আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১২

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_১২

আশফাকের ঘুম ভাঙলো অনেক বেলাতে। চোখ মেলে দিনের কড়কড়ে হলুদ আলো শরীরে লাগতেই তার দিনক্ষন সব গুলিয়ে গেল। চোখটা আবার বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা সময় ধাতস্থ করার পর আশফাকের গতকাল রাতের কথা সব মনে পড়ল। গতকাল হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য আশফাক বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়ে গেল কেন? তবে কয়েক মুহুর্ত পর দীপা যখন বলছিল, অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সময় তার কেন একবারও দীপার কথা মনে পড়লো না তখন আশফাক বুঝতে পেরেছিল, দীপা কোনোভাবে রুহীর ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে এবং এরপররেই সে সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছিল।

অনেকটা প্রতিরক্ষার ভঙ্গিতে সে দীপাকে বলেছিল, তুমি রুহীকে চিনলে কী করে? আর তুমি ভুল ভাবছ দীপা। রুহী শুধু আমার ছাত্রী। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

কথাগুলো বলার পর আশফাক করুণ চোখে দীপার দিকে তাকিয়েছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে যে কোনো পুরুষই নিজ স্ত্রীর করুণা ভিক্ষা চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দীপার পরের কথাটায় আশফাক বুঝতে পেরেছিল, বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সে বোকার মত দীপার ফাঁদে পা দিয়েছে। দীপা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতই আশফাককে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু সে নিজেই রুহীর প্রসঙ্গ তুলে দীপার কাছে সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে।

দীপা রাগে অন্ধ হয়ে বলেছিল, এর মানে আমি এতক্ষন যা বলেছি তা-ই ঠিক? তোমার জীবনে আসলেই কোনো মেয়ে রয়েছে? আর সেই মেয়েটির নাম রুহী? সে তোমার ছাত্রী?

স্বাভাবিক ভাবেই আশফাক চুপ করেছিল। একবার কোনো কথা বলে ফেললে সেটা আর ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। তবুও সে তার ভুলটা শুধরে নেয়ার একটা শেষ চেষ্টা করেছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেছিল, আরে না না। আমি তো বললাম তুমি ভুল ভাবছো। রুহী কেন কোনো মেয়ের সাথেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

দীপা বলেছিল, তাহলে তুমি রুহীর কথা কেন বললে?

আশফাক সেই মুহুর্তে দীপার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দীপা কয়েকটা মুহুর্ত আশফকের জবাবের অপেক্ষা করেছিল। তারপর আশফাকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটু বাঁকা হেসে বলেছিল, তোমার জবাবের আমার প্রয়োজন নেই আশফাক। খুব ভালো মতই বুঝতে পারছি, আমি নিছক কোনো সন্দেহ করিনি। তুমি এখন যায়-ই বলো না কেন আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করছি না। একটা কথা খুব ভালো মত জেনে রেখো আশফাক, ভালোবাসা হয়ত ফিরে পাওয়া যায় তবে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

আশফাক কাতর গলায় বলেছিল, দীপা প্লিজ। একটু শান্ত হও। এভাবে মাথা গরম করো না।

দীপা কঠিন গলায় বলেছিল, আমার মাথা ঠিক আছে আশফাক। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোমার আর তোমার ছাত্রীর মাথা ঠিক আছে তো? বিশেষ করে তোমাদের শরীর ঠিক আছে তো? নাকি ইতিমধ্যেই গরম শরীরগুলো তোমরা ঠান্ডা করে ফেলেছ?

আশফাক চুপ করেছিল। সত্যি বলতে কী আশফাক সেই মুহুর্তে দীপাকে রীতিমত ভয় পাচ্ছিল।

আশফাকের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে দীপা বলেছিল, থাক তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি সত্যটা জানতে চাচ্ছি না। কিছু সত্য না জানাটায় হয়ত আমাদের দুজনের পক্ষে ভালো হবে।

তারপর আর কথা থাকে না। কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অবাক হলেও সত্য, এরপর থেকে দীপা তার সাথে ভীষণ শীতল আচরণ করছিল। অন্য সময় সামান্য একটু মান অভিমান হলেই দীপা তাদের বিছানা আলাদা করে দেয় অথচ কাল রাতে দীপা দিব্যি তার পাশে শুয়েছিল। দীপার থেকে মাত্র কিছু দুরত্বে শুয়ে আশফাক দীপার ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। আশফাক কয়েকবার দীপাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল তবে লাভ হয়নি। তাতে দীপার কান্নার গতি এতটুকু কমেনি। অনেক রাত অবধি আশফাক নিজেও ঘুমাতে পারেনি। বিছানার এপাশ ওপাশ করেই রাত পার হয়ে গিয়েছিল। আশফাকের স্পষ্ট মনে আছে ফজরের আজান পর্যন্ত সে জেগে ছিল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। সারা রাত জাগরনের ক্লান্তিতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল।

আশফাক ঘড়িতে দেখল দুপুর বারোটা বাজে। ভাগ্য ভালো আজ সকালে তার কোনো ক্লাস ছিল না। তবুও ক্লাস রুটিনটা আরেকবার চেক করার জন্য সে মোবাইলটা এদিক ওদিক খুঁজল। তার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল রাতে শোবার সময় মোবাইলটা সে বালিশের পাশে রেখেছিল। তবে মোবাইল গেল কোথায়? মোবাইলটা কী দীপা সরিয়েছে? আশফাক ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। মোবাইলটা যদি দীপা সরিয়েও থাকে তাহলেও কোনো লাভ হবে না। মোবাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা রয়েছে। এই পাসওয়ার্ড বের করার সাধ্য দীপার নেই।

আশফাক পুরো বাড়িতে দীপাকে খুঁজলো। দীপা কোথাও নেই। ল্যান্ডফোন দিয়ে সে দীপাকে ফোন করল। কয়েকবার রিং বেজে যাবার পরেও দীপা ফোন ধরল না। আশফাক দীপার বাবার বাড়িতে একটা ফোন করল। দীপা সেখানেও যায়নি। আশফাক বেশ অবাক হলো। রাগ করে সে বাবার বাড়িতে যেতে পারত। এটা দীপার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। এর আগে অসংখ্যবার এমন ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া এখন সেখানে বাবু রয়েছে। তবুও দীপা আজ বাবার বাড়িতে না যেয়ে অন্য কোথাও গিয়েছে। আশফাক দীপার যাওয়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলো নিয়ে চিন্তা করলো। দীপার ছোটবেলার এক বান্ধবীর বাসা আছে মিরপুরে। আশফাক সেখানে ফোন করল। দীপা সেখানেও নেই। আরো কয়েকজন কাছের বন্ধুবান্ধবকে ফোন করার পর আশফাক বেশ চিন্তায় পড়লো। দীপা আর কোথায় যেতে পারে এই সম্পর্কে তার ধারনা নেই। হঠাৎ করে আশফাকের মাথায় একটা ভাবনার উদয় হলো। দীপা তার ক্যাম্পাসে যায়নি তো? কাল যেহেতু আশফাকের কাছে সে রুহী সম্পর্কে ধারনা পেয়েছে তাই দীপা হয়ত রুহীর সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত গিয়েছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আশফাক ভেতরে ভেতরে তীব্র আতঙ্কে জমে গেল। একমাত্র আল্লাহ জানেন দীপা এতক্ষণে ক্যাম্পাসে যেয়ে কী ঝামেলাটা বাধিয়েছে!

দীপা তার ক্যাম্পাসে যেতে পারে এই বিষয়টা তার আরো আগে ভাবা উচিৎ ছিল। আশফাক আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। সারে বারোটা বাজে। দীপাকে খুঁজতে তার অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। আশফাক আরেকবার ল্যান্ডফোন থেকে দীপাকে ফোন করল। মোবাইলে একটানা রিং বেজে গেলে। দীপা ফোন ধরল না। এদিকে রুহীর মোবাইল নাম্বার তার মুখস্থ নেই। এই যুগে কেউ কারো মোবাইল নাম্বার মুখস্থ করে রাখে না। মোবাইলে নাম্বার সেভ করে রাখে। তাই রুহীকে ফোন করে কিছু জানানোর সুযোগটুকুও আশফাক পেলো না।

আশফাক বেশ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। এই মুহুর্তে তার মাথা কাজ করছে না। আজ দুপুর দুইটার পর তার তিনটা ক্লাস আছে। ক্লাসগুলো জরুরী। না নিলেই নয়। হালকা কিছু খেয়ে আশফাক ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

…………

দীপা চলে গেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। রুহী একই ভাবে ক্যান্টিনে বসে রয়েছে। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। অথচ পানি খাবার মত ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটায় তার নেই। সুমি অনবরত ফোন করছে। একটু পর ক্লাস আছে। ক্লাসটা সম্ভবত আশফাক স্যারের। এই মুহুর্তে আশফাক স্যারের মুখোমুখি হবার সাহস তার নেই। দীপার বলা কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে। দীপার গলায় যতই কাঠিন্য থাকুক না কেন তার চোখে একটা হাহাকার মেশানো যন্ত্রনা ছিল। এই হাহাকারটুকু রুহীর ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের সামান্য কিছু ভালোলাগার অনুভুতির জন্য সে আজ একটা মেয়ের জীবন নিজের অজান্তেই নষ্ট করে দিয়েছে। যদি সত্যি সত্যি আশফাক আর দীপার সম্পর্কটা ভেঙে যায় তাহলে দীপা আর তাদের বাচ্চাটার কী হবে? আর এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে কি পারবে আশফাকের সাথে সুখি হতে? কিংবা আশফাক কি সত্যি তাকে মন থেকে মেনে নিবে? নাকি দীপা ছেড়ে গেছে বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে? তাছাড়া বাবা মা! তারা যখন এতকিছু জানবেন তখন কী হবে? তারা কি এত কিছু জানার পরও তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করবেন? রুহী আর কিছুই ভাবতে পারলো না। দিপা তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। সেই প্রশ্নের উত্তর সে তখন দিতে পারেনি। এখন সেই প্রশ্নটা নিজেকে নিজেই একবার করলো। সে কি আসলেই আশফাককে ভুলে থাকতে পারবে? আশফাকের সাথে চিরদিনের মত যোগাযোগ বন্ধ করে সজলের সাথে সংসার করা তার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব হবে? রুহীকে বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। তার সামনে উত্তরটা আপনাআপনি চলে এলো। রুহী অবাক হয়ে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক।

“চলবে”

আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here