#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_০২
তরী চলে যেতেই আমি অবাক হয়ে অনিকের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম।চোখের দৃষ্টি দিয়ে জানতে চাইলাম,তরী তোমার সাথে এরকম আচরণ করলো কেন!
আমার চোখের ভাষা বুঝে নিতে কষ্ট হলো না অনিকের।আমতা আমতা করে বললো,
–আমিও তো বুঝলাম না,এমন করলো কেন ও!
আমরা দুজনেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
তারপর অনিক চলে গেল অফিসের জন্য তৈরি হতে আর আমি জায়গাটা দ্রুত হাতে পরিষ্কার করে, নাস্তা বানানোর কাজে লেগে গেলাম।
টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে।অনিক ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হলো।
ডাইনিং রুমে এসে একটা চেয়ার টেনে ব্যাগটা রেখে,পাশের চেয়ারটায় নিজে বসলো।
আমিও ওর মুখোমুখি বসলাম।।তরীর খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে অনিক জিজ্ঞেস করলো,
–তরীকে ডাকোনি?
–ডেকেছি অনেকবার।দরজা খুলছে না।বললো ক্ষুধা নেই।
অনিক ছোট্ট করে “ওহ্ ” বলে, চুপ করে খেতে লাগলো।অর্ধেক খেয়েই উঠে গেল সে।বললো তার অফিসে নাকি আজকাল কাজের চাপ বেশি যাচ্ছে।তাই আগে আগে যেতে হবে।
আমি আর ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না।
অনিককে বিদায় দিয়ে ঘরের টুকিটাকি কাজ করছিলাম।একটু পরেই তরী বের হলো ওর রুম থেকে,পুরোদমে তৈরি হয়ে।আমার চোখাচোখি হতেই একটু হাসলো।এখন ওকে একদম স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
আমি বললাম,
–একদম খালি পেটে বের হয়ো না,অল্প হলেও খেয়ে যাও।
–না আপু।আমার ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।বাহিরে থেকে কিছু খেয়ে নিব ক্লাস শেষ।
–আচ্ছা সাবধানে যাও।
-আচ্ছা আপু।
একটু আগেও যে মেয়েটা অস্বাভাবিক আচরণ করলো এখন সে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলে ক্লাসের জন্য বের হয়ে গেল।আশ্চর্য তো!
তরী যাওয়ার পর দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।এখন পুরো বাসায় আমি একা।একা বাসায় খুব দমবন্ধ লাগে।কাজকর্ম সব সেরে টিভি দেখা,ফেসবুকিং আর গল্পের বই পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না আমার।
যতক্ষণ মেহেরীমা কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে,সময়টা খুব দ্রুতই চলে যায় তার।কিন্তু সারাদিন তো আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকার জো নেই।
২/৩ জনের সংসারে কতই বা আর কাজ থাকতে পারে।তাছাড়া সে সংসারের কাজে বেশ দক্ষ।অল্প সময়েই অনেক কাজ করে গুছিয়ে ফেলতে পারে।
দুপুরের আগে আগেই মেহেরীমা সব কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে গেল।
এই সময়টা তার বেশ উদাস উদাস লাগে।না সকাল,না বিকাল; এমন একটা সময়ে কোনো কিছুতেই মন বসে না তার।
ফোনটা হাতে নিয়ে অনিককে কল দিল একবার।রিং হয়েই কেটে গেল।দ্বিতীয় বার আর কল করলো না।কে জানে হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে।
অনিক কিছুদিন যাবৎ তাকে সময় খুব কম দিচ্ছে।সারাক্ষণ কাজের তাড়ার মধ্যে থাকে।
আগে রোজ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় কপালে একটা করে চুমু খেয়ে তাকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকতো,কই আজ তো চুমু খেল না!মানলাম সে তাড়াহুড়োয় বের হয়ে গেছে তাই বলে তাকে একটু আদর করতে কি খুব বেশি সময় ব্যয় হয়ে যেত?
অভিমানে চোখ ছলছল করে উঠে মেহেরীমার।
আগেও মাঝে মাঝে অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে যেতো অনিক।এমনও হয়েছে অফিস থেকে রাত ১২টা বাজে বাসায় এসে আবার সকালে ঘুম ভেঙেই অফিসে রওনা হতো।
কিন্তু ওর এবারের ব্যস্ততাটা কেন যেনো মেনে নিতে পারছে না মেহেরীমা,কেমন একটা অস্বস্তি, ভিতরে ভিতরে একটা অশান্তি কাজ করছে তার।
মেহেরীমা রুমে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো,তার ভীষণ অস্থির লাগছে।
অস্থিরতা কাটানোর উত্তম উপায় হলো কোনো কিছুতে নিজেকে মগ্ন রাখা।
সে রবীন্দ্রনাথের একটা বই নিয়ে ব্যালকুনিতে চলে আসলো।
ব্যালকনির মেঝেতে সবুজ ঘাসেই ফরাস বিছানো আছে।সেখানে আরাম করে বসে,এক মনে বইটা পড়তে লাগলো।
কলিং বেল বাজছে….
মেহেরীমা বই রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
তরী ক্লাস শেষ করে ফিরে এসেছে।
আমি ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে মৃদু হেসে বললাম,
–তুমি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসো,আমি খাবার রেডি করছি।
–ওকে আপু।
মেহেরীমা ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো।নিজের প্লেটে ভাত বাড়লো সাথে আমার প্লেটেও ভাত দিল।
আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে খেতে বসলাম।
খাওয়ার আগে, অনিককে একটা ফোন দিলাম।
রিং হয়েই যাচ্ছে,ধরছে না।আরও কয়েকবার ট্রাই করলাম,এবারও ধরলো না।
আমি মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলাম,
–“উফফ”
–কাকে কল দাও আপু?
–অনিককে।
অনিকের নামটা শুনতেই তরীর চোখ কেমন ঝিলিক দিয়ে উঠলো,আমার চোখে তা এড়ালো না।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো মুখে বললো,
–ধরছে না?
–না।
তরী গলায় খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো,
–আমি একবার আমার ফোন দিয়ে ট্রাই করে দেখবো আপু?
–মানে কি?আমার ফোন ধরছে না তো তোমার ফোন ধরবে কীভাবে?
ফোনের কাছে থাকলে তো অবশ্যই কল রিসিভ করতো।এখন হয়তো ব্যস্ত আছে।
তরী একবার ঢোক গিলে গলাটা প্রায় খাঁদে নামিয়ে বললো,
— হ্যাঁ তাইতো।ফোনের কাছে থাকলে তো তোমার কলই দ ধরতো।আমি যে কি বোকা!
আর কথা না বলে চুপচাপ দু’জন খেতে লাগলাম।হঠাৎ কি মনে হলো,মেহেরীমা খাওয়া বন্ধ করে বলে উঠলো,
–তরী,তোমার ফোনটা দাও তো।
–তরী একটু ইতস্তত করে ফোনটা মেহেরীমার হাতে দিয়ে দিল।
মেহেরীমা অনিকের নাম্বারে ডায়াল করলো।একবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ করলো অনিক।
আমার বুকের কোথাও যেনো একটা খোঁচা মেরে উঠলো।
–হ্যালো তরী।
একটু আগেই তো আমি কল দিলাম,রিসিভ তো কেউ করলো না!
“তরীর কল রিসিভ করা,ওর মুখে তরীর নামটা শোনা” আমার বুকের ভিতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে।আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বললাম,
–আমি মেহেরীমা।
মনে হলো তরীর ফোনে আমার কন্ঠ আশা করেনি অনিক।সে কিছুটা থমকে গিয়ে আবার পরক্ষণেই হেসে বললো,
–অহ্ মেহেরীমা! আমি মাত্রই তোমাকে কল ব্যাক করার জন্য ফোনটা হাতে নিলাম।আর তখনি তরীর ফোন!
আমি যথা সম্ভব শান্ত স্বরে বললাম,
–হুম বুঝতে পেরেছি।কোথায় ছিলে?অনেকবার ফোন দিলাম।
–একটা জরুরী কাজে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল সোনা।ফোনটা ভুলে ডেস্কে ফেলে রেখে গিয়েছি।
কেন ফোন করেছিলে?
প্রশ্নটা করেই আবার মৃদু হেসে বললো,
আমি খেয়েছি কিনা জানতে,তাইনা?
–হুম।
–হ্যাঁ লক্ষ্মীটি।খেয়েই এই মাত্র অফিসে আসলাম।তুমি খেয়েছ তো?
— হ্যাঁ খাচ্ছি।
আরও দুয়েকটা কথা বলে ফোন কেটে দেয় মেহেরীমা।তরী এতক্ষণ নীরবে খাচ্ছিল আর ওদের কথা শুনছিল।
ফোনটা তরীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় মেহেরীমার মনে হলো তরী একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে!আসলেই কি হাসছে!নাকি আমি ভুল দেখলাম!
আমি খাবারের দিকে মনোযোগ দিলাম। ভাত শুধু মাখিয়েই যাচ্ছি, মাখিয়েই যাচ্ছি।ভাতের লোকমা আর মুখে উঠছে না।
এদিকে তরী খাওয়া শেষ করে তার রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল।
যখন বুঝলাম আমার আর খাওয়া হবে না,ক্ষুধা মিটে গেছে।তখন আর বৃথা চেষ্টা না করে সব গুছিয়ে রেখে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম,অনিক আমার ফোন ধরলো না কিন্তু তরীর ফোন ধরলো!ও তো জানতো আমি প্রতিদিন দুপুরে খাবারের সময়ে ওকে ফোন দেই।গত ৪ বছরে এই নিয়মের কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনে পড়লো না।তবুও কেন ফোন কাছে রাখলো না!
ও বলেছে,ও ব্যস্ত ছিল।আসলেই কি তাই?নাকি আমার ফোন ধরতে এখন আর ওর ভালো লাগে না?অনীহা চলে এসে আমার সাথে কথা বলতে?অনিক কি বদলে যাচ্ছে!
আবার এমনও তো হতে পারে যে অনিক হয়তো ঠিকই বলছে।ও হয়তো আসলেই মনের ভুলে ফোন রেখে চলে গেছিল।কাকতালীয় ভাবে ফোন হাতে নেওয়া মাত্রই তরীর ফোন এসেছে, তাই ও রিসিভ করেছে।
নাহ্,এটা নিয়ে আর ভাববো না।আর ভাবতে পারছি না।
কিন্তু ভাববো না,বললেই কি আর ভাবনারা থেমে থাকে?আবারও নানারকম হিবিজিবি ভাবনারা এসে মেহেরীমার মাথায় ভর করতে থাকে।
আচ্ছা তরী কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী?আমি কি আমার ভালোবাসায় কোথাও ঘাটতি রেখেছি?
আমি পুরাতন হয়ে যাইনি তো অনিকের কাছে!
উফফ তরী!তরী!তরী!আর নিতে পারছি না।
১ মাসের কিছু বেশি সময় হবে তরী আমাদের বাসায় এসেছে।প্রথম ১৫/২০ দিন খুব ভালোই কেটেছে আমাদের জীবন।
এতোদিন তেমন কিছু খেয়াল না করলেও,আজকাল তরীর মধ্যে কিছু সুক্ষ্ম পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি।
যেমন,অনিক যখন বাসায় না থাকে তখন ও বেশিরভাগ সময়েই ওর রুমে থাকে।কিন্তু যখনই অনিক বাসায় আসে ও ড্রয়িংরুমে টিভির সামনে বসে থাকে কিংবা সামনে বই নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ে।ও আসার সময় হলেই কেমন পরিপাটি হয়ে থাকে,যেকোনো উছিলায় অনিকের সাথে অনর্থক হেসে হেসে কথা বলতে থাকে।হাসি যেনো মুখ থেকে সরেই না।
আর আজকে সকালের ঘটনাটা আমি তো ভুলতেই পারছি না।
আমাকে আর অনিককে একসাথে দেখে ওর মুখে যে অনুভূতিটা আমি ফুটে উঠতে দেখলাম সেটা আমাকে বারবার ওর ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করছে।
স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে হঠাৎ ওর অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন যেখানে ওকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার কথা,সেখানে ওর মুখে স্পষ্টতঃই ফোটে উঠেছিল রাগ আর বিষাদের সংমিশ্রণ!
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঠিক সন্ধ্যার কিছু আগ মুহুর্তেই মেহেরীমা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
———-
রাত-৮ঃ১৫
২ বার কলিং বেল বাজলো…
মেহেরীমা এখনো ঘুমে।
তরী এসে দরজার কী হোলে চোখ রেখে দেখলো,ঐপাশে অনিক দাঁড়িয়ে আছে।
সে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসলো,দ্রুত ঠোঁটে একটা হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক ঘষলো,চুলে চিরুনি চালালো।
এর মধ্যেই আরো বার দুয়েক কলিং বেল বাজলো।
তরী ঝটপট ফ্ল্যাটের দরজার কাছে যেতে যেতে আরেকবার মেহেরীমার রুমের দিকে চোখ বুলালো…নাহ্, মেহেরীমা এখনো জাগেনি।সে তখনো গভীর ঘুমেই আছে।
তরী দরজা খোলে দিল…..
#চলবে…
[গল্প শুরু যেহেতু করেছি নেক্সট পার্ট তো দিবই।😇
তাই নেক্সট না লিখে যদি গল্প সম্পর্কে ২/১ লাইন(মতামত,পরামর্শ বা উপদেশ) লিখেন। তাহলে পরবর্তী পর্ব লিখতে উৎসাহ জাগে।😊]