আমার আকাশে মেঘ জমেছে পর্ব ৬

আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৬
.
আমার পরবর্তী দিনগুলো কাটছিল বিমর্ষ। আব্বা আম্মার কমতি টের পাচ্ছিলাম রীতিমতো। রোবট হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হতো চাপের মাঝে থাকলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভুল ছিলাম। অতিরিক্ত চাপে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। মনি মা’র হাজার বারণ আমি শুনিনি।
-” অতিথি তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস। আমি কী মরে গেছি নাকি? আমি আছি তো তোর জন্য। এভাবে নিজের অযত্ন করে কী লাভ হবে। নিজের আব্বা আম্মার কথা ভাব।”
আব্বা-আম্মার কথা ভাবলে আমি আরও কষ্ট পেতাম। বুকে ভারী চাপ অনুভূত হতো।
মনি মা তাই বাধ্য হয়েই প্রহর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেন।
প্রহর ভাই আগে সপ্তাহে দুই তিনদিন ফোন দিতেন। কিন্তু এরপর প্রায় প্রতিদিনই ফোন দিয়ে কথা বলতে লাগলেন আমার সাথে। তিনি আমাকে বুঝাতেন জীবন পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত মানুষদের জীবনী শোনাতেন ; যারা প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিজেদের লক্ষ্য হারায়নি।
ডাক্তার হওয়া আমার স্বপ্ন ছিলনা কখনো। এটা ছিল আমার আব্বার স্বপ্ন। আমি আব্বার স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য উঠে পরে লাগলাম। বেঁচে থাকতে তো কিছুই করতে পারিনি। আমার চিন্তায় আব্বা কত রাত ঘুমাতে পারতেন না ভাবতেই কষ্টের কান্না দলা পাকিয়ে উঠত। অনেক সময় ক্লাস করতে যেয়ে চোখে ঝাপসা দেখতাম। আমাদের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাতেমা সিদ্দিকা ম্যাডাম একদিন আমাকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠালেন।
-” অতিথি তুমি খুব ব্রাইট একটি মেয়ে। আমি আমার ক্যারিয়ারে কখনো কাউকে এতো পরিশ্রম করতে দেখিনি। তোমার পরিশ্রম ফল দিবে। বাট আই থিংক দিস ইজ নট গুড ফর ইউর হেলথ। তুমি কী আমার পাশের চেয়ারটায় এসে বসতে পারবে?”
ম্যাডাম সেদিন স্ফিগমোম্যানোমিটারে আমার প্রেশার মেপে আৎকে উঠেছিলেন।
-” এই মেয়ে তুমি কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করো বলো তো আমাকে? তুমি কী জানো তোমার অবস্থা কতটা খারাপ? কয়দিন ধরে ঘুমাও না?”
প্রতি উত্তরে আমি শুধু হেসেছিলাম। ঘুম আমার হয়না অনেকদিন ধরেই। রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। ঘুম যাতে না আসে তাই কড়া করে কফি খেতাম। ডাক্তার হতেই হবে কথাটা আমার নিউরনে গেঁথে গিয়েছিল।
ম্যাডাম সেদিন হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করে আমার সাথে খোলামেলা আলোচনা করেন। আব্বা -আম্মার মৃত্যুর খবর শুনে তিনি কষ্ট পান।
-” দেখো অতিথি, আমি বলবো না তুমি এই নিয়ে কষ্ট পেয়ো না। এটা বলা অন্যায় হবে। তবে আমরা মানুষেরা সামান্য কিছুদিনের জন্য পৃথিবীতে আসি। জন্ম নিলে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। তোমার রক্তচাপ ১৬০/১১০। অর্থাৎ তুমি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে ভুগছ। অতিথি, তুমি বললে ডাক্তার হওয়া তোমার বাবার স্বপ্ন। তুমি সুস্থ না থাকলে তোমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে কী করে? আমি বলবো তুমি নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাও। ক্যাফেইন জাতীয় খাবার এভয়েড করো। সুষম খাবার খাও, বাইরে শান্ত খোলা পরিবেশে হাঁটা চলা করো। তোমার এই মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতার জন্য স্ট্রোক, অ্যানজাইমা, দৃষ্টিক্ষীণতা, প্যাপিলিওডিমা, অন্ধত্ব, প্যারালাইসিস, হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিউর পর্যন্ত হতে পারে। বি সিরিয়াস অতিথি। তুমি একজন ফিউচার ডাক্তার। তোমার হাতে অনেক রোগী প্রাণ ফিরে পাবে। নিজের জীবনের গুরুত্ব বুঝতে শেখো।”
.
ম্যাডামের সেদিনের কথাগুলো আমি মন দিয়ে শুনেছিলাম। ভাবছিলাম কী করছি আমি এসব? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, ঘাড়ে ব্যাথা, ঝাপসা দৃষ্টি। একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়েও আমি সিনটমস গুলো বুঝতে পারিনি।
নিজের যত্ন নিতে লাগলাম আগের মতো।
.
মনি মা’র সাথে কথা বলে ঠিক করলাম গ্রামে হাসপাতাল বানাবো। কিন্তু সেখানে গিয়ে এক ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। গ্রামে নতুন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মতি কাকা। উনি আব্বার খুবই বিশ্বস্ত একজন লোক ছিলেন। ছোটবেলায় এই মানুষটির কাঁধে চেপে আমি স্কুল যেতাম।
আশ্চর্য হয়েছিলাম, মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে নির্বাচন হয়ে গেল কীভাবে? অবাকের পালা শেষ হয়নি তখনও। আব্বার সব জমি মতি কাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন। দলিলের সব জায়গায় মতি কাকার নাম। আব্বা নাকি কাকার নামে সব দিয়ে গেছেন। হাসপাতালের জন্য রেখে যাওয়া জায়গা ছিল আমার একমাত্র ভরসা। ইচ্ছা ছিল আব্বার বাদ বাকী জমি বিক্রি করে হাসপাতালের জন্য রেখে যাওয়া জায়গায় ইটের গাঁথুনি দিব। কিন্তু মতি কাকা জানায় উক্ত জমিও আব্বা কার নামে জানি হেবা (মৌখিক দান) করে দিয়ে গেছেন। রাগ উঠেছিল খুব। বিশ্বাসঘাতক কাকে বলে চিনেছিলাম সেদিন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিছু বাক্য রয়েছে,
“যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কত আপনজন পর হয়ে যাবে, কত বিশ্বাসী ভেঙে দেবে বিশ্বাস,
কত স্নেহের ধন ধরবে রুদ্রমূর্তি,
কত চেনা হয়ে যাবে অচেনা..”
.
শূণ্য হাতে গ্রাম থেকে ফিরি। মনি মা আমাকে প্রতিশ্রুতি দেন আব্বার নামে হাসপাতাল করতে উনি আমাকে সাহায্য করবেন।
কষ্ট হচ্ছিল আব্বার ইচ্ছা পূরণ করতে পারছিলাম না বলে।
তবে আমার কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট দেখেছিলাম হাসপাতালে এমার্জেন্সি বিভাগে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত রোগীদের দরিদ্র আত্মীয়দের দেখে। চোখে পানি চলে আসত বার্ণ ইউনিটের দগ্ধ রোগীদের আহাজারিতে।
মর্গে যখন চোখের সামনে জীবনের প্রথম পোষ্টমর্টেম দেখি তখন রীতিমতো আমার হাত পা কাঁপছিল। আত্মহত্যা কেস ছিল সেটি। ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহনন। নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। আমাদের ৩০ জনের গ্রুপের সাথে ছিলেন ডা. এময়াদুল হক স্যার। তিনি আমাকে বলেছিলেন,
-” মিস অতিথি শক্ত হতে শিখুন। আমাদের কাজই এটা।”
আমি শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কাজের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ নয়।
.
প্রহর ভাই যেইদিন দেশে ফিরেন আমি সেদিন বাসায় ছিলাম না। জানতাম প্রহর ভাই আসবে। কিন্তু ক্লাস সবার আগে।
বাসায় ফিরে নিজের ঘরে যেয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকি। ভেবেছিলাম একেবারে ফ্রেশ হয়ে উনার সাথে দেখা করতে যাব। কিন্তু বের হয়ে আমার খাটে প্রহর ভাইকে শুয়ে থাকতে দেখি। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। উনিই কথা বলা শুরু করেন।
-” কেমন আছো অতিথি?”
-” ভালো।”
আমার পা থেকে মাথা অবধি দেখে উনি বলেছিলেন,
-” তুমি বদলে গেছ। গ্রামের সেই চঞ্চল মেয়েটির সাথে তোমার কোন মিল পাচ্ছি না।”
-” সময়ের সাথে সবাইকে পাল্টাতে হয় ভাইয়া।”
-” আমি গত তিনমাস ধরে ফোন করে তোমাকে পাইনি। যখনই ফোন দিয়েছি শুনতে পেয়েছি তুমি ঘুমাচ্ছ নয়ত পড়ছো।”
উনি হাত দিয়ে আমার থুতনি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-” এতো কীসের পড়া যে আমার সাথে কথা বলতে পারছিলে না? এখন আর ভালো লাগে না?”
প্রহর ভাইয়ের কণ্ঠে সেদিন রাগ থাকলেও চোখে দেখতে পেয়েছিলাম অসীম ভালোবাসা। সেই প্রথম প্রহর ভাইকে “প্রহর ভাই” বলে না ডেকে “প্রহর” বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু লজ্জায় ডাকতে পারিনি। এই মানুষটাকে এভয়েড করার সাহস আমার ছিল না। আমার কোন দোষ ছিল না। মনি মা আমাকে কথা বলতে দেননি। জোর করতেও পারতাম না। মনি মা’র এক কথা
“সবুরে মেওয়া ফলে”..

সেই কথা না বলার শাস্তি স্বরূপ আমাকে টানা দশ মিনিট জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন বজ্জাত লোকটা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। ভুল না করেও ভুলের শাস্তি পাচ্ছিলাম।
নড়াচড়া করার চেষ্টা করলেই বলে উঠত,
-” এই এতো নাড়াচাড়া করছো কেন? চুপচাপ দাড়াও। তোমার নাকি উচ্চরক্ত চাপ? এভাবে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলে সিস্টোলিক, ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অবশ্য তুমি বললে, তোমাকে একেবারে সুস্থ করার জন্য চুমু থেরাপির সাহায্য নিতে পারি।”
-” ছিঃ দূরে থাকুন। আপনার এসব অযৌক্তিক কথা কোন বইতে লিখা রয়েছে?”
কলার নেড়ে উনি একচোখ টিপি দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন,
-” এই যে আমার মানে ডা. প্রহরের মনের বইতে। বুঝলে আমি হলাম বিলেত ফেরত ডাক্তার। আমার মুখের বাণী সত্য চিরন্তন। ”
এ যেন নতুন প্রহরকে দেখছিলাম আমি। তিতা করল্লার মুখ দিয়ে রসমালাই বের হচ্ছিল।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here