আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১৭

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৭

আফিমের বুকে মাথা গুঁজে শক্ত করে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নাফিয়া।নিরবে তার কয়েক ফোঁটা অশ্রু কণা সমাধিত হলো আফিমের বুকে।একটুখানি ভিজলো ছেলেটার শার্টের কিছু অংশ।
নাফিয়ার অশ্রু কণাগুলো আফিমের ভেরতের পীড়া, ক্রোধানুভূতি ক্রমশ বাড়িয়ে চলছে।নিজের মায়াবীনিকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে আফিম।চোখ বুঁজে জোরে জোরে ক’বার নিশ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।নির্ঘাত সেদিন লোকটার হাতের সাথে সাথে জান টাও নিয়ে নিতো আফিম।কিন্তু ভাবলো তার মায়াবীনি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ঐ লোকটার দেওয়া বাজে স্মৃতির বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।তাহলে লোকটা কেনো একেবারে মৃত্যু অর্থাৎ মুক্তি পাবে এতো সহজে।সেজন্যে লোকটার জান না নিয়ে তার হাতজোড়াকে কেটে দিয়েছে আফিম।তাও নিজের হাতে।যাতে করে লোকটা যতদিন বাঁচবে ততদিন যেনো নিশ্বাস নেওয়াটাও বিষাক্ত লাগতে থাকে তার।
হাত কাটবার সময়ে লোকটার করা আর্তনাদ, আকুতি-মিনতি,ব্যথায় গগনবিদারী চিৎকার সবটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আফিমের।মুহূর্তেই রাগের মাত্রা কিছুটা কমলো তার।এই স্মৃতি হৃদয়ে মৃদু প্রশান্তিও এনে দিলো আফিমের।রাগের মাত্রা কিছুটা কমে আসায় নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আফিম।নাফিয়ার কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে সে বলে ওঠে,
-কাঁদে না মিস.শেখ।You are a strong girl,right?
আফিমের কথায় একটু নড়েচড়ে ওঠে নাফিয়া।আফিমের বুকে নাক ঘষে চোখের পানি,নাকের পানি এক করে ছেলেটার শার্টের বুকের অংশটুকু পুরোটা ভিজিয়ে দিয়েছে সে।সফলভাবে শার্টখানা ভিজাবার পর আফিমের বুক হতে মাথা তুলে ছেলেটার চোখে চোখ রাখে নাফিয়া।ভিজে চোখে তাকিয়ে রয় নিজের মনের চিলেকোঠায় যত্নে পুষে রাখা সকল অনুভূতির অধিকারী পুরুষটির দিকে।যে পুরুষের চোখে ভরসা খুঁজে পায় সে,খুঁজে পায় নিজের নিরাপত্তা।
মায়াবীনির মায়াভরা চোখে অশ্রু বড্ড বেমানান।তাই তো সহ্য করতে পারে না আফিম।নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে দেয় তার প্রেয়সীর চোখের পানি যেনো মুছে দিচ্ছে সকল কষ্টেভরা স্মৃতি।মুগ্ধতায় ভরে ওঠে নাফিয়ার মন।এতো যত্নে এই প্রথম তার মাম্মি ব্যাতীত অন্য কেউ তার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। ঠোঁটে প্রশান্তির মৃদু হাসি ফুটে ওঠে নাফিয়ার।সে কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমার পুরোটা অতীত আজ আপনাকে জানাতে চাই আফিম।একটু শুনুন?
উত্তরে আফিম শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-উহু আর না।অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয় না মিস.শেখ।যে স্মৃতি আমাদের কষ্ট দেয় তা মনে করাটা বোকামি মাত্র।কারণ ছোট একটা জীবনে সুখ না কুড়িয়ে দুঃখবিলাস করাটা চরম রকমের সময়ের অপচয়।
-Totally agree with you my boss.[আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত]
ঠোঁটে হাসি টেনে কথাটা বলে নাফিয়া।আফিমও নিজের ঠোঁটে হাসি টেনে ডান হাত দ্বারা আলতো করে নাফিয়ার নাক টেনে দেয়।আফিম হাত সরাতেই নাফিয়া মন খারাপের স্বরে ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-কিন্তু আফিম,আমার তো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।না বললে আমার পেট ব্যথা করবে।
মেয়েটার এমন কথায় হাসি পায় আফিমের।প্রতিবার মনে মনে ভীষণ রকমের মুগ্ধ হয় আফিম নাফিয়ার এসব বাচ্চামিগুলোতে।এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।কিন্তু সেই বাজে স্মৃতি সমন্ধে আবারও শুনতে হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় তার।কিন্তু তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেয়সীর মন রাখতে সম্মতি দিতে বাধ্য হয় সে।বলে ওঠে,
-ঠিক আছে,বলো।
আফিমের সম্মতি পেয়ে ঠোঁটে একটু হাসি টানে নাফিয়া।নিজের সম্পূর্ণ জীবনটা তুলে ধরতে চায় সে এ মানুষটার সামনে।চায়,আফিম যেনো সবটা জেনে তাকে নিজের হৃদয়ে একটুখানি ঠাঁই দেয়।তাই তো মন খুলে সব বলতে চায় আজ সে।আফিমের জায়গায় অন্য কেউ হলে এভাবে নিজের জঘন্য অতীত এতো সহজে বলতে পারতো না নাফিয়া।কিন্তু ছেলেটাকে সে যতটা চিনেছে,জেনেছে,বুঝেছে তাতে সে এতোটুকু জানে যে আফিম বিশ্বাস ও ভরসার যোগ্য একজন ব্যাক্তি।সে আর যাই হোক, নাফিয়ার অতীত দিয়ে নাফিয়াকে বিচার করবে না বা অতীত সমন্ধে জেনে নাফিয়াকে ছোট চোখে দেখবে না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ঠোঁটে টেনে রেখে আফিমের বাম হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে নাফিয়া বলে ওঠে,
-হাঁটতে হাঁটতে বলি?
নাফিয়ার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইশারায় সম্মতি দেয় আফিম।আফিমের বাম হাতের মুঠোয় থাকা নিজের ডান হাতটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাফিয়া।মুহূর্তেই ঠোঁটে আলতো হাসি এসে জায়গা করে নেয় তার।মনে ভরসা বৃদ্ধি পায়।ভরসা পায়,এই মানুষটা আগলে রাখবে তাকে অতি যত্নে।ছাড়বে না হাত,ছুটবে না এই হাতের বাঁধন।
অতঃপর চোখ বুঁজে জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় নাফিয়া।ক’সেকেন্ড সময় নিয়েই বলতে আরম্ভ করে,
-তখন সবে আমার ১২ বছর বয়স।শৈশব থেকে ধীরে ধীরে কৈশোরে পদার্পণ করছিলাম।আসছিলো শারীরিক পরিবর্তন।কখন যে লোকটার বাজে দৃষ্টি পড়লো আমার উপর বুঝতেই পারিনি।যেদিন বুঝতে পারি সেদিনটি ছিলো আমার জীবনের অন্যতম জঘন্য দিন।
মাঝে মাঝে আমাকে ঘুম পড়াতে গিয়ে মাম্মি নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন।তো সেদিন রাতেও মাম্মি আমাকে ঘুম পড়াতে গিয়ে আমার সাথে আমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।কিন্তু ঘুম না আসায় আমি সজাগই ছিলাম।সজাগ থাকায় হুট করে খিদেও পেয়েছিলো।মাম্মিকে ডেকে যে খাবারের কথা বলবো তাতেও মন সায় দিলো না।মানুষটা এমনিও সারাটা দিন সংসারের কাজে খাটা-খাটুনি করেন।তাই তার প্রশান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে হলো না। নিজে নিজেই গেলাম রান্নাঘরে খাবারের সন্ধানে।রান্নাঘরে দুধ জ্বাল করা ছিলো আর কৌটোতে ছিলো বিস্কুট।ব্যাস কাপ,প্রিজে সেসব নিচ্ছিলাম। এমন সময় হটাৎ খালু এসে আমার বাহু চেপে ধরেন।চমকে তার দিকে তাকাতেই আমাকে বলে ওঠেন,
“কিরে নুফি,কি করছিস?”
লোকটাকে এমনিও পছন্দ ছিলো না আমার।তাই তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলেছিলাম,
“হাত ছাড়ুন খালু,ব্যথা লাগছে।”
উত্তরে লোকটা বলে উঠলেন,
“আহারে!আয় আদর করে দিচ্ছি।”বলেই লোকটা বাজে ভাবে শরীর স্পর্শ করতে আরম্ভ করেছিলো।সাথে সাথে চিৎকার করে উঠেছিলাম।লোকটা দ্রুত মুখ চেপে ধরেছিলো আমার।জোর করে তার রুমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।আর আমি তার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম।হুট করে দরজার দিকে চোখ যায় আমার,দেখি মাম্মি রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন।সে যেনো নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।লোকটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত থাকায় তিনি মাম্মির উপস্থিতি টের পাননি।কিন্তু আমি দেখেছিলাম মাম্মিকে।ক্রোধনরত অবস্থায় তাকিয়ে ছিলাম মাম্মির দিকে।লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো দেখে শব্দ করতে পারিনি।কিন্তু মনে মনে চলছিলো হাজারো আকুতি-মিনতি।আমার চোখ দুটো সাহায্য ভিক্ষে চাচ্ছিলো।বয়স কম হবার পরও খালুর নিয়ত খারাপ তা বুঝেছিলাম আমি।তাই তো নিজেকে খালুর হাত থেকে ছুটানোর জন্য ছটফট করছিলাম আর সাহায্যের আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম মাম্মির দিকে।এর ক’সেকেন্ডের মাঝেই মাম্মির চেহারাই যেনো বদলে গিয়েছিলো।চোখমুখে ক্রোধের অগ্নি ধাউ ধাউ করে যেনো জ্বলে উঠেছিলো।সে এক রণচণ্ডী রূপ!স্ত্রী হিসেবে মাম্মি সবসময় অবলা নারীর রূপ ধারণ করে থাকলেও সেদিনের ক্ষিপ্ত মা ছিলো ভয়ংকর ক্রোধান্বিত এক ধ্বংসাত্মক নারী।দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে ছুরি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।কোনো কিছু না ভেবেই সে আঘাত করে খালুর হাতে।এসব এতো দ্রুত হয় যে খালু কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা বুঝে উঠতে পারছিলো না।তাকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর নূন্যতম সময় না দিয়ে আবারও আঘাত করতে আরম্ভ করেছিলো মাম্মি।এক আঘাতে যেনো মাম্মির ক্রোধ এক বিন্দুও কমেনি।তাই তিনি বারংবার এলোপাতাড়ি আঘাত করে চলছিলেন খালুকে।প্রথমবারের জন্য খালুর চোখে মাম্মির প্রতি ভয় জন্মাতে দেখেছিলাম সেদিন।ভীত চোখে তাকাচ্ছিলেন তিনি মাম্মির দিকে এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন,মাম্মিকে থামানোর চেষ্টাও করেন তিনি।কিন্তু মাম্মিকে সেদিন থামানো যাচ্ছিলো না।ছুরি দ্বারা বার বার আঘাত করায় খালুর হাত, বুক,গালসহ আরো অনেক জায়গায় কেটে যায়।রান্নাঘরের ফ্লোর রক্তে ভরে ওঠে।এতো ছোট বয়সে একদিনে এতো কিছু নিতে পারিনি আমি।এমন রক্ত দেখেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
কথাগুলো বলে থামে নাফিয়া।আফিমের দিকে তাকায় সে।ছেলেটার চোখমুখ স্বাভাবিক নয়।কেমন এক ভয়ংকর রাগ ফুটে উঠেছে ছেলেটার মুখশ্রীতে।নিরবে নিজের রাগ দমিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত ছেলেটা।নাফিয়া তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমাকে কি আপনার অপবিত্র মনে হচ্ছে আফিম?ঐ লোকটার বাজে স্পর্শে অপবিত্র হয়েছি আমি?
নাফিয়ার করা প্রশ্নদ্বয় কানে আসতেই কান গরম হয়ে গেলো আফিমের।মুহূর্তেই ক্রোধের পরিমাণ সীমা অতিক্রম করে ফেললো তার।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভয়ংকর ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো তোর।সাহস কি করে হলো নিজেকে অপবিত্র বলার?

চলবে।

[সুন্দর মন্তব্য করার অনুরোধ রইলো।লেখায় ভুল থাকলে অবশ্যই বলবেন প্রিয় পাঠক মহল❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here