো।”
শান্ত হতাশ হয়। ওর ঠোঁটের হাসি নিভে গেল। একটু ভেবে বলল,
“তোমার আদরূপ ভাই কি কলেজে আসে?”
“না!”
“এহসাস ভাইয়াও এখন তেমন এদিকে আসে না।”
ঈপ্সার মুখ কালো হয়ে যায়। কতদিন ভাইকে দেখে না। এদের হয়তো কোনো ধারণাই নেই এহসাসের সাথে কী ঘটেছে! কেন সে আসে না।
“ঈপ্সা, এই ঈপ্সা!”
“হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে?”
“বলছিলাম কলেজের গন্ডির মধ্যে না হয় সীমাবদ্ধ থাকবে আমাদের বন্ধুত্ব। তুমি চাইলে মোবাইলে কথা হবে আর না চাইলে হবে না।”
“তুমি দেখছি বন্ধু না হয়ে ছাড়বেই না।” রেলিঙ ঠেসে দাঁড়িয়ে বলল ও৷ শান্তকে কেন যেন ওর ভালো লাগল। কথা বলতে খারাপ লাগছে না। অস্বস্তি হচ্ছে না সেদিনের মতো। একটা ছেলেবন্ধু বানালে কী আর এমন হবে! বন্ধু তো বন্ধুই! তাছাড়া ছেলেটা ওর জন্য মার খেয়েছে। তার এইটুকু অনুরোধ রাখবে না?
শান্ত দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।
“হবে বন্ধু?”
ঈপ্সা হাসি চেপে বলে,
“না!”
শান্তর আশান্বিত মুখটা আবার হতাশায় নিমজ্জিত হতে দেখে হেসে ফেললো ঈপ্সা।
“হ্যাঁ।
“হ্যাঁ! তারমানে আমরা ফ্রেন্ডস?”
ঈপ্সা মাথা নাড়াতে শান্ত হাসে। ঈপ্সা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সতর্ক করে বলে,
“শুধু বন্ধু। ভুলেও যদি প্রেম টেমের কথা বলেছ তো আমার ভাইদের সামনে নিয়ে ছেড়ে দেবো তোমাকে।”
চলবে,,,