“আকাশী”
পর্ব ১৮.
একা চলা কঠিন নয়, আবার অত্যন্ত সোজাও নয়। একা একা অনেক কিছুই সংঘটিত হয় না। জীবন চলার পথে যে রাস্তা দিয়েই যাওয়া হোক না কেন, ওই অজানা রাস্তার সম্বন্ধেও কারো কাছ থেকে জেনে নিতে হয়। এভাবে পদে পদে অন্যের সাহায্যের দরকার হয়, হোক তা নিতান্ত ছোট কিছু। আকাশী এই সমস্যার সম্মুখীন প্রায়ই হচ্ছে। একদম একা চলার প্রতিজ্ঞাটা ভঙ্গ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আবার একা একা অনেক কিছুই পারা যায় না। এই যেমন, একদিন কলেজে না গেলে কারো কাছে ফোন করে পরবর্তী দিনের পড়ার কথা জেনে নিতে হয়। এভাবেই একা একা সবকিছু সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। সে আবার ভাবল, জীবনে এমন অনেক স্টোরি পড়েছি, যেগুলোর অন্তরায় যে কেউ সাহায্য ব্যতীত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। কেউই একা কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। হয়তো গাড়ির প্রয়োজন হয়। এটাও একটা মানুষ চালায়। রাস্তার দরকার হয়। এটার পেছনে মানুষের কর্তৃত্ব। এভাবেই চারিদিকে মানুষের সহায়তা ছড়িয়ে আছে। আজ ভর্তিও হয়েছে অনিকের সহায়তায়, মন্দ কিছু নয়। আমরা উপরে উঠতে চাইলে কিছু কিছু খুঁটির প্রয়োজন হবেই। এগুলো তো একা তৈরি করা সম্ভব নয়। আকাশী সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে একা থাকার প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে। সে যথারীতিতে কলেজে বন্ধু-বান্ধব বানাতে শুরু করল। ভালো ছাত্রীরাও আকাশীকে তাদের সহপাঠী হিসেবে বেশ সম্মান দেয়। কারণ পড়ুয়ারা পড়ুয়াদের পছন্দ করে।
তার দিনকাল ভালই চলতে শুরু করল। পরিচিত সহপাঠীদের মধ্যে একটি মেয়ের সাথে তার অত্যধিক ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। মেয়েটির নাম ঝুমুর। আকাশীর বাড়ি থেকে তার বাড়ির দূরত্ব এক মাইলের বেশি নয়। প্রতিদিন আকাশী তাকে ফেরার পথের সঙ্গী হিসেবে পায়, যার ফলে তাদের বন্ধুত্বটা সুদৃঢ় হয়েছে। এরপর তারা কলেজে যাওয়ার পথেও এক হয়। একদিন আকাশী কলেজের সামনে ঝুমুরের সাথে নেমে পড়ার পর লক্ষ করল, একটি ছেলে তাকে দেখে মৃদু হেসেছে। তাকে কেন যেন পরিচিত বোধ হয়। মনে পড়ল। এই ছেলেটিকে মাঝে মাঝে ক্লাসমেট হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু ছেলেটির হাসির অর্থ সে বুঝতে পারে না। ঝুমুরের সাথে সে কলেজে ক্লাস করতে চলে গেল। ক্লাস শেষে ছেলেটি ইচ্ছে করেই তাদের সামনে এসে পড়ে। আকাশী সবকিছুকেই প্রথমে স্বাভাবিক ভাবে দেখে। তাই ছেলে হিসেবে তাকে পরোয়া করেনি। সে মেয়ে হলেও আকাশী ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতে যেত।
‘ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের?’
‘হ্যাঁ। তোমার নাম আকাশী তাই না?’
‘জ্বি, কিছু বলবেন?’
‘না, ভাবলাম দুই বছর ক্লাসমেট হিসেবে মিলেমিশে পড়াশোনা করতে হবে। বন্ধুত্ব করে নেই। আমি রাজিব।’
‘ভালোই করলে রাজিব।’ ছেলেটির মতিগতি ভালো দেখে আকাশী তৎক্ষণাৎ তাকে তুমি করে বলে ফেলল।
এতে ছেলেটির সঙ্কোচ অনেকটাই কমে এসেছে। সে পাশের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, ‘ও নিশান। আমাদের সাথে পড়ে।’
আকাশী মুচকি হেসে পরিচিত হলো। ছেলে দুটো প্রথমে সঙ্কোচ করছিল আকাশীর সাথে কথা বলতে। বোরকা পরে, সম্ভবত ভদ্রঘরের মেয়ে। সাহসে কুলাতো না। পরক্ষণে আকাশীকে ফ্রি মাইন্ডের মেয়ে হিসেবে আবিষ্কার করে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হলো।
আকাশী বাড়িতে ফিরে আসে। ক্ষেতের মাঝখানের রাস্তাটায় আজ সে এক অচেনা ভদ্রলোককে দেখেছে। এগ্রাম-ওগ্রাম ঘুরে বিধায় প্রায় মানুষকেই সে চেনে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত কারো বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু তার চাহনির কারণে আকাশীর তাকে ভদ্রলোক ভাবতে বিবেকে বাধল। আকাশী দ্রুতপদে হেঁটে বাসায় ফিরে এসে গোসল সেরে খাবার খেয়ে নেয়। দুপুরের বিরক্তিকর সময়টা পার করতে সে পুকুরঘাটে গিয়ে বসল। কিছু মহিলা গোসল করছে। তার মনে রীতিমতো লোভ জাগতে লাগল পুকুরে গোসল করার। পরক্ষণে লোভটাকে সামলাতে সে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে। তখনই চোখ যায় দুপুরে দেখা লোকটার ওপর। এই সময় ছেলেরা আশেপাশে থাকে না মেয়েরা গোসল করে ভেবে। কিন্তু এই লোকটা এখানে করছে কী? লোকটা একদৃষ্টিতে পুকুরের নিচের সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে। আকাশীর তাকে দেখে থাকার বিষয়টা সে বোধ হয় লক্ষই করেনি। আকাশী ফুঁসে উঠল। কারণ নিচের সিঁড়িতে মেয়েরা বসে বসে শরীরে সাবান ঘষছে।
আকাশী উঠে দাঁড়ায়। লোকটা তাকে এতক্ষণে খেয়াল করে যেন কিছু হয়নি এমন বেশে চুপটি করে কেটে পড়ল। আকাশী একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক হয়েছে, এখন আর না। এই বাড়ির লোকের নানা আত্মীয় আসতেই পারে। তাদের মাঝে এই ধরনের খারাপ লোকেরও অস্তিত্ব থাকতে পারে। এই ধরনের লোকেরা তো সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিছু একটার বন্দোবস্ত করতেই হবে।
আকাশী সমস্যাটা নিয়ে ফারুক চেয়ারম্যানের বাসায় উপস্থিত হলো।
‘আকাশী মা যে? আয়, ভেতরে আয়।’
তিনি পত্রিকাটা সোফার সামনের টেবিলে ভাঁজ করে রাখলেন। আকাশী তাঁর পাশে বসল।
‘কী সমস্যা?’
‘সমস্যার কথা আপনি কী করে বুঝলেন?’
‘সমস্যার কথা তোর মাথায় ঘুরপাক খেলেই তোকে এতো চিন্তিত দেখায় আর তুই এভাবেই গম্ভীর হয়ে আমার পাশে বসিস। তখন লাগে, তুই হঠাৎ করেই আমাকে চাচা থেকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিয়েছিস।’ ফারুক হাসলেন।
‘চাচার সময় আপনি চাচা। আবার সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হলে তখন আপনি চেয়ারম্যান। আমি আজ চেয়ারম্যানের কাছেই এসেছি।’
‘বল কী বলবি।’
‘চাচা, আমাদের বাড়ির মেয়েদের পুকুরে গোসল করার সময় প্রাইভেসির ব্যবস্থা নেই। ঘাটের সামনে টিন বাঁধানো আছে ঠিক। কিন্তু খারাপ লোকেরা ঠিকই দূর থেকে হলেও সিঁড়ির নিচের দিকে চেয়ে থাকে। আপনার মনে হয় না, কিছু একটার ব্যবস্থা করা উচিত যাতে মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে গোসল করতে পারে?’
‘কথা তো ঠিক বলেছিস। কিন্তু আমি কী করতে পারি?’
‘পুকুর তো অনেক বড়। তিনটা ঘাট আছে। একটা ঘাটের চারিদিকে কি সিমেন্টের দেয়াল তোলা যেতে পারে না?’
‘কিন্তু পুকুর আরও অনেকে ব্যবহার করবে। যাদের কাছে যে ঘাট আগে পড়ে সেই ঘাটেই তারা যায়। কাকে কাকে থামিয়ে রাখব? আর সম্মুখের ঘাট বড় বিধায় ছেলেমেয়েরা সেখানেই যেতে চায়।’
‘সম্মুখের ঘাটে কে বলছে? ঘাট বাকি দুটোর একটিতে তো ওই অবস্থা করা যেতে পারে। মেয়েরা একটু অভ্যস্ত হলেই সম্মুখের ঘাট ছেড়ে দিতে পারবে।’
‘বললেই সবকিছু হয়ে যায় না। এগুলো সামাজিক কাজকর্ম। একজনের দ্বারা হয় না।’
‘তাই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনি কথাটি তুললে বাকির সমর্থন না করে পারবে না। আর আপনিই তো বলেন, আপনি চারিদিকের উন্নয়ন বৃদ্ধি করতে চান।’
‘চাই বটে। কিন্তু মেয়েরা এই নিয়ে বিরোধ করলে?’
‘সংকল্প একটা এঁটে ফেললে কারো পরোয়া নাই করা উচিত। আর আপনি তাদের ভালোর জন্যই তো কাজটা করবেন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে দেখি।’
সন্ধ্যায় একটি বৈঠকের আয়োজন হলো। ফারুক বাড়ির কিছু বিজ্ঞ লোকের সাথে বিষয়টা নিয়ে শলাপরামর্শ বিনিময় করলেন। একজন মধ্যবয়স্কা আড়ালে থেকে বললেন, ‘ওই বেহায়া আকাশীর কথায় কেন মত দিতেছেন? আমাদের কাছে ওর মতো মাইয়ার পরিকল্পনার দরকার নাই, যে মেয়ে পুরুষদের দেখিয়ে দেখিয়ে পাড়া বেড়ায়। ওকে দেখে দেখে আমাগো মাইয়ারাও খারাপ হইতেছে।’
আকাশী কথাটি শুনতে পেয়ে মৃদু হাসল। তারপর আড়ালে থাকা ওই কণ্ঠকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি সামান্য শাড়ি পরে ঘুরলে তাতে আপনাদের সমস্যা। মনে করেন ছেলেরা আমার দিকে হাবলার মতো চেয়ে আছে। আপনার জ্ঞাতার্থে বলে দিই, তাদের কারো পরোয়া আমি করি না। সবসময় মেয়েরাই কেন ত্যাগ স্বীকার করবে? পুরুষদের নজর থেকে বাঁচার জন্য তারাই কেন ঘরকুনো হয়ে থাকবে? তারাও মানুষ। এই পথ এই ঘাট সবকিছুতেই ছেলেদের মতোই মেয়েদেরও সমান অধিকার আছে। খারাপ নজর থেকে বাঁচা মেয়েদের কর্তব্য হলে, ছেলেদেরও কর্তব্য হওয়া উচিত নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখা। তাদের দোষ কী দেবো! আপনাদের দৃষ্টিই বিবাদ তৈরি করে। আজ দু’একটা ছেলে আমার দিকে তাকায় বলে ফোঁস করে উঠছেন। অথচ পুকুরঘাটে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কত কত অজানা ছেলে সিঁড়ির দিকে তাকায়। তখন তো প্রশ্ন উঠে না। তখন তো মেয়েরা গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কাপড় সামলায় না। আমি ঢেকে শাড়ি পরলেই কেন প্রশ্ন উঠে? এই প্রশ্ন করার আগে তো কখনও প্রশ্ন করতে পারেননি, আমাদের বাড়ির নাম বদলানো হচ্ছে না কেন।’
সভার অনেকেই হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণ মেয়েটির কথাকে স্পর্ধার উচ্চ সীমায় উত্তীর্ণ ভাবছিল। এখন চমকেই উঠে।
আকাশী বলে চলেছে, ‘মনে সম্ভবত করিয়ে দেওয়া লাগবে, এই বাড়িটির নাম আপনাদের ভাষার বেহায়া মেয়ের চেয়েও অধিক একটি মেয়ের নামে। এটা পাল্টানোর প্রশ্ন তো কারো মুখে উঠে না। মনে করিয়ে দেওয়া লাগবে, বাড়িটা যে মেয়ের নামে, সেও একসময় বেপরোয়া চলাফেরা করত। পুরুষেরা তাকে দেখতেও আসত। এটা নিয়ে তো বিবাদ তৈরি হয় না। আপনাদের জানানোর জন্য এও বলে দিই, এসব আমি কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কারণেই করেছি। আগে একটি মেয়েকে ঘর থেকে বেরুতে দেখলে ছেলেদের তৃষাতুর নজরের অভাব হতো না। এখন তাকিয়ে দেখুন, মেয়েরা এসএসসিও দিতে পারছে। ছেলেদের আশেপাশে চলতে পারছে। খুব কম ছেলেই তাদের দিকে তাকাচ্ছে। এটা কি ভালো কোনো লক্ষণ নয়? অন্তত আগের তুলনায় তৃষাতুর দৃষ্টির সংখ্যা কমেছে। কিন্তু আপনারা তো এসব দেখবেন না। তৃষাতুর দৃষ্টি থেকে আপনাদের রক্ষা করার জন্য এই পরিকল্পনার কথা চেয়ারম্যানকে বলেছি তা দেখবেন না। প্রশ্ন তোলার জন্য দেখবেন পরিকল্পনা প্রদানকারীকেই, তার চরিত্রে অসামঞ্জস্যতা বের করে।’
সভাটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আকাশী এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে সে চলে গেল।
অনেকক্ষণ পর ফারুক বলে উঠলেন, ‘আকাশী ভুল কিছু বলেনি। ওর মন সাফ আছে। ওর গতিবিধি আমি বুঝি বলেই ওর কথাকে এতটা মূল্য দিই। ও প্রায়ই সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলে। যে মেয়ে চিন্তাধারার উন্নতির কথা চিন্তা করতে পারে, তার চরিত্র খারাপ হতে পারে না। ওর চালচলনে আমি সত্যিই অন্যের কল্যাণ করার প্রত্যাশা খুঁজে পেয়েছি। এমন মেয়ের দোষ খুঁজে বার করা ভালো নয়। আমরা যারা অন্যের দোষ খুঁজে ফিরি, তারাও কোনো নিষ্পাপ শিশু নই। আমাদের মাঝেও অনেক দোষ লুকিয়ে থাকে। কিন্তু তা না, আরেকজনেরটাকে বড় করে দেখি। যাইহোক, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অনিককেও স্যাটল করে দিয়েছি। এখন যদ্দিন আছি, কিছু করতে চাই। আমি সত্যিই চাই, আমার যাওয়ার আগে অন্তত ভালো কিছু করে যাই। আমি চাই না, আমাদের এই বাড়িটাতে খারাপ কিছু থাকুক। তাই যথাশীঘ্র দক্ষিণের ঘাটের চারিপাশে দেয়াল তোলার ব্যবস্থা করব। আর একটা রাস্তা তৈরি করে দিব, যাতে সম্মুখের ঘাটের মতো ফ্রি একটা জায়গা হয়। সবাই যাতে চলাচল করতে পারে।’
চেয়ারম্যানের কথায় বাকিরাও সমর্থন করল। পুকুরটা চেয়ারম্যানের। যাই খুশি করতে পারেন। আর তাছাড়া যাদের বিন্দুমাত্র খরচ হয় না, তারা মাথা ঘামাতে চায় না। তাই এক্ষেত্রেও কেউ দ্বিমত করেনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঘাটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যায়। সম্মুখের ঘাট মেয়েরা আগের মতো করেই ব্যবহার করছে। তবে নতুন একটা পরিবর্তন এসেছে। যারা গোসল করতে আসে, তাদের মধ্যে লজ্জার আবির্ভাব ঘটেছে। আগের মতো হাসি-তামাশা বাদ দিয়েছে। সর্বোপরি মাথায় এনেছে, এটা একটা পাবলিক জায়গা। নিজেদেরই ঠিক রাখতে হবে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার